ফিলিস্তিনি গল্প

ব্রেকিং নিউজ...উম্মু আহমাদ

তরুণ লেখক নাইরুঝ কারমুত একজন সাংবাদিক, লেখক ও নারী অধিকার কর্মী। ১৯৮৪ সালে দামেস্কের ইয়ারমুক শরণার্থী শিবিরে একজন ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালের অসলো শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে ১১ বছর বয়সে তিনি গাজা উপত্যকায় ‘ফিরে’ আসেন, এখন সেখানেই বাস করছেন। তিনি বর্তমানে নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। তিনি লিঙ্গ বিষয়ক সচেতনতা বাড়াচ্ছেন আর নীতি, আইন ও মিডিয়াতে নারীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা প্রচার করছেন। তিনি তার প্রথম সংগ্রহ ‘আবায়াহ আল-বাহার’ বা সমুদ্রের চাদর-এর জন্য ক্রিয়েটিভ উইমেনস অ্যাওয়ার্ড ও পেন পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেন। নাইরুঝের গল্পগুলো বিশ্বব্যাপী গল্পের স্থানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। নাইরুঝ কারমুত তার সাহিত্য প্রকল্প সম্পর্কে মিশরের আরবি গণমাধ্যম আল-আহরামকে বলেছিলেন, ‘আমি সাহিত্য করার পরিকল্পনা করিনি। বরং আমি বহু বছর ধরে রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছি, ফিলিস্তিনের মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। সাহিত্য রচনা প্রথমে শৈল্পিক ও নান্দনিক মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। আমার পূর্ববর্তী পেশাগত অভিজ্ঞতা আমাকে জীবন্ত বাস্তবতা থেকে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে যা একটি জীবন্ত থিয়েটার তৈরি করেছে।’ সমস্ত মানুষের মতো তিনি সংগ্রাম ও সংঘাত, সহিংসতা ও আগ্রাসন সত্ত্বেও মানবতার জয় আকাক্সক্ষা করেন। তিনি মিশরীয় নোবেলজয়ী লেখক নাগিব মাহফুজের লেখা দ্বারা প্রভাবিত। তিনি মনে করেন, সৃজনশীলতা নিজের বা অন্যের প্রতি পূর্বপক্ষপাত ছাড়াই জীবনকে উপস্থাপন করে। গল্পটি নাইরুঝ কারমুত-এর ‘উম্মু আহমাদ...খবরু আজিল’ মূল আরবি ভাষা থেকে সাম্প্রতিক দেশকালের শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগের জন্য রূপান্তর করেছেন- লেখক ও অনুবাদক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

রান্নাঘরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভোরের চড়ুইগুলো কিচিরমিচির শব্দে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। এই জানালাগুলো নতুন দিনের আলোয় মিলিত হচ্ছে। জানালা গলে আসছে সকালের সুবাস। সুবাসে মিশে আছে ভয়। যেটা হামলে পড়ছে উম্মু আহমাদের হৃদয়ে।

উম্মু আহমাদ রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে বাসন, কাপ ও চামচগুলো খুবই নিখুঁতভাবে ধুয়ে ফেলছেন। তিনি বিমান হামলা ও বোমার শব্দ টের পাননি। তিনি শুনছেন কল থেকে প্রবাহিত পানির শব্দ। সাবানের ফেনা নিয়ে চিন্তা করছেন। কাচের পাত্র ও পানির ফোঁটা সূর্যের রশ্মির সাথে তার কোমল চোখকে ভেদ করে। উম্মু আহমাদের গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে, তার পাত্রে পানির শব্দ মিশে যাচ্ছে।

তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পান। দালানগুলো জ্বলছে। হঠাৎ একটি দ্রুতগতির অ্যাম্বুলেন্সের শব্দে তিনি অবাক হয়ে যান। তিনি দেখেন গাড়িটি রাস্তার বাধা বিপত্তি পার করে ছুটে আসছে আর ভেতরে মেডিক্যাল টিম। রাস্তায় হ্যান্ডমাইক থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রতিরোধের জন্য একে অপরকে আহ্বান জানাচ্ছে।
-তুমি কি জানো কে মারা গেছে? কুকুরের বাচ্চারা চড়ুইপাখির মতো আমাদের সন্তানদের শিকার করছে।

ফোন বেজে ওঠে, উম্মু আহমাদ হাঁপাচ্ছেন, তার বোন ডাকছে:
-হ্যালো।
-হ্যালো, তুমি ঠিক আছ?
-আমরা ভালো আছি, তোমার সম্পর্কে আমাকে আশ্বস্ত করো।
-আমাদের চারপাশে বোমা বিস্ফোরণ, উম্মু আহমাদ আর আমি শিশুদের জন্য ভয় পাচ্ছি।
-কিসের জন্য অপেক্ষা করছ? বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের কাছে চলে আসো। আমাদের বাড়ি নিরাপদ।
-ঠিক আছে, আমি বাচ্চাদের জামাকাপড় পরিয়ে দিচ্ছি আর দেখছি কোনো গাড়ি আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে কিনা।
-সাবধান, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করুন।

উম্মু আহমাদ তার ছেলে আহমাদ ও তার দুই মেয়ে জেনিন আর ইয়াফাকে দেখছেন, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধের পর ঘুমিয়ে আছে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বিস্ফোরণ ও কাচ ভাঙার ভয়ে সারা রাত জানালা বন্ধ করা হয়নি। তারা তাদের বিছানা বিছিয়ে দিয়েছে। বাড়ির মাঝখানে, বিপদ থেকে দূরে থাকার জন্য তাদের ঘর ও বিছানা পরিত্যাগ করেছে, তবে বিপদ আসন্ন, তারা যতই দূরে থাকার চেষ্টা করুক না কেন।

তিনি ইউপিএস ব্যাটারিগুলো পরিচালনা করেন, যা ক্রমাগত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় বাড়িতে যাতে সামান্য আলো সরবরাহের ব্যবস্থা হয়। তিনি টেলিভিশনে হৃদয়বিদারক খবর দেখেন আর শুধুমাত্র কোথায় খবর সম্প্রচার হচ্ছে খোঁজেন। চ্যানেলের পর চ্যানেল টেপেন। তিনি বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের কথা শুনে যুদ্ধ কখন শেষ হবে তা অনুমান করতে চেষ্টা করেন।

-মানুষ মারা গেলে কথা বলে লাভ কী? কথা বলতে বলতে আমরা বিরক্ত।

আহমাদ জেগে ওঠে, তার কম্পিউটার ও সেলফোনের কাছে ছুটে যায়, তার মেসেজগুলো পড়ে। চোখ ধোয়, এখনো ঘুম ঘুম ভাব রয়েছে তার। নিজের সাথে কথা বলে:

-এরা কয়জন আক্রমণ করেছে, এটা কি সম্ভব যে তারা আমাদের দখলে আসবে? তারা অমুক অমুকের দালান আক্রমণ করেছে। হায়, ইবন অ্যালান শহীদ হয়ে গেল। অভিশপ্ত হোক তোমার বাবা, তুমি কুকুরের দুই সন্তান, আল্লাহ যথেষ্ট করুন। ও মা।
-কী খবর?
-খবর শুনেছ?
-আমি শুনলাম তুমি যা বললে আর কিছুই না। তোমার মুখ ও বাথরুমের দুর্গন্ধ একাকার। তাই এই ফোনটা রেখে পানি থামার আগেই গোসল করতে যাও, কিছু গরম পানি আছে।

তার বোন তার দুটো ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আসে, তাদের চোখ বিভ্রান্ত হয়, তাদের কণ্ঠস্বর বাধাগ্রস্ত হয়, তাদের শ্বাস কাঁপতে থাকে আর তারা ভয়ঙ্কর মিসাইলের শব্দে আতঙ্কিত হয়। তারা ঘরে প্রবেশ করে।
-ও উম্মু আহমাদ, ভয়ঙ্কর দৃশ্য, লাশ পড়ে আছে, রাস্তায় রক্ত, এই লোকেরা আল্লাহকে ভয় করে, পরাক্রমশালী আল্লাহ তাদের ও ক্ষমতাবানের ক্ষমতা নেওয়া থেকে রক্ষা করুন।
-গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তুমি ভালো আছো? আরাম করো, বোন আমার। আর বাচ্চাদের জন্য শক্ত থাকো।
-আল্লাহ ভরসা।

জেনিন জেগে ওঠে, তার পাশে তার বোন জাফাকে দেখে, ভয় পায় আর আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করে:
-জাফা ভালো থাকুক, আমি মরে গেলে কোনো সমস্যা নেই, তবে জাফা এখনো ছোট।

তার ফোন বেজে ওঠে, তার ফুপু কল করেছে :
-হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
-ওহ, ফুপু, ওয়ালাইকুম আসসালাম।
-ফুপু, আমাদের চারিপাশে বিপজ্জনক পরিস্থিতি।
-এখানে আশঙ্কাহীনভাবে আস, আমাদের বাড়ি নিরাপদ।
-ফুপু, তোমাদের বাড়ির রাস্তা অনেক লম্বা।

বাড়িটি গাজা শহরের কেন্দ্রস্থলে ছিল, সমুদ্রের ঢেউ আর বালির সুগন্ধযুক্ত। উম্মু আহমাদের বোন জেনিনের খালা উত্তরে বেইত লাহিয়াতে থাকতেন, আর জেনিনের ফুপু দক্ষিণে আল-কারারায় থাকতেন। সেখানে ট্যাংক, আর্টিলারি আর ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দ্বারা বোমাবর্ষণ করা জ্বলন্ত এলাকা ছিল, আর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রতিরোধ করছিল, আর সেখান থেকে অনুপ্রবেশ করছিল... ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো তাদের রক্ষা করেছিল। উম্মু আহমাদের বাড়ি সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজের গোলাগুলির শব্দে কেঁপে উঠছিল। দেয়াল, জানালা, বিছানা, চেয়ার, থালা-বাসন কাঁপছিল। তবে সেটা তার খালা আর মামার বাড়ির চেয়ে নিরাপদ ছিল।

জেনিন তার মায়ের কাছে ছুটে যায়, তাকে চুম্বন করে, উম্মু আহমাদ জেনিনকে জড়িয়ে ধরে, আর তার জন্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।
-ও মা, ফুপু আমাদের কাছে আসছে, ওদের বাড়ি নিরাপদ নয়।
-কষ্টের বাড়ি, এখানে হাজার হাজার বন্ধুতে ভরে গেছে, আল্লাহ‌র ইচ্ছা, তাদের আমাদের এখানে নিরাপদে নিয়ে আসবেন।

আবু আহমাদ আল-ফেদায়ি সাত বছর আগে একটি বেদনাদায়ক যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, আর তার স্মৃতি, তার কণ্ঠ ও তার ফিসফিসানি এখনো তার স্ত্রী উম্মু আহমাদ ও তার সন্তানদের মাঝে জীবন্ত। আসলে তার দুর্দান্ত স্মৃতি রয়েছে। একজন প্রচণ্ড যোদ্ধা, যিনি তার জমি ও তার নীতি-আদর্শ ত্যাগ করেননি। তিনি স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি কোনো চিন্তা ছাড়াই এটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, যেটা ছিল জীবনকে বোঝার একটি মসৃণ স্রোতের মতো। ফুপু তার তিন সন্তানকে নিয়ে আসে, তাকে শুভেচ্ছা জানায়, ঘাম ঝরছে, আর তার মাথা থেকে তার রুমাল খুলে নেয়:
-ও উম্মু আহমাদ, তুমি কোথায়? তুমি কি দেখতে পাচ্ছ যে তারা ফিলিস্তিনে কী করছে? হাসপাতাল ও স্কুলগুলো লোকে পূর্ণ। রেড ক্রস কী করতে চায়? আমি ভাবছি কীভাবে আমরা তোমার কাছে এসেছি। একটি নতুন অভিবাসনের খোঁজে মানুষ বাড়ি থেকে স্কুলে যাচ্ছে। দখলদারিত্ব আমাদের ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে আর বিশ্ব কোথায় দেখছে? আরবরা, পৃথিবীর অন্য দেশগুলো কোথায়? ওহে বান কি মুন!
-সাবধান, আমার বোন, আসো আমরা অবিচল থাকি, আল্লাহ আমাদের সাথে আর সত্য আমাদের সাথে।

গাজা উপত্যকা উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, একটি শক্ত কাঠামো, একটি সমতল সিমেন্টের পৃষ্ঠ। লোকেরা প্রায় জানালা দিয়ে কথা বলে, পানির অভাব, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আর খুব কম লোকই যাতায়াত করতে সক্ষম, তবে ফিলিস্তিনিরা এই উপত্যকাকে ভালোবাসে, আর তারা বলে, আল্লাহর কসম, এটি একটি বরকতময় দেশ।

হত্যা ও ধ্বংসকামী শত্রুদের লক্ষ্য থেকে আড়াল হয়ে সবাই এই বাড়িতে জড়ো হয়েছে। রমজান মাস। গ্রীষ্মের প্রচ- তাপ মনকে প্রজ্বলিত করে, দীর্ঘ সময় উপবাসের সময় থেকে শরীর শুকিয়ে যায়, তবু আশা যে তারা একটি মহান পুরস্কার পাবে। লোকেরা আল্লাহর উপাসনা করত, বিশ্বাস করত, প্রার্থনা করত, একগুঁয়েমিদের প্রতিরোধ করত, তারা ভয় করত। সবাই একমত তাদের চাই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র।

উম্মু আহমাদ তার ফুপু ও চাচার সাথে রান্নাঘরে প্রবেশ করলেন দীর্ঘ উপবাসের পর সেহরি তৈরি করতে। খাবারের প্রতি তাদের ক্ষুধা বেড়ে গেল। তারা অনেক দূরের স্বাদের জন্য, আরও সুন্দর কল্পনার জন্য, লুকিয়ে থাকা প্রেমের গল্পগুলোর জন্য, সমুদ্রের খোলের জন্য যার প্রতিধ্বনি দূরের স্মৃতি বহন করে। হেসে উঠলেন, বর্তমানে সংবিত ফিরলে রান্নাঘরের যন্ত্রপাতিতে আঘাত করলেন। উম্মু আহমাদ তার বোনের কাছে :
-আমি শপথ করে বলছি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে সূর্যাস্ত হয়েছে। আমার মাথা ঠিক করার জন্য আমি এক কাপ কফি আর একটি সিগারেট চাই। এই মাথাটি রাত করে জেগে থাকা, ঘুমের অভাব আর ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দে মারা গেছে। তোমার হাতে যা আছে তা ফেলে দাও আর আমি তোমাকে এক কাপ কফি প্রস্তুত করে দিচ্ছি।

যে মেয়েরা দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে, তাদের প্রিয় ডেজার্ট ডিশ তৈরি করতে বাড়ির মাঝখানে জেনিন ও জাফার সাথে জড়ো হয়েছিল। কাতায়েফ, একটি জনপ্রিয় মিষ্টি। যেটা এক ধরনের আচার। এটা আরবরা রমজান মাসে পছন্দ করে। 

তারা আতঙ্কিত ছিল। প্রতিটা মিসাইল আঘাতের সাথে সাথে নিচের মাটি কেঁপে উঠছিল। তারা পুনরায় কথা বলতে শুরু করল, হাসতে থাকল, সেখান থেকে পালানোর চেষ্টাও করল... যুদ্ধের কোলাহল, যুদ্ধের ভয়াবহতা- এখানে বা ওখানে টিভি চ্যানেলে সিরিজ দেখা, ব্যঙ্গাত্মক কমেডি বা রোমান্টিক নাটক দেখার আবেগ চুরি করে নিয়ে গেছে। 

বাচ্চা ছেলেরা পুরুষদের মতো যুদ্ধের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, আর তারা ফতোয়া জারি করে, বিশ্লেষণ করে। আর যে যা বলে তার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করার জন্য প্রতিযোগিতা করে। কণ্ঠস্বর উঁচু করে, তারা রেগে যায়, প্রতিরোধকে সমর্থন করে, আর এমনি এমনি মরতে অস্বীকার করে, তাই তারা যে কোনো সময় আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়। অনুভূতি আর চিন্তাভাবনা দিয়ে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতা করে। যাদের কাছে একটি অস্ত্র রয়েছে তারা শত্রুর সাথে লড়াইকে গ্রহণ করার মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে নেয়। যার কাছে একটি ছোট অস্ত্র আছে তা দিয়েও লড়াইয়ের মর্যাদায় খুশি। তারা একটি বিজ্ঞ নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখে- যে জানে কখন যুদ্ধ শুরু করতে হবে আর কখন এটি শেষ করতে হবে।

ছেলেরা আগেভাগেই পরিপক্ব হয়েছে। তাদের জীবনের কয়েক বছরে ধারাবাহিক যুদ্ধের সাথে কাটছে, যা তাদের জীবনের আনন্দ আর বেপরোয়া মানসিকতাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর তাদের পুরুষত্বের আবরণ ও প্রজ্ঞার পোশাক পরিয়েছিল।
-ও মা, আমরা কাঠকয়লা প্রস্তুত করতে শুরু করেছি, আমাদের একটি হুক্কা দরকার।
-ওরেম্মা, তোমার কত প্রশংসা?
-আহমাদ তোমার এক ভাই, একটু নয় দেখতে হুবহু তোমার বাবার মতো। আল্লাহ তোমার বাবার প্রতি রহম করুন।

কে বাসন ও চামচ আনবে আর কে তার পছন্দের পাত্র দিয়ে টেবিল সাজাবে তা বলে দেওয়া আছে।

আহমাদ তার চাচাতো ভাইয়ের প্রিয় সালাদ বাটি চুরি করে ঘরে ছুটে যায়, যখন তার কাজিন তাকে অনুসরণ করে :
-এটি তোমার জন্য, আর এটি তোমার জন্য নয়, আমার কাছে যা তুমি চেয়েছিলে।

তারা কুস্তি করে, হাসে আর আহমাদ প্লেটটা তার চাচাতো ভাইকে ফিরিয়ে দেয়।

মাগরিবের আজানের পর দরিদ্ররা গভীরভাবে প্রার্থনায় মগ্ন হয়। সবাই সতর্ক, শান্ত রাস্তায় কোনো মানুষ নেই, আপনি যা শুনছেন তা হলো গুঞ্জনের শব্দ ও থালা-বাসনের ঝনঝন শব্দ, অদ্ভুত বাতাস, সবার মধ্যে তীব্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণা।

রক্ত টেবিলে ঢেকে গেছে, খাবার ও পানীয়ের সাথে মিশে গেছে, সবাই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, হাসি অদৃশ্য হয়ে গেছে, পারিবারিক শব্দ নেই, নিরাপদ বাড়ির দেওয়াল নেই, ধোঁয়া আর ধুলোয় ঘরের সবকিছু ঢেকে গেছে, জানালা পড়ে গেছে, কাচ ভেঙে গেছে। .

টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ, পাখিরা তাদের প্রান্ত থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বিশ্ব উম্মু আহমাদের জানালার দিকে তাকায়। কিন্তু উম্মু আহমাদ বিশ্বের জানালা থেকে তার ঘর দেখতে পাননি, তিনি নিউজ বুলেটিন দেখেননি।

একটা মিসাইল যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। এটা ছিল জীবনের কান্নার সাথে খাবারের টুকরা। চিৎকার সম্পূর্ণ হয়নি। ফুপু-চাচা তাদের সন্তানদের বাঁচাতে পারেননি। মিসাইলের গতি যে কোনো কিছুর চেয়ে দ্রুত ছিল।

উম্মু আহমাদের বাড়ি নিরাপদ ছিল, যেমন তিনি সবাইকে বলেছিলেন। সবাই মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে এসেছিল, শুধু আরেকটি মৃত্যুর সাথে দেখা করতে। উম্মু আহমাদ তার স্বামীর স্মৃতি ও তার ভিটের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি সবাইকে রক্ষা করতে পারেননি।

অ্যাম্বুলেন্স ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা উম্মু আহমাদের বাড়িতে ছুটে যায়। তারা ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটে। তাদের জুতা রক্তে রঞ্জিত। আহমাদের হুক্কার কাঠকয়লা এখনো জ্বলছে। উম্মু আহমাদ তার ছেলের জন্য কাঠকয়লা পোড়াচ্ছিলেন। মাগরেবের আজানের পর ছোট মেয়ে তৃষ্ণার্ত মায়ের শিরা ভিজানোর জন্য এক গ্লাস পানি পান করাচ্ছিল। অনেকক্ষণ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকার পর উম্মু আহমাদ রান্নাঘরের জানালার নিচে ইয়াফাকে জড়িয়ে ধরেন। জানালা আর নেই। কাচ ছিল। তিনি আর আসমান একাকার হয়েছিল। ইয়াফা মারা যায়নি। তার চোখ অশ্রুসজল ও বিচলিত। সে কথা বলতে পারছিল না। তার মা উম্মু আহমাদ তাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। সবাই শহীদ হয়েছেন, আর উম্মু আহমাদ মারা গেলেও ইয়াফা মরেনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //