রাইড শেয়ার

বসন্তের প্রথমদিন। টিএসসি মোড়ের যে দিকটায় রোকেয়া হল সে দিকের ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী। পরনে তার বাসন্তী জমিন আর লাল পাড়ের শাড়ি, পরিপাটি চুলের খোঁপায় গোঁজা বেলিফুলের মালা; রাজকুমারের অপেক্ষায় যেন বৈদিক যুগের কোনো এক আশ্রমকন্যা অরণ্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি একবার সামনের রাস্তার দিকে, আরেকবার হাতের মোবাইল স্ক্রিনের ওপর। সে আসলে মোটরবাইকের জন্য ‘চলো’ অ্যাপসে কল করেছে।

কিছুক্ষণ পর তার সামনে এসে দাঁড়াল একটি মোটরসাইকেল। হেলমেট পরিহিত চালক বললেন- ‘আপনি কি জারা? আমি ‘চলো’ রাইড শেয়ার থেকে এসেছি। গুলশান-১, স্টারবার্ক কফিশপে যাবেন, ঠিক না?”

জ্বী। আপনি কি সুনীল? -মেয়েটি জিজ্ঞেস করে।

জ্বী- মাথা দুলালেন মোটরবাইকের চালক।

সুনীলের বয়স কত আর হবে পঁচিশ বা ছাব্বিশ আবার ত্রিশও হতে পারে অথবা কোনো ধুসর সীমারেখায়। দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম হলেও মুখখানি রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। তবে চোখ দুখানি উজ্জ্বল, বেশ মায়াবী চাহনিতে ভরা। 

মেয়েটির দিকে একটা হেলমেট এগিয়ে দিয়ে সুনীল বললেন- এটা পরে নিন। মেয়েটি হেলমেট পরে নিয়ে বাইকে বসল। বাইক শাহবাগ গণজাগরণ চত্বরের মোড় পার হয়ে কন্টিনেন্টাল হোটেলের পাশের ভিআইপি রোড হয়ে মিন্টো রোড ধরে এগিয়ে চলল। মিন্টো রোড থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে সোজা হাতিরঝিলের মধ্য দিয়ে গুলশানের দিকে ঢুকে পড়ল বাইকটি। বসন্তের গোধূলী রাঙা রোদ যুবতীর গালে পড়ে যেন কোনো পৌরাণিক যুগের এক মনোহর দৃশ্যের সৃষ্টি করে চলেছে।

সুনীল এতক্ষণ খেয়ালই করেননি তার যাত্রীর মুখখানি। বাইকের লুকিং গ্লাসে যাত্রীর মুখখানি তিনি ভালো করে দেখতে পেলেন। এ কাকে দেখছেন তিনি! তার অনেক দিনের চেনা মুখ; তার স্মৃতির পাতায় এতকাল রয়েছে যে মুখের প্রতিচ্ছবি। কী আশ্চর্য! তা হলে কবিতা এখন জারা, নাকি এ অন্য কেউ। না, এই মুখ তার অচেনা হওয়ার নয়। ‘নিষাদ কি কখনো পঙ্খিনীর গোত্র ভুল করে?’ এ তার খুব চেনা; স্কুলের সহপাঠী, সেই কবিতা। তখন কেমন একহারা ছিপছিপে চেহারা ছিল, এখন বেশ প্রশস্ত শরীর, চেহারাও হয়েছে বেশ, যেন পরীস্তানের রাস্তা ভুল করা কোনো পরী নেমে এসেছে ধূলিমাখা মাটির পৃথিবীতে। কবিতা তাকে চিনতে পারেনি। না পারাটাই স্বাভাবিক। ব্যাংক লোন-সুবিধা নিয়ে ইএমইতে তিনি একটি মোটর বাইক কিনেছেন। সেই মোটরবাইক রাইড শেয়ারিং করে জীবন চালান। গরিবরে কি কেউ মনে রাখে? অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, হয়তো বহুদিন।

সেই কবে, কতকাল আগে কিংবা বহুকাল আগে দর্শনা কলেজে একাদশে শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন সুনীল। মাধ্যমিকে সায়েন্স নিয়ে বেশ ভালো রেজাল্ট করে, উচ্চমাধ্যমিকেও তিনি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। চণ্ডীপুর গ্রাম থেকে প্রতিদিন বাইসাইকেলে চেপে তাকে আসতে হতো কলেজে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তার মা তাকে সাইকেলটি কিনে দিয়েছিলেন। কী প্রিয় একটা সাইকেল তার! সাইকেলে উঠে সুনীলের মনে হতো তিনি এক রাজকুমার, তার সাইকেল একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া, যেন মেঘের ভেতর দিয়ে উড়ে উড়ে সে চলেছে দেশ হতে দেশান্তরে।

কবিতারা এখানকার স্থানীয় নয়। তার বাবা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি চিনিকলের ক্যামিস্ট ছিলেন। চাকরির সুবাদে তাদের দর্শনাতে আসা এবং বসবাস। দর্শনা মফস্বল হলেও চিনিকলের কারণে বেশ গোছানো শহরতলি। সেখানেই সুনীল কবিতার সহপাঠী ছিলেন। সুনীলের মনে হতো কবিতাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নারী। প্রথম যৌবনে সুনীল হয়তোবা কবিতাকে ভালোবেসেছিলেন। কবিতা বেশ অ্যাডভান্স প্রকৃতির মেয়ে, সহজে আলাপ জমাতে পারে। আর সুনীল ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। গরিবের ছেলেরা চিরকাল যেরকম হয়; লাজুক আর দারিদ্র্যের জাঁতাকলে আড়ষ্ঠ প্রকৃতির। একদিন কলেজ ছুটির পর কবিতা লাফ দিয়ে সুনীলের সাইকেলের পেছনে বসে পড়ল, কিছুদূর যাওয়ার পর নেমে বলেছিল- তুমি একটা মোটরবাইক কিনতে পারো না। তোমার বাইকেরপেছনে চেপে সারাদিন ঘুরব। সুনীল বলেছিলেন- একদিন কিনব। তোমাকে নিয়ে সারা দর্শনা শহর ঘুরিয়ে আনব; ওই পর্যন্তই। তিনি কথা রাখতে পারেননি তখন। চার ভাইবোনের সংসার সামলাতেই পারেন না, পরের ক্ষেতে কামলা দেন বাপ, অভাব আর অভাব। তার ওপর আবার বাইক। ভিখারীর পুত্রের যেন পঙ্খিরাজ ঘোড়ার শখ। সেটা স্বপ্নে হতে পারে, বাস্তবে নয়। বাস্তবে জীবন একটা শঙ্খনীল কারাগার, যে কারাগারের লোহার শিক দেখা যায় না, সে অদৃশ্য শিক ভেঙে বেরিয়েও আসা যায় না। সে শুধু কারাগারে জীবন কাটায়। মৃত্যু কেবল তাকে মুক্তি দিতে পারে। তা ছাড়া মানুষ একটা অসম্পূর্ণ প্রাণী। কোনো দিন পূর্ণতা পায় না। 

এ পৃথিবীতে চরম অসহায়, পরাধীন এবং অসম্পূর্ণ একটা জীবন তার। পূর্ণতার অভিলাষে এই পরাধীনতার সাথে তাকে আপষ করেই চলতে হয়। আপষ করতে করতে একদিন সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, জীবনের সেই অসম্পূর্ণতা আর কোনো দিনই সম্পূর্ণ করতে পারে না। মনের গভীরে যদি কোনো ইচ্ছা থাকে তা সেখানেই হারিয়ে যায়, কোনো দিন আর পূরণ হয় না।

সময় পেরিয়ে গেছে অনেকটা। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর কবিতারা ঢাকা চলে গেল। সুনীলের আর বাইরে যাওয়া হয়নি। দর্শনা সরকারি কলেজে পাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। তার পর কে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল সে কথা তো আর ডাইরিতে লেখা হয়নি। সময় দ্রুত বদলে গেল শরতের নীল আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘমালার মতো। স্বপ্ন যেন হাতের মুঠোয়। মুঠোয় মুঠোয় পৃথিবী ঘুরপাক খাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতা আর বাজার অর্থনীতির ঘূর্ণিপাকে এক নতুন পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। সে পৃথিবীতে স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক বুঝতে পারা যায় না। নতুন পৃথিবী আর সুনীলরা যেন তার অসহায় অতিথি।

গুলশান স্টারবার্ক কফিশপের সামনে যখন মোটরসাইকেল থামল তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মোটরসাইকেল থেকে নেমে কবিতা ভাড়া মেটানোর জন্য যখন সুনীলের সামনে দাঁড়াল, হেলমেট খুলতে খুলতে সুনীল জানালেন ভাড়া লাগবে না, কবিতা। কেমন আছো? চমকে উঠল কবিতা, সে কিছুক্ষণ ভাবল মনে মনে; এ নামে তো তাকে একজনই ডাকত, তার কলেজ জীবনের বন্ধু সুনীল! তবে কি এই চালক সেই সুনীল। ইস, রাইড নেওয়ার আগে একবারও কেন চালককে সে দেখেনি। হেলমেট মাথায় থাকার কারণে চেনাও মনে হয়নি। অথবা তাকে সে চিনে নেওয়ার চোখ বহুকাল আগেই হারিয়ে গেছে।

ঠিক তখন আর একটি কল এলো সুনীলের ফোনে। তিনি কল রিসিভ করলেন। ‘স্যার আপনি কোথায় যাবেন? আপনার লোকেশনে থাকুন, আমি আসছি’- বলে সুনীল ফোন রেখে কবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বিদায় নিতে চাইলেন। এবার আসি, আরও একটা রাইড শেয়ারের কল পেয়েছি, ভালো থাক- কথাগুলো বলে তিনি চলে গেলেন।

তখন গোধূলীর আলোয় কিংবা ল্যাম্পপোস্টের লাল সোডিয়াম বাতির আলোয় সুনীলের মুখটা বেশ চকচক করছিল। মোটরবাইক কিছুক্ষণের মধ্যে হারিয়ে গেল পাশের রাস্তায়। সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল কবিতা। এখন আর বাইকটা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে তার পাশে এসে দাঁড়াল শোভন। শোভন কবিতার বয়ফ্রেন্ড। 

শোভন কবিতার হাত ধরে বলে- চলো যাই। 

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কবিতার মুখ থেকে, সে চাপা স্বরে বললো- চলো। তারা দুজন হাত ধরে কফিশপের দিকে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে রাস্তার দুপাশে জ্বলে ওঠা ল্যাম্পপোস্টের আলোর ভিড়ে হারিয়ে গেল সুনীল আর তার মোটরবাইক। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //