অনেকটা পথ যাবার পর

‘আলো ও তাপ আগুনের ধর্ম, তাপ ও আলো ভিন্ন যে আগুন তা প্রকৃত আগুন নয়।’

আগুনটা অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে নেচে নেচে সামনে এগুচ্ছিল। প্রথমে ওটা ছিল ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গ মাত্র, দুর্বল আর স্বল্পায়ু, তারপর বাতাসের সামান্য দোলায় সে উড়ে গিয়ে স্পর্শ করল কাছেই মাটিতে লুটিয়ে থাকা একটা সুতি কাপড়, মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা শুধু, তারপর সেখান থেকেই উচ্চাভিলাষী অগ্নিশিশুকে আকৃষ্ট করল সামনে পড়ে থাকা আরও সব দাহ্য বস্তু, যাদের সামান্য আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে শক্তি বাড়ল তার, লকলকিয়ে উঠে এলো উপরের দিকে, নিজ ধর্মে অবিচল থেকে দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিল; যা পেল সামনে তাই, চামড়া ও কাপড় পোড়ার বিশ্রী গন্ধে ভরে উঠল ঘর। 

আগুনের সঙ্গী ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া পাখা মেলে উড়ছে ঘর জুড়ে। অভ্যাসবশত রেজাউল করিমের মুখ গহ্বরে তার প্রায় অসাড় জিহ্বা খানিকটা নড়াচড়া করল। কিন্তু তাতে কোনো শব্দ বের হলো না। বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে রেজাউল করিমের বাকযন্ত্র। বাঁচার তাগিদে নীরবে চিৎকার করছে জিভ, কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পাচ্ছে না।

ঝাপসা ধোঁয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না রেজাউল করিম, ভারী হয়ে যাওয়া চোখের পাতা দুটো নামিয়ে এবার চোখ বন্ধ করলেন তিনি, আর তার সামনে থেকে সরে গেল পর্দা। রেজাউল করিম অবাক হয়ে দুচোখ ভরে দেখতে থাকলেন, তার শুধু মনে হলো, দেখা কখনো ফুরায় না। একই দৃশ্য বার বার দেখলেও মনে হয় দেখা শেষ হয় নাই, কিছু দেখা বাকি থেকে গেছে। সেই বাকিটা যে কী তাও যেন ঠিকমতো জানা নাই।

এই জানা-অজানার মাঝেই বন্ধ চোখের সামনে খুলে যায় একটা উজ্জ্বল পথ, রেজাউল করিম ভাবেন, এমনও তো হয় যে, একটা রাস্তা ধরে বহুদূর যাওয়ার পর হঠাৎই বোঝা যায়, এটা ভুল পথ, এই রাস্তায় কখনো গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না।

তখন প্রথমে থমকে যাওয়া তারপর ফিরে যাওয়ার কথা ভেবে ক্লান্তি নামে মনে, মনে হয় কেন তবে এই কাঁটাময় পথে এসে দুর্লভ সময়ের এত বিরাট অংশ খরচ করে ফেললাম, এরচে অন্য কোনো রাস্তা ধরাই তো ভালো ছিল। যে রাস্তা ধরে আরও কম মেধার মানুষজন তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে।  

কিশোর বেলায় রেজাউল করিমের ইচ্ছা ছিল পরিব্রাজক হবেন, পায়ে হেঁটে প্রথমে সারা বাংলাদেশ, পরে পুরো বিশ্ব ভ্রমণ করবেন তিনি। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং, ফা হিয়েনের মতো বিখ্যাত পর্যটক হয়ে, উড়বেন ভাসবেন চলিষ্ণু মেঘের মতো; কিন্তু তা কি আর হলো? আটকে দিল লোভ, আটকে দিল মোহ। মেঘ ভেসে চলে গেল, আমি রয়ে গেলাম গাছের মতো, এক জায়গায় স্থির। 

প্রথম যেদিন কাগজে নিজের লেখা ছাপা হলো, লেখার সঙ্গে ছাপা হলো নিজের নাম। আহা সেদিনই প্রথম বুঝলাম, নিজের নামটা মানুষের কত প্রিয়। বার বার ঘুরে ফিরে দেখা, মনের মধ্যে আলোড়ন, বুকের মধ্যে ঢেউ তোলা, একটা ছোট্ট ছড়ার নিচে ছাপার অক্ষরে লেখা রেজাউল করিম। কী আনন্দ, কী শিহরণ! সেই আনন্দ শিহরণের লোভেই যেন চিরকালের মতো বাঁধা পড়ে গেলাম।

আমার বন্ধু গৌতম বলল, ‘কবি লেখকদের পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। তাহলে লেখার সুবিধা। তাছাড়া এটা স্বাধীন পেশা। উন্নত মম শির, কারো সামনে মাথা নোয়াতে হয় না। কাউকে স্যার বলতে হয় না, বুঝছিস?’

‘বসদেরও স্যার বলে না?’

‘নারে। সেটাই তো মজা। বসদেরও ভাই বলে ডাকা যায়।’  

সেই মোহ আহা, কাস্টমসের লোভনীয় চাকরি আর ভালো লাগল না, তখন পোস্টিং হয়েছিল বেনাপোলে, শামসুদ্দিন ভাইকে বলতে গিয়েছিল রেজাউল করিম। দৈনিক নব অভিযান পত্রিকার সম্পাদক শামসুদ্দিন ভাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে চোখ বুলিয়ে বলেছিলেন,‘বাহ্! ভালো চাকরি! কিন্তু চাকরগিরি করতে পারবা তো? সাংবাদিকতার নেশা বইলা একটা কথা আছে, অনেকেই গিয়া টিকতে পারে না’

‘আসলে ফ্যামিলির সবাই চায়, সরকারি চাকরি, 

সুযোগ-সুবিধা বেশি...’ 

‘না, না, ঠিক আছে। আমিও চাই ভালো হোক তোমার।’

তখনো রেজাউল করিম জানত না যে আসলে ভয়ানক এক নেশার চক্করেই পড়ে গেছে সে। রক্তের গভীর গোপনে সেই নেশার প্রভাব তাকে চাকরিতে মন বসাতে বারণ করে, মনে হয় এইখানে কেন এলো সে, এ তো তার স্থান নয়। এ ভুল জায়গা, এ ভুল কাজ। এখানে তাকে মানায় না, এই 

সংস্কৃতিতে সে বেমানান। এইখানে গিভ অ্যান্ড টেকের খেলা না খেললে উন্নতি করা যায় না। এখানে তার হিসাবে গরমিল বেঁধে যায়। এখানে নিজেকে পরাধীন মনে হয়। মনে হয় চোরাবালিতে, পাঁকের মধ্যে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে সে।

‘চাকরিটা ছাইড়া দেই... ’ বউকে বলে সে।  

সুলেখা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘কী হইছে? আরও দশজন মানুষ চাকরি করতেছে না? নাকি দুই লাইন ছড়া আর তিন লাইন খবর লেইখ্যা তুমি আলাদা হয়ে গেছো...’

কখনো অফিসফেরত বিমর্ষ স্বামীকে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করে সে, ‘দেখো নব অভিযানে তোমার দুই-তিন মাস বেতন হতো না, টিউশনি করা লাগত, এইখানে মাস শেষে ভালো বেতন পাও। সংসারে টানাটানি নাই। খামাকা ওই অনিশ্চিত জীবনের কথা মনে করো কেন? কেন পেছনে ফিরে তাকাও?’             

হায়, রেজাউল করিমের মনে হয়, সুলেখা আমায় বুঝতে পারে না। এই দমবন্ধ করা পরিবেশে, এই বন্ধুহীন নিরানন্দ জায়গায়, এই দেওয়া-নেওয়ার হাটে, হায়! সুলেখা কেন বোঝে না? সে কি এভাবেই যন্ত্রণা সয়ে যাবজ্জীবন এই কারাগারে থাকতে বাধ্য করবে আমাকে? 

কমিশনার স্যার বলেন, ‘মনে রাখবেন কাস্টমস সরকারের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আহরণ করে ও মানুষকে সেবা দিয়ে থাকে। কার্গো ও আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট কিন্তু আপনাদের হাতে।’

‘ইয়েস স্যার!’ 

‘কোনো অবৈধ পণ্য পাচার করা যাবে না। প্রয়োজনে ব্যাগেজ তল্লাশি করবেন। সরকারের রাজস্ব আদায় করবেন। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে অযথা হয়রানি করবেন না।’ 

‘ইয়েস স্যার!’ 

‘কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন পুলিশ একে অপরের পরিপূরক। চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি রোধে আপনারা একযোগে কাজ করবেন।’

‘ইয়েস স্যার! ’

‘স্যার, স্যার, স্যার’ রেজাউল করিমের জিহ্বার চামড়া উঠে যায় স্যার ডাকতে ডাকতে। কাতর মন বলে, বেরিয়ে পড়ো। এই আটকে পড়া জীবনের চেয়ে পথ ভালো। খোলা প্রান্তরে অন্তত প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়া যায়। জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটা যায়, শিশির ভেজা ঘাসের স্পর্শ-গন্ধ পাওয়া যায়। ওহে সুদূরের পিয়াসি, তুমি না একদা পরিব্রাজক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলে!

পৃথিবীর অপূর্ব মায়াময় আলো-বাতাস ছুঁয়ে দেখবার আকাক্সক্ষা করেছিলে!  সুলেখা এসব শুনে খিলখিল করে হাসে। বলে, ‘আজকাল বিনা পয়সায় কোথাও যেতে পারবে না। ঘুরতেও টাকা লাগে, পায়ে হাইট্টা আর কতদূর যাবা, বলো? টাকা কামাও, টাকা জমাও তারপর দুইজনে মিলে বিশ্ব ভ্রমণে যাব।’

সুলেখা স্মার্ট, সুন্দরী, হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। সে তার গুণমুগ্ধ বন্ধুবান্ধব নিয়ে পিকনিকে যায়, সপ্তাহ শেষে পার্টি করে। ক্ল্যাসিক্যাল গান গায়। মহা আনন্দে দিন কাটায়।   

সুলেখা বলে, ‘শোন, তোমার কর্মচারীরা নাকি এসপি সাহেবের মেয়ের তিনটা বাক্স আটকে দিছে, একটু ছেড়ে দিও তো।’

‘বাক্স ছাড়া যাবে না, ওইগুলিতে ঝামেলা আছে।’ রেজাউল করিম বলে।  

‘থাকলে থাকুক। উনি খুব রিকোয়েস্ট করেছে। তুমি বলে দিলেই তো হয়।’ 

‘না। এটা সম্ভব না।’ 

সুলেখা রাগ করে বলে, ‘তুমি একটা বিরক্তিকর মানুষ। নীরস। প্রাণহীন। নির্দয়। কোনো চার্ম নাই। তোমার সঙ্গ অসহ্য। তুমি তো সামান্য অফিসার! কমিশনার সাহেবকে বললেই উনি ছেড়ে দিবেন।’ 

রেজাউল করিম বলে, ‘সুলেখা, চাকরিটা ছাইড়া দেই। ভাল্লাগে না আর ...’

সুলেখা তাতে সায় দেয় না। বলে, ‘আসো একটা সন্তান নেই, তখন তোমার চাকরি ছাড়ার বিলাসী ইচ্ছা আর থাকবে না।’ 

শরীরে শরীর ঘষলেই কি সন্তান নেয়া যায়? যদি সন্তান স্বর্গ থেকে নিজে নিজে নেমে না আসে? সংসারে সন্তান এলে কি সুলেখা বাধ্য হয়ে রেজাউল করিমের সঙ্গে থাকত? কে জানে? হয়তো সন্তানের মায়ায় সম্পর্কটা কর্তব্যের চিকন সুতায় ঝুলে থাকত। ডিভোর্সের কারণ হিসেবে সুলেখা লিখেছিল, ‘মনের মিল না হওয়া’। ফাঁকা বাড়ি, শূন্য বারান্দা গুনগুন করে বলে, মনের সঙ্গে মনের মিল হলো না। অমিলে ভরা এমন সংসারে সন্তান না এসে ভালোই হয়েছে হয়তো।  

রেজাউল করিম এখন দায়মুক্ত। ঝাড়া হাত পা। সুলেখা চলে গেছে, যার সঙ্গে তার মনের মিল হয়েছে এমন একজনের কাছে। স্ত্রীপরিত্যক্ত পুরুষ মানুষকে সমাজ কি করুণার চোখে দেখে? আড়ালে বিদ্রুপ করে? দুর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষ ভাবে? ভাবে কমজোর? কোমর ভাঙা? বউ ধরে রাখতে পারে না যে, সে আবার পুরুষ নাকি?

রেজাউল করিম মাথা নিচু করে হাঁটে, আগের চাইতে আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। আশেপাশে কেউ কেউ অবজ্ঞার হাসি হাসেন, অনেকে অনেক রকম ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে। রেজাউল করিম সেসবে কান দিতে চায় না। কিন্তু তবু কিছু না কিছু কথা বাতাসে ভেসে কানে আসে। ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে ধরে তাকে। 

‘শামসুদ্দিন ভাই, আমি শেষ পর্যন্ত  চাকরিটা ছাইড়া দিলাম, এখন আপনের পত্রিকায় একটা যেমন তেমন কাজ হইলেই চলবে।’

রেজাউল ফোন করলে শামসুদ্দিন ভাই আঁতকে ওঠেন, ‘করছো কী? অমন দামি চাকরি কেউ ছাড়ে...’

‘পারতাছিলাম না, ভাই, মনের উপর খুব চাপ পড়ছিল...’ 

শামসুদ্দিন ভাই তখন দৈনিক নব প্রকাশের সম্পাদকীয় বিভাগে জয়েন করতে বলে রেজাউল করিমকে। 

‘দেখো, এইটা ছাড়া তোমারে আর কোনো চাকরি দিতে পারব না। বেতন তেমন বেশি না। পোষাবে কি না দেখো।’ 

রেজাউল করিম বলে, ‘এটাতেই চলে যাবে।’  

ছোট ভাই শফিউল করিম এসে রাগে-ক্ষোভে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে, ‘এইটা কোনো কাজ করলেন, দাদা, এত ভালো চাকরি ছাইড়া কলম পেষার কাজ নিলেন? আপনেকে আব্বা এত কষ্ট করে পড়ালেখা করাইলো। পরিবারের প্রতি আপনের একটা দায়িত্ব-কর্তব্য আছে না? আব্বা-আম্মা অসুস্থ, তাদের চিকিৎসার খরচ লাগে...’

‘সেই খরচ দেয়া যাবে।’ রেজাউল করিম সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়। 

‘ভাবিও আপনেকে ছাইড়া গেল! আফসোস! সংসারটাও ভালোভাবে করতে পারলেন না। কেমনে সারা জীবন একা একা থাকবেন? যা হইছে, হইছে এখন আরেকটা বিয়া করেন।’

রেজাউল করিম ছোট ভাইকে মৃদু ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। নিজেকে বরং তার এখন মুক্ত মানুষ মনে হয়। বাঁধা-ধরা, মাপা কথা বলা, লোভে চকচক চোখের মানুষে ঘেরা জীবন থেকে বাইরে এসে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সে আসলে ভালো খাজনা আদায়কারী নয়, রাষ্ট্রের পাইক-পেয়াদা হিসেবেও সে ব্যর্থ, অপদার্থ। তারচে স্বাধীনভাবে পত্রিকায় কাজ করাই তার জন্য সমীচীন। 

তবে পুরনো জায়গায় ফেরাটাও সবসময় যে খুব সহজ নয়, সেটা বুঝতে পারে রেজাউল করিম, গত তিন/চার বছরে তার চেনা জগতেও যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষগুলোর চেহারাও যেন পাল্টে গেছে। 

বন্ধুবান্ধব মাথা নেড়ে বলে, ‘বোকামি করছেন ভাই। স্রেফ পাগলামি করছেন! বুঝবেন, কিছুদিন গেলেই বুঝবেন। কাজটা ঠিক করেন নাই।’

সবাই সুলেখার মতো এত বৈষয়িক হয়ে গেল কীভাবে? এত বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন! রেজাউল করিম চায়, অন্তত কেউ একজন তাকে বলুক যে সে ঠিক কাজটাই করেছে, বলুক, ওহে বন্ধু, হৃদয়ের আর্তনাদ শুনেছ তুমি, মনের আকুতিটা বুঝেছ, যা করেছ তা ভালোই করেছ। এটাই সঠিক। এটাই কাম্য ছিল। আত্মাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছ। এই তো চাই! ব্রেভো! প্রত্যেকের আত্মা বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাক। 

শামসুদ্দিন ভাই চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে বলেন, ‘এত দাঁতালো সম্পাদকীয় লেখো কেন ভাই? পত্রিকাটা বন্ধ করতে চাও? লেখা থেকে দাঁত ফালাও। মোলায়েম করো। বিপ্লব করার কথা ভুলে যাও।’

‘চারিদিকে এত তোষামোদি কেন, এত চাটুকারিতা?  শামসুদ্দিন ভাই, আমি কি তবে এই জগতেও অচল হয়ে গেলাম? আমাকেও আর সবার মতো চালাক আর ধুরন্ধর হতে হবে? গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে হবে?’ 

‘তা না। তবে তোমাকে একটু কৌশলী হতে হবে। সিনিয়রদের বেশি বেশি সালাম আদাব দিবা। যেদিকে বৃষ্টি পড়ে ছাতাটা আস্তে করে সেদিকে ঘুরায়া দিবা। এতে দোষের কিছু নাই। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার যোগ্যতা বাড়াতে হলে অ্যাডাপটেশান মানে অভিযোজন পাওয়ার বাড়াতে হবে। এখন চলো একটু পাগলা পানি খেয়ে আসি।’    

শামসুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আগেও ক্লাবে গেছে রেজাউল। উনার এক ব্যবসায়ী বন্ধু আছে আরিফ হাসান, যিনি বিনা পয়সায় দামি মদ খাওয়ায়। বিনিময়ে তার ননস্টপ কথা শুনতে হয়। ভদ্রলোক পারেনও বটে। বলতেই থাকেন, বলতেই থাকেন। শামসুদ্দিন ভাই কথা শোনার ভান করেন বটে তবে তার নজর থাকে মদের গ্লাসে।

আরিফ হাসান কথা বলেন আর শামসুদ্দিন ভাই আকণ্ঠ মদ গিলেন। রেজাউলের ভালো লাগে না। তবু শামসুদ্দিন ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে সে ক্লাবে গেল। আরিফ হাসান মদের অর্ডার দিয়ে যথারীতি একপাক্ষিক কথা বলতে থাকল, ‘সরকারি অফিসে 

টাকা-পয়সা না দিলে একদম কাজ হয় না, বুঝছেন? সব শালারা হাঁ করে বসে থাকে টাকার জন্য। আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের দরকার দ্রুত কাজ। নয়তো লস খাবো। কে লস করতে চায়, বলেন? লস যাতে না হয়, সেই জন্য আমরা ঘুষ দেই। সোজা কথা। এইগুলি ঘুষ না, স্পিড মানি। ফেলো কড়ি মাখো তেল! টাকা কথা বলে, ফাইল দ্রæত চলে।’

শামসুদ্দিন ভাই পিপাসার্ত মানুষের মতো মদ গিলে যাচ্ছিল। যেন পান করা ছাড়া জগতে আর কোনো লক্ষ্য নাই। রেজাউল করিমও এক-দুই পেগ খেয়েছে, কিন্তু আরিফের বাগাড়ম্বর সেদিন অসহ্য লাগছিল তার কাছে। বেয়ারা খালি গ্লাস আবার ভরতে এলে সে কিছু না বলে সটান উঠে দাঁড়াল, তারপর কাউকে কিছু না বলে সোজা বেরিয়ে এলো বাইরে। 

আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। হালকা বাতাস বইছে। ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রেজাউল করিমের মনে হলো, আমি কি করছি এসব? বিষাক্ত, দূষিত মানুষদের সঙ্গে বসে দুর্লভ মানব জীবন অযথাই এভাবে অপচয় করছি, আমার তো পরিব্রাজক হওয়ার কথা। বন্ধনহীন, স্বাধীনভাবে চলমান বাতাসের মতো, ভাসমান মেঘের মতো আমি পৃথিবীর সর্বত্র পর্যটন করে বেড়াব, নিরিবিলি জীবন কাটাব, তা না করে কী করছি আমি?

যেমন স্বপ্ন দেখেছি, তেমন একটা বাধাহীন, গণ্ডিহীন, মুক্তির উল্লাসে ভরা স্নিগ্ধ, কোমল আর প্রশান্তিময় জীবন আমার কি হবে না কখনো? আমি কি দেখব না জগতের বিচিত্র দৃশ্য? পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, তরঙ্গ?  

এক কামরার একলা ঘরে ফিরে এসে সারা রাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে নিদ্রাহীন রাত কাটল রেজাউল করিমের। সকালে ঘাড় আর মাথায় তীব্র ব্যথা নিয়েই অফিসে গেলে শামসুদ্দিন ভাই ঝাড়ি দেয়, ‘কী মিয়া? কালকে কিছু না বইলা কই গেলা গিয়া? ভাবলাম জল বিয়োগ করতে গেছো, কিন্তু আর খবর নাই।’  

রেজাউল করিম বলল, ‘ভাই চাকরিটা করব না, ছাইড়া দিব।’

শামসুদ্দিন ভাই মøান হাসল, ‘তুমি কি ছাড়বা মিয়া? মালিক পক্ষ লোক ছাঁটাইয়ের নোটিশ দিছে, সেইখানে তোমার নাম চার নম্বরে আছে।’

রেজাউল করিম মাথা নিচু করে বসে থাকে, তার মাথাব্যথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শামসুদ্দিন ভাই বলে, 

‘অসুবিধা নাই, তোমার জন্য আরেকটা কাজ ঠিক করছি। অনলাইন পত্রিকা। কাজের চাপটা একটু বেশি। কিন্তু কাজ করে মজা পাবা।’  

‘কিন্তু আমি তো ভাই আর চাকরি করব না ঠিক করছি। ছাঁটাই হওয়াতে বরং আমি খুশিই হইছি। এইবার সত্যি বের হয়ে পড়ব।’

মাথা তুলে রেজাউল করিম কণ্ঠে জোর করে আনন্দ আর উৎফুল্লতা মিশিয়ে বলে। শামসুদ্দিন ভাই অবাক হয়ে তাকান, ‘মানে কী?’ 

‘বিশ^ ভ্রমণে বের হব। পায়ে হেঁটে। অনেক দিনের ইচ্ছা। এবার সেই ইচ্ছা পূরণ করব। প্রভিডেন্ড ফান্ডের কিছু টাকা পাইছিলাম তাতেই হয়ে যাবে... ’

বলতে বলতেই রেজাউল করিমের কথা কেমন জড়িয়ে আসে। তার মনে হয় জিহ্বা ভারী হয়ে উঠছে। হাত পা ঝিমঝিম করে অবশ হয়ে যাচ্ছে। মুখ এক পাশে বেঁকে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রেজাউল করিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, পারল না। শামসুদ্দিন ভাই টেবিলের ওপাশ থেকে চিৎকার দিল, ‘রেজাউল কি হইল? ঠিক আছো তুমি? এই রেজাউল, 

এই ...’

রেজাউলের ছোট ভাই শফিউল করিম গাজীপুরের চালার হাট বাজারে একটা ওষুধের দোকান চালায়। সেখানে জমি কিনে একটা বাড়িও করেছে। সেই বাড়ির বারান্দায় একটা হুইল চেয়ারে সারাক্ষণ বসে থাকে রেজাউল। স্থবির, শান্ত, স্থির, শব্দহীন, কর্মহীন। শফিউলের বউ সারাক্ষণই গজ গজ করে,

‘ঘাটের মড়া, প্যারালাইসিসের রুগী আইসা পড়ছে আমার সংসারে, এই বোঝা আমি কেন টানমু? আমার কী ঠেকা পড়ছে? আপদ মরলেও বাঁচতাম।’

তার কথা রেজাউল করিম শোনে কিনা বোঝা যায় না। মাসিক বেতনে একটা ছেলে রেখে দিয়েছে শফিউল, সে এসে সকাল-সন্ধ্যা রেজাউলকে দেখাশোনা করে, খাওয়ায়, গোসল করায়, পরিষ্কার করে, বসায়, শোয়ায়।

গাজীপুরে খুব মশার উপদ্রব বলে সন্ধ্যাবেলা রেজাউল করিমকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে তার পায়ের কাছে একটা কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে যায় পরিচর্যাকারী ছেলেটা। রাতে শফিউল বাড়ি ফিরে বড় ভাইকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আজও সন্ধ্যায় তার পায়ের কাছে কয়েল জ্বলছিল। এঁকেবেঁকে সরু একটা ধোঁয়া বেরুচ্ছিল কয়েল থেকে।

রেজাউল ঘাড় নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে এক দৃষ্টিতে দেখছিল কয়েলটাকে, হঠাৎ একটা স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে পড়ল তার অবশ পায়ের কাছে মাটিতে লুটিয়ে থাকা লুঙ্গিতে, রেজাউল করিম বসেই রইল, দাহ্য বস্তু পেয়ে আস্তে আস্তে জ্বলে উঠল আগুন শিশু, মুহূর্তে যৌবন পেয়ে গেল আর বিপুল স্নেহে জড়িয়ে ধরল তাকে, অভ্যাসবশত রেজাউল করিমের মুখ গহ্বরে তার প্রায় অসাড় জিহ্বা খানিকটা নড়াচড়া করল।

কিন্তু তাতে কোনো শব্দ বের হলো না। রেজাউল করিম এবার তার অবসন্ন চোখ বন্ধ করল, চোখের সামনে খুলে গেল একটা সবুজ মায়াবী পথ। তখন যেন বিভূতিভূষণের পথের দেবতা এসে তার সামনে দাঁড়ায়, প্রসন্ন হেসে বলে, ওহে মূর্খ মানব, পথ তো কখনোই শেষ হয় না। সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের পথে, দিন-রাত্রি পার হয়ে, জন্ম-মরণ, যুগ মহাযুগ পাড়ি দিয়ে পথের বিচিত্র আনন্দ যাত্রায় তোমাকে স্বাগত। চলো, এগিয়ে যাই।

রেজাউল করিম শোনে, কোথাও কোকিল গাইছে। দেখে, কোথাও উচ্চ পর্বতসারিতে জমে আছে বিস্তীর্ণ বরফ রাশি, কোথাও বইছে উষ্ণ ঝরনা, নদী গান গাইছে কোমল সুরে, কোথাও ধু-ধু মরুভূমি, ওই দূরে দেখা যায় মরূদ্যান।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //