ক’তে কল্লোল

আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। একটু মানে ছয়টায় ওঠার কথা ছিল ঘুম ভাঙল ৬.২০ এ। কল্লোল মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলো। এই যে ২০ মিনিট দেরি হলো, এর জের সারাদিন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। কল্লোল বিরক্তি ভরা মন নিয়েই বিছানার বাঁ পাশের দিকে তাকায়। বালিশটা তেমনি আছে। মানুষটা পাশে নেই। হাত দিয়ে ওর বালিশটা স্পর্শ করে ওর ছোঁয়া নিতে চায়। মনে পড়ে ও রাতে ডিউটিতে গেছে। আজ সকালে আটটায় ডিউটি শেষ হবে। অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেলা ১০ টা। ততক্ষণে কল্লোল ওর অফিসে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই সময়ের মধ্যে আর দুজনের সঙ্গে না দেখা হবে, না কথা হবে! কল্লোলের মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনে মনে ভাবে আহ্ জীবন! আহা জীবন! 

এখন এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই। সে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে। পাশের দরজাটা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢোকে। হিন্দোল আর মৃদুল ঘুমাচ্ছে। হাত দিয়ে জানালার পর্দাটা সরায়। বাইরের আলো এসে দুই ভাইবোনের মুখে পড়ছে। পুরো ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। এ আলো যেন কল্লোলের সংসারেরই আলো। কল্লোল, মীনাক্ষী, হিন্দোল আর মৃদুল চারজনের সোনার সংসার। বড় শান্তির, বড় সুখের সংসার। নিজের সংসারের সুখ-শান্তির কথা ভাবতে ভাবতে আবারও মনটা আনন্দে ভরে উঠে। 

কল্লোল হিন্দোলের মাথায় হাত রেখে বলে গুড মর্নিং বাবা। ছেলে চোখ বন্ধ রেখেই দুই হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে গুড মর্নিং বাবা। আই লাভ ইউ। কল্লোলও ছেলেকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরে বলে আই লাভ ইউ টু। সোনামনি উঠে পড়ো আমাদের স্কুলে যেতে হবে। ছেলেটা ঠিক যেন কল্লোলের কার্বন কপি। বাবা যেমন ছেলে ঠিক তেমন। ছেলে বাবার কথা শুনে বাবার গলা ছেড়ে আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। এবার কল্লোল বিছানার ওপাশে মৃদুলের দিকে যায়। 

ও এখনও ঘুমাচ্ছে। বাবা ভাইয়ের কোন আলাপই শোনেনি। মৃদুলের মাথায় হাত রাখতেই ও চোখ মেলে তাকায়। মেয়েটা বড্ড সেনসিটিভ। ঠিক যেন! নাহ্! কল্লোলের এখন এসব ভাবার সময় নাই। মেয়ে বাবার গলা জড়িয়ে বলে গুড মর্নিং বাবা। 

কল্লোল ওকে জড়িয়ে ধরে বলে গুড মর্নিং মামনি। এবার উঠে পড়ো। মেয়ে বাবার কথামতো বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। 

কল্লোল দুজনকেই তাগাদা দেয়। চলো উঠো আমাদের দ্রুত রেডি হয়ে স্কুলে যেতে হবে। 

হিন্দোল বলে হ্যা, বাবা। আমাদের সেই রোজকার রুটিন। রেডি হও, খাওয়া দাওয়া করো। 

মৃদুল বলে, স্কুলে যাও। 

কল্লোল বলে, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। 

তিনজনে এবার হো হো করে হেসে ওঠে। ছেলে মেয়ে দুটোই হয়েছে ভীষণ লক্ষ্মী। পুরোই মায়ের মতো। কোনকিছুতেই ওদের কখনোই কোন ক্লান্তি নেই। কল্লোল দুজনকে দুই টয়লেটে পাঠিয়ে কিচেনে যায়। দুজনের টিফিন এবং নাশতা রেডি করে বেরুতে বেশ সময় পেরিয়ে যাবে। ঘড়িতে অলরেডি ৬.৩০। ৭.৩০ এ বাসা থেকে বের হতে না পারলে ওরা ৮.৩০ এ স্কুলে পৌঁছাতে পারবে না। মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে নিজেদের তৈরি করা, স্নান, নাশতা, সব কিছু মিলিয়ে বড্ড কম সময়। কল্লোল প্রায়ই ভাবে প্রতিদিন সকালের এই এক ঘণ্টার মহাযজ্ঞে যদি সময়টা বাড়িয়ে আর একটু বড় করা যেত। কতই না ভাল হতো! 

সংসার এমন এক স্থান যে দায়িত্ব নেয় তাকেই সারাজীবন দায়িত্বের বোঝা টেনে যেতে হয়। ছোটবেলার এই দায়িত্ব কল্লোলকেই পালন করতে হতো। এখন সংসার জীবনে এসেও সেই বিষয়ের কোন ব্যত্যয় হয়নি। কল্লোলের কাজ করতেই ভাল লাগে। ব্যস্ততাই জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছে। ব্যস্ত থাকার সবচেয়ে বড় সুখ জীবনের সবকিছু দুঃখবোধ ভুলে থাকা যায়। 

দুই সন্তান রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসে। মৃদুল বলে বাবা তোমার হয়নি। মামনি বসো আনছি, বলেই কল্লোল টেবিলে পরোটা আর ডিম ভাজা এনে রাখে। 

চারজনের একই খাবার। যখন যা রান্না হবে সেটাই খেতে হবে। ব্যস্ততার এই জীবনে নিজের পছন্দমতো খাবার বেছে খাওয়ানোর কোন সুযোগ নেই। ওরা তিনজনে যে খাবার খাবে ডিউটি থেকে ফিরে মীনাক্ষীও সেই খাবারই খাবে। প্রতিদিনের এই রুটিন এভাবেই চলে আসছে। 

মৃদুল বলে, বাবা তুমি স্নান করো নি! কল্লোল যাই মা বলে উঠে যায়। 

এবার হিন্দোল মৃদুলকে তাগাদা দেয়। দ্রুত করো। রেডি হতে হবে। ওরা দুই ভাইবোনে দ্রুত নাশতা খেতে মনোযোগ দেয়।  

বাবা-সন্তান তিনজনে মিলে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছে। ঠিক সেই সময় রাকিব ভাইও সন্তানদের দিয়ে বের হয়। একসঙ্গে তিনজনে মিলে রাকিব ভাইয়ের গাড়িতে চড়েই রওয়ানা দিলো। 

রাকিব ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় চাকরির সুবাদে। সেই থেকে সম্পর্ক অটুট। দুজনে বিয়েও করেছে কাছাকাছি সময়ে। সন্তানদের বয়সও প্রায় একই। একই স্কুলে ওরা পড়ে। দুই পরিবার নিজেদের জীবনের অনেক কিছুই শেয়ার করে। বিশেষ করে কল্লোলের জীবনের বহু সত্য মিথ্যা, টক-মিষ্টি গল্পের সাক্ষী তিনি। 

চারজনকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুজনে মিলে অফিসের দিকে রওয়ানা হলেন। রাকিব ভাইয়ের ড্রাইভিং দক্ষতা খুব সুন্দর। কল্লোল এ দিক দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে। তবে, মীনাক্ষী আর রাকিব ভাই দুজনকে মাপলে দুজনকেই ১০ এ ১০ দিতে হয়। কল্লোল এসব নিয়েই ভাবছিল ঠিক তখনই তারা পৌঁছে গেল অফিসের গেটে। ওরা দুজনে যেখানে কাজ করে এটা একটা সংঘ। নানা, ধর্ম, বর্ণ, জাত-পেশার মানুষ এখানে আসে। এখানে মানুষকে সুখী থাকার মন্ত্র শেখানো হয়। কল্লোল এখানে টানা ১৪ বছর চাকরি করছে। চাকরিতে কোন ক্লান্তি নেই। প্রতিদিনই নতুন জীবন। নতুন অভিজ্ঞতা। নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ। অনিন্দ্য সুন্দরের মুখোমুখি হয় যেন প্রতিদিন। 

আজ মঙ্গলবার। আজ সারাদিন একটার পর একটা সেশন চলবে। আজ ব্যস্ততার শেষ নেই। কল্লোল দ্রুত অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়। প্রোগ্রামের সবকিছু ঠিকমতো চলছে কিনা চেক করে। প্রথম সেশন শুরু হয় ৯টায়। আজ সকালের সেশনে বেশ অতিথি এসেছে। অতিথিদের চেয়ারগুলো কানায় কানায় পূর্ণ। পুরো হলভর্তি অতিথি দেখে কল্লোলের বেশ ভাল লাগে। সত্যি অপূর্ব সুন্দর। মনে মনে ভাবে এভাবে যদি সবাই আসত তাহলে কতই না ভাল হতো। সুখী মানুষে দেশটা ভরে যেত। যখন সব সিট কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তখন সত্যি খুবই ভাল লাগে। প্রতিদিনই নতুন নতুন অতিথি আসে তবু কিছু অতিথি মনে দাগ কেটে যায়। এমনই একজন ছিল সে। গত ৫ বছরে তাকে একদিনও দেখা যায়নি। 

কল্লোলের বিয়ের পরই সে আসা বন্ধ করে দেয়। অফিসিয়াল সম্পর্কের বাইরেও সে অন্য কিছু চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতার জন্য কল্লোলের পক্ষে এটা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তাকে ভালই লাগত কিন্তু মায়ের তাকে একদমই পছন্দ ছিলনা। মা না চাইলে ছেলে কি আর অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারে! মা সবসময় চাইত তার ছেলের বউ হবে ফর্সা, দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। হতে হবে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আর পরিবারের প্রতিপত্তিও থাকতে হবে। ঠিক যেমন কল্লোলের পরিবারের আছে। তাকে মন্দ লাগত না কিন্তু মাকে এড়িয়ে কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। 

কি এমন হয়েছিল? সবার সঙ্গে যেমন কাজ সংক্রান্ত কথা হয় তার সঙ্গেও তাই হতো। তবু তার মধ্যে কি যেন ছিল! কি যেন ছিল! সে প্রচুর আকর্ষণ করত। সে প্রতিদিন আসত। আজ কেন যেন তার কথা খুব মনে পড়ছে। কল্লোল নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয়। কি দরকার তার কথা মনে পড়ার! চলেই যখন গেছ তখন ফিরে আসার কি দরকার! 

যখন সে নিয়মিত আসত তখন একদিন সে না এলে অনেক খারাপ লাগত। কল্লোল ভাবত বুঝি তারই এমন হয়। কিন্তু তার ভাবনা মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে সে রাতের বেলা মেসেঞ্জারে এলো। প্রথম প্রশ্ন ঘুমিয়েছেন? 

কল্লোল বুঝতে পারেনা। সেই কি সত্যি কথা বলছে নাকি অন্য কেউ? কিছুক্ষণ সে বিহ্বল হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর সে রিপ্লে দেয়। না, ওপাশ থেকে তার প্রশ্ন এত রাত পর্যন্ত জেগে আছেন যে! 
- আজ অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি ছিল তাই বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। 
- ও আচ্ছা। কাল কি অফিসে আসবেন? হ্যাঁ কেন? আপনার জরুরি কোন কাজ আছে? তবে আমি একটা মিটিংয়ে থাকব। আপনার জরুরি কোন প্রয়োজন থাকলে রাকীব ভাইকে বলতে পারেন। 
- না তেমন জরুরি কিছু না। তবে, আমি কাজটা আপনাকে দিয়ে করাতে চাই। 

এমন বাক্য অপেশাদার তবু মনের কোথায় যেন সুর ওঠে। দুজনের আলাপ বাড়তে থাকে। 
- আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি? 
- হ্যা, প্লিজ বলুন। আপনি কি বিবাহিত? 
- না। আপনি? 
- না। 
- ও আচ্ছা। 
- আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই। 
- কি বলুন, প্লিজ। 
- আমি একজন শিশু দত্তক নেব। তার নাম রাখব সীমান্ত ইয়াসমিন কল্লোল। নামটা কেমন হয় বলবেন? 
- কেন? আমার নাম জড়িয়ে রাখছেন কেন? 
- আরে আপনার নাম জড়িয়ে রাখছি এমন কথা আপনাকে কে বলল? সারা বাংলাদেশে কি শুধু আপনিই একজন কল্লোল আছেন? আপনিই কি এই নামের এক এবং একমাত্র মানুষ। 
- ও তাই বুঝি! তো আপনার চেনা জানা কতজন কল্লোল আছে? 
- শ খানেক তো হবেই। 
- নাম শোনান দেখি। 
- ও আচ্ছা। নাম শুনতে চান। বলছি শুনুন তাহলে আপনি যেমন কল্লোল রায়, এমন আরও আছে নাহিদ শরীফি কল্লোল, কাদির কল্লোল, আসিফ শওকত কল্লোল, রহিমুদ্দিন কল্লোল, হুমায়ুন আহমেদ কল্লোল, জামাল হোসেন কল্লোল, দীপ্তেশ মুখার্জী কল্লোল, কল্লোল ব্যানার্জী... 
- হয়েছে হয়েছে, থাক থাক। আপনার কল্লোল নামের ঝাঁপি আর খুলতে হবে না। প্লিজ ওটা বন্ধ রাখুন। 
- কেন? আপনি মাত্র এই কয়টা নামেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন? আরও আছে বলছি। 
- না, রাত অনেক হয়েছে এবার ঘুমান। 
- ঠিক আছে। তবে কথা এটাই রইল। আমি যে শিশুসন্তান দত্তক নেব তার নাম এটাই রাখব। 

আপনি কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার এটা নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। বলেই কল্লোল গুড নাইট জানিয়ে নেট ডিসকানেক্ট করে ঘুমিয়ে পড়ে। 

এরপর বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্ম্যা, মহানন্দায় অনেক জল গড়িয়েছে। দুজনে রাতের পর রাত ম্যাসেঞ্জারে- হোয়াটসঅ্যাপে অনেক গল্প করেছে। কখনও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা, কখনও প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলাপ, কখনও নিজেদের বন্ধুদের নিয়ে কথা, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি  কোনকিছুই বাদ যায়নি। 

কল্লোলের বিয়ে নিয়ে মা-কাকীমারা অনেক আলাপ করেছে। সবশেষে মায়ের পছন্দের মেয়ে ডা. মীনাক্ষীর সঙ্গেই ওর বিয়ে হয়েছে। 

সে একসময় প্রতিদিন আসত। এরপর ২/৩ দিন পরপর আসত। পরে সপ্তাহে একদিন আসত। এরপর ধীরে ধীরে মাসে একদিন আসত। কিছুদিন পর ২/৩ মাস পর তাকে একবার দেখা যেত। সে যেন সময় নিলো, কল্লোলের বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে দিল। ও ঠিক যে মাসে বিয়ে করল এরপর থেকে তাকে আর কোনদিন সংঘে দেখা যায়নি। রাকিব ভাই ছাড়া এ নিয়ে কল্লোল আর কারো সঙ্গে কখনও কোন আলাপও করেনি।

যখনই সে আসত। কল্লোলের দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিত। আর এই হাসি নিয়ে অফিস কলিগদের চাপা হাসি হৈ হুল্লোড় পড়ে যেত। সে যে কি দিন গেছে! এমনকি মিটিংয়ে বসে ফেরদৌসী আপা পর্যন্ত টিপ্পনি কাটতে ছাড়েননি। এটা কোন জীবন হলো একসময় মনে হতো চাকরিটা ছেড়ে দেই। কলিগরা যত তাকে নিয়ে বিদ্রূপ করত, তার প্রতি যেমন অনেক বিরক্তি কাজ করত, তেমনি তাকে অনেক ভালও লাগত। 

কিন্তু মায়ের মতের বাইরে যাবার কোন সুযোগও ছিল না। বলার কোন সুযোগ ছিল না। মায়ের নিজের পছন্দের মেয়েকেই চাই। এমনিতে দাদার নিতা বৌদিকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে এক বিড়ম্বনা। তারপর মামলা, হামলা, হাঙ্গামা, ঝক্কি-ঝামেলা সব মাকেই সামলাতে হয়েছে। তারপরে নিজেই যদি এমন ভুল করে বসে মা সইবে কি করে? কল্লোল তার ভাবনার জাল বুনে চলে। তাকে নিয়ে বেশি ভাবা হয় না। অফিসে কাজের চাপ বাড়ে। কলিগের টিপ্পনি, বিদ্রূপ আর খুনসুটি বাড়ে। 

বিশেষ করে কল্লোলের বিয়ের পর তাকে আর সংঘে দেখা যায়নি। 

কল্লোলের বিয়ে, সংসার, হিন্দোল, মৃদুল, সব মিলেই তার জীবন। এসব নিয়েই ওর স্বর্গসুখের রাজ্য। আজ কেন হঠাৎ তাকে এত গভীরভাবে মনে পড়ছে! সত্যি কিছু স্মৃতি বড় একঘেয়ে, বড় বিরক্তিকর। 

কল্লোল নিজের কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা হয়না। আজ একের পর এক অতিথি আসছেন। কারো দিকেই সে মনোযোগ দিতে পারছে না। কেমন যেন অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে। মনে হচ্ছে, সে আসবে, আসবেই, আসবে। 

প্রথম সেশন শেষ হয়ে অতিথিরা বিদায় নিলেন। কল্লোল দ্বিতীয় পর্বের প্রস্তুতি সেরে নিজের চেয়ারে বসল। এখন প্রোগ্রাম শুরু। ব্যস্ততা কিছুটা কম। অফিসের টেবিলে তেমন কোন ভিড় নেই। কিন্তু এ কি দেখছে সে! কে ও! ও যে সেই! যে কিনা সেই কত্ত বছর আগে কল্লোলকে ভালোবাসার কথা বলেছিল। মা রাজী হবে না বলে সে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সে এতবছর পর কেন এলো? এতদিন কোথায় ছিল? সঙ্গে একজন ছোট্ট শিশু। সে কে ওর? ও কি বিয়ে করেছে? কাকে বিয়ে করেছে? এতদিন সংঘে আসেনি কেন? কল্লোলের মাথায় একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। 

সে ভেতরে আসে এবং একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে সেই দুষ্টু মিষ্টি হাসি। কল্লোলের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন আছেন? ও বলে ভাল। এরপর আর কোন কথা মুখ দিয়ে বের হয় না। নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু সামনের জনের কোন অস্বস্তি নেই। সে আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। কল্লোলের দিকে তাকিয়ে বলে, ওকে আপনার কাছে রেখে যাই। সেশন শেষ হলে এসে নিয়ে যাব। বলেই তার সন্তানকে কল্লোলের দিকে এগিয়ে দেয়। কল্লোল ওর হাত ধরে বলে কি নাম তোমার? সীমান্ত। তাহলে পুরো নাম কি? কিছুটা অস্বস্তি কাজ করে কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না। ওকে কাছে টেনে নেয়। বলে ঠিক আছে আপনি প্রোগ্রাম শেষ করে আসুন। ও আমার কাছে থাকুক। 

সীমান্ত চার বছরের মিষ্টি শিশু। মুখটা যেন মায়ের আদল। ঠান্ডা, শান্ত, ধীর। কল্লোল ওকে কোলে নিয়েই কিছুক্ষণ বসে থাকে। শিশুটি পরম স্নেহে ওর ওপর হাত রেখে বসে আছে। কিছুই বলছে না। কল্লোলের জীবনে প্রথম দেখা এই শিশুটিকে ভীষণ আপন মনে হয়। মনে হয় কত আপন, কতদিনের চেনা! 

এমন সময় রাকিব ভাই মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে বলেন, উপরে এসো। কাজ আছে। 

কল্লোল সীমান্তকে কোল থেকে নামিয়ে নিজের চেয়ারে বসায়। বলে, মামনি তোমাকে রেখে তো আমি এখন কাজে যাব। 

সীমান্ত ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। যেন কতকিছু বোঝে। একদম ওর মায়ের মতো। কিন্তু শিশুটির বাবা কে? কল্লোল ওকে চেয়ারে বসিয়ে টেবিলে সাদা কাগজ আর কলম দিয়ে বলে, তুমি এখানে ছবি আঁকতে পারো। বলেই সে দ্রুত চলে যায়। 

সীমান্ত কল্লোলের সিটে বসে বসে ছবি আঁকছে। যখনই সীমান্ত ছবি আঁকে তার ছবির থিম থাকে বাবা, মা আর সে। 

ফেরদৌসী আপা অফিস রুমে ঢোকেন। কল্লোলের চেয়ারে বসে আছে একজন ছোট্ট শিশু। একদম কল্লোল ঠিক যেভাবে মাথা সবসময় নিচু করে বসে বসে কাজ করে একদম ঠিক সেভাবেই কাজ করছে। কিন্তু এ তো হিন্দোল বা মৃদুল নয়, তাহলে এ কে? হঠাৎ করে ওর দিকে তাকালে মনে হয় যেন ঠিক কল্লোলের ছোট সংস্করণ। ফেরদৌসী পুরো অফিস রুমের দিকে তাকায়। মাহমুদ, বসরী, সাবিকুন, অনিক কেউ নেই। শুধু এই ছোট্ট শিশু একা বসে বসে ছবি আঁকছে। শিশুটির কোনদিকে দৃষ্টি নেই। একমনে ছবি আঁকছে।

ফেরদৌসী বলে, এই মিষ্টি বাবুটা কে? এবার সীমান্ত মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। কিন্তু এই মানুষটি কে সে চিনতে পারে না। 

ফেরদৌসী জিজ্ঞেস করে তোমার নাম কি? 
- সীমান্ত। 
- সীমান্ত কি? 
- সীমান্ত ইয়াসমিন কল্লোল। 
- কল্লোল! ফেরদৌসী বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে শিশুটির দিকে তাকায়। ততক্ষণে সে মাথা নিচু করে আবার ছবি আঁকায় মনোযোগ দিয়েছে। 
- ফেরদৌসী জিজ্ঞেস করে, বলতো মামনি  ক’তে কি হয়? 
- ক’তে কল্লোল। 
- ক’তে আর কি হয়? 
- ক’তে কথা হয়। 
- ক’তে আর কি হয়? 
- ক ’তে কও হয়। 
- তার মানে কি? 
- মানে হলো, কল্লোল কথা কও। 
- কে শিখিয়েছে? 
- মা। 

ফেরদৌসীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। তবে কি ওরা যা ভাবত তাই ঠিক! সব সত্যি! ফেরদৌসীর মাথাটা ঘুরছে। ও পড়ে যাচ্ছে। 

এদিকে কল্লোল ওপরের কাজ শেষ করে আবার সীমান্তের কাছে আসে। ওকে একা রেখে গেছে। এত ছোট্ট শিশু ভয় পায় কিনা তাই ওর এত তাড়াহুড়ো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই সীমান্ত জোরে বলে ওঠে - আংকেল, আন্টি-দীদাতো পড়ে যাচ্ছে। (এই মানুষটিকে আন্টি নাকি দিদা ডাকতে হবে ওর মাথায় ঢোকে না। তাই এই দ্বৈত ডাক)। কল্লোল দৌড়ে গিয়ে ফেরদৌসী আপাকে ধরে ফেলে। আর অন্যদের জোরে ডাকতে থাকে। 

এদিকে ফেরদৌসী আপা বিড়বিড় করছে এই শিশুটির বাবা তাহলে কি কল্লোল! বসের হঠাৎ অসুস্থতায় অস্থির হয়ে ওঠে কল্লোল। আপার কোন শব্দই ওর কানে ঢোকে না। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //