হাতির দাঁতের চিরুনি

(মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের পটভূমিতে লেখা ‘হাতির দাঁতের চিরুনি’ একটি অসাধারণ ছোটগল্প। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়-গল্পটির লেখক নগুয়েন সাঙ সম্পর্কে কোনো তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, কেননা ভিয়েতনামের ‘পুতুল সরকার’-এর পক্ষে এ ধরনের বৈপ্লবিক গল্পের লেখককে স্বনামে আত্মপ্রকাশ করতে দেওয়াটা তখনকার দিনে ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। ছদ্মনামের আড়ালেও নগুয়েন সাঙ-এর অন্য কোনো ছোটগল্প আর পড়া হয়নি। তবে এ লেখকের জন্ম সাল অনুমান করেই নিতে পারি ১৯২৫-এর কাছাকাছি।)

ম্লান জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া শরবনের মাঝখানে লুকিয়ে আছে কুটিরটি। চারদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি গরান গাছ। জোয়ারের পানি এসে সমস্ত জায়গাটাকে ধুয়ে দিয়ে যায়। এটা যোগাযোগ রক্ষাকারী দলের একটা গোপন আস্তানা। আস্তানাটা ছোট তবে ভিড়ে বোঝাই। কখন যাবার পালা আসে, সেই সময়টুকুন প্রতীক্ষায় এক ধরনের বন্দিদশার অনুভূতি নিয়ে আমরা তক্তপোশে পা আড়াআড়ি করে বসে আয়েশ করছিলাম।

সময় কাটাবার জন্য স্থির করলাম, গল্প বলা হবে। আমাদের সেই বর্ষীয়ান সঙ্গীটিকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না। দারুণ গল্প ওস্তাদ, বলেছিল সে। তার স্থূল রসিকতাগুলো-প্রতিরোধের রসিকতাগুলোও-আমাদের হাসিয়ে মারত; কিন্তু সেই রাতে তাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছিল। সে নিজে থেকেই কথা বলতে চাইছিল, অথচ আমরা সবাই যখন রাজি হলাম তখন মানুষটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

মাথাটা সামান্য নিচু করে ভীষণ নিস্পন্দ হয়ে বসে রইল সে আর দৃষ্টি মেলে রাখল চতুর্দিকের বিশাল জলরাশির দিকে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু শোনার প্রত্যাশায় আমরা তখন রঙ্গরসিকতা করা বন্ধ করে দিলাম। বাইরে ঝোড়ো বাতাস বয়ে চলেছে, জল-তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে পড়ছে গরান গাছগুলোর গায়ে। কুটিরটা টলমল করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একটা নৌকোর মতো। কয়েকটা সারস অস্বস্তি ভরে নড়েচড়ে উঠল, অন্যরা ডানা ঝাপটিয়ে বাতাসে গা ভাসাল। ঢেউ আর দমকা বাতাস মানুষটাকে যেন কোন দূর অতীতের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। যেন কোনো দূরাগত কণ্ঠস্বর শুনবে বলে উৎকর্ণ হয়েছিল সে। তারপর নিচু গলায় সে তার কাহিনি শুরু করল-আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল দিগন্ত আর দূরের ঝিলমিলে নক্ষত্রগুলোর দিকে।...

কাহিনিটা এক বছরেরও বেশি আগেকার; কিন্তু তারপর থেকে যতবার কাহিনিটা আমার মনে পড়েছে, হতবিহ্বল হয়ে গেছি-মনে হয়েছে আমি যেন সদ্য একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি।

সেদিন আমি এমজি ফাঁড়ি থেকে ডিএ ফাঁড়িতে যাচ্ছিলাম। মোটর বোটটা তীর ছেড়ে রওনা হতেই আমরা সকলে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম, বোটটা কে চালাচ্ছে। আগ্রহটা শুধু অনুসন্ধিৎসার তাগিদে নয়। রওনা হওয়ার আগে সংযোগ রক্ষাকারী ঘাঁটির নেতা আমাদের বলে দিয়েছিলেন, আমাদের সামনে এক দীর্ঘ এবং বিপদসংকুল যাত্রাপথ। মোটর বোট ছাড়া আমাদের পায়ে হেঁটেও যেতে হবে অনেকটা। জলে জল্লাদ বাহিনী আমাদের সহজেই দেখে ফেলতে পারে, আর স্থল পথে আমরা সহজেই কমান্ডো বাহিনীর মুখে গিয়ে পড়তে পারি। জল্লাদেরা আকাশ পথে এসে আমাদের মাথায় ঘূর্ণি তুললে, আমাদের শান্ত হয়ে থাকতে হবে এবং কঠোরভাবে সারেঙের নির্দেশ মতো চলতে হবে। তার অর্থ, আমাদের ভাগ্য আমরা সারেঙের হাতেই তুলে দেব। স্বাভাবিক কারণেই আমি তাই জানতে চেয়েছিলাম, সারেঙটি কে? অন্ধকারে শুধু দেখতে পেলাম, আমাদের চালক একটি ছিপছিপে তরুণী-আমেরিকায় তৈরি একটা কারবাইন তার কাঁধে ঝোলানো, গলায় রুমাল বাঁধা।

জনশ্রুতিতে জেনেছিলাম, এই ঘাঁটিতে যোগাযোগ রক্ষার কাজে একটি দারুণ চালাক-চতুর মেয়ে আছে। একদিন মেয়েটি একদল কর্মীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নদী পার হওয়ার আগে, নদী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা ধান ক্ষেতের মধ্যে সবাইকে দাঁড়াতে বলে। তারপর পুরুষ সঙ্গীটিকে নিয়ে মেয়েটি জায়গাটা একটু দেখে-শুনে নেওয়ার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়; কিন্তু নদীর কাছাকাছি একটা বেড়া-লাগানো ফলের বাগানে পৌঁছেই ও বুঝতে পারে, ওরা শত্রুপক্ষের গোপন আস্তানার মধ্যে এসে পড়েছে। বিচলিত হওয়ার এতটুকুও লক্ষণ না দেখিয়ে মেয়েটি তখন ওর বন্ধুটিকে বলে, ‘সব ঠিক আছে। তুমি গিয়ে মুসাফিরদের এখানে নিয়ে এসো। আমি নৌকোটা ওপারে নিয়ে যাব।’

মেয়েটি বেশ উঁচু গলাতেই কথাগুলো বলেছিল, যাতে শত্রুরা তা শুনতে পায়; কিন্তু ঐ কথাগুলোর মাধ্যমেই ও পুরুষ-সঙ্গীটিকে একটা গোপন সংকেত জানিয়ে দেয় এবং সে দ্রুত ফিরে গিয়ে ওখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অন্য একটা জায়গা দিয়ে সবাইকে নিঃশব্দে নদী পার করিয়ে দেয়। এদিকে মেয়েটি তখন ওখানে দুটো গ্রেনেড পেতে, নিজেও নিরাপদে নদী পার হয়। একটা বড়সড় দলকে জালে ধরার আশায় শত্রুপক্ষ নিস্পন্দ হয়ে অপেক্ষা করছিল; কিন্তু সময় বয়ে চলে, কিছুই হয় না। অবশেষে প্রতারিত হয়েছে বুঝতে পেরে কমান্ডোরা একে অন্যকে খিস্তিমিস্তি দিতে দিতে নিজেদের ঘাঁটির দিকে পা বাড়ায়; তখন যাবার পথে তারা ওই গ্রেনেডের ফাঁদে পা দেয় এবং তাতে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি হয়। পরে এই কাহিনিকেই খানিকটা ডালপালা গজিয়ে নিয়ে সবাই বলতে শুরু করে, মেয়েটির ঘ্রাণশক্তি সাংঘাতিক তীক্ষ্ন, গন্ধ শুঁকেই ও শত্রুসৈন্যের অবস্থান, উপস্থিতি সব বুঝতে পারে। 

আমি ভাবছিলাম, আমাদের মোটর বোটের চালিকা যদি সেই মেয়েটিই হয়, তাহলে খুব একটা দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ থাকে না।

‘এই ঘাঁটিতে কজন মহিলা কাজ করছেন?’ অনুসন্ধিৎসু ভঙ্গিতে আমি জানতে চাইলাম?

‘মোটে দুজন, একজন রাঁধুনি আর আমি।’

জবাবটা শুনে ভীষণ স্বস্তি পেলাম। নিঃসন্দেহে এই মেয়েটিই সে। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো, ওর বয়স আঠারো বা বড়জোর কুড়ি। মেয়েটিকে আমার বেশ ভালো লাগছিল, আরও কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু মোটর বোটের চাকাটা নিয়ে ওকে ব্যস্ত থাকতে দেখে, আমি আমার ইচ্ছেটাকে ত্যাগ করলাম। কাছিটা চাকতির মধ্যে জড়িয়ে মেয়েটি টান টান হয়ে দাঁড়াল, তারপর কাছের অন্য একটা মোটর বোটের দিকে ফিরে বলল, ‘আমি আগে রওনা হচ্ছি। ঠিক আছে?’

‘সব ঠিক। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।’ পাশের বোট থেকে যোগাযোগ কর্মীরা বলল। কখনো কখনো ওরা মেয়েটিকে ‘হাই বোন’ (বড় আপা) আবার কখনো বা ‘উত বোন’ (ছোট বোন) বলে ডাকে। সবাইকে ‘ছোট ভাই’ বলে সম্বোধন করে মেয়েটি বিচক্ষণের মতো কয়েকটা কথা বলল। তারপর মার্জিত-বিনীত ভঙ্গিতে আমাদের সমস্ত ব্যক্তিগত দরকারি জিনিস নিজেদের পকেটে বা আলাদা পুলিন্দা করে নিতে বলল, যাতে হেলিকপ্টার বা কমান্ডোদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ হলে ক্ষয়-ক্ষতি এড়ানো যায়।

খানিকটা নরম আর মিষ্টি সুরে মেয়েটি এই সম্ভাব্য বিপদগুলো সম্পর্কে আমাদের সাবধান করে দিলো- যা ঘাঁটির নেতাটির ভঙ্গির সঙ্গে মেলে না। আস্তে আস্তে গরান গাছের ঘন বেষ্টনী পেরিয়ে আমাদের মোটর বোট দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চলল। বাতাসে মধুর হিমেল স্পর্শ। মেয়েটির নির্দেশ মতো যাত্রীরা নিজেদের মালপত্র নিয়ে ব্যস্ত। দরকারি কাগজপত্র আর পথ-খরচার টাকাটা বাদে আমার কাছে মূল্যবান জিনিস বলতে আর কিছুই ছিল না-ওগুলো আমি সর্বদা নিজের পকেটেই রাখি; কিন্তু হঠাৎ হাতির দাঁতের ছোট্ট চিরুনিটার কথা মনে পড়ে গেল। তাই ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে চিরুনিটা খুঁজে বের করলাম। তারপর দরকারি কাগজপত্রের সঙ্গে সেটাকে বুকপকেটে রেখে, পকেটটা একটা সেফটি পিন দিয়ে সাবধানে গেঁথে রাখলাম।

ছোট্ট ওই চিরুনিটা আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন। ওটার দিকে তাকালেই আমি এক ধরনের উৎকণ্ঠা আর অনুশোচনার দাহ অনুভব করি।

নতুন করে শান্তি স্থাপন হওয়ার ঠিক পরবর্তী দিনগুলোর কথা। আমি ও আমার এক বন্ধু আমাদের গাঁয়ে ফিরছিলাম। মেকং নদীর মোহনার কাছে পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। ফরাসিরা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করার পর ১৯৪৬ সালের শুরুতে আমরা দুজনই প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলাম। আমার বন্ধুটি ছিল তার পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান, তাই তাকে সাউ বলে ডাকা হতো। সাউয়ের একমাত্র মেয়েটির বয়স তখন বড়জোর এক বছর। সাউয়ের স্ত্রী যতবার মুক্তাঞ্চলে সাউয়ের সঙ্গে দেখা করতে আসত, সাউ প্রতিবারই স্ত্রীকে বিশেষ করে পীড়াপীড়ি করত যাতে ও পরের বার মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে; কিন্তু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হতো বলে সাউয়ের স্ত্রী মেয়েকে সঙ্গে নিতে ভরসা পেত না। ওর পক্ষেও ওই পথ পেরিয়ে আসাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। তাই সাউ ওকে দোষ দিতে পারত না।

দীর্ঘ আট বছর ধরে মেয়েকে সে শুধু ছোট্ট একটা ছবির মাধ্যমেই দেখেছে। এখন বাড়ি ফেরার পথে পিতৃত্বের এক বর্ণনাতীত অনুভূতি তাকে চঞ্চল করে তুলল। নৌকোটা ঘাটের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ সাউ দেখতে পেল, বছর আষ্টেক বয়সের একটি ছোট্ট মেয়ে-মাথায় বব ছাঁট চুল, পরনে কালো প্যান্ট আর লাল ফুলের ছাপওলা একটা জামা-তাদের বাড়ির সামনের দিকের উঠোনে একটা আম গাছের ছায়ায় আপন মনে খেলছে। সাউ তখন সুনিশ্চিত, ও তারই মেয়ে। নৌকোটা তীরে পৌঁছানো অব্দি অপেক্ষা না করে সে তক্ষুনি লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নৌকোটা পেছন দিকে সরে গেলআমি তখন প্রায় ঝুলছি। সাউ তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘থু, আমার মামণি সোনা!’

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি সাউয়ের ঠিক পেছনেই ছিলাম। সে আশা করেছিল, মেয়ে ছুটে এসে দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরবে। সামনের দিকে ঝুঁকে, দু হাত বাড়িয়ে, মেয়েকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে, আরও কয়েক পা এগিয়ে গেল। তার ডাকে চমকে উঠে ছোট্ট মেয়েটা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল-ভীষণ উদ্ভ্রান্ত আর বিহ্বল দেখাচ্ছিল ওকে। ওদিকে সাউ কিছুতেই নিজের আবেগকে সামলে রাখতে পারছিল না। অতর্কিত আবেগে আত্মহারা হলেই তার ডান গালের কাটা দাগটা লাল হয়ে ওঠে, মুখটা ভয়ঙ্কর দেখায়। সেই বীভৎস মুখ আর বাড়ানো হাত নিয়ে সাউ আস্তে আস্তে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যায়-কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে অস্ফুটে বলে, ‘আয় সোনা মা! আয়!’

ছোট্ট মেয়েটি ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না- চোখ পিট পিট করে ও আমার দিকে তাকাচ্ছিল- যেন জানতে চাইছিল, লোকটা কে। আচমকা ওর মুখখানা পাংশুল হয়ে উঠল। একছুটে পালিয়ে যেতে যেতে ও চিৎকার করে উঠল, ‘মা, ও মা!’

সাউ নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ দুটো তখনো মেয়েকে অনুসরণ করছে, মুখটা বেদনায় বিকৃত, হাত দুটো অবসন্নের মতো ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে।

অনেকটা পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে বলে বাড়িতে থাকার জন্য আমাদের হাতে মোটে তিনটে দিন সময়-বাবাকে ভালোমতো চিনে নেওয়ার জন্য সময়টা ওই মেয়েটির পক্ষে আদৌ যথেষ্ট নয়। সেদিন রাতে ও বাবাকে মায়ের সঙ্গে শুতে দিল না। তীব্র আপত্তি দেখিয়েও নিজে বিছানা থেকে নেমে, মাকেও খাট থেকে টেনে নামাল। প্রতিদিন প্রায় পুরো সময়টাই সাউ মেয়ের সঙ্গে লেগে রইল, ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল; কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। সাউ ভীষণ আশা করেছিল, মেয়ের মুখ থেকে সে ‘বাবা’ ডাক শুনবে; কিন্তু ওই শব্দটা মেয়ের মুখ থেকে কিছুতেই বেরুলো না। রাতে খাওয়ার সময় মা যখন বাবাকে ডেকে দিতে বলল, মেয়ে মায়ের মুখের উপরে বলে বসল, ‘তুমি নিজেই ডাকো না!’

মা এবারে রাগে ফেটে পড়ল, বড় একটা খাওয়ার কাঠি তুলে নিয়ে মেয়েকে মারের ভয় দেখিয়ে, কথা শুনতে বলল। থু তখন শুধু বলল, ‘খেতে এসো।’

সাউ কিছু না শোনার ভান করে চুপটি করে বসে রইল, অপেক্ষা করতে লাগল মেয়ের মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাকটা শুনবে বলে। থু কিন্তু রান্নাঘর থেকেই গলা চড়িয়ে বলল, ‘খাবার দেওয়া হয়েছে।’ সাউ তবু নড়ল না। মেয়ে এবারে রাগ দেখিয়ে মায়ের দিকে ফিরে তাকাল, ‘আমি তো তোমার কথামতো কাজ করলাম; কিন্তু কেউ তো আমার ডাক কানেই তুলছে না!’

সাউ সামান্য মাথা নেড়ে মেয়ের দিকে তাকায়, মৃদু হাসে। হয়তো খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে বলেই তার চোখ ফেটে জল বেরোয় না। ভাতের হাঁড়িটা আগুনে বসিয়ে তার স্ত্রী ওবেলার রান্নার জন্য কিছু আনাজ কিনতে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় মেয়েকে বলে যায়, দরকার হলে ও যেন বাবাকে সাহায্য করতে বলে। হাঁড়িটা ফুটছিল। থু ঢাকনা খুলে একটা বড়সড় চপস্টিক দিয়ে ভাতটা নেড়ে দেয়। হাঁড়িটা বেশ ভারী, ওর পক্ষে ওটাকে নামিয়ে ফ্যান গালা রীতিমতো কষ্টকর কাজ। একবার সাউয়ের দিকে তাকাল ও। আমি ভাবলাম, এবারে ওর খেলা শেষ-এখন বাবাকে ডেকে সাহায্য করতে বলা ছাড়া ওর আর কিচ্ছুটি করার নেই; কিন্তু থু এক মুহূর্ত চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘ভাত ফুটছে। আমার হয়ে ফ্যানটা একটু গেলে দাও।’

এবার আমাকেই ব্যাপারটাতে মাথা গলাতে হলো। কীভাবে কথাবার্তা বলতে হয় তা শেখাবার চেষ্টায় আমি থুকে বললাম, ‘তোমার বলা উচিত ছিল: বাবা, ফ্যানটা গালতে আমাকে একটু সাহায্য করো না!’

মেয়েটি যেন আমার কথা গ্রাহ্যই করল না। ফের চড়া গলাতেই ও বলল, ‘হাঁড়ি ফুটছে। ভাতগুলো বেশি নরম হয়ে যাবে।’

সাউ তবু অনড় হয়ে বসে থাকে।

আমি থুকে ভয় দেখিয়ে বলি, ‘ভাতটা নষ্ট করে ফেললে মা কিন্তু নির্ঘাত তোমাকে মারবে। তার চাইতে বাবাকে একটু সাহায্য করতে বলো না কেন!

একবার শুধু ‘বাবা’ বলে ডাকো। দ্যাখোই না চেষ্টা করে।’

ভাতটা উথলে উঠতেই মেয়েটা যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল, তবু জিদ ছাড়ল না। এক টুকরো ন্যাকড়া দিয়ে ও হাঁড়িটা নামাবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ভাতগুলো তখন আরও জোরে জোরে ফুটছে। প্রচণ্ড চাপে পড়ে মেয়েটা তখন প্রায় কাঁদো-কাঁদো। একবার হাঁড়িটার দিকে, তারপরেই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে ও। ওর অসহায় ভাবভঙ্গি যেমন করুণ তেমনি মজাদার। আমরা ভাবছিলাম, এবারে ও হাল ছেড়ে দেবে; কিন্তু শেষাব্দি ও বড়সড় একটা হাতা দিয়ে ফ্যান তুলে তুলে ফেলতে লাগল আর বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগল, যেগুলো আমরা ঠিক শুনতে পেলাম না। সত্যি, কী সাংঘাতিক মেয়ে!

খাওয়ার সময় সাউ মাছের খানিকটা হলদে ডিম থুয়ের পাতে তুলে দিল। থু চপস্টিক দিয়ে সেটাকে পাতের একপাশে সরিয়ে রাখল এবং তারপরেই, একেবারে হঠাৎ চতুর্দিকে ভাতটাত ছিটিয়ে ডিমটাকে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল। ওর ব্যবহারে রেগে গিয়ে সাউ ওর পাছায় একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। তারপর চিৎকার করে বলল, ‘এত জেদি কেন তুমি?’

আমি ভেবেছিলাম, ছোট্ট মেয়েটা এবারে কেঁদে উঠবে কিংবা ছুটে পালাবে; কিন্তু ও নিচের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে রইল। এক মুহূর্ত পরে ও ডিমটা তুলে নিয়ে ফের নিজের বাটিতে রাখল। তারপর নিঃশব্দে উঠে এগিয়ে গেল নদীর ঘাটের দিকে। এক লাফে নৌকোয় উঠে মেয়েটা শেকলের বাঁধন খুলে ফেলল, ইচ্ছে করে অহেতুক ঝনঝন শব্দ তুলল শেকলে, তারপর বৈঠা নিয়ে ওপারে যাওয়ার জন্য নৌকো চালিয়ে দিলো। সেদিন নানির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল থু। নানিকে ও সবকিছু বলল আর কাঁদল। সন্ধ্যাবেলা মা ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করল; কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পরের দিনই সাউ চলে যাবে, তাই সাউয়ের স্ত্রী শেষ রাতটা স্বামীর সঙ্গে একা কাটাতে চাইছিল- ফলে মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য ও তেমন করে পীড়াপীড়িও করল না।

পরদিন সকালে আত্মীয়-স্বজন দলে দলে সাউকে বিদায় জানাতে এলো। নানির সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটাও ছিল তাদের মধ্যে। সাউ তখন সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত। মনে হচ্ছিল মেয়ের দিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। স্ত্রী তার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে দিয়েছে। এক কোণে একটা দরজার থামের সঙ্গে একা একা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থু ওর বাবাকে ঘিরে রাখা লোকগুলোকে দেখছিল। কেমন যেন অন্য রকম লাগছিল মেয়েটাকে- হাবভাবে কোনো দুর্বিনীত ভঙ্গি নেই, ভ্রু দুটোও কুঁচকানো নয়। আলতো করে উপরের দিকে উঠে যাওয়া ওর দীর্ঘ অক্ষিযুগল যেন কোনোদিনও পলক ফেলেনি। ফলে আরও বড় বলে মনে হয় ওর চোখ দুটোকে। স্পষ্টই বোঝা যায়, এখন ও আর কিছুই চিন্তা করছে না।

যাওয়ার মুহূর্তে সবাইকে বিদায় জানিয়েই সাউয়ের চোখ দুটো মেয়েকে খুঁজতে থাকে। থু তখনো সেই কোণটিতে দাঁড়িয়ে। বোঝাই যাচ্ছিল, সাউ মেয়েকে একবারটি জড়িয়ে ধরতে চায়; কিন্তু পাছে ও পালিয়ে যায়, তাই মেয়ের দিকে সে শুধু তাকিয়েই থাকে। তার দৃষ্টিতে অপার স্নেহ; কিন্তু তাতে এক নিবিড় বিষাদের ছোঁয়া। থুয়ের চোখেও আমি সেই মুহূর্তে একটা ঝিলিক ফুটে উঠতে দেখলাম।

‘চলি,’ সাউ নরম গলায় বলল।

ভেবেছিলাম মেয়েটা অমনি স্থাণু হয়েই দাঁড়িয়ে থাকবে; কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ ও চিৎকার করে উঠল, ‘বাবা, বা...বা...’

নৈঃশব্দ্যকে ছিঁড়েখুঁড়ে ওর সেই চিৎকার প্রত্যেকের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেল। অনেক বছর রুদ্ধ থাকার পর ঠিকরে বেরিয়েছে ওই ‘বাবা’ ডাক। কাঠবেড়ালির তৎপরতায় দু- হাত বাড়িয়ে থু ছুটে গেল ওর বাবার দিকে। সাউয়ের গলা জড়িয়ে ধরল ও। মনে হলো ওর চুলগুলো যেন খাড়া হয়ে উঠেছে। বাবার বুকে লেপ্টে গিয়ে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে যেতে দেব না, বাবা। তুমি আমার সঙ্গে থাকো!’ বাবা মেয়েকে জড়িয়ে রাখল- মেয়ে চুমু দিতে লাগল বাবার গালে, চুলে, ঘাড়ে, এমনকি মুখের দীর্ঘ কাটা দাগটাতেও।

নানি তখন গত রাতের ঘটনাটা সবাইকে বললেন। থু কেন ওর বাবাকে চিনতে চায় না তা আবিষ্কারের চেষ্টায় উনি থুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন ওই মানুষটাকে ও বাবা বলে ডাকে না।

‘না, ও আমার বাবা নয়।’ বিছানায় এপাশ- ওপাশ করতে করতে জবাব দিয়েছিল থু।

‘তুমি তা কী করে জানলে? বাবা তো কত দিন হলো ঘরছাড়া। তাই কি তুমি বাবাকে চিনতে পারছ না?’

‘ছবিতে আমি বাবাকে যেমনটি দেখেছি, ওই লোকটা মোটেই তেমন দেখতে না।’

‘কিন্তু তাহলেও ও-ই তোমার বাবা। হয়তো এত দিন বাদে বলে এখন ওকে একটু বেশি বয়সী বলে মনে হচ্ছে।’

‘না না, বয়স বেশ বলে নয়। আমার বাবার গালে কোনো কাটা দাগ নেই।’

নানি তখন সমস্ত কিছু বুঝতে পারলেন। থুকে উনি বুঝিয়ে বললেন, ঘর ছেড়ে তার বাবা এত দিন ফরাসিদের সঙ্গে লড়াই করেছে আর তাতেই অমন চোট পেয়েছে। খালের অন্য প্রান্তে একটা ফাঁড়িতে ফরাসিরা কী ধরনের অত্যাচার করেছে, তাও তিনি ওকে শোনালেন। মেয়েটা নিঃশব্দে তার সমস্ত কথা শুনেছে, মাঝে মাঝেই শুনতে শুনতে ছটফট করেছে, তারপর বড়দের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। শেষে ভোর হতেই ও নানির সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আসতে চেয়েছে। 

বাবার বুকে শক্ত করে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল মেয়েটা। সাউও তার আবেগ চেপে রাখতে পারছিল না-কিন্তু মেয়ে তাকে কাঁদতে দেখবে, তাও সে চাইছিল না। এক হাতে মেয়েকে জড়িয়ে রেখে, অন্য হাতে নিজের অশ্রু মুছছিল সে। মেয়ের চুলে চুমু দিয়ে সে অস্ফুটে বলল, ‘বাবাকে এবারে যেতে দাও, সোনা। আমি শিগগির আবার বাড়িতে ফিরে আসব।’

‘নাআআআ,’ মেয়ে চিৎকার করে আরও শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল-দু-হাত আর দু-পা দিয়ে আঁকড়ে রাখল বাবাকে। যারা ওখানে হাজির ছিল, তারা কেউই চোখের জল সামলাতে পারল না। আমিও খুব সহজভাবে নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। সাউকে আরও কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার কথা বলতে পারলে আমি ভীষণ খুশি হতাম; কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু অসুবিধে ছিল। আমরা জানতাম না আমরা দক্ষিণেই থাকব, নাকি নতুন করে জোট বেঁধে উত্তরে যাব। আপাতত আমাদের পুরনো দলে গিয়ে যোগ দিতে হবে, তারপর নতুন নির্দেশ নিতে হবে এবং তখন, উত্তরে যেতে হলে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিগুলো সেরে ফেলতে হবে। যাবার সময় হয়ে গেছে। বাবাকে ছেড়ে দেবার জন্য সবাই মেয়েটাকে বোঝাবার চেষ্টা করছে।

সাউয়ের স্ত্রী বলল, ‘থু, বাবাকে যেতে দাও সোনা! আমাদের দেশ আবার নতুন করে জুড়ে গেলেই বাবা এখানে ফিরে আসবে।’

নানি মেয়েটির চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘লক্ষ্মী মেয়ে, বাবাকে যেতে দাও সোনা! বলে দাও, বাবা যেন তোমার জন্য একটা চিরুনি কিনে আনে।’

‘বাবা, আমার জন্য একটা চিরুনি কিনে এনো,’ থু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। তারপর মুঠি আলগা করে বাবার কোল থেকে নেমে এসে নিজের পায়ে দাঁড়াল মেয়েটা।

কিছুদিন বাদে সাউ আর আমি পূর্ব নাম বো- তে গিয়ে একটা গণ-সংগঠনে সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজকর্ম করি। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত সময়টা ছিল অন্ধকারময়। মার্কিন-দিয়েম শাসনতন্ত্র তখন প্রতিরোধবাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে। আমাদের তখন অরণ্যে-জঙ্গলে বাস করতে হয়েছে। সেখানে আমাদের জীবন ও কার্যকলাপ ছিল ঘটনাবহুল- সে সমস্ত বলতে গেলে সারারাত কেটে যাবে। এমন অনেক রাত গেছে যখন কমান্ডোরা তিন তিনবার আমাদের ঘিরে ফেলেছে, তিনবারই আমরা পালিয়ে বেঁচেছি। কত দিন খাওয়া জোটেনি, বুনো গাছের পাতা খেয়ে থাকতে হয়েছে; কিন্তু সে সব অন্য কাহিনি।

জঙ্গলের মধ্যে এক টুকরো প্লাস্টিকের চাদর দিয়ে ছাদ বানিয়ে দড়ির দোলনায় শুয়ে আমরা রাত কাটাতাম। মেয়েকে মেরেছিল বলে সাউ তখন প্রায়ই খুব বিবেক-দংশন অনুভব করত। একদিন আমাদের কথাবার্তা চলার মধ্যেই ও হঠাৎ ওর দোলনায় উঠে বসে বলল, ‘এখানকার লোকেরা তো প্রায়ই হাতি শিকার করতে যায়। আমার মেয়ের চিরুনি বানাবার জন্য একটুকরো হাতির দাঁত জোগাড় করা যায় কিনা দেখতে হবে।’

তারপর থেকে মানুষটা ওই আশা নিয়েই দিন কাটাত। এর কিছুদিন বাদেই আমাদের দলের রসদে টান পড়ায় আমরা কিছু বুনো জন্তু শিকার করার কথা ভাবলাম- তবে তীর- ধনুক দিয়ে, রাইফেল দিয়ে নয়। কারণ আমাদের নিরাপত্তার খাতিরে অরণ্যের নিস্তব্ধতা বজায় রাখতেই হবে। হাতি শিকারের কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না; কিন্তু দৈবক্রমে একদিন একটা হাতিকে আমাদের আস্তানার সামনে দেখা গেল। আমাদের মধ্যে কেউই হাতি শিকারে আগ্রহ দেখাল না; কিন্তু সাউ সেটাকে তাড়া করবে বলে স্থির করল। একটি বন্ধুকে নিয়ে সে একট ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রইল, অপেক্ষা করতে লাগল হাতিটা ওদের নাগালের মধ্যে আসবে বলে। হাতিটার ঠিক দু- চোখের মাঝখানে তীর মেরেছিল ওরা।

সেই বিকেলটার কথা আমার আজও মনে পড়ে। জঙ্গলের মধ্যে প্রবল বর্ষণ তখন সবে শেষ হয়েছে। জলের ফোঁটাগুলো ঝিলমিল করছে গাছের পাতায় পাতায়। আমি আমার প্লাস্টিকের ছাদের তলায় বসে কাজ করছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন চিৎকার করছে। চোখ তুলে দেখি, বনপথ দিয়ে সাউ আমাদের আস্তানাটার দিকেই ছুটে আসছে। হাত তুলে সে আমাকে একটুকরো হাতির দাঁত দেখাল। একটা ছেলেমানুষের মুখের মতো ঝলমল করছিল তার মুখখানা।

পরে একটা কুড়ি মিলিমিটারের টোটাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সাউ ছোট্ট একটা করাত বানিয়ে নেয়। প্রায়ই দেখা যেত, একজন মণিকারের মতো একাগ্রতা, দক্ষতা আর অধ্যবসায় নিয়ে সে ওই হাতির দাঁতের টুকরোটা দিয়ে চিরুনি তৈরি করার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে চলেছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে আমি তার কাজ লক্ষ করতাম। সাধারণত দিনে সে কয়েকটা করে দাঁত বানাত। অবশেষে পুরো চিরুনিটাই একদিন তৈরি হয়ে গেল। চিরুনিটা খুব একটা বড় নয়- লম্বায় দশ আর চওড়ায় দেড় সেন্টিমিটার। বহু কষ্টে সাউ চিরুনির হাতলে খোদাই করে লিখল: ‘ভালোবাসা আর শুভেচ্ছাসহ, আমার মামণি থু-কে।’

চিরুনিটা সাউয়ের বিক্ষুব্ধ মনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল, যদিও তার মেয়ে তখনো সেটা ব্যবহার করার সুযোগ পায়নি। কোনো কোনো রাতে দেখা যেত, সাউ অনিমেষে চিরুনিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, নিজের চুলে ঘষে ঘষে সেটাকে পালিশ করছে। মেয়েকে আবার দেখার জন্য তার আর্তি ছিল আকুল; কিন্তু ইতোমধ্যে একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল। সেটা উনিশশ আটান্নোর শেষাশেষি, আমাদের হাতে তখনো কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। একবার মার্কিন আর পুতুল সরকারের যৌথ আক্রমণ চলার সময় একটা মার্কিন বিমান থেকে ছুটে আসা গুলি বুকে লেগে সাউ মারা যায়।

মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছেটা বলে যাওয়ার মতো শক্তিও তার ছিল না। শুধু পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই চিরুনিটা সে বের করে এনেছিল। তারপর চিরুনিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়েছিল অপলক। তার সেই শেষ দৃষ্টিপাত বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি সেদিন থেকে আমি মাঝে মাঝেই কল্পনায় দেখতে পাই, সাউ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

‘চিরুনিটা তোমার মেয়েকে আমি পৌঁছে দেব,’ ওর দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে আমি নিচু গলায় বললাম। আমার কথাটা শুনে সাউ চিরদিনের মতো চোখ বুজল।

সেই অন্ধকারের দিনগুলোতে শুধু জীবিতদের নয় মৃতদেরও লুকিয়ে থাকতে হতো। রীতি অনুযায়ী সাউয়ের কবরটাও তাই ভূ-সমতল থেকে উঁচু করে তৈরি করা যায়নি- কারণ কবরের খোঁজ পেলে শত্রুরা সেটাও অপবিত্র করতে পারে। চিনে রাখার জন্য কাছাকাছি একটা গাছের গায়ে আমি একটা চিহ্ন খোদাই করে রাখলাম।

সেই সময়ে আমরা এভাবেই বেঁচে ছিলাম, এভাবেই মরেছি। সে এক অসহনীয় অবস্থা, তাই আমাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে জেগে উঠতে হয়েছিল।

কিছুদিন বাদে আমি একটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ প্রতিরোধ ঘাঁটিতে এলাম। একদিন এক আত্মীয় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। আমি তার মাধ্যমে থুকে হাতির দাঁতের চিরুনিটা পাঠাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু শুনলাম থু আর ওর মা নাকি সায়গন না অন্য কোথাও চলে গেছে। মার্কিন আর পুতুল-সরকারের সেনারা সেখানে কমিউনিস্ট নিধনযজ্ঞ শুরু করেছিল। তারা সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালিয়েছে সবাইকে ধরে ধরে বন্দি শিবিরে ঢোকাবার জন্য বাড়ি- ঘর- দোর পুড়িয়ে দিয়েছে এবং কয়েক বছরের মধ্যে গোটা গ্রামটাই সম্পূর্ণ জনহীন হয়ে গেছে।

চিরুনিটা আমি নিজের হাতেই ধরে রইলাম। ওটার দিকে তাকাতেও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল আমার।

আমাদের মোটর বোটটা মৃদু গুঞ্জন তুলে ছুটে যাচ্ছিল। যে মেয়েটির হাতে আমাদের জীবন নির্ভর করছে, তার মুখখানা একবারটি ভালো করে দেখার জন্য এক তীব্র আকাঙাক্ষা অনুভব করছলাম আমি। রাতটা তেমন অন্ধকার নয়। তারায় ভরা আকাশের এখানে- সেখানে কিছু কিছু আবছা মেঘের আড়াল। ম্লান আলোয় আমি শুধু মেয়েটির অস্পষ্ট দেহরেখা, একটু গোলমতো মুখ আর অবর্ণনীয় দৃষ্টি মেশা একজোড়া চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম। এবং তাতেই আমি চমকে উঠলাম-মনে হলো, ওকে আমি আগে অন্য কোথাও দেখেছি।

হঠাৎ কে একজন চিৎকার করে উঠল, ‘উড়োজাহাজ! উড়োজাহাজ!’ যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে বোটটা দুলে উঠল। অনেকেই আর্তনাদ করে উঠল, ‘পাড়ে ভেড়াও।’

‘কোথায় উড়োজাহাজ?’

‘আমাদের পেছনে-আমি তার আলো দেখেছি।’

‘পাড়ের দিকে বোটের মুখ ঘোরাও! একটা জেট আসছে!’

মেয়েটি মোটর বোটের গতি কমিয়ে সামান্য সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘না, ওটা উড়োজাহাজ নয়। ওটা তারার আলো।’

ওর শান্ত সংযত কণ্ঠস্বর বোটে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনল। ভারি নরম আর মধুর কণ্ঠ মেয়েটির। তারপরেই ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিলো ও।

বেশ কয়েক দিন পায়ে চলার পর এই মোটর বোটে ভ্রমণ আমাকে সত্যিই আনন্দ দিচ্ছিল। তবে শত্রুর বিমানবাহিনী সম্পর্কে আমি তখনো খানিকটা অস্বস্তি অনুভব করছিলাম।

বোটটা এবারে খোলা মাঠ দিয়ে বয়ে চলা একটা খালে গিয়ে ঢুকল। কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই, শুধু দূরে গুটি কয়েক বাঁশঝাড়। যেন আমার গোপন অনুভূতির হদিস পেয়েই মেয়েটি বোটের গতি বাড়িয়ে দিল। খালের জল ফুলে ফুলে উঠতে লাগল বোটের সামনের দিকে, আর পেছন দিক থেকে দুটো দীর্ঘ জলধারা ঢেউ হয়ে ছুটে যেতে লাগল তীরের দিকে, কাঁপিয়ে তুলল আগাছার ঝাড় আর বুনো ফার্নের শিকড়গুলোকে।

যাত্রীরা শান্ত হয়ে এই দ্রুতগতির জলযাত্রা উপভোগ করছিল। হঠাৎ মেয়েটি মোটর থামিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘উড়োজাহাজ!’

বোটটাকে ও একটা বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল। আমাদের পেছন পেছন আর একটা বোটও সেখানে এসে আশ্রয় নিল। এতক্ষণে আমরা মার্কিনি হেলিকপ্টারগুলোর গুঞ্জন শুনতে পেলাম। জনশ্রুতিতে যেমনটি শুনেছি, মেয়েটির ঘ্রাণশক্তি ঠিক ততটাই তীক্ষ্ন কিনা- আমি জানি না; কিন্তু মোটরের আওয়াজের ভেতর থেকেও- ও কী করে হেলিকপ্টারের গুঞ্জন শুনতে পেল, তা সত্যিই এক আশ্চর্য কাণ্ড!

যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় বোটটা দুলছিল। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় মেয়েটি বলল, ‘আপনারা শান্ত হোন। জল্লাদরা এখনো অনেক দূরে। লাফিয়ে পাড়ে নেমে, আপনারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লুকিয়ে থাকুন। ওরা আমাদের দিকে আলোর ঝলক ছড়ালে, যেখানে আছেন সেখানেই পড়ে থাকবেন- নড়াচড়া করবেন না।’

মেয়েটির কথার মধ্যেই আমি ছাড়া অন্য সকলে পাড়ে নেমে পড়েছিল। আমিও লাফাতে যাচ্ছি- হঠাৎ মেয়েটি বলল, ‘কাকু, আপনি এখানেই থাকুন। বোটে তো আমরা মোটে কজন। চিন্তা করবেন না।’

অন্য কেউ এ উপদেশ দিলে আমি শুনতাম না; কিন্তু মেয়েটির আচার-ব্যবহার আমাকে এমন মুগ্ধ করেছিল যে আমি বোটেই রয়ে গেলাম।

জল্লাদরা খালের অন্য প্রান্ত থেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো, আগে আগে ছুটে এলো তাদের আলোর ঝলক। এক ঝাঁক জাহাজের মতো গর্জন তুলে তারা ক্রমশ আরও কাছে এগিয়ে আসছিল। এ ধরনের কাজে আমেরিকানরা সাধারণত তিনটে করে হেলিকপ্টার ব্যবহার করত- একটা আলো ফেলত আর বাকি দুটো বোমা বর্ষণ করত।

মেয়েটি ফের আমাকে পরামর্শ দিল, ‘গাছের ডালপালা দিয়ে নিজেকে বেশ করে ঢেকেঢুকে চুপটি করে বসে থাকুন।’

এই প্রথম জল্লাদদের আলোর ছটায় আমি ধরা পড়লাম। আলোটা আমার গায়ে এসে পড়তেই আমি তার প্রচণ্ড তীব্রতা আর মাথার উপরে তাদের ডানার ঝাপটানি স্পষ্ট করে অনুভব করলাম। ভয় হচ্ছিল আমাদের বোটটাও ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে। হেলিকপ্টারগুলোর ডানার ঝাপটে যেন একটা ঘূর্ণিঝড়ে ডালপালার আড়ালগুলো উড়ে গেল, পড়ে রইল শুধু নিচেরগুলো। মনে হলো, এই শেষ- তবু নিজেকে ছোট করে ফেলতে মাথাটা দুই কাঁধের মাঝখানে গুঁজে দিলাম। যেন আমার উৎকণ্ঠা অনুমান করেই মেয়েটি ফের আমায় ভরসা দিতে চেষ্টা করল, ‘আমরা নিজেদের দেখতে পাচ্ছি বটে, তবে ওরা কিন্তু আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।’

আগের বারের মতো ওর কথাগুলো এবারে আমার মনে তেমন করে কোনো প্রভাব ফেলতে পারল না। একবার মনে হলো, জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি; কিন্তু সময়মতো নিজেকে খুব জোর সামলে রাখলাম।

সেই ভয়ঙ্কর আলোর ঝলকানি ক্রমশ আবছা হয়ে এলো, ইঞ্জিনের গর্জন মরে যেতে লাগল একটু একটু করে। হেলিকপ্টারগুলো চলে গেল, ফের অন্ধকার হয়ে গেল চতুর্দিক। পাছে শত্রুরা ফিরে আসে, সেই ভয়ে আমি তখনো নড়াচড়া করতে ভরসা পাচ্ছিলাম না।

‘ওরা ক্ষমতার বহর দেখাতে এসেছিল; কিন্তু নিজেরাই কিছু দেখতে পায়নি।’ মেয়েটি বলল, ‘স্রেফ শান্ত হয়ে শুয়ে থাকলেই হলো, নড়াচড়া করা চলবে না।’ তারপর মাঠের দিকে তাকিয়েই যাত্রীদের বোটে ফিরে আসার জন্য ডাকল। কয়েকজন একেবারে ভিজে গিয়েছিল। গজগজ করতে করতে তারা নোংরা পোশাক-আশাক বদলে নিল। ফের গর্জন করে উঠল আমাদের মোটর বোট।

মাঝ রাতের পর আমাদের দলটা তীরে নেমে পায়ে হাঁটতে শুরু করল। ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে কর্দমাক্ত এবড়ো- খেবড়ো পিছল খাতগুলো পেরিয়ে একজন একজন করে এগিয়ে চললাম সকলে। নিজেদের চটিগুলো আমরা হাতে করে বইছিলাম, হাতড়ে হাতড়ে এগোচ্ছিলাম এক পা এক পা করে। তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই আমরা আছাড় খেয়ে পড়ছিলাম-একজনের পর আর একজন। নদীর তীরের কাছাকাছি একটা জায়গায় এসে মেয়েটি আমাদের দলটাকে থামতে বলল। তারপর দুজন স্কাউটকে পাঠিয়ে দিল জায়গাটা একবার পর্যবেক্ষণ করে আসার জন্য।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই তারা শত্রুপক্ষের কমান্ডোদের সাক্ষাৎ পেল। সাধারণত ওরা নদীর ধার বরাবর গাছগাছালির মধ্যে লুকিয়ে থাকে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে ওরা খোলা মাঠেই আস্তানা গেড়ে বসেছিল। চারদিক দিয়ে গুলি ছুটতে লাগল, উড়ে যেতে লাগল মাথার একেবারে কাছ ঘেঁষে।

‘ভাই তুমি, তুমি দলটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও,’ মেয়েটি হুকুম দিল। ‘আমি এখানে থাকব।’ ওর কথা বলার ধরনে মনে হলো, ও-ই এ দলের নেত্রী। ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকেও আমাদের সঙ্গে যেতে বলি; কিন্তু ততক্ষণে ও উধাও হয়ে গেছে। তখনো বাতাসে শিস তুলে গুলিগোলা ছুটছে, তারপর খসে পড়ছে একটু দূরে গিয়ে। খাতটার যথাসম্ভব কাছ ঘেঁষে আমরা শুয়ে রইলাম, মাথা তোলার কোনো চেষ্টাই করলাম না।

হঠাৎ আমার বাঁ দিক থেকে একটা কারবাইনের আওয়াজ পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুপক্ষের গুলিবর্ষণের নিশানা সে দিকে ঘুরে গেল। বুঝতে পারলাম, মেয়েটি ইচ্ছে করেই নিজের দিকে শত্রুপক্ষের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

‘থু, ছুটে পালাও,’ নির্দেশ এলো। আমাদের দলটা তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে ছুটে গেল। গুলি গোলাতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না; কিন্তু ভয়ও লাগছিল না- শুধু ভাবছিলাম, মেয়েটির ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে। মাঠের ভেতর দিয়ে এলোমেলোভাবে ছুটে আমরা সামনের ঝোপঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম, তারপর সেখান থেকে নদীর কাছে গিয়ে নিরাপদে নদী পেরুলাম।

গুলিবর্ষণ তখন আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে থেকে আমি মেয়েটির কারবাইনের আওয়াজ আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করলাম- কিন্তু বৃথাই। মেয়েটির জন্য আমার উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল।

কমান্ডোদের নাগাল থেকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে ছুটে আসায় আমরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। জায়গাটা গ্রামেরই একটা অংশ; কিন্তু ডি এ ফাঁড়ি থেকে আগত নতুন পথপ্রদর্শকের জন্য আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। একটা আনারস ক্ষেতে আমরা জড়ো হয়েছিলাম। শত্রুদের ছড়িয়ে দেওয়া বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে ক্ষেতটা এমনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে একটা গাছেও ফল ধরেনি। আমাদের মধ্যে কেউই হারিয়ে যায়নি। ছোটাছুটির সময় কেউ কেউ রবারের চটি হারিয়েছে, কেউবা নদী পেরুতে গিয়ে হারিয়েছে কাঁধের ঝোলা। বয়সে সবার চাইতে বড় হলেও আমি কিন্তু কিছুই হারাইনি।

আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। পথপ্রদর্শকরা আমাদের এক রাতের বিশ্রাম মঞ্জুর করেছিল। কেউ কেউ দড়ির দোলনা ঝোলাবার হাঙ্গামা না করে ঝোলাগুলোকে বালিশ বানিয়ে মাটিতেই শুয়ে পড়ল এবং খুব শিগগির তাদের নাক ডাকতে শুরু করল। অস্বস্তি ভরা মন নিয়ে আমি শুধু তন্দ্রায় ঢুলছিলাম। স্বপ্ন দেখলাম আমি যেন নিজের জেলার দিকে চলেছি। অনেক গ্রামই অদ্ভুত রকমের আলাদা দেখাচ্ছে। গ্রামের মানুষদের বাধ্য হয়েই নিজেদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে বন্দিশিবিরে গিয়ে বাস করতে হচ্ছে।

পরে ওই ঘরবাড়িগুলোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বাগানগুলোও একেবারে বদলে গেছে। সাউ আর আমি যখন গ্রামে ফিরছিলাম, তখনকার দৃশ্যগুলো আমি আবার দেখতে পেলাম। দেখলাম আমরা পরস্পরের কাছ থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নিচ্ছি, সাউ আমার হাতে চিরুনিটা তুলে দিচ্ছে- যেটা আমি আজও নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝেই আমি জেগে উঠছিলাম আর কমান্ডোদের কার্যকলাপের দিকে লক্ষ রাখার জন্য যারা পেছনে রয়ে গেছে তাদের কথা, বিশেষ করে ওই মেয়েটির কথা ভাবছিলাম। নিজেকেই জিজ্ঞেস করছিলাম, কী হতে পারে ওই মেয়েটির আর অন্যান্য সংযোগকারীর? তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ছিলাম সুনিবিড় ক্লান্তিতে।

তারপর এক সময় পায়ের শব্দ, কণ্ঠস্বর আর হাসির অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলাম। জেগে উঠে দেখি, ভোর হয়েছে। আকাশের গায়ে টুকরো টুকরো মেঘ ঝুলে রয়েছে নিশানের মতো। সবাই উচ্ছল ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছে। মোটর বোটের মেয়েটিও রয়েছে- ওর সারা গা ভেজা, 

পোশাক- আশাক কাদায় মাখামাখি। তার মানে, ও ঠিক সময়মতোই এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।

আমি দলটার দিকে এগিয়ে গেলাম- ওরা তখন পরস্পরকে বিদায় জানাচ্ছে। মেয়েটিকে এবার আরও ভালোভাবে দেখতে পেলাম। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে ও এইমাত্র একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফিরেছে, অথচ দেখে মনে হয় যেন তেমন সাংঘাতিক কিছুই হয়নি। ওর চেহারাটা রোদে- পোড়া, চোখ দুটি উজ্জ্বল, বয়স বছর কুড়ির বেশি নয়। কানের ঝুমকো দুলে ওকে আরও ছেলেমানুষ বলে মনে হয়। আমার দিকে এগিয়ে এলো ও। আমি ওকে প্রশংসা আর কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইছিলাম। তাই সুস্মিত মুখে বললাম, ‘মাগো, তোমার জন্য আমার ভাষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তোমাদের পরিবারে তুমি কত নম্বর সন্তান?’

‘আমি এক নম্বর, কাকু।’

‘তাহলে সবাই তোমাকে উত বোন বলে কেন? তার মানে কি তুমি বিবা...’

‘না,’ আমাকে প্রশ্নটা শেষ করার মতো সময় না দিয়েই ও বলল, ‘আমাদের পরিবারে আমিই প্রথম জন্মেছি, আর আমিই শেষ। আমি বাবা- মায়ের একমাত্র সন্তান।’

‘তোমাদের গ্রামের নাম কী? মনে হচ্ছে, আমি আগে কোথায় যেন তোমাকে দেখেছি।’

‘আমি কুলাও সিয়েঙ থেকে এসেছি।’

নিজের গ্রামের নামটা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে ফের জিজ্ঞেস করলাম, ‘চো মোই জেলার কুলাও সিয়েঙ গ্রাম- লঙ চাউ সা প্রদেশ, তাই নয় কি?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘কী নাম তোমার?’

‘থু।’

‘কী বললে তুমি? থু?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবার নাম সাউ আর মায়ের নাম বিন?’

মেয়েটি এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে- ও একটিও কথা না বলে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ করতে লাগল। ডিএ ফাঁড়ির পথপ্রদর্শকরা তখনই রওনা হওয়ার জন্য আমাদের তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বলছিল; কিন্তু তাদের কোনো কথাই আমি শুনিনি, শোনার মতো কোনো ইচ্ছেও আমার ছিল না। আমাদের দুজনের মধ্যে কারুরই তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। মেয়েটি তখনো গোল গোল চোখ দুটি মেলে আমার দিকে দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে। নিজের মনেই বললাম, এ নিশ্চয়ই আমার ভাইঝিটির চোখ। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবার নাম সাউ, তাই না মাগো?’

‘হ্যাঁ... কিন্তু আপনি তা কী করে জানলেন?’

আবেগ সামলে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, ‘আমি তোমার বা-কাকু। তোমার বাবা যেদিন বাড়ি থেকে চলে আসে, সেদিনটার কথা তোমার মনে আছে? মনে আছে, সেদিন সে তোমাকে একটা চিরুনি কিনে দেবে বলে কথা দিয়েছিল?’

মেয়েটি আলতো করে মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

তোমরা তো সবাই জানো, প্রতিরোধ- সংগ্রামের সময় এ ধরনের অপ্রত্যাশিত দেখা সাক্ষাৎ প্রায়শই ঘটত। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি পকেট থেকে সেই হাতির দাঁতের চিরুনিটা বের করে নিলাম।

‘তোমার বাবা এটা তোমাকে পাঠিয়েছে। এটা সে নিজের হাতে তৈরি করেছিল।’

মেয়েটির বিহ্বল হয়ে ওঠা মুখখানিতে ওর চোখ দুটোকে যেন আরও বড় বড় লাগছিল। চিরুনিটা হাতে তুলে নিল ও। মনে হলো, চিরুনিটা যেন বাবার সঙ্গে ওর বিচ্ছেদের দিনটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা আমাকে এক চরম বেদনায় ভরিয়ে তুলল। আমি জানতাম- ও প্রচণ্ড খুশি হয়েছে এবং ওর সেই নিবিড় আনন্দে আমার ব্যাঘাত ঘটাতে ইচ্ছে করছিল না। ইচ্ছে হচ্ছিল মিথ্যে করে বলি, ‘তোমার বাবা ভালোই আছে। সে বাড়িতে ফিরতে পারছে না, তাই আমাকে বলেছে এটা তোমাকে পৌঁছে দিতে।’

মেয়েটির চোখের পাতা দুটি কেঁপে উঠল। অস্ফুট কণ্ঠে ও বলল, ‘আপনি ভুল করেছেন। আমার বাবা এ চিরুনি পাঠায়নি।’

আমি হতাশ এবং তার চাইতেও বেশি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাউ তোমার বাবা আর বিন তোমার মা, ঠিক কিনা?’

‘হ্যাঁ, ঠিক।’

মেয়েটি তখন প্রায় কাঁদো কাঁদো, অশ্রু ছলছল করছে ওর চোখ দুটিতে। তবু আবেগ সামলে ও বলল, ‘যদি ভুল না করে থাকেন, তাহলে আপনি মিথ্যে বলছেন। আমি জানি আমার বাবা মারা গেছেন।’

ফের ওর চোখ দুটি চিকচিক করে উঠল, অশ্রু নেমে এলো ওর দু-গাল বেয়ে। বলল, ‘আমি সমস্ত দুঃখ-কষ্ট জয় করতে পারি। আমাকে সত্যি কথা বলতে ভয় পাবেন না। দু-বছর আগেই আমি জানতে পেরেছি, আমার বাবা মারা গেছেন। তারপরেই আমি যোগাযোগের কাজ করার জন্য মায়ের কাছে অনুমতি চাইলাম।’

মেয়েটি আরও কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু বলতে পারল না- কথাগুলো ওর গলায় আটকে গেল। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ও, চুলগুলো শুধু কাঁপতে লাগল থিরথির করে। আমিও চুপ করে রইলাম। দলের সঙ্গীরা রওনা হওয়ার জন্য আমাকে তাড়া দিচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। তাই থুয়ের ঠিকানা চাইলাম, সংক্ষেপে ওর মা আর আত্মীয়-স্বজনের স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিলাম।

থুয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দটুকু টিকে ছিল মাত্র কয়েক মুহূর্ত। রওনা হওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বশেই ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তাহলে চলি, মাগো!’ কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে ও অস্ফুটে কী যেন বলল, আমি শুনতে পেলাম না। খানিকটা দূরে এগিয়ে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি, ও-ও আমাদের পেছন পেছন আসছে। একটা নালার কাছে এসে ওকে থমকে দাঁড়াতে হলো। বাতাসে দুলে দুলে ওঠা ধানের চারাগুলো যেন ঢেউয়ের মতো ছুটে যাচ্ছিল ওর দিকে। ওর পিছনে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে পাতা ঝরে যাওয়া নারকেল গাছগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন বাতাসে ঝুলে থাকা কোনো রাক্ষুসে মাছের কঙ্কাল। গাছগুলোতে নতুন পাতা এসেছে, দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন আকাশের দিকে উদ্যত একরাশ তলোয়ারের অরণ্য।  

ভাষান্তর: লাভলু হীরা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //