ভালোই চলে যাচ্ছে

এক. রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অন্যান্য দিনের মতো মোবাইল, চায়নিজ টর্চ আর সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে বাইরে গেল না মজহার। এতে অবাক হওয়ার কথা রাবেয়ার, তবে অবাক হওয়ার বদলে শঙ্কিত হয়ে উঠল সে।

এখন কী কী ঘটবে বা ঘটতে পারে তা এতদিনে জানা হয়ে গেছে তার। অন্যান্য রাতে তো দশটার দিকে রাতের খাবার খেয়ে ফোন, চায়নিজ টর্চ আর ক্যাপস্টানের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে তার প্রাণের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেরিয়ে যায় মজহার। ফিরে আসে বারোটা কি একটার দিকে। মজহারের মতিগতি খুবই চিত্তাকর্ষক। তার বন্ধুরা আর রসিক গ্রামবাসী তাকে নিরাশ করেনি। তারা ‘মজহার মিয়া’ নামটি ‘মজার মিয়া’তে রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছে। তবে পরিচিত মহলের কাছে সে মজার মিয়া হলেও রাবেয়ার কাছে নয়। 

‘কাইলকা কাউরিয়াকান্দি যা...’ মোটামুটি পাঁচ বছর ধরে এভাবেই শুরু হয়ে আসছে মজহারের ‘জরুরি’ কথাগুলো। বাপের বাড়ির গ্রামটার নাম শুনলে ভেতরটা নেচে ওঠার কথা যে কোনো গৃহবধূর; কিন্তু এই মুহূর্তে রাবেয়ার শিরদাঁড়াজুড়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বিয়ের তিনটা বছর গেছে একরকম ভালোয় ভালোয়, পরের দুবছর সামান্য উৎপাত আর এর পরের গত তিন বছর ধরে তো পরিস্থিতি চরমে। ‘বিশটা আজার ট্যাকা অইলেই অইতো, একটা পুরানা ইজিবাইক লইতাম...’- এ তো জানা কথাই যে, এখন রাবেয়া বাপের বাড়িতে যেতে অস্বীকার করবে আর বিগত ‘সামান্য উৎপাত’-এর দুবছরের কালে বাপের বাড়ি থেকে বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় লাখখানেক টাকা এনে দেওয়া হয়েছে- এ কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। এতে মজহারের ইজ্জতে টোকা লাগবে এবং সে প্রথমে গলা চড়াবে, তার পর কোমল বালিশ তুলে বাবেয়ার মাথায় বাড়ি দেবে, এর পর কোমল আর কঠিনের মাঝামাঝি হাত দিয়ে চড়-চাপড় বোলাবে, তারও পরে হাতে নেবে গরুমারা পাচন। ততক্ষণে ভয় পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠবে সাত বছরের বৈশাখী, আর উঠেই সবকিছু বুঝে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশ্বব্দে কাঁপতে থাকবে। রাত-বিরাতে চিল-চিৎকারে পাড়া-প্রতিবেশীরা শুরুতে যেমন ছুটে আসত, এখন আর কেউ আসে না। তো এভাবেই ঘটতে থাকে সব। 

দুই. সুজাতপুর নামক উপজেলা সদরটি এখনো পৌরসভা হয়ে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করেনি। তার পরও হরেক কিসিমের ব্যবসাপাতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে গঞ্জটি। সুজতপুরের চার-পাঁচটা স্বর্ণকারের দোকানের মধ্যে সুনীল বণিকের ‘মা তারা শিল্পালয়’টি ব্যবসায় আর ধারে-ভারে সর্ববৃহৎ। গঞ্জের সকলেই জানে সুনীল বণিকের স্বর্ণকারের ব্যবসাটা শুধু নামেই, আসলে সে করে ‘ট্যাকার ব্যবসা’। তার ট্যাকার ব্যবসাটা আবার দুই রকমের। একটা হচ্ছে স্বর্ণ বন্ধক রেখে অথবা কোনো কিছু বন্ধক না রেখেই সুদে টাকা ধার দেওয়া, আর একটা হচ্ছে- রাতে দোকানের পেছনে ‘তিনতাস’-এর আসর বসানো। সরকারি দলের যুব সংগঠনের উপজেলা শাখার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাটির সঙ্গে সুনীল বণিকের খুব দহরম-মহরম। তা সুনীল তার ব্যবসাপাতি নিয়ে আছে ভালোই। এ মুহূর্তে সুনীলের ক্যাশ-কাউন্টারের সামনে বসে আছে মজহার। সুনীলের আনিয়ে দেওয়া পান আর সিগারেটের সদ্ব্যবহার করছে। চুপচুপে তেল দেওয়া চেহারায় সুখি সুখি ভাব। সুনীলের রাতের তিনতাসের আসরের নিয়মিত সদস্য মজহার। এই মুহূর্তে তারা আলাপ করছে আসন্ন রাতের দানে খুরশেদ পাইকারকে কী করে ‘বাটে’ ফেলতে হবে। ঠিকমতো বাটে ফেলতে পারলে খুরশেদ পাইকারের কাছ থেকে লাখখানেক হাতিয়ে নেওয়া যাবে। এজন্য গঞ্জের মশহুর জুয়াড়ি মজনু মেম্বারকে দলে টানতে হবে। তিনজন এক হয়ে গেলে কাউকে বাটে ফেলা তো পানিভাত। তবে মজনুকে দোকানে এনে কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তাই মজনুর সাথে মোবাইলে নিজেই কথা বলে নেবে বলে জানায় সুনীল। 

তিন. গত বিকেলবলাটায় যে সুখি সুখি ভাব ছিল মজহারের চেহারায়, রাতে আর সেটা থাকেনি। আগের দিন রাতে বউকে পিটিয়ে কিছু না পেয়ে রাতের আসরের সতীর্থ মনিরের কাছ থেকে ধারে নেওয়া তিনটা হাজার তো গেছে, শেষ পর্যন্ত গেছে সিগ্রেট কেনার জন্য আলাদা করে রাখা আড়াইশও। আচ্ছা, সুনীলদা কি বেইমানি করল! নাকি মজনু? না, এমনটা হতে পারে না। এমনটা ভাবলে আসরের বিশ্বাস নষ্ট হবে। সে যা-ই হোক, এখন দরকার একটু ধোঁয়া। সে ব্যবস্থাও সর্বদাই রাখে সুনীল। তিনতাসের ঘূর্ণি শেষ। এখন শুরু হবে কল্কির ঘূর্ণি। কল্কির তৃতীয় চক্করের কালেই মনে হলো মজহারের, কেউ তাকে ধোঁকা দেয়নি আসলে, ধোঁকা দিয়েছে রাবেয়া। 

‘দাদা, তুমারে না অনেক দিন আগেই কইসলাম এক বোতল লেম্বুপানি দিতে? দেও নাই ক্যান?’

‘কস কী মজাইর‌্যা? মজার কতা হুনাইলি?’

সুনীলেরও তখন কল্কির প্রভাবে মাথা ঝিমঝিম। মজহারের ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কনটেইনার থেকে একটা খয়েরি কাচের বোতলে ঢেলে দেয় খানিকটা ঝাঁঝালো তরল। তার পর খবরের কাগজ দিয়ে মুড়েও দেয়।

‘সাবধান, হাত লাগাইস না কইয়া দিলাম, লাগাইলে মরছস।’

খুরশেদ আর মজনু টাকার ভাগ বুঝে নিয়ে আগেই লাপাত্তা।

চার. রাত প্রায় দুই টার দিকে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো মজহারের ঘর থেকে। রাবেয়া আর তার মেয়ে বৈশাখীর মরণ-চিৎকার। চলতেই থাকলো অনেকক্ষণ ধরে। প্রতিবেশীরা শুধু রাবেয়ার চিৎকার হলে হয়তো একটু শুনে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ত; কিন্তু সাত বছরের মেয়েটা এমন করে চিৎকার করছে কেন? তা ছাড়া রাবেয়ার আজকের আওয়াজটাও তো অন্যসব দিনের চেয়ে আলাদা! 

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আশপাশের ঘরগুলোর জনাদশেক মানুষ টর্চ কিংবা কুপিবাতি নিয়ে এসে হাজির। বৈশাখী মেয়েটার পুরো মুখসহ মাথার একপাশ পুড়ে গিয়ে কালো হয়ে গেছে। রাবেয়ার হাতে পড়েছে কয়েক ফোঁটা। 

যেহেতু বৈশাখীর গলাটা জড়িয়ে শুয়েছিল রাবেয়া। যেহেতু রাবেয়ার জায়গায় আজ শুয়েছিল বৈশাখী। 

পাঁচ. সুজাতপুর বাজারের এক প্রান্তে একটি দোচালা টিনের ঘরে ‘ইলেভেন রোজ যুব সংঘ’-এর অফিস। সংগঠনের সভাপতি শাহীন আহমেদের কানে গেল খবরটা। সংগঠনের ছয়-সাতজন সদস্যকে সাথে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি বৈশাখী আর রাবেয়াকে দেখতে গেল শাহীন। রাবেয়ার যদিও ভর্তি থাকতে হচ্ছে না; কিন্তু মেয়ের কারণে তো তার থাকতেই হচ্ছে। আবাসিক চিকিৎসক বললেন, ‘এসিড বার্নের ট্রিটমেন্ট তো এখানে হবে না। পিজির বার্ন ইউনিটে অথবা অন্য কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’

হাসপাতাল থেকেই ফোনে জেলা সদরে থাকা প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধির সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করল শাহীন। তিন দিনের মাথায় সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে রাবেয়া আর বৈশাখীকে নিয়ে ছোট একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার দিকে রওয়ানা দিল শাহীনসহ আরও দুজন। অ্যাসিড-আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়- এমন একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন দৈনিকের ওই জেলা প্রতিনিধি। 

ছয়. বাপের বাড়ির কেউই রাবেয়ার ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার পরও রাবেয়ার বাপ একদিন সঙ্গী হলেন রাবেয়ার। ইজিবাইকে চেপে বাপের বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার পেরিয়ে সুজাতপুর বাজার, তার পর সিএনজিতে চড়ে আরও দশ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জেলা সদর। ক্রিমিনাল কোর্টের জাঁদরেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনোয়ার মুস্তাফিজের চেম্বারে বসা রাবেয়া আর তার বাপ। সব শুনে আইনজীবী বললেন, ‘মেয়েদের পক্ষে এখন আইন খুব কড়া। এর মধ্যে এটা হচ্ছে- অ্যাসিড-সন্ত্রাস। দুইটা মামলা করে দেব। একটা হচ্ছে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের, আর একটা হচ্ছে যৌতুক চেয়ে বউকে নির্যাতন। হারামজাদা এইবার বুঝবে মেয়েদের গায়ে হাত তোলার মজা!’

এতদিন বাড়িতেই ছিল মজহার। এবার পালাল। 

সাত.  তিন মাস চিকিৎসা শেষে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল বৈশাখী। ফিরে এল বাড়িতে। পুরো চেহারা আঁৎকে ওঠার মতো বীভৎস, তার পরও একটু একটু করে বাইরে বের হতে লাগল সে। শাহীনদের তৎপরতায় ফিরে গেল স্কুলেও। অ্যাসিড-দগ্ধদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান পত্রিকায় সংবাদ দেখে সরেজমিনে এসে মেয়েটির সহায়তায় মাসে চার হাজার করে টাকা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। এ জন্য একটি ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছে তারা। 

আট. ঘটনার এক বছরের মাথায় রাবেয়াকে বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়। শুরু হয় বাড়ি বাড়ি কাজ করে কারও বাড়িতে থেকে যাওয়া। একদিন রাবেয়ার সাথে দেখা করল মজহার। পলাতক অবস্থা থেকে ফিরে এসে নিজের বাড়িতেই থাকতে শুরু করেছে সে। রাবেয়ার কাছ থেকে যতটা মারমুখী আচরণ আশঙ্কা করেছিল, ততটা না পেয়ে ভেতরে ভেতরে অবাক হয় মজহার। একদিন পাড়া-প্রতিবেশীর অবাক চোখের সামনে দিয়ে বৈশাখীকে সাথে নিয়ে মজহারের পেছন পেছন তার ঘরে আবারও প্রবেশ করে রাবেয়া। 

নয়. অনেকদিন পর আবার সুনীল বণিকের ‘মা তারা শিল্পালয়’-এ এসেছে মজহার। আবার তার চেহারায় এসেছে তেলমাখা চেকনাই। এ ছাড়া অনেকদিন পর ফিরে আসায় সুনীল খাতিরটাও করেছে দারুণ। চায়ের সাথে গরম মোগলাইও আনিয়ে খাইয়েছে। এখন আয়েশ করে পানটা চিবুচ্ছে মজহার।

মাসে কড়কড়ে চার হাজার টাকা! তবে মজহার এতোটা অবিবেচক নয়। সাড়ে তিন হাজার নিজের পকেটে নিয়ে পাঁচশ দিয়ে এসেছে রাবেয়াকে। সংসারের খরচ আছে না! 

সব মিলিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছে মজহারের। আজ রাতে সুনীলের দোকানের পেছনে আসরটা জমবে চমৎকার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //