নীড়

শরতের দুপুর। রৌদ্রতপ্ত। সাধারণত শরতকালে এত গরম হয় না। কিন্তু এখনকার পরিবেশ পুরোই উল্টো। এখন সারাবছরই বেশ গরম থাকে। বৃষ্টি হলে সামান্য ঠান্ডা। এরপরই আবার সেই গরম। এরমধ্য দিয়েই জীবনযাপন করতে হয়। কিছুই করার নেই। এই গরমের মধ্যেই নিজের লাগেজটা নিয়ে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ায় মুনিমা। এখন রিকশার জন্য অপেক্ষা। মাত্র কয়বছরে রিকশা ভাড়া এত বেশি বেড়েছে যে বলার কথা না। 

মুনিমার আয় কিন্তু সেই তুলনায় বাড়েনি। আজিমপুর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন যেতে মাত্র কয়েক মাস আগেও সে রিকশা ভাড়া দিত ৫০-৬০ টাকা। এখন সেই ভাড়া একদাম ১৫০। এরপরও সব রিকশাচালক যেতে চায় না। যারা যায়, স্টেশনে নামার পরে আবার বলে মামা ২০ টাকা বাড়াই দ্যান। মুনিমা তাদের কথা শুনে হাসে। তাহলে ১৫-২০ মিনিট ধরে রিকশা ভাড়া করে এত কষ্ট করে এসে কি লাভটা হলো! 

আজ এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই একজন রিকশা চালক কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে, মামা কই যাইবেন? মুনিমা বলে, কমলাপুর। রিকশাওয়ালা বলে, কমলাপুর রেলস্টেশন। মুনিমা উত্তর দেয়, হ্যাঁ। 

রিকশাওয়ালা বলে, মামা ভাড়া একদাম ১৫০ টাকা। মুনিমা বলে ভাড়া ১৫০ টাকাই তো। রিকশাওয়ালা বলে, হ্যাঁ। ওঠেন। এবার রিকশাওয়ালা নিজেই মুনিমার লাগেজটা রিকশায় তোলে। মুনিমা নিজে রিকশায় উঠে। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে শুরু করে।

এবারের ট্যুর খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। কোন উপায় নেই। মায়ের খুব জরুরি তলব। আবার কি হলো? ভাবি ভাইয়াদের, বা আপা দুলাভাইদের কি সমস্যা কে জানে! ছোটভাই শান্তর বিয়ের পর থেকেই এই ঝামেলাগুলো বেড়েছে। আগে সব দিব্যি চলছিল। কত হাসিখুশি প্রাণবন্ত পরিবার ছিল ওদের। এখন প্রত্যেক মাসেই মিটিং-সিটিং। রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি। মুনিমার এসব একদম ভালো লাগে না। কিন্তু কিছুই করার নেই। সংসারে বাস করতে গেলে সুখের বিপরীতে অসুখের সাথে লড়াই করতেই হবে। মুনিমা পারিবারিক বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতেই রিকশা কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে দাঁড়ায়।

মুনিমা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রিকশা থেকে নামে। এখন রেলস্টেশন অনেক পরিচ্ছন্ন হয়েছে। মুনিমা যখন প্রথম ঢাকায় আসে তখন এত পরিচ্ছন্ন ছিল না। ভিক্ষুক আর কুলিদের উৎপাতে খুব কষ্ট হতো। এখন কোন ভিক্ষুক নেই। তবে, যাত্রীদের মালামাল পরিবহনের জন্য কুলি আছে। এই কুলিরা অনেক ভদ্র। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সাদা রংয়ের পোশাক পরে থাকে। পোশাকগুলো এত পরিচ্ছন্ন আর ইস্ত্রি করা যে প্রথম যেদিন মুনিমা দেখেছে সে খুব খুশি হয়েছে। প্রত্যেক কুলির বুকে তার নাম এবং নম্বর দেয়া আছে। এই নম্বরটাই তার আইডেনটিটি। যাত্রীদের কাছ থেকে কোন বাড়তি টাকা নেয়া বা কোন নারী যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ দুর্ব্যবহার করে তাহলে তার নম্বরটি শুধু রেল অ্যাপসের নির্দিষ্ট নম্বরে এন্ট্রি করে দিলেই হবে। বাকি কাজ কর্তৃপক্ষ করবে। যখন থেকে এই সিস্টেম চালু হয়েছে এরপর থেকে কোন ঝামেলাই হয়নি। অবশ্য প্রথমে রেল কর্তৃপক্ষ তাদের পুরো এক মাসের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। যখন এই ট্রেনিং শুরু হয় এই সময়ে রেলের প্রচুর প্রতিবেদন তৈরি করেছে মুনিমা। আজ রেল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন করছে। আর মুনিমা নিজেই সেই সুফল পাচ্ছে এটা ভাবতেই ওর বেশ ভাল লাগে। 

আজ ট্রেন ছাড়বে ঠিক ১টা বেজে ৩৫ মিনিটে। ট্রেন দিয়েছে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এখন ধোয়ার কাজ চলছে। এটা শেষ হলেই মুনিমা উঠে বসবে। সে চারপাশের যাত্রীদের দেখতে থাকে। ঐ পাশে বসে আছে একটা পরিবার। চারজন সদস্য। সবচেয়ে ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি থমকে যায়। ঠিক যেন সোনিয়ার ছোট সংস্করণ। যখন সে ছোট্টটি ছিল একদম এই রকমই ছিল। আজ সেই সোনিয়ারই মেয়ে এই শিশুটির সমান বয়সী। শিশুদের একটা বৈশ্বিক মিল আছে। সব শিশুই ইনোসেন্ট। যখন কোথাও শিশুরা থাকে দেখে মনে হয় যেন বাগানে ফুল ফুটে আছে। 

মুনিমা এসব কথা ভাবতে ভাবতেই গার্ড ট্রেনের দরজা খুলে দেয়। সে লাগেজ নিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় পাশে এসে ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলে দাঁড়ায়। সে বলে, আপু আমি তুলে দিচ্ছি। মুনিমা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দেয়। ছেলেটি প্রথমে মুনিমার লাগেজ তুলে। এরপর নিজের লাগেজটি উঠায়। মুনিমাকে জিজ্ঞেস করে আপনার সিট নম্বর কত? মুনিমা বলে, ডাব্লিউ- ৩৪। আরে আমার তো ৩৩। বাহ্! আপনার পাশে সিট পেয়ে ভালোই লাগল। 

এরপর সেই তাদের লাগেজ ঠিকঠাক মতো রাখল। মুনিমা ধন্যবাদ জানালো। ট্রেন চলতে শুরু করার পর দুজনে দুজনের মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারো প্রতি কারো খেয়াল থাকল না। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশনে যখন ট্রেনটি পৌঁছায় তখন রাত ৯.৩০ বাজে। এমন কোন রাত না। রোজ তো এই সময়ে মুনিমা রিপোর্ট শেষ করে অফিস থেকে বের হয়। অবশ্য এটা ঢাকা শহর নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কিন্তু এতে কি আসে যায়। এখন শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে প্রচুর। পৌরসভার পক্ষ থেকে রাস্তাঘাট ঠিক করা হয়েছে। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো আছে। আর স্থানীয় প্রশাসন এত শক্তিশালী যে, ছিনতাই তো বহু দূরের কথা রাস্তায় কেউ যে কোনো মেয়েকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করবে এটা চিন্তাও করে না কেউ। প্রতিটি মোড়েই সিসি ক্যামেরা আছে। ক্যামেরাগুলো প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদারক করা হয়। আর প্রতি মাসের শেষ বুধবার বিকেলে প্রতিটি পাড়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উঠান বৈঠক হয়। এই বৈঠকে সকল অভিভাবকের উপস্থিত থাকাটা বাধ্যতামূলক। এই এক উঠান বৈঠক পুরো জেলার চিত্র বদলে দিয়েছে। মুনিমা ভাবে, সারাদেশে যদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই সিস্টেম চালু করা যেত তাহলে দেশটা কত সুন্দরভাবেই না চলত। এই বৈঠকে মুনিমা নিজেও আব্বা-আম্মার সঙ্গে ২ বার গেছে। এবং সেখানে তার খুব ভালো লেগেছে। বৈঠকে কারো নামে নেগেটিভ কোনো কথা উঠাটাকেই ঐ পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত অসম্মানজনক মনে করে। সবাই এই ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকে। আর এখানে আলোচনায় আসে কার পরিবারে সন্তানের জন্ম হলো। তারা শুভকামনা পায়। যাদের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষার জন্য শহরের বাইরে যায় তারা পরামর্শ এবং শুভেচ্ছা পায়। নতুন যারা বিয়ে করে তারা শুভকামনা পায়। কেউ মারা গেলে তাদের জন্য শোক জানানো হয়। অসুস্থ হলে সুস্থতার জন্য দোয়া করা হয়।

আর নিজেদের শহর আরও কিভাবে বাসযোগ্য রাখা যায়। এটা নিয়ে আলোচনা হয়। এখানে কেউ ছোট বড় নয়, বাসিন্দা হিসেবে সবাই সমান মর্যাদা পায়। 

যে শহর এত্ত সুন্দর সেখানে কেউ ট্রেন থেকে নামলে তাকে নিয়ে অভিভাবকদের কোনো চিন্তা করতে হয় না। মুনিমা ট্রেন ছেড়ে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখে আব্বা-আম্মা দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে। সে খুব খুশি হয়। মেয়ে নিরাপদে পৌঁছেছে দেখে তারা দুজনেও খুব খুশি হয়। তিন জনে মিলে এগিয়ে যায় নিজেদের নির্ধারিত অটোরিকশার দিকে। 

মুনিমা রাস্তায় আসার সময় অটোতে বসে পুরো শহর দেখে। সত্যি এত সুন্দর শহর! যেন মায়ায় মোড়ানো এক ছবি। গত ২০ বছরে এই শহরের চেহারা আমূল বদলে গেছে। রাস্তার দুইপাশে গাছের সারি। সবচেয়ে বেশি, পুরো রাস্তা জুড়ে কোন একটুকরো ময়লা কাগজের টুকরো বা পলিথিন নেই। কোথাও কোন কাদামাটি জমে নেই। শহরের প্রতিটি বাড়ির বারান্দা এবং ছাদে ফুল গাছের সারি। গাড়িগুলো লাইন ধরে চলছে। কারো দ্রুত যাবার তাড়া নেই। কোনো হর্ন নেই। এই মুনিমার স্বপ্নের শহর! রাস্তায় কোন সাইনবোর্ড বা পোস্টার নেই। তবে, প্রতিটা বাড়ি এবং অফিসের নম্বর এবং ঠিকানা দৃশ্যমান। সার্জেন্ট আতাউল হক ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনের টগর ফুলের গাছগুলোর পাতায় পাতায় ফুল ফুটে আছে। রাতের লাইটের আলো পড়ে ফুলগুলো আরো সাদা আভা ছড়াচ্ছে। মুনিমা বলেন, সবকিছু এত পরিচ্ছন্ন খুব ভালো লাগে। এই শহরে ঢুকলে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। 

আব্বা বললেন, এই শহর সুন্দর করতে শহরের সবাইকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। তবে, তরুণ প্রজন্মকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। নবাবগঞ্জ, শাহনেয়ামতুল্লাহ, মহিলা আর সিটি কলেজের গ্রাজুয়েশন লেভেলের ছাত্র-ছাত্রীদের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। তারা যা পরিশ্রম করেছে তা অবর্ণনীয়। এরজন্য প্রশাসনকেও অনেক ধন্যবাদ দিতে হয়। তারা যেভাবে চেয়েছে প্রশাসন তাদেরকে সেভাবেই সাহায্য করেছে। প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া এই সাফল্য পাওয়া সম্ভব ছিল না।

তিনজনে বাসায় ফিরলে মুনিমা স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসে। এবার আম্মা বলেন, এবার তোমাকে কেন ডেকে পাঠানো হয়েছে জানো কিছু?

না আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। এবার আবার কি সমস্যা হলো? 

আব্বা বলে, এবার নতুন সমস্যা। তোমার আম্মা আর আমাকে আলাদা করা। 

মানে কি? - মুনিমা ক্ষেপে উঠে। 

আম্মা বলে, এতদিন জমি ভাগের ব্যাপার নিয়ে আলাপ ছিল। সেগুলো সব ভাগ করে দেয়া হয়েছে। আমরা চলে গেলে কে বাড়ির কোন অংশ নেবে সেগুলোও লিখে দেয়া হয়েছে। এখন আমাদের দুজনকে আলাদা করতে পারলে তারা বাঁচে। 

মুনিমা অনেক ক্ষেপে যায়। কিন্তু তাদের দুজনের সামনে প্রকাশ করতে চায় না। এত বিড়ম্বনা আর ভালো লাগে না। এবার এর একটা বিহিত করতেই হবে। মুনিমা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। বলে, কাল আমাদের মিটিং কখন? 

আব্বা বলেন, সকাল ছয়টায় বসবে বলেছে। কালকের সকালে সবার হাঁটা বাতিল করা হয়েছে। মিটিং শেষ করে সবাই যার যার অফিসে যাবে। মুনিমা সব কথা শুনে বিছানায় ঘুমাতে যায়।  

সকাল ছয়টা বাজার আগেই সবাই বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে। মুনিমারা চারভাই, তিনবোন। মুনিমা ছাড়া সব্বাই বিবাহিত এবং ঘোর সংসারী। বড় ভাই-ভাবি, অন্য ভাইয়েরা, বড় আপা-দুলাভাইসহ সবাই আছে। শুধু শিশুরা এই বৈঠকে অনুপস্থিত। মুনিমা ভাই-বোনদের মতলব বুঝতে পারে। এরা যে কূটচাল চালতে চায় তা তাদের সন্তানদের জানাতে চায় না। মুনিমা মাত্র দুইদিন আগেই বিশ্ব প্রবীণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে প্রবীণদের সন্তানদের জন্য বুক ভরা হাহাকার আর সন্তানদের নিপীড়নের যে চিত্র উঠে এসেছে তা এক কথায় ভয়াবহ। বাড়িতে এখন আব্বা আম্মার সঙ্গে সোনিয়া আর রাসেল থাকে। বাকিরা সবাই আলাদা আলাদা সংসার পেতেছে। সোনিয়া আর রাসেল যে আব্বা আম্মার সঙ্গে আছে এটা আব্বা আম্মাকে দেখবে বলে নয়। তাদের আর্থিক অবস্থা এখনও ছেড়ে যাবার মতো হয়নি বলেই তারা যায়নি। অবশ্য তাদের দুজনকে দোষ দেয়া যায় না। বিয়ে করেছে মাত্র ৫ বছর। গুছিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই। 

প্রথমেই আব্বাই কথা শুরু করেন। বলেন, আমার প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা তোমরা সবাই এত সকালে আজকে উপস্থিত হতে পেরেছ দেখে আমরা দুজন খুব খুশি। তোমরা কে কি চাও তা আমাদের বলতে পারো। সেজ ছেলে সুজন বলেন, আব্বা আপনি হয়ত আন্দাজ করতে পেরেছেন। আমরা কি বলতে চাই। অনেক দিন ধরে আপনি এবং আম্মা একসঙ্গে থাকছেন। 

আব্বা শুধরে দিয়ে বলেন এটা ৪৮ বছর। 

ছেলে আবার শুরু করে আপনাদের দুজনের বয়স বাড়ছে। আপনারা একা একা থাকেন। আমাদের আপনাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। তাই ভাবছিলাম... ছেলের গলা ধরে আসে। 

মুনিমা মনে মনে ভাবে। আজ আবার কি হলো? সেজ ভাইয়া তো আব্বা আম্মার জন্য এত আন্তরিক কোনদিনই ছিল না। 

বড় ভাইয়ের কথার পিঠে ছোটভাই কাজল বলেন, তাই আমরা ভাবছি আপনাদের এখন আর এভাবে বাড়িতে থাকার দরকার নাই। আপনারা আমাদের ভাইবোনদের কাছে ভাগ ভাগ করে থাকবেন। 

মুনিমার কাছে আলোচনার বিষয়বস্তু পুরো পরিষ্কার হয়। সে, বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়। বড়ভাইয়া আপনারও কি তাই মত। যদিও মুনিমা জানে, ভাইয়ার এখন সেই মেরুদণ্ড নেই। বিয়ে করলে আর সন্তানরা বড় হলে কি পুরুষ মানুষের মেরুদণ্ড নষ্ট হয়ে যায়! মুনিমা প্রায়ই বিষয়টা ভাবে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে দৃঢ় কণ্ঠে চরম পারিবারিক সত্যি কথা তারা বলতে পারে না কেন? এর কোনো উত্তর মুনিমার জানা নেই। 

বড় ভাইয়া বলে, সবাই যা ভাবছে আমারও মত তাই। এবার মুনিমা মেজ ভাইয়ার দিকে তাকায়। 

মেজ ভাইয়াও একই কথা বলেন। মুনিমা বড় দুলাভাইয়ের দিকে তাকায়। এই মানুষটার সাহস এখনও পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। তিনি বলেন, আমার মতে মা-বাবা এক বাড়িতে থাকলেই তারা বেশি ভালো থাকবেন।

মুনিমা মনে মনে বড় দুলাভাইকে ধন্যবাদ দেয়। কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না। অন্তত একজন পুরুষ তো পাওয়া গেল যে কিনা এখনও মেরুদণ্ড সোজা রেখে কথা বলতে পারে। 

মুনিমার কথার মাঝখানে মেজ ভাবি কথা বলে উঠে। বলে, এত কথার কি দরকার মুনিমা। তুমি ঢাকায় থাক। তুমি তো বাড়িতে থাক না। আব্বা আম্মার কোন কিছুই তুমি দেখ না। আর তুমি বিয়ে করোনি। তুমি এসব সংসারের কি বুঝবে। 

আব্বা বলেন, মেজ বউমা সংসারের আলোচনায় সঠিক আলাপে থাকলে সবার জন্যই মঙ্গল। 

আম্মা বলেন, মেজ বউমা তোমার যখন ছোট ছেলের জন্ম হয়। তখন তুমি ৪০ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলে। জেলায় তোমার পর্যাপ্ত চিকিৎসা ছিলনা। তখন মুনিমা ঢাকায় না থাকলে তোমাকে বাঁচিয়ে ফেরা আমাদের পক্ষে মুশকিল হয়ে যেত। আজ সেসব কথা তুমি কিভাবে ভুলে গেলে!

মুনিমা বলে, আমার ধৈর্যৈর বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আব্বা-আম্মাকে আলাদা করার বিষয় নিয়ে তোমরা আলোচনা করছ দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। এইরকম আলোচনা তো হয় নিম্ন আয়ের পরিবারে। আমাদের আব্বা-আম্মা দুজনেই সচ্ছল। তারা এখনও কর্মঠ। তারা সামাজিক সকল কাজে দায়িত্ব পালন করেন। তারা নিজেরা আয় করেন। তাদের নিজেদের বাড়িতে থাকেন। তাদের তোমরা কিভাবে আলাদা করতে চাও? মুনিমার রাগ সবার জানা। ও যখন কথা বলে কাউকে কথা বলতে দেয় না। তবে, ওর একটা বৈশিষ্ট্য অন্যায় কিছু সে কখনও বলে না। 

মুনিমা এক নিঃশ্বাসে বলে চলে, আব্বা আম্মা এই বাড়িতেই থাকবে। আর কেউ তাদের আলাদা করার কথা চিন্তাও করবেন না। আব্বা-আম্মা যেভাবে তাদের আয় থেকে আমাদের সব ভাইবোনদের যখন যার টাকার দরকার হয় সেভাবেই দিবে। আর মৌসুমী ফল, ফসল যেভাবে ভাগ ভাগ করে দেয় সেভাবেই দিবে। আর তোমাদের যার যখন দরকার সে তখন আব্বা আম্মার কাছে এসে থাকবে। ভুলে যেও না। তারা এখনো সচল আছেন। আর তাদের কারণেই আমরা সবাই নিজেদের আয়ের বাইরেও অনেক ভালো থাকি। 

আব্বা আম্মার ইচ্ছে হলে কোন সন্তানের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। থাকবে। তবে, সেটাও কখনোই এক সপ্তাহের বেশি নয়। তোমরা কেউ ভুলেও আব্বা আম্মাকে বাড়ির কাজের বুয়া, কুক, ম্যানেজার, সন্তানের ন্যানি বানানোর চিন্তা করবে না। আব্বা আম্মার কাছে যা পাচ্ছ তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো। এর বেশি যদি পাবার চেষ্টা করো তাহলে আমও যাবে, ছালাও যাবে। 

তখন সেজ ভাবি বলে, সোনিয়া আর রাসেল তো চলে যাবে তখন আব্বা আম্মাকে রান্না করে কে খাওয়াবে। তুমি? 

আব্বা বিরক্ত হয়ে বলেন, যখন যে পরিস্থিতি আসবে তখন আমরা সেটা সেভাবেই সামাল দেব। তোমরা এসব নিয়ে আগেই বেশি ভেব না সেজ বৌমা। 

এবার সহ্য সীমার বাইরে গিয়ে, বড় ভাবি বলে উঠেন। আব্বা আম্মার এত বাড়িতে থাকার কি দরকার? তাদের তো বয়স হয়েছে। তারা ভাগ হলে বাড়িটা ভাগ হয়। 

বড় ভাই এবার মুখ খুলেন। বলেন, দেখ বাড়িটা আব্বা আম্মার শ্রমের ঘামের বাড়ি। পারলে তুমি এরচেয়ে বড় বাড়ি করো কে নিষেধ করেছে। 

মুনিমা প্রমাদ গুণে। আজ রাতে ভাইয়াকে ভাবি ঘুমাতে দিলে হয়!

সবার রাগ, গজগজানি, বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতার মধ্যে দিয়েই মিটিং শেষ হয়। আব্বা আম্মাকে একসঙ্গে থাকার সুযোগ পেয়ে মনে মনে খুশি হন। আরও একজোড়া দম্পতি খুশি হয়। তারা হলো সোনিয়া আর রাসেল। ভাগ হলে সবচেয়ে বেশি  বিপদে ওরা দুজনেই পড়ত। 

সবাই ধীরে ধীরে উঠে চলে যান। মুনিমা জানে, এরা এত সহজে থামবে না। সন্তানরা বড় হলে কেন যেন বড় বেশি স্বার্থপর হয়ে যায়। তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত থাকে। বাবা-মায়েরও যে অধিকার বলে কিছু থাকতে পারে তারা তা ভুলে যান। 

সবাই চলে গেলে আব্বা-আম্মা-মুনিমা-রাসেল-সোনিয়া- একসঙ্গে চায়ের টেবিলে বসে। সোনিয়া চা বানিয়ে আনেন।  রাসেল সবাইকে কাপে চা ঢেলে দেন। মুনিমা মনে মনে ভাবে, প্রথম যখন চিফ রিপোর্টার পারভীন সুলতানা আপা প্রবীণ দিবসের এসাইনমেন্ট দেন মুনিমা খুব রাগ করেছিল। রেল বিট তার। মুনিমা সুলতানা একজন সফল রিপোর্টার। এরমধ্যে প্রবীণ দিবস কি করে আসে? চিফের উপর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ করেই সেই এসাইনমেন্টে সে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই অফিসের করা রিপোর্ট যে নিজের বাবা-মায়ের জীবনে এত উপকারে আসবে সে কল্পনাতেও ভাবেনি। 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবে, কাল ঢাকায় পৌঁছে চিফ রিপোর্টারকে একটা ধন্যবাদ জানাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //