তুষারপাত যে শব্দ তৈরি করে

আমি বলতে পারি না যে তারা মেয়েটাকে বের করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, তারা তাকে থাকতেই বলেছিল। সেপ্পি বলেছিল, এটা তো তোমারই বাড়ি। এখানেই তুমি জন্মেছিলে, আর আমরা- মা বলেছিল, একজন মা তার মেয়ের কাছে সবসময় মা-ই থাকে; কিন্তু বাবা বলেছিল- আহ্, তোমরা ওকে একা থাকতে দাও।

বাবা আরও বলেছিল যে, জন যাকে মেয়েটা পছন্দ করে, একজন ভালো মানুষ। তারপর সে ঘোড়াকে ঘাস দেবার জন্য চলে গিয়েছিল। দিনটা ছিল অত্যন্ত ঠান্ডা। তার বুড়ো বাপ যখন গোলাবাড়ির উঠোনে অনিচ্ছায় করছে এমন ভাব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছিল, তখন তার মুখ থেকে বের হওয়া বাষ্প মেয়েটা দেখতে পাচ্ছিল। 

মা রাতের খাবারের জন্য আলুর খোসা ছিলে রাখছিল।

সেপ্পি বলল যে খালি আলু আর আলু তার আর ভালো লাগছে না।

মায়ের নাক দিয়ে সর্দি পড়ছিল আর সে সেটা বারবার মুছছিল।

সেপ্পি বলল যে, জন সৎ আর নির্ভরযোগ্য।

সেপ্পি আরও বলতে চাচ্ছিল কীভাবে সে- 

সেপ্পি জন সম্পর্কে বলতে চাচ্ছিল।

মেয়েটা বলতে চাইছিল যে-

সে বলতে চাইছিল কীভাবে সে-

সে তাদেরকে বলল কীভাবে একবার সে-

সে তাদেরকে বলল যে একজন পুরুষের মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার থাকে যা মেয়েরা পছন্দ করে না।

তার মা তাদের বাবা সম্পর্কে এরকম বলেছিল। তাছাড়া খোদার ইচ্ছা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।

সেটা ভালো বা মন্দ, যে কারণেই হোক না কেন-

খোসা ছড়ানো আলুগুলোকে ধোয়ার জন্য নিতে নিতে মা বলল।

বাবা রান্নাঘরে এলো।

হঠাৎ করেই বাবার মনে হলো ঘরটাতে ঠান্ডা অনেক বেড়ে গিয়েছে।

সে বলল যে, সময়টা খুব কঠিন যাচ্ছে।

হয়তো সবচেয়ে ভালো হতো মেয়েটা যদি ক্ল্যারেনডনে ফিরে যেতে পারত যেখানে জন রয়েছে। 

সে হয়তো-

সেখানে অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র বিক্রি করে সে ভালোই টাকাপয়সা আয় করছিল। সে হয়তো-

আমি বলতে পারি না যে তারা তাকে বের করে দিয়েছিল।

মেয়েটা শুনতে পেল যে আস্তাবলে ঘোড়াটি খুর দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে।

দিনটা ছিল ঠান্ডা। বরফসাদা কুয়াশার চাদর উপত্যকার উপর দিকটা ঢেকে রেখেছিল। পাহাড়ি ঝরনাটার উপরে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলীটার পাশঘেঁষে কারখানাঘরটা দেখা যাচ্ছিল। মেয়েটা জানত যে জলের ধারা ঝরনায় গর্জন করে নামছে। এমন শীতেও বাষ্প উঠে কুণ্ডলীটার সৃষ্টি। সে অবাক হলো যখন দেখল, অনেককাল আগে সে যে পানির উপর চোখা চোখা পাথরস্তম্ভ পেরিয়ে ঝরনার পেছনের পাথুরে মাটিতে জন্মানো ঘুঘুরঙা ফুলের গাছ আনতে সেখানে যেত, সেকথা এখন মনে পড়ল। হিমশীতল ঠান্ডায় নাকমুখ জমে শক্ত আর নীল হয়ে যেত। কোনো ধাতব বস্তু ধরলে আঙুলে লাগত আর তা টেনে তোলার চেষ্টা করলে জ্বালা করত। কুয়াশার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যেত না, এমনকি কোনো কুকুরের ঘেউ ঘেউ বা মোরগের ডাকও নয়। কামারের হাতুড়ির শব্দও যেন চাপা পড়ে গিয়েছে। 

রান্নাঘরটা ঠান্ডা ছিল, ঠান্ডা ছিল মায়ের নাকে সর্দির ফোঁটাটাও। বাবা আগুনের পাশে বসল, এবং জানালা দিয়ে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। উপত্যকা আর কারখানার সীমানা পেরিয়ে তার দৃষ্টি আরও দূরে চলে গিয়েছিল; আমার মনে হয় তার চোখ যেন গ্রীষ্মের স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করছিল, যখন সোনালি গমের ক্ষেত বাতাসে দুলবে; কিন্তু এটা গরমের সময় নয়। এখন শীতকাল এবং দিনটাও ঠান্ডা। বাবা মুরগির ঘরের দরজার ছিদ্র বন্ধ করতে গেল আর একটা ডিম নিয়ে ফিরে এলো। ওটা মুরগির খাঁচাতেই ঠান্ডায় বরফ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মা অনেকক্ষণ ধরে এটাকে গরম করার চেষ্টা করল। বাবা-মায়ের জন্য তার দুঃখ হলো। তার এটাও মনে পড়ল যে তারা তাকে তাড়িয়ে দেবে না। সময়টা ছিল অত্যন্ত ঠান্ডা আর নীরব। এরকম সময়ে আপনি যদি স্লুইসগেটের ভেতর দিয়ে নিচে আছড়ে পড়া জলের গর্জন শুনতে চান, তাহলেও কেবল বরফের শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাবেন না...। 

মেয়েটার খুব মনে হল যে এই ঘরে তার একজন বন্ধু থাকলে ভালো হতো।

সে তার বাবাকে এটা বলার চেষ্টা করল। 

বোধহয় সে শুনছে। 

আঃ, মেয়েটাকে একটু একা থাকতে দাও, বাবা বলল।

মা বলল যে জন ভালো মানুষ এবং নির্ভরযোগ্য।

সেপ্পি বলল যে সে চাইলে শহরেও থাকতে পারে।

বাবা বলল যে সে সবসময়ই স্বাগত, তবে কিনা আরও একজনকে খাওয়ানো- 

মা হাঁচি দিলেন এবং নাক মুছলেন। 

মৃত্যু পর্যন্ত আমরা একত্রে থাকব-

ঘরের দেয়ালগুলো যেন ফিসফিস করে কোনো ধর্মীয় গান গাইছিল।

মেয়েটার মনে হলো ছাদে বুঝি তুষারকণা ক্যাচক্যাচ শব্দ করছে।

সেপ্পি পানি তুলতে গেল।

ঠিক এটা বলা যাবে না যে তারা তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেটাই আমি আপনাদেরকে আবারও বলতে চাচ্ছি। আমি বলতে চাই যে তারা দরজা খুলল আর তাকে বের করে দিল ব্যাপারটা এমন নয়। 

এটা তোমার বাড়ি আর তুমি এখানেই জন্মেছিলে।

ওহ! তাকে একা থাকতে দাও।

হয়তো আগামীকাল জন তাকে নিতে আসবে।

মেয়েটা চিৎকার করে বলতে চাইল যে জন আর কখনো তার দেখা পাবে না।

রাস্তাটা খোলাই ছিল।

সে আঙুলে একটা সোনার আংটি পরল।

সন্ধ্যা নামলে মেয়েটা উপরতলার একটা কামরায় গেল। তারা বলেছিল যে সে ফেরত এলে এখানে তার ব্যাগটা রাখতে পারবে। কামরাটা সবসময়ই তার জন্য ফাঁকা রেখে দেওয়া হবে। সে দেখতে পেল যে আলমারিতে সেপ্পির কাপড় রাখা। ওর জুতাও ছিল বিছানার কাছেই। ড্রেসিং টেবিলে সে জনের ছবিটা রেখেছিল। ওটাকে সে মাদুরের নিচে লুকিয়ে ফেলল। মেয়েটা একটা ব্যাগ গোছাল আর বাড়ির সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়বে সে অপেক্ষা করতে লাগল।

বাড়িটা নীরব হয়ে গেলে সে দরজা খুলল আর চুপচাপ পথে নেমে পড়ল।

বাস থামার জায়গাটা বেশি দূরে নয়।

সে আংটিটা বেচে দেবে।

হোটেলে কাজ নেবে।

কেউ জানবে না সে কোথায় গিয়েছে।

তারা অবশ্য তাকে তাড়িয়ে দেয়নি।

সে যখন দরজাটা বন্ধ করল তখন বাড়িটা খুব নীরব ছিল।

কিন্তু তার মনে হলো যে সে যখন বাইরে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে তখন জানালায় জোড়ায় জোড়ায় চোখ তাকে দেখছে।

তার আরও মনে হলো যে সেপ্পি যে ঘরটায় ঘুমাত তার জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।

তীব্র ঠান্ডায় সে সাউথপোর্টগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করল।

ওটা এলে একপা দুপা করে এগিয়ে গেল।

উপায় একটা হবেই, সে ভাবল।

মেয়েটা সিটে বসল আর বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। এক লম্বা যাত্রার এটা ছিল সবে শুরু। সে বাইরের বরফের দিকে তাকিয়ে থাকল, তীব্র ঠান্ডায় যা নীল হয়ে গিয়েছে...

ভাষান্তর : কবির চান্দ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //