মরুতেষ্টা

পশ্চিম কালাহারির নিরিবিলি ‘খই-পল্লি’। বাথান সাহেবের মেম এসেছে লন্ডন থেকে। চারদিকে ভিড় করেছে তাম্রকান্তি খই ছেলেমেয়ে। মাথার ক্লিপ থেকে স্লিপারের ফুল পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে দেখছে তারা। ঢিলেঢালা কমলা ম্যাক্সির ফোকর গলে বেরিয়ে এসেছে মেমের হাত-পা-আঙুল। আগ্রহ করে কেউ কেউ ছুঁয়েও দেখছে তাকে। তার দীঘল বল্লীদেহে স্বাভাবিক নারী-বক্রতার কোনো আভাস পায় না তারা, তাই সরলভাবেই তাকে চিহ্নিত করে কাঠিমেম নামে।

সঠিক সময়ে গবাদি পশুর বাথানে পৌঁছে অবাক হলো হেনরিয়েটা। ব্যস্ত স্বামী উইলিয়ামের দেখা নেই তখনো। ঘিরে ধরা সরল খই ছেলেমেয়েগুলোকে খুব ভালো লাগে কাঠিমেমের। ব্যাগ থেকে তাদের জন্য বের করে দেয় সুগার ক্যান্ডি। নিজেও একটা মুখে দেয় সে, দেখিয়ে দেয়, কামড়ে নয়, কীভাবে চেটে খেতে হয় ক্যান্ডি।

উইলিয়ামের দেরি দেখে একাই নতুন বাংলো-বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে কাঠিমেম। ইংল্যান্ডে এমন একটা বিশাল বাংলোর কথা ভাবাই যায় না। দোতলায় ঝুল-বারান্দা সংলগ্ন একটি বিশ্রাম কক্ষে ঢুকে পড়ল সে। শো-কেসের মধ্যে সাজানো সারি সারি অনেকগুলো রাইফেল। কয়েকটিতে শুটিং ক্লাবের দূরপাল্লার রাইফেলের মতো দুরবিন লাগানো। এমন সুনসান পরিবেশে নিরাপত্তাবোধকে অস্বীকার করা যায় না। 

বারান্দায় বেরিয়ে এলো কাঠিমেম। বিকেলের স্তিমিত আলোয় দেখতে পেল দূরে, কাঁটাতার ঘেরা একটি জলাশয়। তার পাশ দিয়ে টহল দিচ্ছে দুজন বন্দুকধারী। শুনেছে এখানে জলের অভাব, তাই হয়তো এত প্রহরা। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে, চুরি করে জল নিয়ে যাবে যারা তারা নিশ্চয়ই পিপাসার্ত মানুষ। কাঁটাতার দিয়ে রাখা মানে কিছু মানুষকে বঞ্চিত করা। এই বঞ্চিত মানুষদের জন্য কাঠিমেমের মনটা ব্যথিত হয়ে ওঠে।

ধকধক শব্দে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের আওয়াজ কানে আসতেই ঝলমল করে ওঠে পালিশ করা কাঠের অভ্যন্তর। ঘরে ঢোকে উইলিয়াম, ‘তোমার পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো হেনরিয়েটা? আমি একটু সিকিউরিটি প্রবলেম সমাধান করছিলাম।’ কাঠিমেম তাকে সঙ্গে করে বারান্দায় যায়, কাঠের বাংলোর বেশ প্রশংসা করে সে। এক সময় জানতে চায়, ‘জলাশয়ে কাঁটাতার কেন উইলিয়াম?’ উইলিয়াম একটু বিরক্ত হয়, ‘তুমি এখানে নতুন এসেছ, এসব জানার সময় তোমার এখনো হয়নি হেনরিয়েটা।’

দুই
নতুন মরু-পরিবেশে কাঠিমেমের ঘুম পালিয়ে যায়, বাংলোর জানালা গ’লে দূরে, প্রত্যন্ত জনপদে। বাথানে ঘুরতে বের হয় কাঠিমেম, সঙ্গে ভাঙা ইংরেজি-জানা বান্টু ড্রাইভার। কাঁটাতার ঘেরা জায়গার পাশ দিয়ে যাবার সময় জিপ থামাতে বলে সে। বান্টু তাকে বোঝাল, ‘বছর দুই আগে এই এলাকাটা জংলি খইদের আস্তানা ছিল, এখন এটা আমাদের দখলে। সাহেব বেড়া দিয়েছে। তার কড়া হুকুম, একটা কুকুরও যেন এখান থেকে পানি পান করতে না পারে। জংলি খইরা একবার হইচই করতে এসে সাহেবের গুলির আওয়াজে পালিয়েছে। অনেক দূরে সরে গেছে ওরা, এদিকে তেমন একটা আসে না। ইদানীং সাহেব দয়াপরবশ হয়ে রাখালের চাকরি দিয়েছে দুয়েকজনকে।’

বাথানের সীমানা ঘেঁষে চৌচক্র-টানে এগিয়ে চলেছে জিপ, পথরোধকারী তৃণঝোপ অবজ্ঞা করে। দূর থেকে মনে হলো, সামনে এক সারি পুতুলের ঘর-বাড়ি। ঘরগুলোর নির্মাণ-কাঠামো দেখে বুঝে নিল নৃতত্ত্বের ছাত্রী কাঠিমেম, ওগুলো আফ্রিকার বিলীয়মান খইভাষীদের আস্তানা। একসময় এই শিকারি-সংগ্রহকারী জাতি গোটা আফ্রিকাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের তাড়িয়ে এনে হাজির করেছে বিজন মরু কালাহারির কাঠগড়ায়। 

বাথানের কিনারে খই-পল্লিতে জিপ থামতেই পোষা পায়রার মতো ছুটে এলো একপাল ছেলেমেয়ে। কাঁধের ঝোলা থেকে ম্যাকিনতোশ চকলেট বিলিয়ে খই-সুরের গুঞ্জন উপভোগ করল কাঠিমেম। দুটি খই যুবতি দুধ ভরা বালতি হাতে দাঁড়িয়ে পড়ল ভিড়ে। চ্যাপ্টা মুখের উপর মঙ্গোলীয় চোখ আর নিগ্রোপ্রতিম নাক বসানো মেদহীন সুঠাম গড়ন। তাদের নগ্ন নিসর্গ বুকে জমাট বেঁধে আছে পৌরাণিক তাম্র-বর্ণ। সেদিকে হঠাৎ বিজাতীয় বান্টু ড্রাইভারের চোখ পড়তেই পাশ ফিরল মেয়েরা। স্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের অপ্রতুল পশুচর্মে ঢাকা সুডোল নিতম্ব। এমন অদ্ভুত নিতম্ব-ঢেউ সারা ইউরোপে কোথাও দেখেনি কাঠিমেম। মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলার প্রবল ইচ্ছেটা সংবরণ করতে হলো তাকে, খই-ভাষার বিন্দুবিসর্গও বোঝে না সে। শুধু খেয়াল করে, তাদের দ্রুতলয়ের কথার সঙ্গে সঙ্গে অনুরণিত হচ্ছে পিয়ানোর নিচু সপ্তকের কিছু টুংটাং ঝট্কা সুর। পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি এমন অদ্ভুত সুরে কথা বলে কিনা, জানা নেই কাঠিমেমের। খইদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে কাঠিমেম। যত দুর্বোধ্য আর কষ্টসাধ্যই হোক, খই-ভাষাটা তার আয়ত্ত করা চাই। তাদের সুখ-দুঃখ বোঝার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠল তার মনে।

ভিড়ের মধ্যে কাঠিমেমকে অভিবাদন করে দাঁড়াল মঙ্গো। প্রথমে ঝটকা সুরে সে তার নামটা বলল। তারপর ইশারায়-ইঙ্গিতে প্রাণপণ বোঝাতে চেষ্টা করল, জলের অভাবে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, বাথানে কোনো রাখালের চাকরি পেলে পরিবারসহ বেঁচে যাবে তারা। কিন্তু বাথান সাহেব জানিয়েছে, নতুন গবাদি পশুর চালান না এলে আর কোনো নতুন লোক নিয়োগ করা যাবে না। কাঠিমেম তবু তাকে আশাহত করে না, মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে বলে। 

একটি খই যুবতির হাত থেকে দুধ ভরা বালতি নিয়ে ইঙ্গিতে আতিথ্য করে কাঠিমেম, ‘একটু দুধ পান করে যাও।’ মঙ্গো ইতস্তত বোধ করে। ঝটকা হাসিতে এক খই যুবতি তাকে উৎসাহিত করে, ‘যতটুকু পারিস টেনে নে মঙ্গো। আর যদি রাতটা আমাদের সঙ্গে থাকিস তো দুধ দিয়ে তোকে স্নান করিয়ে দেব।’ বালতিতে মুখ ডুবিয়ে যুবতি-টানকে উপেক্ষা করে পিপাসার্ত মঙ্গো।

তিন
শীতের শুরুতে কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে মরুর তাতাল। দুদিন অর্ধ-উপবাসের পর ভূরিভোজের আয়োজনে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে খই-পল্লি। অসময়ে গোটাকয়েক স্প্রিংবক হরিণ মারা পড়েছে আজ। খোদাই করা কাঠের পাত্রে জমা করা হয়েছে ভেষজ আরক মেশানো কিছু রক্ত যা কিছুটা পিপাসা মিটাতে পারে। মাঝখানে মাংস ঝলসানো অঙ্গারের সঙ্গে জঠরের আগুনে জ্বলছে ক্ষুৎপীড়িত 

নর-নারী। সর্দারের মেয়ে কোরার পেছনে এসে উপস্থিত হয় মঙ্গো। পুরু ঠোঁটে মিষ্টি হাসে কোরা। তার দেহটা ধনুক-বাঁকা হয়ে গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয় মঙ্গোকে। অদৃশ্য এক বিষমাখা তীর এসে বিঁধে যায় মঙ্গোর বুকে। হাত-পা তার অবশ হয়ে আসে শরাহত হরিণের মতো। আবার মিষ্টি হাসে কোরা, দুর্বোধ্য খই-মুদ্রায় দু’হাত ঘুরিয়ে/ কিছু একটা আবদার করে সে। মঙ্গো যুবক-লজ্জায় ঝলসানো হরিণের দিকে দৃষ্টি ফেরায়।

মঙ্গো ইঙ্গিত বোঝে না। এবার স্পষ্ট করে দুটি আঙুল দেখায় কোরা। মঙ্গো বোঝে, সে দুটি সন্তান চায়। খই নিয়মে বিয়ের আগে সন্তান চাওয়া খুব স্বাভাবিক। থিতু গলায় ফিসফিসিয়ে বলল মঙ্গো, ‘এসব কাজে অনেক সময় লাগে, আগে তোর বুকের “মরুলা ফল” আরও বড় হোক।’ কথা শুনে কোরার বুক শিরশির করে। হাঁটু মুড়েও মরুলার কাঁপুনি বন্ধ করতে পারে না সে। অস্থিরতা লুকিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে তোকে ১০ আঙুলের ১০ দিন সময় দিলাম।’

এবার বিভ্রান্তির ঘোর কেটে যায় মঙ্গোর। সন্তান নয়, কোরা তাকে একজোড়া উটপাখির ডিমের কথা বলেছে যার খোলস দিয়ে সে তৈরি করবে জল রাখার পিপে। মঙ্গো ঘাবড়ে যায়। তার চেয়ে আরও দুই হাত গলা-লম্বা পাখির ডানার তলা থেকে ডিম সরিয়ে নেয়া সহজ কাজ নয়। তার ভীতু ভাব দেখে অভয় দেয় কোরা, ‘উটপাখি দেখতে যত বড়ই হোক আদতে সে কাপুরুষ। বিপদ দেখলে বালিতে মুখ গুঁজে থাকে ভয়ে।’ বৃষ্টির জল সম্পূর্ণ নিঃশেষ হবার আগেই ডিমের পিপে ভরে রাখতে চায় কোরা, তৃষ্ণাময় ভবিষ্যতের জন্য। কোরার কথা শুনে নিজেকে টানটান সাহসী করে তোলে মঙ্গো, কাল সকালেই উটপাখির সন্ধানে বের হবে সে। 

খই পল্লিতে কাতর ঘুমে রাত্রি গড়িয়ে চলে পিপাসার্ত ভোরে। যে যেদিকে পারে ছিটকে বেরিয়ে পড়ে জলের সন্ধানে। ঘুম থেকে উঠে একটা বুনো বেল ভেঙে নিয়ে তৃণের জঙ্গলে পা বাড়ায় মঙ্গো। কোরা এসে পথ আগলে দাঁড়ায়, ‘একা কখনো উটপাখিকে ভোলানো যায় না মঙ্গো, ওরা সহজ সরল খই মেয়ে নয়। চল্ আমিও যাব তোর সঙ্গে।’ 

ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে তৃণাঞ্চলে গিয়ে একসময় থমকে যায় দুজন। কালো রঙের একটি পুরুষ উটপাখি পাখা বিস্তার করে সূর্য আড়াল করছে। পাখিটা ডিমে তা দিচ্ছে না, শুধু উষ্ণতা থেকে নিষিক্ত ডিমকে রক্ষা করছে ছায়া দিয়ে।

একটি বাঁকা ডাল আর মাথার উপর ধূসর-রঙা ঘাস চাপিয়ে নকল উটপাখি সাজে মঙ্গো। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পাখিটার দিকে। উটপাখি ভাবে, দলের কোনো উট-বিহঙ্গী হয়তো ফিরে আসছে পালাবদলের কাজে। কৌতূহলে পা পা এগিয়ে যায় নকল পাখিটার কাছে। এক পর্যায়ে সন্দেহ গাঢ় হলে প্রচণ্ড গতিতে রুখে যায় তার দিকে। লু-হাওয়ার বেগে ছুটে আসা রুষ্ট পাখিটার সঙ্গে দৌড়-প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে মঙ্গো। সামনে এক বাবলা গাছ পেয়ে তরতর করে উঠে পড়ে উঁচু ডালে।

বাবলা পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় মঙ্গো, উটপাখির তাওয়া থেকে দুহাতে দুটো ডিম নিয়ে সরে পড়েছে কোরা। চিল-চক্কর ঘোরা পথে বাবলা গাছের কাছে ফিরে আসে সে। শুকনো ঘাসের ডগার মতো শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে আছে কোরার ঠোঁট। তার হাতে বিঘত আকারের দুটো সাদা ডিম, যেন জলে ভরা। সাবধানে মঙ্গোর হাতে একটিকে গড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘পাত্রের জোগাড় হলো, এবার পাতাল থেকে জল তুলতে হবে। খইদের নিরাশ করে এ বছর সাত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে গেল 

মরু-বৃষ্টির জল, দেড় মাসও টিকল না। এদিকে বাথান সাহেবের দখল করা জলাশয়ের পথও বন্ধ, দুই বান্টু বন্দুক ঘাড়ে দিনরাত পাহারা দিচ্ছে।’

গাছের গোড়ায় মাটিতে বুক লাগিয়ে ক্লান্তিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে কোরা। দমকা খই-হাওয়া তার কোমরের হরিণ-চামড়ার পাট খুলে লজ্জায় বাবলা গাছের চারদিকে ঘুরপাক খায়। অবসন্ন মনে মুহূর্ত গোনে কোরা...। স্পর্শ করার লোভটা সংবরণ করে মঙ্গো। বাথানের খই মেয়েদের কাছ থেকে শুনেছে কাঠিমেমের নিতম্বপ্রীতির কথা। খই-নিতম্বিনীর হাতে দুধ-ভরা বালতি! এমন তো কোরার হাতেও থাকতে পারে। তাকে নিয়ে যেতে হবে বাথানে, কাঠিমেমের কাছে। 

তেষ্টায় গলা কাঠ হয়ে আসে মঙ্গোর। হঠাৎ মনে হয়, পিপাসার কথা বলেছিল কোরা। হাতের ডিমটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার। তন্দ্রালু কোরার হাতটা শেষ অবলম্বনের মতো আঁকড়ে ধরে আছে ভবিষ্যৎ জলের পিপে। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মঙ্গো। একপলক ঘুম-গোলাপি চোখের পাতা নাড়ে কোরা। মঙ্গো সাবধান করে, ‘ডিম দুটো সামলে রাখ্, বানর আসতে পারে।’

বাবলা গাছের ঝিরিপাতায় কুয়াশার মতো কণা-কণা মধু। পিঁপড়েরা গাছ বেয়ে উঠছে শীতের সঞ্চয়ে। পথভ্রষ্ট হয়ে কয়েকটা পিঁপড়ে কোরার বুকে বিভ্রান্তিতে ভোগে। জঙ্গলে এমন খাদ্যগন্ধী ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে এরা পরিচিত নয়। পিঁপড়ে সরিয়ে পাশ ফেরে কোরা, কনুইয়ে ভর করে তালুর উপর মাথাটা ঠেকনা দেয়, যেভাবে পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য মাটির উপর খইরা ঘুমিয়ে থাকে। শরীরটাকে কাত করে জঙ্ঘা দিয়ে ঢেকে রাখে কষ্টার্জিত জলের পিপে।

কাছেই শুকনো কাঁটাঝোপের পাশে আঙুল চারেক এক শুকনো ডগা পরীক্ষা করে মঙ্গো। হাত দেড়েক গর্ত করে একটি রসালো কন্দ তুলে নিয়ে ফিরে যায় কোরার কাছে। ফ্লিন্ট পাথরের ধারালো রেঁদা চালিয়ে আঁচড়ে নেয় একমুঠো ছালবাকলা। দুহাতে প্রাণপণ লেবুচিপা করে কোরার মুখে নিঙড়ে দেয় আঙুলের স্বেদসহ কয়েক ফোঁটা ভেষজ রস।

চার
গভীর রাতে আকাশের অঙ্গার-লাল নক্ষত্র আর্দ্রার দিকে তাকিয়ে মঙ্গোর দেহের উষ্ণতা খোঁজে কোরা। ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতেই। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মঙ্গোর ঘরের দিকে। আর সব ঘরের মতোই সাধারণ একটি ঘর। এক সারি ধনুক-বাঁকা ডালের ওপর কয়েক চাঁই ঘাসের বহর। অস্থায়ী নিবাসে এর চেয়ে বেশি কিছু বাহুল্য মনে করে খইরা। তবু ঘরের খিলানে পাখির পালক, নিচে হরিণ চামড়ার ফরাশ তাকে জলাশয়ের মতো টানে। মঙ্গোর সঙ্গে এই ফরাশে আয়েশ করে ঘুমাতে চায় সে। কিন্তু সন্তানসম্ভবা না হলে বিয়ে করার ছাড়পত্র নেই খই সমাজে। খই জাতির এই লজ্জাকর ভালোবাসার পরীক্ষাটা তার ভালো লাগে না।

দুটি ফাঁপা নল হাতে ঘরে ঢোকে মঙ্গো। ক্লান্ত কোরাকে বিছানায় দেখে বলে, ‘তুই এখানে এসে ঘুমোচ্ছিস! আচ্ছা ঘুমো, আমি পিপের জন্যে জল খুঁজে আসি।’ কোরা তার পিপাসার্ত সত্তাকে দুভাগ করে একটিকে শুইয়ে রাখে হরিণ-ফরাশে, অন্যটিকে নিয়ে রওনা হয় মঙ্গোর পেছন পেছন।

চারদিকে শুকনো ঝোপঝাড় দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠে জল-সন্ধানীরা। তবে কি এবার পশ্চিমের বান্টু এলাকায় জল-ভিক্ষায় বেরুতে হবে! একবেলা হাঁটাপথের দূরত্বে পৌঁছে গেছে সাদা সাহেবরা। খইরা সাহেবদের চোখের বিষ। তারা ব্যঙ্গ করে, খইরা ভয়ানক জংলি, বুশম্যান। বান্টুরা বদলে গেছে কৃষকের জাতে। বাথানে রাখালের কাজগুলো তাই তাদেরই জোটে বেশি। মঙ্গো ভাবে, কোরাকে নিয়ে একবার কাঠিমেমের সঙ্গে দেখা করা দরকার। মেম নিশ্চয়ই দুই বাটি দুধ দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করবে। 

দুই জোড়া পিপাসার্ত মরু-চোখে খানাতল্লাশি চলে চৌদিকে। জন্ডিস আক্রান্ত তৃণঝোপের মধ্যে চোখে পড়ে এক চিলতে টিয়ে-সবুজ রঙ। মঙ্গো অনুমান করে মাটিতে জলের অস্তিত্ব। ঝোপের পাশে মরু-শিয়ালের মতো মাটি খুঁড়তে থাকে দুজন। হাত দুয়েক গর্ত করার পর কাঠের শাবলটা ভিজে ওঠে। নরম বালির মধ্যে দুটি লম্বা নল পুঁতে দেয় মঙ্গো, পাশে রাখে দুটো ডিমের পিপে। একটি নলকে পালাক্রমে চুষতে থাকে ওরা। হঠাৎ মুখ ভরে ওঠে কাদা-জলে। কিন্তু পিপে ভরার চেষ্টা ব্যর্থ হতে থাকে। অক্লান্ত খই-খাটুনিতে যতটুকু জল উঠে আসে ওপরে তার চেয়ে বেশি ঘাম ঝরে যায় তাদের গা থেকে। অগত্যা দুটো বুনো ওল সংগ্রহ করে পল্লির পথে পা বাড়ায় সেদিনের মতো।

পরদিন গাছে দুটো বেবুন দেখে উৎসাহী হয়ে ওঠে দুজন। জলের ঠিকানা বেবুনরা সঠিক জানে। দুজন মিলে বুদ্ধি করে। কাছেই কয়েকটি গেরুয়া উইয়ের ঢিবি, প্রায় বুক সমান উঁচু। কোরার ঝুলি থেকে কিছু বীজ নিয়ে চিবুতে থাকে মঙ্গো। মনোযোগী হয়ে ওঠে বেবুনরা। উই-ঢিবির দেয়ালে মাপজোক করে একটি গর্ত খোঁড়ে সে। গর্তের মুখটা সরু হলেও ভেতরটা প্রশস্ত। বেবুনদের দেখিয়ে দেখিয়ে সেই গর্তের ভেতর দুই মুঠো বীজ রেখে সরে দাঁড়ায় তারা। অনুসন্ধিৎসু ছোকরা বেবুনটা গর্তে হাত ঢুকিয়ে মুঠি ভরে নিল বীজে। স্ফীত মুষ্টি আটকে গেল গর্তের ছোট মুখে। প্রাণীটা মুঠি খুলল না, হাতটাও আটকে রইল। কুমা করা রজ্জুতে সহজেই তাকে বন্দি করে ফেলল মঙ্গো, বেঁধে রাখল গাছের সঙ্গে। কোরা ঝুলি থেকে লতাপাতাভোজীদের প্রিয় কিছু লবণ-কেক বের করে ছড়িয়ে দিল বেবুনের সামনে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়ার পর লবণের টুকরোগুলো খেয়ে পিপাসার্ত হয়ে পড়ল বেবুন। অল্পক্ষণের মধ্যেই পিপাসায় চিৎকার শুরু করলে কোরা তার বাঁধন খুলে দিল।

বেবুন ছুটে চলেছে। মঙ্গো আর কোরা সন্তর্পণে দৌড়াচ্ছে তার পেছন পেছন। দীর্ঘ পথ লাফ-দৌড়ের পর বেবুনটি হঠাৎ ঢুকে পড়ল ভূগর্ভের এক চিকন ফাটলে। উঁকি মেরে দেখল মঙ্গো, পিপাসার্ত বেবুন উবু হয়ে জলপান করে চলেছে। জলাধারের প্রবেশপথ বেশ সঙ্কীর্ণ। বড় আকারের বন্য জন্তুরা তৃষ্ণা মেটানোর সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে এখনো ফাটলের ভিতর জমে আছে বেশ খানিকটা অব্যবহৃত জল।

জলাধার আবিষ্কারের আনন্দকে কেন্দ্র করে উল্লসিত হয়ে ওঠে খই-পল্লি। সর্দার মেয়েকে আদর করে, মঙ্গোকে সম্মান করে বুদ্ধিমান আখ্যা দিয়ে। কোরা মায়ের কাছে মঙ্গোর সঙ্গে রাত্রিযাপনের ব্যাপারটা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে ফেলে। মা তার অতীত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মেয়ের হাতে তুলে দেয় দুই মুঠো শুকনো মরুলা ফল। নেশাকর এই ফলের নিশি-গুণে বিয়ে-পর্বটা নাকি দ্রুত এগিয়ে আসে।

খইরা নতুন করে পল্লি সরিয়ে নিয়েছে নতুন আবিষ্কৃত জলাধারের কাছে। মাস-দুয়েক পরে জল শুকিয়েছে সেখানেও। শিকারি পুরুষরা ক্রমাগত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে খই-নারীদের ভেষজ খাবার সংগ্রহে। শীতার্ত পল্লিতে আবার কাতর রাত্রি গড়িয়ে চলেছে তৃষ্ণার্ত ভোরে। যে যেদিকে পারে ছুটছে জলের সন্ধানে। মঙ্গোর ঘরের মেঝেতে উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত অনেকগুলো জলের পিপে পুঁতে রেখেছে কোরা। বৃষ্টি নামা পর্যন্ত পিপের জল কি শেষ হয়ে যাবে! অজানা শঙ্কায় বুক তার তৃণডগার মতো শুকিয়ে ওঠে।

পাঁচ
কোরাকে সঙ্গে নিয়ে মঙ্গো যখন বাথানে পৌঁছল তখন কাঠিমেম সেখানে নেই, রয়েছে সাহেব। বাথানের কোণে নতুন একটা স্কুলঘর। সুর করে ইংরেজি ছড়া পড়ছে কিছু খই-বান্টু ছেলেমেয়ে। গবাদি পশুর বড় একটা চালান এসেছে, ব্যস্ততার সঙ্গে নতুন লোক কাজে নেওয়া হচ্ছে।

বান্টুদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে দুজন। অধিকাংশ বান্টুই কাজ পেয়ে যায় রাখালের। সাহেব তাদের সঙ্গে অনর্গল বান্টু ভাষায় কথা বলে। খই-ভাষী মঙ্গোর কথা বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয় সাহেব। সহকারী বান্টু মঙ্গোকে আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়, তাকে রাখালের কাজে রাখতে সাহেবের আপত্তি নেই; কিন্তু সঙ্গের মেয়েটিকে নেওয়া যাবে না, সে যেন পল্লিতে ফিরে যায়। কোরার জন্য অনুরোধ করে মঙ্গো, কিন্তু সাহেব রেগে যায়। বান্টু ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বগোত্রীয় লোকের ত্রাণ-কর্মে।

কোরা বুঝতে পারে মঙ্গোর কষ্ট; তবু উদাসীন হেসে প্রস্তাব দেয়, ‘আমি ফিরে যাই পল্লিতে, মাঝে মাঝে না হয় তোর সঙ্গে দেখা করে যাব।’ মঙ্গো তাকে এগিয়ে দেয় অনেকটা পথ, রাস্তায় কোনো কথা হয় না। প্রথম ও শেষ কথা বলে কোরা, ‘তোকে ছাড়া একা একা আমি জলপান করব কী করে! ডিমের পিপেগুলো আমরা দুজন কত কষ্ট করে’ আর বলতে পারে না কোরা, এক দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে যায় কাঁটাঝোপের আড়ালে।

তৃষ্ণার সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে রাত্রি। তারার আলোয় নিজ হাতে গড়া খই-ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢাকে কোরা। তার কেবলই মনে হয়, মঙ্গো আর কখনো ফিরে আসবে না। কাঠিমেমের বাথানে প্রাণভরে দুধ পান করে হয়তো অন্য কোনো খই মেয়ের সঙ্গে ঘুমুবে সে। উটপাখির ডিম তাকে আর কখনো সংগ্রহ করতে হবে না। নাভির নিচ থেকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠে বুকের বাম দিকটাতে ছড়িয়ে পড়ে তার। প্রতিটি প্রশ্বাসে অনুভব করে সে, খই-পল্লিতে একটি পিপাসার্ত শিশু ক্রমশ অস্তিত্বময় হয়ে উঠছে।

ছয়
অন্ধকারে দুহাত দিয়ে কোরার কোমরটা জাপটে ধরে কেউ...। অভিমানে চুপ করে থাকে কোরা। এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে যায় মঙ্গো‘তুই চলে আসার পর কাঠিমেমের সঙ্গে অনেক গল্প হয়েছে আমার। মেম এখন ঝরঝরা খই-ভাষা শিখেছে। আমাদের উটপাখি ভোলানোর গল্পটা তাকে বলেছি, সে দুটো উটপাখির ডিম চেয়েছে তোর কাছে, ঘরে সাজিয়ে রাখবে বলে। তোকে সে দুগ্ধ দোহনের কাজটি দিতে চেয়েছিল। প্রস্তাব শুনে সাহেব রেগে আগুন হয়ে মেমকে একলা ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল, আমাকেই এগিয়ে দিতে হলো তাকে বাংলো পর্যন্ত, খুব মন খারাপ হয়েছিল কাঠিমেমের। রাস্তায় যেতে যেতে কাঁটাতার ঘেরা জলাশয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মেম বলল‘আমি জানি, এ পানির মালিকানা তোমাদের, উইলিয়াম তা জবরদখল করেছে। আমি তাকে বুঝিয়েছি, অনুরোধ করেছি কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি, তোমাদের হাতে এই জলাশয় তুলে না দিয়ে আমি কোনোদিন লন্ডনে ফিরে যাব না। তোমরা এখন একজোট হও, চারদিকে খই-পল্লিতে খবরটা ছড়িয়ে দাও। ঠিক সাতদিন পর ভরদুপুরে, যখন তোমাদের শরীরের ছায়া খুব ছোট হয়ে আসবে তখন এই জলাশয়ের পাড়ে এসে হাজির হবে তোমরা। আমিও এখানেই থাকব।’

নির্ধারিত দিন দুপুরবেলা কাঁটাতারের চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল খই-ভাষীরা। তাদের হাতে কাঠের বর্শা, শাবল, তীর-ধনুক। কাঠিমেমকে এগিয়ে আসতে দেখে হইচই পড়ে গেল তাদের মধ্যে। ভিড় ঠেলে মঙ্গো এগিয়ে গেল তার কাছে। কাঠিমেম খই-ভাষায় তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার আমরা কাঁটা তারের বেড়া ভেঙে ফেলব, খুঁটিগুলো উপড়ে ফেলব।’

তার কাটা যন্ত্র দিয়ে একটা একটা করে সবকটা তার কেটে দিল কাঠিমেম। জলাধারে টহলরত বন্দুকধারীরা পিছু হটে গেল। বিষমাখা তীরের ভয়ে ভড়কে গেছে বান্টু রক্ষীরা, সাহেবের হুকুম অমান্য করে বাংলোর দরজায় ছিটকিনি এঁটে দিয়েছে তারা। বাংলোর বারান্দা থেকে সাহেব এসব দেখে আশ্চর্য হয়ে ভাবল, খইরা একজোট হলো কীভাবে! 

এক ঝাঁক পিপাসার্ত খই ছেলেমেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের ভেতর। চিৎকার করে আমন্ত্রণ জানাল তাদের প্রিয় কাঠিমেমকে। ঈশ্বরের কাছে বিড় বিড় করে কী যেন প্রার্থনা করল কাঠিমেম, তারপর নেমে গেল জলাশয়ে।

খইদের উল্লাসে ফাটল ধরিয়ে হঠাৎ ভেসে এলো গুলির আওয়াজ। কাঠিমেমের রুপালি শরীর জলাশয়ের পানিতে আছড়ে পড়ল খইদের মাঝখানে। মঙ্গো চিৎকার করে উঠল, ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেল কোরা।’ কোরার হাত থেকে খসে পড়ল উটপাখির দুটো সাদা ডিম।  

*[আফ্রিকার দক্ষিণাংশে অবস্থিত বোট্সওয়ানার এক সতীর্থ কলমনবিশের মুখ থেকে শোনা খণ্ড খণ্ড কাহিনি অবলম্বনে রচিত।]

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //