নাইওর যাওয়ার ঠিকানা হারিয়ে গেছে

বাড়ি ভর্তি লোক। চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপড়শি সবার মুখেই হাসি আনন্দ হৈচৈ, খাওয়া-দাওয়া, ছোটাছুটি- যেন আনন্দের ফোয়ারা। গ্রামোফোন রেকর্ডে হাই ভলিউমে গান বাজছে। তার সাথে কেউ কেউ হাত পা নেড়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নাচ করছে।

বুড়ো-বুড়িদের হাঁকডাক কারো কানেই পৌঁছুচ্ছে না। উপলক্ষ বাড়ির ছোট ছেলের বিয়ে। আনন্দপুর থেকে নতুন বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে সবাই। আনন্দপুর আমাদের গ্রাম থেকে এক রাত আর প্রায় এক দিনের দূরত্ব। গুরুজনদের পছন্দের বিয়ে, বৌয়ের মুখটাও ভালো করে দেখা হয়নি। কত নিয়ম-আচার এই সবের বেড়া টপকে নতুন বৌকে বরণ করে ঘরে তোলা হলো দোতলায় ছোট চাচার ঘরে। ছোট চাচা সেই যে বাড়িতে ঢুকে বিয়ের পোশাক পাল্টিয়ে কখন যে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেরিয়েছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। সে এমনিতেই একটু লাজুক প্রকৃতির। ইচ্ছে থাকলেও নতুন বৌয়ের খোঁজখবর করার সাহস পায়নি। বৌয়ের খোঁজখবর করা যখন যাবেই না তখন আর বাড়িতে থেকে লাভ কী!

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। তো সেই বাড়ি ভর্তি লোকজনের আনন্দ উল্লাস হঠাৎ এক চিল- চিৎকারে থমকে গেল- একেই বোধহয় বলে বিনা মেঘে বজ্রপাত। কার চিৎকারে যে এমন অঘটন ঘটল তা উদ্ধার করা না গেলেও জানা গেল ভীষণ এক খবর- নতুন বৌ রান্না ঘরে ঢুকে খাবার খাচ্ছে। জুতসই কোনো খাবার না পেয়ে সামনে পাওয়া মিষ্টির হাঁড়ি থেকে দু-একটা রসগোল্লা মুখে পুরেছে হয়তো। খবর সত্য, খাবারের সন্ধান খুঁজে পেতে রান্নাঘরে ঢুকতে সে বাধ্য হয়েছে প্রচণ্ড খিদের তাড়নায়। বাপের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা প্রায় যায় যায়। এর ভিতরে তার যে খিদে পেতে পারে সে কথা কেউ ভাবল না বলেই তো তাকে এমনটা করতে হলো। আর ওমনি রব উঠল নতুন বৌয়ের এ কী কাণ্ড! ছিঃ ছিঃ লজ্জা-শরম সব কি উঠে গেল দুনিয়া থেকে?

নতুন বৌ আমার ছোট চাচি। লজ্জার হাঁড়ি যখন হাটে ভাঙাই পড়ল তখন একরত্তি মেয়ে আমাদের ছোট চাচি মরিয়া হয়ে এসে দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজায়- তোমরাই তো বলেছ আমাকে, আজ থেকে এটা তোমার বাড়ি, তোমার সংসার, তুমি সব দেখেশুনে থাকবে। আর এখন আমি রান্নাঘরে ঢুকেছি বলে তোমরা ছিঃ ছিঃ করছ? তোমরা কেমন মানুষ গো!

সেদিনই বোঝা গিয়েছিল ছোট চাচি কোন ধাতের মানুষ। তিনি হাতে জ্বলন্ত মোমবাতির উত্তাপ নিয়েছিলেন সংসারে ঢোকার প্রথম দিনেই। সেই আগুনের লেলিহান শিখাকে ঝরনাধারা ভেবে স্নান করেছেন অবিরাম। সে আগুনকে সহজ স্বাভাবিকতায় সহ্য করে সবার ছোট হয়েও সংসারের স্টিয়ারিং কব্জা করেছিলেন পরম দক্ষতায় আর মমতায়। সবার প্রতি ছিল তার মাতৃসুলভ খেয়াল। তার এসব গুণের জন্য মুকটহীন রানির মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি আমাদের সংসারে। আমি ঠিক বুঝতে পারতাম এত কিছুর পরও তার বাপের বাড়ির টান ছিল প্রচণ্ড। আমি ছিলাম তার অবসরের সঙ্গী, বই পড়ার সাথি। কারণে অকারণে বনেদি-বাপের বাড়ির প্রসঙ্গ চলে আসত তার কথায়। বিয়ের পর সেই যে শ্বশুরবাড়ি এসেছেন সে আসাই তার শেষ আসা ছিল। এত তেজস্বিনী সূর্যের মতো এক নারী- যখন তার বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ত তিনি হু হু করে কাঁদতেন। বুক ভেসে যেত চোখের চলে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলতেন আমার নাইওর যাওয়ার ঠিকানা হারিয়ে গেছে। আমি কোথায় যাব?

ছোট চাচা বহুবার চেষ্টা করেছেন তার বাপের দেশ রূপনগরে নিয়ে যেতে। চাচি রাজি হননি। অবশ্য তার কারণও ছিল।

নাইওর যাওয়া সে তো বাঙালি বিবাহিত নারীর এক চিরন্তন চাওয়া। নাইওর এসে শ্বশুরবাড়ির সকল শাসন বারণের শিকল ছিঁড়ে ভাই-বোনদের সাথে পুকুরে ঝাঁপিয়ে সাঁতরিয়ে দুপুর পার করা, জ্যোৎস্নারাতে ছাদে বসে সবার সাথে গল্প-গানে রাত পার করা, কথাবলা ময়না পাখিটার সাথে খুনসুটি করা। গাছগাছালি ঘেরা তাদের দোতলা বাড়িটার উঠোন জুড়ে মায়ের ধান শুকোতে দেওয়া, পায়ে নেড়ে সেদ্ধ ধানগুলো চৈত্রের রোদে ভেজে তোলা- এসব স্মৃতি তাকে বড় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।

ছোট চাচির নাইওর যাওয়া কেন ঘটল না? নাইওর নিয়ে যাওয়ার জন্য তাহলে কি কেউ ছিল না তার? সবই ছিল কিন্তু নিয়তিই তাকে এমন কাঙাল করে রেখেছিল। ছোট চাচির বিয়ের পরপরই তার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বাবা গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে, সকল জমিজমা গুটিয়ে আমেরিকা প্রবাসী হয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজন থাকলেও সেই কষ্টে তিনি কখনো গ্রামে বেড়াতে যেতে রাজি হতেন না।

এ শুধু আমাদের ছোট চাচির কাহিনি নয় আরও বহু নারীর আরও কতশত কারণে যে নাইওর যাওয়া ঘটে না তার হিসাবনিকাশ কে রাখে? তবু চাতক পাখির মতো আশা রয়ে যায় নাইওর যাওয়ার জন্য।

আজকাল আমাদের গ্রাম-বাংলা থেকে শত শত হারিয়ে যাওয়া লোক-শব্দের মতো ‘নাইওর’ এই শব্দটিও হারিয়ে যেতে বসেছে। বিয়ের পর নানা উপলক্ষে মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে অতিথি হয়ে আসে। শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে তারা নাইওর এসে যেন কটা দিন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়।

এই নাইওর আসার আবার কতকগুলো নাম আছে। ভাদর কাটানি, জোড়া মাসের নাইওর, প্রথম সন্তান প্রসবের সময়, শীতের পিঠা-পুলি অথবা মধুমাসে মেয়ে-জামাইসহ নাতি-নাতনিদের আম, কাঁঠাল খেতে আসার নাইওর। একটা সময় ছিল সন্তান হওয়ার সময় মেয়েকে বাপের বাড়িতে আনাটাই ছিল নিয়ম। সন্তান প্রসবের পর মেয়েটির ও নবজাতকের যে যত্নের প্রয়োজন হয় সেটি বাপের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও কল্পনা করা যায় না। নাইওর এসে তারা সেই যত্নটি পেতেন। আর শিশুটি পেত তার জন্মস্থান নানাবাড়ি অথবা মামাবাড়ির ঠিকানা বলার অহংকার।

তোরা কে যাস রে ভাঁটির গাঙ বাইয়া...অথবা মাগো তুমি নিয়ো নাইওর এক হপ্তা পরে/ভাই বোনেরে পাঠায় দিও আমার নতুন ঘরে...এ সব গানের কথায়, সুরের হাহাকারে সে সময়ের নারীর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান সহজেই অনুমেয়। মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা তো ছিলই না আবার একা চলাফেরা করার মতো সামাজিক অবস্থাও ছিল না, ছিল না মনের জোরও। আগের দিনে বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। বিয়ের পর একটি মেয়ে বাপের বাড়ির সমস্ত অধিকার ছেড়ে সেই যে জবুথবু হয়ে ঢুকত, শুরু থেকেই শ্বশুরবাড়ির সংসারের জোয়াল চাপিয়ে দেওয়া হতো তার ঘাড়ে। বেচারার সে ভারে নাভিশ্বাস উঠত। উপরন্তু স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি বা সে বাড়ির বড়দের কড়া শাসনে থাকতে হতো। ইচ্ছে-স্বাধীন মতো তার কিছু করার অধিকার ছিল না। প্রতিবাদহীন সে জীবন ছিল জড়বস্তুর মতো। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রাণ হাঁসফাঁস করত একটু মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। বাপের বাড়িতে অসবার জন্য তার প্রাণ কাঁদত। সে জন্যই বোধহয় সমাজে কিছু নিয়ম চালু হয়েছিল যেমন ভাদরকাটানি নাইওর, জোড়া মাসের নাইওর মেয়েদের বাপের বাড়ি আসার কারণ তৈরি করতে। এসব নিয়ম চালু না থাকলে মেয়েদের জীবন যে কেমন হতো তা আজকের এ অবস্থানে থেকে কল্পনাই করা যায় না।

দুঃখজনক হলেও আমাদের গ্রাম-বাংলার এই সব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে নগর সভ্যতার আগ্রাসনে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে দুটি পরিবারের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ঠিকই কিন্তু এই সম্পর্ক আরও গভীর ও মধুর হয়ে ওঠে এই নাইওর সংস্কৃতি চর্চায়। যদিও মেয়েরা এখন অনেকাংশেই স্বাধীন। তবু বিয়ের পর মেয়েরা আশা করে স্বামী সন্তান নিয়ে সম্মানের সাথে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাবে, যাকে আমরা নাইওর বলি। মেয়েদের জীবনে একটা সময় স্বামী, সন্তান, সংসারের মায়ায় জড়িয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার তাগিদটা কমে আসে। তখন হয়তো তার যাওয়ার আফসোসটাও তেমন তীব্র থাকে না।

সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়, বদলেছে মানুষের মন। বদলেছে সমাজও। এই প্রজন্মের কাছে কাগজ কলমে চিঠি লেখা যেমন অবাস্তব লাগে ঠিক তেমনি নাইওর শব্দটির ব্যাখ্যা শুনলেও তার কাছে অকল্পনীয় মনে হবে। যেমন আজ আমরা সতীদাহ প্রথা ইতিহাসে পড়ছি। কিন্তু তা তো এক সময় বাস্তবে ছিল; তেমনি নাইওর সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক ইতিহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে এই অস্থির সময়ে পরিবারে পরিবারে স্বার্থ নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত সে সময়ে হারিয়ে যেতে বসা বাংলার নাইওর সংস্কৃতির চর্চা একটি শুভ লক্ষণ। সম্পর্কগুলো যেন দূরে সরে না যায়। আত্মার বন্ধনে অপার ভালোবাসায় সম্পর্কগুলো দৃঢ় হোক, শান্তির পরশ ছুঁয়ে থাকুক সবাইকে- এ চর্চার একান্ত চাওয়া কন্যাসন্তানের সকল অধিকার সমুন্নত থাকুক। আবহমান গ্রাম-বাংলার মায়া মমতার ঐতিহ্য তুলে ধরবার চেষ্টাকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। প্রাণভরে অভিনন্দন জানাই ‘দখিনের কবিয়াল’কে। নাইওর বেঁচে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে আবহমান কাল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //