রূপান্তর

সামান্য বিষয় নিয়ে এভাবে কেউ রিঅ্যাক্ট করে! কিছুতেই মিলাতে পারে না অনিল, অরণির এ কাণ্ডটা। না হয় তরমুজটার ভেতরে সাদা হয়েছে, তাতে কী হয়েছে! সব তরমুজ ভেতরে টকটকে লাল হবে তার কি নিশ্চয়তা আছে। আর কেনার সময় কি কেউ তরমুজের ভেতরে ঢুকতে পারে যে দেখে কেনা যায়? আকারে বড় হলে একটা কথা ছিল।

ছোট তরমুজের ধরনই এমন। হলে লাল হবে, না হলে সাদা। দোকানিই বলে দেয়, ‘ভাই, এইটা হইলো কপাল। ছোট তরমুজ কাইট্টা বিক্রির সিস্টেম নাই, ফেরতেরও সিস্টেম নাই।’ সারা বিকাল ঝগড়া তো হলোই, রাতের খাবার বন্ধ, সকালে এক ব্যাগ কাপড় নিয়ে বাসা থেকে ছুট! এটা কি হয়? অনিল গড়গড় করে। 

অনিল এমনিতে শান্ত। কথা বলে কম। একা হাঁটে, চলে। নব্যনগরায়িত এই এলাকায় পুরনো সঙ্গীরা অনেকেই জীবন সঙ্গতির সাথে না পেরে ধীরে ধীরে অন্যত্র চলে গেছে নগরভার বহন করতে না পেরে। ঢুকছে নতুন মানুষ। উঠছে বহুতল ভবন। এক ভবনে শত মানুষ। শত রকমের। কারোরই অভাব নাই, অনটন নাই। অল্প কয়েক পুরনো বাসিন্দার সঙ্গে অনিলও পৈতৃক ভিটা নিয়ে টিকে আছে দাঁতে দাঁত কামড়ে। নিচু বাড়ি, ভাঙাচোরা ঘর।

বেসরকারি চাকরি। আয় সামান্য, ব্যয় ভারি। অরণি চঞ্চল। বেড়াতে পছন্দ করে। খেতেও। হাতের কিছু কাজ জানে। পুঁজির টানে কিছুই করতে পারে না। যা করে স্বামীর বেতনের সাথে মিলিয়ে সংসারের গোড়ায় ঢেলেই শেষ। মেজাজে চড়া হলেও সবসময় চটে না। গতকালের কাণ্ডটায় অনিল তাই হতবাক। 

গরম পড়ার পর থেকেই অরণি একটা বড় তরমুজের কথা বলছিল। লাল, চিনির মতো রোয়াওয়ালা মিষ্টি। ছোটবেলা থেকেই তার তরমুজ পছন্দ। একটা তরমুজ হলে সেদিন আর ভাত লাগে না। ঘুরে ঘুরে তরমুজ খেয়েই সারা। অনিলও দেখেছে।

এবার তিন দিন দুইশ টাকার মধ্যে যে তিনটা তরমুজ এনেছে প্রতিবারই দশাধরা। ফকফকা সাদা। সাত-আটশ টাকার তরমুজ আনা অনিলের পক্ষে সম্ভবও না। বলতে গিয়েই বেঁধেছে বিপত্তি। ‘তোমার দ্বারাই সম্ভব না, আর সবার দ্বারাই সম্ভব। পাশের দালানের লিয়াকত সাহেব, তার পাশের দালানের তৃতীয় ফ্ল্যাটের সুধীন সাহেবদের দ্বারা সম্ভব। তারা তো অনেক বড় চাকরি করে না।

একজন সরকারি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর, আরেকজন মিডলক্লাস অ্যাকাউন্ট্যান্ট। গলির সাত তলা দালানের নিচতলার সমীর সাহেব, তারও বিদ্যুৎ অফিসের মাস্টাররোলের চাকরি অথচ রোজ হাতে করে একটা না একটা বড় তরমুজ নিয়ে ফেরে। তোমার বেলায়ই তরমুজের দাম মাথার উপরে! আনতে চাও না, বললেই হয়, হয় না?’ অনিল উত্তর দেয় না। তা-ই তো।

অনিলও তো মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে দেখেছে লিয়াকত সাহেবকে, সমীর সাহেবকে, সুধীনকে। তারই হিংসা হয়েছে তাদের হাতে এত বড় বড় তরমুজ দেখে। শুধু কি তরমুজ। এলাকাটি সিটি করপোরেশনে নেয়ার পর থেকে খালি জায়গা আর পুরনোদের পুরনো বাড়ি কিনে যারা বহুতল তুলেছে, ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে যারা উঠেছে তাদের অনেককেই তো অনিল দেখে চাকচিক্যের অদ্ভুত মোড়কে মোড়ানো।

অথচ সবাই না হলেও বেশিরভাগই নাকি সীমিত আয়ের লোক, সরকারি অথবা বেসরকারি। এদের কেউ কেউ আবার দামি দামি গাড়ি. অত্যাধুনিক মোটর বাইক চালিয়ে অফিসে যায়, আসে। নিজের জামা, স্ত্রীর গায়ের শাড়ি, গহনা, সন্তানদের খরচ দেখে চোখ চড়কা। অনিল ভাবনাটাকে বাড়ায় না। অরণি ভাবে মাঝে মাঝে।

রাতে ঘুমানোর আগে এটা ওটা বলতে বলতে অনিলের বুকের কাছ মাথা ঘেঁষে কানের কাছে প্রায়ই বলে, ‘আমাদের বাড়িটার কাজ কবে ধরবা? সব বাড়ি কত্ত বড় বড়, আমরা এই টিনশেডে! ফাউন্ডেশন দিয়ে না পারো অন্তত বাড়িটা উঁচা করে সামনে কয়েকটা দোকান তোলো না, কিছু ভাড়াও তো আসব। আর কত?’ অনিল চুপ করে থাকে। অরণি নিরাশ হয়ে বুক থেকে মাথা নামিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। 

কয়েকবার ফোন করার পরও অরণি ফোন রিসিভ করে না। পরে ফোনটা ধরে। ‘বাসায় আসবা না?’ অনিল বলে। ‘আসব না আর। কী হবে এসে। সেই তো জলাবদ্ধতা, ধুলা, বালি! কে ভাবে আমার কথা? আমার কথা বললেই তো তোমার কান কিছু শুনতে পায় না।’ ‘বিষয় তো তা না অরণি। বিষয় তরমুজ। কালই অফিস থেকে ফেরার পথে একটা বড় তরমুজ নিয়ে আসব।

টকটকে লাল, চিনির রোয়ার মতো, মিষ্টি। চলে আসো। তাছাড়া আম্মাও কাল আসছে। এসে তোমাকে দেখতে না পেলে কষ্ট পাবে। একটা তরমুজই তো, অসুবিধা হবে না।’ বলে ফোনটা রাখে অনিল। অনিল জানে, অরণির এই প্রস্থানে তরমুজই কারণ না।

এটা হলো অনেক দিন কোনো বিষয়ে বা অনেক বিষয়ে ক্ষোভ, অভিমান, রাগ, না বলা কথা পুষে রাখার পার্র্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো। অরণি এমনি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। অনিলের পক্ষে প্রতিসপ্তাহে বা মাসেও কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয় না বিধায় অরণি নিয়ম করে প্রতিবেশীর বাসায় বেড়াতে যায়। স্ত্রীলোকদের সাথে মেশে। গল্প করে।

তাদের কাছে তাদের ও তাদের স্বামীদের রোজগার, খরচ ও যাপনের যে আড়ম্বরতা শোনে, তা শুনে শুনে অরণির মধ্যে যে ক্রিয়া হয় তারই প্রতিফলন এরূপ কিছু। অনিলও এতদিনে বুঝে গেছে। বরং যতটুকু নমনীয় থাকা যায় ততটুকু তার জন্য কল্যাণ। অরণি এগুলো জানে। জানে বলেই যতবার এবাড়ি ছেড়ে যায় ততবারই সে ফিরে আসে, অনিল যেয়ে না নিয়ে আসলেও। 

পাড়ার আটত্রিশ নম্বর বাড়িটির সামনে লোকের গিজগিজ। কেউ বলছিল, ‘ঠিকই আছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে।’ অরণি ফিরতি পথে রিকশা থেকে শব্দগুলো শুনলো। রিকশাওয়ালাকে সামনে রাখতে বলে অরণি জিজ্ঞাসা করলো, কী হয়েছে এখানে, জানেন? অরণি নেমে পড়ে রিকশা থেকে।

বদরুলের দোকানে ব্যাগটা রেখে বাড়িটার দিকে আগায়। এই বাড়িতে লিয়াকত সাহেব থাকেন। লিয়াকত সাহেবের স্ত্রী অরণির পছন্দের মানুষ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই কালো জ্যাকেট পরিহিত দুজন নারী, ব্যাচে লেখা ‘ডিবি’ চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই-যে এই দিকে আসবে না। নিচে যান।’

আশপাশে যাদেরকে দেখা গেল, তারাও বিভিন্ন বাহিনীর লোক। ডাকাতি হয়নি তো লিয়াকত ভাবিদের বাসায়! ক্ষণিক ভেবে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে এখানে, কার ফ্ল্যাটে? একজন বলল, ‘লিয়াকত সাহেব, সে নাকি পাহাড় সমান অবৈধ সম্পদের মালিক। ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা আরও কি কি।

ধরা খাইছে, ভালো হইছে এইবার।’ অরণির দুই পা বলহীন মনে হলে পড়তে পড়তে একটা খুঁটি ধরে দাঁড়াল। বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে সুধীন, সমীর সাহেবের বাসার দিকে রওয়ানা করল। বাসায় যেয়ে দেখে দুই বাসায়ই তালা ঝুলছে। এক কিশোরী সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘ওরা বাসায় নাই। লিয়াকত সাহেবের বাসায় প্রশাসন আসার পর ওরাও উধাও।’

অরণি বাসায় ফিরে টিভির সামনে বসে। চ্যানেলগুলো লাইভ দেখাচ্ছে। স্ক্রল চলছে। ‘সড়ক ও জনপথের কম্পিউটার অপারেটর কাম পিয়ন আবু সাঈদ লিয়াকত অবৈধ চাকরি-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ভুয়া বিল উত্তোলন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে অবৈধভাবে জড়িত থেকে কোটি টাকা অর্জন ও আত্মসাতের অভিযোগে নিজ ফ্ল্যাট থেকে নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার, বেনামে সম্পত্তির দলিলসহ আটক;

স্ত্রী, সন্তানদের এবং সরকারি অন্য মন্ত্রণালয়, দপ্তরের সম্পদ লুটপাটের সাথে সম্পৃক্ত অন্যদের বিরুদ্ধেও অভিযান চলমান থাকবে।’ বিশ্বাসের দেয়ালে জোরে ধাক্কা লাগলে দেয়াল যেমন ঘট করে ফেটে যায় বা ধপ্ করে পড়ে যায় কাত হয়ে তেমনি অরণি পুরনো সোফার কুশনে ভর দিয়ে বসে পড়ল। শুধু একটা স্বগোক্তি করল, মানুষ এইরকম হয়! 

অনিলের ফোনটা বন্ধ। অরণি অস্থির। কতকগুলো আত্মঅনুশোচনা তাকে ভেতর থেকে পিরানহা মাছের মতো ঠোঁকরাচ্ছে। তার মুখ লাল, চোখ ঝাপসা। অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। অনিল যখন বাসায় ফিরল অরণি তখন রেগে অস্থির, ‘ফোন বন্ধ কেন তোমার?

এতক্ষণ কেউ ফোন না ধরে?’ অণিল চুপ। তার দুই হাতে দুইটা বড় তরমুজ। ছুরির টানে চিড় ধরা। চিড়ের ভিতরটা রক্তের মতো লাল, চিনির রোয়ার মতো লালের মধ্যে দানা দানা। অনিলের চোখও সম লাল। অরণি তাকায় অনিলের আপাদমস্তক।

অনিলের চোখ আর তরমুজের চিড়ে লালের মধ্যস্থলে যেন অনেকগুলো শুয়োর গোঁত-গোঁত করছে। অরণি দেখতে পায়, পাশেই একটা বিরাট মাঠ, মাঠে অনিল একটা শুয়োরের গায়ে হেলান দিয়ে বসা, যেন শুয়োরটা তার প্রিয় বন্ধু। আর অরণি অনেক দূরে একটা শেগুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আকাশটা তখন গাঢ় মেঘে ছাওয়া।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //