উলের কাঁটা

আখলাক সাহেব একটা ভুল কাজ করে ফেলেছেন। অবশ্য তার বয়সের বিবেচনায় কোনোভাবেই কাজটাকে ভুল বলা যায় না। কাজটা তিনি যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই করেছন। তিনি অল্পবয়স্ক একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছেন। বিয়ে কোনো ভুল কাজ না। বিয়েকে বরং মহান কাজ বলা যেতে পারে।

তবে আখলাক সাহেব যেভাবে বিয়ে করেছেন তাতে এটাকে মহান কাজ বলা যায় না। বিয়েটা তিনি করেছেন গোপনে। গোপনে বিয়ে করাটাও দোষের কিছু নয়, অনেকেই করে। তিনিও করেছেন। যদিও বিয়ের সময় ছোট্ট একটা সমস্যা হয়েছিল। বিয়ে পড়ানোর সময় কাজি সাহেব জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনারা দুজনই?’

আখলাক সাহেব বলেছেন, ‘হ্যাঁ।’

‘আর মানুষ কোথায়?’

‘আর মানুষ মানে?’

‘সাক্ষী লাগবে না? সাক্ষী কোথায়?’

আখলাক সাহেব বিব্রত মুখে বললেন, ‘ম্যানেজ করতে পারিনি। আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিন।’ 

কাজি সাহেবের গলায় বিরক্তি, ‘আমি সাক্ষীর ব্যবসা করি না। এসবে ঝামেলা আছে। যান, সাক্ষী নিয়ে আসেন।’

‘আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি ম্যানেজ করেন। যত টাকা লাগে, দেব।’

টাকার কথায় কাজি সাহেব নরম হলেন। একটা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, ‘দেখি কী করা যায়। তা, মেয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কী?’

আখলাক সাহেব বললেন, ‘মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক করার জন্যই আপনার কাছে এসেছি।’

কাজি সাহেব মেয়েটির দিকে তাকালেন। মেয়েটি মাথা নিচু করে বসে আছে। এখানে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত সে একটা কথাও বলেনি। 

‘আপনার নাম কী?’

মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। সে বুঝতেই পারেনি প্রশ্নটা তাকে করা হয়েছে। আখলাক সাহেব মেয়েটির হাত ধরে মৃদু ঝাঁকি দিলেন। সে হকচকিয়ে তাকালো।

কাজি সাহেব আবার বললেন, ‘আপনার নাম কী?’

মেয়েটি অস্পষ্ট গলায় বলল, ‘মুনিয়া।’ 

‘বাহ, ভালো নাম। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনার বিয়ের বয়স হয়নি।’

আখলাক সাহেব বললেন, ‘হয়েছে। এই যে, সার্টিফিকেট।’ 

কাজি সাহেব গম্ভীর মুখে সার্টিফিকেট দেখলেন। তার পর বললেন, ‘আপনার সার্টিফিকেট কই?’

আখলাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আমাকে দেখেও কি আপনার মনে হচ্ছে যে, আমার বিয়ের বয়স হয়নি?’

কাজি সাহেব হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘না ভাই, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি এর আগেও বিয়ে করেছেন!’ 

আখলাক সাহেব যথেষ্টই বিরক্ত হলেন; কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। তিনি সামান্য টেনশন অনুভব করছেন। কারণ কাজি সাহেবের কথা সত্য। তিনি অনেক আগেই বিয়ে করেছেন। সেই বউ এখন তার ঘরেই আছে, সুলতানা। তার প্রধান কাজ লম্বা দুটো কাঁটা দিয়ে উলের জামা বোনা। 

কাজি সাহেব সাক্ষীর ব্যবস্থা করলেন। এর বিনিময়ে তিনি এক্সট্রা পাঁচ হাজার টাকা নিলেন। বিয়ের কাজও দ্রুত শেষ হলো। আখলাক সাহেবের মনে ক্ষীণ আশঙ্কা ছিল, কাজি হয়তো প্রশ্ন করবেন, আপনি এত বয়স্ক মানুষ, কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করছেন কেন? কাজি সাহেব এমন কিছুই বললেন না। 

বিয়ের কাজ শেষ হতেই মুনিয়া তার নিজের বাড়িতে চলে গেল। 

আখলাক সাহেব বাসায় ফিরলেন রাত বারোটার দিকে। সুলতানা তখন খাটে বসে উলের জামা বুনছেন। তিনি জামা বুনতে বুনতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত রাত করে ফিরলে যে?’

আখলাক সাহেব বললেন, ‘কাজ ছিল, দেরি হয়ে গেল।’

‘ফোন করেছিলাম। মোবাইলও তো বন্ধ।’

‘চার্জ ছিল না।’

‘ও আচ্ছা।’

সুলতানা একমনে জামা বুনেই যাচ্ছেন। তিনি সবসময় ছোটো বাচ্চাদের জামা বানান। অথচ তাদের কোনো ছেলেপুলে নেই। ছেলেপুলে না হওয়াতেই হয়তো সুলতানা মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। তা না হলে কে আর সারাদিন অকারণে বাচ্চাদের জামা বোনে!

আখলাক সাহেব কিছু না খেয়েই ঘুমাতে গেলেন। সুলতানাও এই ব্যাপারে কিছু বললেন না। সম্ভবত খাওয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করার মতো ভালোবাসা তাদের মধ্যে আর নেই।

খুব ভোরে, আজান হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আখলাক সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেন। দেখলেন সুলতানা গভীর ঘুমে। তার মাথার পাশেই পড়ে আছে উল বোনার বড়ো বড়ো দুটো কাঁটা। আখলাক সাহেব দুটো কাঁটাই হাতে নিলেন।

ব্যাপারটা তিনি অনেকদিন ধরেই ভেবে রেখেছেন। কোনো এক সময়ে এই দুটো কাঁটা দিয়ে তিনি সুলতানার চোখ গেলে দেবেন। তিনি আজকাল বউকে সহ্যই করতে পারছেন না। অসহনীয় এই দাম্পত্য জীবন থেকে তিনি মুক্তি চান। এই মুক্তির আশাতেই তিনি মুনিয়াকে বিয়ে করেছেন। তার ডিপার্টমেন্টেরই ছাত্রী। মেয়েটার কেমন দুঃখী দুঃখী চেহারা। 

আখলাক সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুলতানার দিকে। তার চোখেমুখে ভয়াবহ বিতৃষ্ণা। এই বিষাক্ত জীবন তার কোনোভাবেই ভালো লাগছে না। ব্যাপারটা আজই ঘটাতে হবে। এক্ষুণি।

বাইরে কাক ডাকছে। একটা না, শত শত।

কী মনে করে যেন আখলাক সাহেব তার মত পাল্টালেন। সুলতানার বদলে কাঁটা দুটো তিনি বসিয়ে দিলেন নিজের চোখে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //