রং পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছি সময় কাটাতে। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছি কোনো একটা পরিবহনের জন্য। আজ আমার বনভোজনের নিমন্ত্রণ। কারা যেন দিয়েছিল ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে নিমন্ত্রণ একটা আছে- এটা নিশ্চিত। কোনো একটা পরিবহনে করে কারও এসে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা, লাল-হলুদ ফুল আর নীলকণ্ঠ পাখির দেশে। কখন যে আসবে একটা বাস অথবা ট্রেন কিংবা একটা রিকশা! নতুবা অলৌকিক আলোয় সজ্জিত দেবরথ!
ঐ-তো আসছে। ঝাঁ চকচকে একটা বাস মসৃণভাবে এগিয়ে আসছে, যেন পথের সাথে তার কতদিনের সখ্য! বাসের মধ্যে অনেক শিশু। তারা আনন্দে গান গাইছে, নাচছে। আমার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেলো দেখে। আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাত নাড়াতে লাগলাম খুশিতে। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল বাসটা। অদ্ভুত বুনোনের টুপি পরা আমুদে ড্রাইভার আমার দিকে চেয়ে হাসলো।
‘কী মিয়া, কোথায় যাবা তুমি?’
‘আমি...’ এই যাহ! কোথায় যাবো তা তো ভুলেই গেছি; কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে কোথাও! কোথায় যাবো, কেন যাবো তা মনে নেই; কিন্তু এই ঝলমলে বাসটায় আমাকে চড়তেই হবে।
শিশুকণ্ঠের গান ভেসে আসে বসন্তের ফুলের রেণুর মতো করে নাচতে নাচতে।
‘আমি...আমি ওদের গান শেখাতে চাই’
‘বটে, তোমাকে কে বলেছে যে এটা গান শেখানোর স্কুল?’ ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকালো ড্রাইভার।
‘তা হলে... তা হলে আমি ওদের মতো করেই গাই? ওদের মতো হয়ে যাই? এই নাও ব্যাগটা ধরো তো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, চাইলেই হলো আর কি! অতই সহজ!’
‘সহজ না?’ আমি তাকালাম দেবশিশুদের নিষ্পাপ চোখে।
‘খুব কি কঠিন?’ প্রথমবার কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম;
কিন্তু ওরা কেউ কোনো কথা বলছে না। অস্বস্তিকর একটা নীরবতা বিরাজমান। ওদের সুরেলা কণ্ঠের গান বন্ধ হয়ে গেছে সেই কখন!
হঠাৎ করে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে উঠলো- ‘তুমি চলে যাও।’
মৃদু ফিসফিস ধীরে ধীরে সমস্বরে উচ্চারিত হতে থাকে- ‘তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও।’
বাসের ড্রাইভারও এবার মওকা পেয়ে খুব একচোট হেসে নেয় মিটমিটিয়ে, তার গোঁফের ফাঁক দিয়ে। আমাকে একরাশ ধোঁয়াশার মধ্যে নিমজ্জিত করে ভুস করে বাসটা নিয়ে চলে যায়। আমি ধোঁয়াশার মধ্যে খাবি খেতে খেতে শুনতে পাই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে আসা গানের সুর। ওরা আবার গাইতে শুরু করেছে- ‘সহজ মানুষ সেতো বড় সহজ কথা নয়/বৃথেই, শুধু বৃথেই তুমি করছ অনুনয়।’
গানের সুরটা যতই দূরে সরে যেতে থাকে কথাগুলো ততোই আমার মনের মধ্যে গেঁথে যেতে থাকে। এরকম হলে আমার খুব কষ্ট হয়, মাথা ধরে যায়। বিপত্তির যেন শেষ নেই। বাস থেকে নির্গত ধুঁয়াগুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। ওরা মেঘ হয়ে যাচ্ছে। মেঘ আর বৃষ্টির প্রতি আমার নির্লজ্জ কাঙালপনা আছে।
কোনো একটা সময়, আমি বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমার সাথে ভিজতো... কে যেন? কেউ একজন তো ছিল বটেই! খুব মনে আছে আমার; কিন্তু আজ এই হঠাৎ শুরু হওয়া তুমুল বৃষ্টি আমাকে ভীত করে তোলে। আমি দৌড়তে থাকি। খুব দৌড়তে থাকি। নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন আমার। এই নির্জনে কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই। আমি কোথায় যাবো? বুকের ভেতর জীবন ছটফট করতে থাকে।
‘এই রিকশা!’ কোনো মতে বলতে পারি আমি হাঁপাতে হাঁপাতে। রিকশার আরোহিণী আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে যেন।
‘আমাকে নাও... আমাকে নাও’ ব্যাকুল কণ্ঠে বলি আমি। আমি তাকে চিনতে পেরেছি। কী অদ্ভুত কাকতাল, এই ঝড়-জলের রাতে ঠিকঠিক তার সাথেই দেখা হয়ে গেল আমার!
‘না’
শীতল প্রত্যাখ্যান তার কণ্ঠে।
‘কেন?’
‘কারণ, তুমি বেদম হাঁপিয়ে গেছো, তোমার আর আগের মতো দম নেই
কারণ, কারণ তোমার হাতের কাটা দাগটা মুছে গেছে, যায় নিমিষেই
কারণ, কারণ, কারন... তুমি ভুলপথে হাঁটো রাখতে পারো না খেই...’
সে খলবলিয়ে হাসে আমার দিকে চেয়ে।
‘বুড়োদের একটা ট্রেন আছে আর মিনিট দশেক পরে, সোজা গেলে পাবে, ওখানটাতেই যাও!’
আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেয় না সে। হুস করে কোথা থেকে এক অত্যাধুনিক মডেলের গাড়ি এসে থামে। সে চলে যায়। কার সাথে, আমার দেখার ইচ্ছে হয় না।
বুড়োদের ইস্টিশানে আমি যেতে চাই না; কিন্তু আমাকে তো কোথাও যেতেই হবে। এভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলে লাভ নেই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি কী করা যায়। হঠাৎ একটা খসখসে কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলাম,
‘কোথায় যাবে তুমি?’
আরেহ! ধুর। এ যে সেই বুড়োদের স্টেশনেই এসে পড়েছি দেখছি।
‘নাহ, কোথাও না, এমনি হাঁটছি।’
খিক খিক করে হেসে ওঠে বজ্জাত বুড়ো। বলে,
‘আমরাও অমন এমনি এমনি হেঁটেই এখানে এসেছি বাছা, তোমারও আর বেশি দেরি নেই।’
‘দাও তোমার ব্যাগটা আমাকে দাও,’ হৃদ্যতা প্রকাশ পায় একজনের কণ্ঠে।
‘হ্যাঁ, ট্রেন আসতে আর বেশি বাকি নেই,’ সবাই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে আমাকে নিয়ে।
‘বুড়োদের সাথে থাকতে বয়েই গেছে আমার,’ রূঢ়তা প্রকাশ পায় আমার কণ্ঠে।
ট্রেনের হুইসল বেজে ওঠে। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ট্রেনে ওঠার জোগাড়যন্তর শুরু করে।
কিন্তু এ কী! এ ট্রেনটাতো দেখছি বেজায় বেগতিক আচরণ শুরু করেছে! লাইন ছেড়ে দিয়ে আমার পেছনে লেগেছে। আবারও দৌড় দৌড় দৌড়!
কতক্ষণ এভাবে দৌড়েছি মনে নেই। অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো। চেতনা ফিরে পাওয়ার পর দেখি মিশমিশে অন্ধকার এক ঘরে শুয়ে আছি। কারা যেন অপেক্ষা করছিল আমার জন্যই, আমার চেতন ফিরে পাওয়ার জন্যই।
‘এই চুপ চুপ’ উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওরা।
‘তোমরা কে?’
‘আমরা কে অত জেনে কী হবে? তোমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে এনেছি। এখন তোমাকে কোনো এক জায়গায় পৌঁছে দিলেই তো হলো? গাড়ি অপেক্ষা করছে বাইরে।’
‘আমি কোথায় যেতে চাই?’
‘এমন কোথাও, যেখানে সব পরিবহন এসে থেমে যায় তার যাত্রীদের নিয়ে!’
অশুভ একটা ইঙ্গিত তার বলার ভঙ্গিতে।
‘এত তাড়াতাড়ি অবশ্য না গেলেও চলবে, তবে বেশি দেরিও নেই। আর একদিন না একদিন তো যেতে হবেই, নাকি!’ ওরা আমার নীরবতা দেখে প্ররোচিত করার জন্য বলে।
‘এত অন্ধকার কেন এখানে?’ আমি প্রসঙ্গ পাল্টাই।
‘আলো পাবে কোথায় বোকা! সব আলো খরচ করে এসেছো না! যা-ই হোক, শোনো, বেশিক্ষণ কিন্তু সময় নেই, আমরা চলে যাচ্ছি। তুমি সিদ্ধান্ত নাও থাকবে নাকি যাবে। আমরা চলে গেলে কিন্তু এই অন্ধকার ঘরে তোমাকে একা থাকতে হবে।’
‘আমি যাবো না।’
‘যাবে না? আরেকবার ভাবো। একদিন তো আসতেই হবে। কীভাবে, কেমনভাবে আসো তার কোনো ঠিক আছে? আজকের দিনটা ভালো, চলে আসো’
‘নাহ!’ অস্বীকৃতি জানাই আমি। ওরা চলে যায়।
আমি আমার একমুঠো জীবন প্রাণপণে খামচে ধরে থাকি গোঁয়ারগোবিন্দের মতো...
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সাহিত্য গল্প হাসান মাহবুব পরিবহন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh