স্যুইট ভমিট

ভিড় ঠেলে যুবকের গতিতে চলছে তরুণী দিবা। তার পরনে জামবিচি রঙের আকর্ষণীয় সালোয়ার-কামিজ। ভিড়ের মাঝে চলা বাঘিনীর মতো উদ্দীপনা তাকে আরও বেশি করে ভিন্ন করেছে। গাড়ির গড়গড় শব্দ একধারে গর্জন করে চলল। একটু আগেই দিনের আলো ফুটেছে। অথচ পোকা-মাকড়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে যার ঘরে থেকে বেরিয়ে পড়েছে। 

দিবা একটু আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। হালকা কোঁকড়ানো চুলের ভাঁজটি এখনো এলো হয়নি। সবদিক ব্যস্ত তবু এই বেগবতী মেয়েটি কোন গন্তব্যে হেঁটে চলেছে তা জানতে আগ্রহী চোখের কমতি নেই। যেন সে চলার সাথে সাথে জনস্রোতে ঢেউ খেলিয়ে আসছে; কিন্তু অচেনা পথিকদের যত যা ভাবনা আসুক না কেন, শুধু চেয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। 

এই উষ্ণ কাঁপা পরিবেশ দিবার পরিচিত। আরও কিছু সময় তাকে হাঁটতে হবে। তাছাড়া এক দেখাতেই চিহ্নিত করার ক্ষমতা নিয়ে তার বন্ধুমহলে যথেষ্ট প্রশংসা আছে। তারা জানে, চেনা চেনা অথচ চিনতে পারছে না এরকম হওয়া দিবার সাথে একদমই অসম্ভব। যত যেভাবেই কোনো লোক তার সামনে আসুক, আসল রূপ অনাবৃত করতে দিবার এতটুকুও অসুবিধা হয় না। 

এমনকি কোথায় কী কী আছে নেই, বাড়ির থেকে কতদূরে কোন রাস্তায় কোন গাছটার পাতা একটু কমলো, কোন পোস্টারটা আজকেই দেয়ালে লাগানো হয়েছে কোনোটা তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। 

চলতে চলতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দিবার দৃষ্টিটা দ্বিধান্বিত হলো। কারণ মুখের সম্মুখে দুজন ব্যক্তি এগিয়ে আসছে এবং দিবার নিখুঁত পরখ শক্তি তাকে চিনাতে সক্ষম করেছে যে এদের মুখ হুবহু এক। যমজ যে কারও দৃষ্টি কাড়ে কিন্তু এরা খুব স্বাচ্ছন্দ্য পাশাপাশি চলেছে। অথচ কেউ এতটুকু দেখছে না। দিবা বুঝতে পারল, দুজনের সাজগোজে তফাতের কারণেই এমনটা হয়েছে। 

তাদের একজন খুবই অপরিচ্ছন্ন, জীর্ণ এবং গায়ের রং শ্যামলা। সর্বদা হাসমান চেহারা ও অপরিপাটি চুলে মনে হয়; খুব বেশিদিন হচ্ছে না সভ্য মানুষের দল ত্যাগ করেছে। আর তার বরাবর বিপরীত যে; তার চুল ডিম আর তেলে পুষ্ট, উজ্জ্বল। সরু চোখে তুখোড় দৃষ্টি যা কখনো নিশানা ভুল করে না। বাদামি চামড়ায় ছেলেটির ঠোঁট নবজাতক শিশুর মতন গোলাপি।

দিবা বুঝতে পারল না কাকে দেখবে-

তবু চোখ কেড়ে নিল নিঁখুত যুবকটিই। মুগ্ধতা বিন্দু করে কয়েক ফোঁটা জমল চোখে কয়েক মুহূর্তে-দিবা চেয়ে রইল।

ইতিমধ্যেই সে তার খুব সামনে এসে পড়েছে, হেঁটে আসার সাথে সাথে তার শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ সবদিকে ছড়িয়ে গেল। আর তখনই তার মুখটা পলিথিনের মতন দলা হলো। সম্ভবত তার গা গুলিয়ে এসেছিল। দিবা চেয়ে রইল এবং যুবকটির এরূপ হঠাৎ পরিবর্তনের প্রভাব দিবার চোখ মুখেও স্পষ্ট হলো। সে যেন পেট চাপ দিয়ে বাঁকলো আর নলি চেপে এক পশলা হলদে বমি করল দিবার সোজা মুখের উপর। লোকজন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল কিন্তু কেউ দাঁড়াল না। তারা প্রত্যেকে জানে, চোখ থমকে গেলেও পা থামতে পারবে না। ঘটনাটার অভিজ্ঞতা চোখে করে নিয়ে যে যার মতো শুধু চেয়ে চলে যাচ্ছে। তবু বোঝা যায়, গ্রীষ্মের রোদ্দুরে এই তীব্র দৃশ্যটি অনেক ছোট বড়দের মন কাঁপিয়ে গেছে। দিবার টানটান গলায় নামার পথ খুঁজে অর্ধেকটা বমি বুক চুইয়ে আস্তে আস্তে করে গড়াল। দিবার বিচ্ছিরি অনুভূতি হলো। ছেলেটা তখনই স্থান ত্যাগ করেছে। আশেপাশের মানুষজনকে একনজর দেখার জন্য সে চোখ খুলল। দেখতে পেল একই চেহারার সেই শ্যামলা ছেলেটি এখনো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখের উপরে বমির গ্যাসের অসহ্য দুর্গন্ধে দিবার গা গুলিয়ে আসছে। ছেলেটা ধীরভাবে এগিয়ে এলো। সে দিবার হাতে একটা সতর্ক ভঙ্গিতে নোট গুঁজে ফিসফিস করল। কানের কাছে শোনা গেল, ‘যোগাযোগ করবেন।’ দিবার অচেতন মুঠিতে কাগজটা বন্ধ হলো।

সে তখনই চলে গেল। চোখে ভাসমান মানুষ অনেক-কিন্তু শব্দ নেই। হয়তো গাড়ির শব্দ মানুষের পদধ্বনি সম্পূর্ণ স্তিমিত করেছে। কিছু সময়ের মধ্যে দিবাকে ঘিরে একটা মনুষ্যহীন বলয় তৈরি হলো। দূর দূর লোকেরা তাকে লক্ষ করে ব্যবধান রেখে হেঁটে যাচ্ছে। দিবার পাশে যাদের বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তারা কেউ নাক চেপে কেউ আগা থেকে গোড়া চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। দিবাকে দেখে তাদের অভিব্যক্তিটা এমন যেন একেকজনের দিন পুরো মাটি হয়ে গেছে। দিবা তাদের দিনটা নষ্ট করার জন্য দায়ী। 

হঠাৎ একজন মায়ের বয়সী বোরকা পরা মহিলা দিবার কাঁধে খোঁচা দিল। তিনি চোখের ইশারায় একটা দোকানের কোনা দেখিয়ে বলল, ‘যাও মা, পরিষ্কার বাথরুম। দশ টাকা করে নেয়। আর দাঁড়িয়ে থেকো না; পরিষ্কার হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাও।’ দিবার মুখ বন্ধ। কথা বললে তরল মুখে ঢুকে পড়বে। কিছু না বলে সে সেদিকেই গেল। বমি বুক হয়ে পেটে গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। 

গা ভর্তি তরল কিভাবে পরিষ্কার করা যায় মাথায় এলো না। বাথরুমটা সত্যিই বেশ পরিচ্ছন্ন। কাগজটা বেসিনের উপরে রেখে, শেষে সম্পূর্ণ জামাটা বালতিতে চুবিয়ে নিঃশ্বাস পড়ল। রাতে কতটা খেয়ে শুয়েছিল ছেলেটা কে জানে-

জামাটা ঘষতে ঘষতেই দিবা ভাবতে লাগল। 

পাঁচ মিনিট হতে না হতে দরজায় শব্দ হলো। সময় বুঝি শেষ! ভেজা কাপড় শরীরে গলিয়ে দিবা উদ্বিগ্ন চিত্তে দরজা খুলল।

একটা কমলা চাদর পরা লোক। শরীর ছোট হওয়ার কারণে তার মাথাটা দেখতে বড় লাগে।

লোকটা বলল, ‘আপনি তন্ত্র সাধনা করবেন?’ 

কামিজ হয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল মেঝেতে পড়তে লাগল। দিবা সশব্দে জবাব দিল, ‘না।’

‘আপনি সাধু হতে চান না?’

দিবা অবস্থা বুঝে ধড়াম্ করে দরজা বন্ধ করল। অদ্ভুত লোকের দর্শনে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনটার প্রতি এবার গুরুতর বিরক্তি আসছে। কাগজটা বেসিনের কোণের পানিতে আধা ভিজে গেছে। ঘোলা হয়ে কিছু রেখা মুছে গেলেও ঠিকানাটা উদ্ধার হলো। ওটা বেশি দূরে নয়। আবদুল মির্জা ব্রিজ সামনেই। কিন্তু সেখানে যাওয়া কি উচিত হবে! দিবা নিজের জন্য আরও কিছুক্ষণ সময় নিল। কোনোক্রমে ঘটনাটা ভোলা যাচ্ছে না। কতটা জঘন্য! না! এখনো হয়তো সবটা দেখার ক্ষমতা পুরোপুরি হয়নি। বিস্মিত না হয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। বমি কেউ কারও মুখে করতে পারে!

হঠাৎ মনে পড়ল, সকাল বেলা ছোট্ট বোনটি দুঃস্বপ্নে কেঁদে উঠেছিল। এখন প্রায় রাতে সে ভূত-প্রেত দ্যাখে। ভেজা কাপড় জড়ানো গায়ে দিবার অনুভূত হলো, টগর দুঃস্বপ্নে কতটা কষ্ট পায়। তার দিনটা আজ একটা দুঃস্বপ্নই তো ছিল।

এত ছোট বয়সে এতগুলো দুঃস্বপ্নে সে ঘোরাফেরা করে বেড়ায়, অথচ কেউ তাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায় না। আজকের কুৎসিত ঘটনাটা বাড়ি গিয়ে টগরকে নিশ্চয়ই জানাবে দিবা। ভাগাভাগি করলে হয়তো সেও তার বোনকে একটু ভরসা করতে শিখবে। দিবা আবারও একই উদ্দীপনা পেল। 

বাইরে উত্তাপ ছাড়া আর কিছুর আধিক্য নেই। ধুলোয় অস্বাস্থ্যকর রাস্তা সাদাটে হয়ে আছে। দিবার নাক চেপে ধরতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ভদ্রতায় সেটা পারল না। ভেজা কামিজে কালো কার্বন ধুলো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে লাগল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিবা যুবকের গতিতে ছুটল যেভাবে সে পূর্বে চলছিল।

কিন্তু ব্রিজের নিচে নিরিবিলি। গাছপালা একটা দুটো যা আছে তারাও নীরব। মাথার উপর কয়েকটা কাক ডেকে উঠল। শুকনো বড় খালটায় হয়তো একসময় স্রোত ছিল। এখন সেটা নরম কাদার খাল। দিবা কোনো মানুষ দেখল না। অনেকক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ির দিকেই পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই খালের উত্তরে একজন দৃশ্যমান হলো। ছেলেটা সেই যার একটা জড়োয়া আছে যে তাকে এখানে আসতে বলেছে। অদ্ভুতভাবে তার জড়োয়া আর তার প্রতি একই অনুভূতি আসে না। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। সে ধীরে হেঁটে আসছে, যেমনটা সে তখন এগিয়ে এসেছিল। হয়তো সে এভাবেই হাঁটে। 

দিবাকে দেখে কথা বলার আগেই সে পিঠের পেছন থেকে একটা সিলভারের চকচকে দণ্ডের মতো কী যেন বের করল। দুহাতে ঝাড়া দিতেই ওটা চাদরের মতো খুলে গেল। কাছাকাছি এসে সে নিজেকে মাথা পর্যন্ত আড়াল করে দিবার সম্মুখে দাঁড়াল। কড়া রশ্মির প্রতিফলনে সিলভারের পর্দায় দিবার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। দিবা দেখল, তার শরীর অদ্ভুত সব ঝাপসা পোড়া দাগে আঁকা; কেউ যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তার সম্পূর্ণ নতুন এক ছবি এঁকেছে। এই নতুন ছবিতে কোনো ভুল নেই, কোনো কৃত্রিমতা নেই।

সবচাইতে পছন্দের সালোয়ার-কামিজটায় স্পষ্ট হয়ে আছে বমির ছোপ। চুলগুলো অল্প জট পাকিয়েছে সারাদিনের ধকলে। নিজের নতুন প্রতিচ্ছবি দিবার বিশ্বাস হলো না। অনেকটা সকালের সভ্য মানুষের দল ত্যাগ করা ব্যক্তিটার মতন দেখাল দিবার নিজের বিম্বটাকে।

নিজেকে দেখে মুখ ঠেলে কুশ্রাব্য শব্দ বেরিয়ে এলো দিবা ছাড়া কেউ শুনল না। কিন্তু আরও কিছু বলার আগেই ছেলেটা পর্দা নামাল। বলল, ‘ঐ যে ওদিকে দেখো।’

দিবা না তাকিয়েই জবাব দিল, ‘আমি বাড়ি যাব।’

‘তোমার বোনও এখানে আছে।’

শুনতেই দিবা সচেতন দৃষ্টি দিল। সামনে এগিয়ে ঐ তাক করা দিকে খোঁজাখুঁজি চালাল। কিছু মানুষ আছে দূরে-ক্ষুদ্র একটা ভিড়। দিবা আরও কিছুদূর এগোলো এবং টগরকে দেখার নিদারুণ চেষ্টায় কাদায় পা পিছলে পড়ল। 

কিন্তু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াতেই সেখানে ছোট বোনটিকে খুঁজে পেল। জীর্ণ অবস্থায় সে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা নিরেট পাথর খণ্ডে তাকিয়ে সে কোনো চিন্তায় ডুবে। টগর দিবাকে দেখতে পায়নি। 

এক পা হাঁটুসহ কাদা নিয়ে দিবা থমকে রইল।

কী যেন মনে হলো, চারপাশে মাথাসহ শরীর ঘুরিয়ে সে দেখে নিল; আকাশের উপরেও গলা তুলে দেখল। আবার সামনে তাকাতেই তার প্রশংসনীয় চোখজোড়া ব্রিজের উপর আটকে গেল।

সে দেখতে পেল, ব্রিজের একপাশে একজন লোক পথ চলেছে। তার কাঁধে একটা ব্যাগ এবং হাতে একটা ছোট্ট স্টিলের টিফিন। সেই লোকটির সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে একই রকম দেখতে দুজন ব্যক্তি। লোকটি নিশ্চল চেয়ে; দিবাও নিচ থেকে নিষ্পলক চেয়ে। দেখতে দেখতে আকর্ষণীয় লোকটি খুব নিকটে এসে গা গুলানো অভিব্যক্তিতে সজোরে মুখের উপর বমি করে দিল। হুবহু তার জড়োয়া এসে হাতে একইভাবে একটা নোট গুঁজে দিল এবং কানে কানে কিছু ফিসফাস করল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //