বালুচরি

প্রতিদিনের মতো আজও ঘাট থেকে স্নান সেরে বাড়ি ফিরল জয়দেব। আর আজও গঙ্গার কিছু জল ঘটি থেকে হাতে নিয়ে ছিটিয়ে দিল হ্যান্ডলুমটার ওপর। মিনমিন করে মন্ত্র উচ্চারণ করল। তাতে তার বিড়ি খাওয়া ঠোঁট মাকুর তারের মতো খিলখিল করল। তারপর গায়ে আরও একবার গামছা লাগিয়ে পরনের ধুতিটা বদলাল।

এসব নিত্যদিনের ব্যাপার জয়দেবের। ফারাক যেটা আজ দেখা গেল সেটা হলো চোখে। আজ গঙ্গার জলটা ছিটানোর সময় তার চোখ ছলছল করে উঠল। মেশিনটাকে একবার আলতো করে স্পর্শ করল জয়দেব। তার ভেতরটা কেমন নাড়া দিয়ে উঠল। বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল জয়দেবের, বাবা বলতেন, মেশিনটার সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ। আমাদের মান-ইজ্জত। ওর কষ্ট হলে আমাদেরও কষ্ট হয় রে। ঠাকুরদা শশী দাস চামার ছিলেন একজন গুণী তাঁতশিল্পী। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়ে বিশ্বখ্যাতি পেয়েছিলেন। সবাই বলেন, তার হাতে নাকি বিশ্বকর্মা এসে ভর করতেন। গায়ের জল শুকোলে হ্যান্ডলুমটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল জয়দেব। ফুঁক ফুঁক করে কয়েকবার টান দিল। তারপর গবগব করে ছাড়ল ধোঁয়া। সে ধোঁয়ার আউরিবাউরি তার মগজকে আবারো টোকা দিল, ‘আমার কিন্তু ওটা চাইই চাই।’ ‘পাগলি মেয়ে’ বলে ফিক করে হাসল জয়দেব। হাঁটু মুড়ে বসল। মেশিনটার কলকব্জায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করল, ‘আরেকবার তোকে বুনতে হবে রে। আরেকবার। তুই মুখ ফেরাস নে। আমার কথা শুনিস।’ 

তারপর হঠাৎ কিছু  একটা মাথায় খেলতেই জয়দেবের চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে গেল। কেমন একটা এতিম দৃষ্টিতে হ্যান্ডলুমটার দিকে তাকাল। এই প্রথম লক্ষ করল জয়দেব, মেশিনটাকে কতদিন ধোয়া মোছা হয়নি। ধুলো আর ঝুলে ভরে গেছে। অথচ এই মেশিনটা কতদিন তাদের পেটের ভাত জুগিয়েছে। পরনের কাপড় দিয়েছে। আর দিয়েছে বেঁচে থাকার সুখ। অথচ তার গায়ে আমি একটা ন্যাকড়া পর্যন্ত লাগাইনি! নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো জয়দেবের। দরজার ফাঁক দিয়ে ঠাকুরদার ঘরের দিকে চোখ পড়ল তার। দৃষ্টিটা এমন জড়সড়ভাবে পড়ল যেন জয়দেব ভয় পেল। লজ্জা পেল। কোন মুখ নিয়ে সে ঠাকুরদার ঘরের দিকে তাকাবে? সে তো বাপ-ঠাকুরদার কোনো সুনামই বয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বাবা ননী দাস চামারও ছিলেন গুণী তাঁতি। অথচ জয়দেব বাবা মারা যাওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই কারবারটা গুটিয়ে দিল! এখন শুধু হ্যান্ডলুমটা বেচতে যা বাকি। বললে বলল, ‘ওসব লোকসানের কারবার করে কী করব? বাঁচতে গেলে পেটে ভাত লাগে। ঐতিহ্য দিয়ে কী খাব?’ ছেলের কথাটা ভালো লাগেনি মৃণ্ময়ীর। তার মনে হয়েছিল, বেয়াড়া ছেলেটা বাপ-ঠাকুরদার ঐতিহ্যকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। মৃণ্ময়ী জানে, ঘাড় কাত ছেলে তার কথা মানবে না। উল্টো দশ কথা শুনিয়ে দেবে। তার বাপ-ঠাকুরদারা যে জমিজমা সম্পদ-সম্পত্তি কিছুই করে যেতে পারেননি, সে প্রসঙ্গ টেনে বাঁদরের মতো তিড়িংবিড়িং করে লাফাবে। তবুও মৃণ্ময়ী কথাটা বলেছিল, পেটে সন্তান ধারণ করেছে যে হকে সে হকের দাবি নিয়েই বলেছিল, ‘মহাজনের কাছে যা। দেখ না আরেকবার চেষ্টা করে, যদি কিছু  একটা সুরাহা হয়।’ 

নাহ, মহাজনের কাছে আর যায়নি জয়দেব। উল্টো দেমাগ নিয়ে বলেছে, ‘শশী দাস চামারের নাতি কারও কাছে হাত পাততে যাবে না। ট্যাঁকে টাকা না থাক রক্তে সম্মান তো আছে।’ সে আরও দৃঢ় হয়ে বলেছে, ‘গায়ে এখনো রক্ত আছে। হাড়ে মাংস আছে। খেটে খাব। তবুও পরের ওই মাতব্বরিতে খাব না।’ জয়দেব জানে, সে যতই এসব বলুক, তার শরীরে এখন মাংস কম। পাটকাঠির ওপরে গোবর লেপার মতো তার হিলহিলে শরীর। সামান্য ভারেই কঞ্চির মতো বেঁকে যায়। কণ্ঠার হাড় দুটো কানের লতিতে ঠেকব ঠেকব করছে। গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুললে তার বুকটাকে পুঁই মাচা মনে হয়। তার রক্তও টগবগে তাজা নেই। রক্তাল্পতা রোগ কামড় বসিয়েছে কবেই। লাল রঙ আধ মরা ফিকে। অথচ টাক মাথা, ডাহুক চোখ আর শ্যামা গায়ের ধমক কত! মৃণ্ময়ী বলে, ‘শুকনে ধমক।’ তবুও বেটা বাপ-ঠাকুরদার আলে ভেড়ে না।

দুনিয়ায় কি কাজের অভাব? গায়ে বল থাকলে হাল এমনিই চলে। সেই দেমাগ নিয়ে বাপ-ঠাকুরদার কাজ ছেড়ে কত কাজ করল জয়দেব। সদরঘাটের পারানি, চালের আড়তের মুটে, ট্রাকের খালাসি আর এখন টোটোর চালক। টোটোটা কিস্তিতে কেনা। মাস ছয়েক খাটিয়ে সে দেনা অবশ্য শোধ হয়ে গেছে। এখন জয়দেবই মালিক। যতদিন কিস্তিটা বকেয়া ছিল ততদিন তার বুকে বল ছিল না। সবসময় মনে হতো, এই বুঝি মহাজন ঘাড়ে হাত দিয়ে গাড়িটা থেকে নামিয়ে দিয়ে বলবেন, কিস্তিটা আগে শোধ কর তারপর গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত দিবি। এখন তার গাড়িটাকে বাপত্তির সম্পত্তি মনে হয়। ফ্রন্টের দু পাশ নতুন ফুল দিয়ে সাজিয়েছে জয়দেব। বামে-ডানে নতুন আয়না। প্যাসেঞ্জারদের ধরার জন্য বাহারি রঙের ধরাটি। দামি সিট কভার। টোটোটাকে তার স্বর্গরথ মনে হয়। তার এই টোটো চালানো নিয়ে মৃণ্ময়ী দুঃখ করে। বলে, ‘জগৎ জোড়া খ্যাতির কাজ ছেড়ে শেষে তুই ড্রাইভার হলি! আমি তো মরেও সুখ পাব না রে।’ জয়দেব তখন মাকে ঠেস মেরে বলে, ‘ড্রাইভারিটা হলো পেটের হিল্লে আর তোমাদের ওই লোকসানের খটখটে মেশিন টানাটা হলো খ্যাতির গিল্লে (গিল্লা)।’ কথাটা শুনে হাউমাউ করে উঠেছিল মৃণ্ময়ী। কথাটায় তার হৃদয়ে একটা বড়সড় ক্ষত হয়ে গেছিল। ‘খ্যাতির গিল্লে’ কথাটার চেয়ে ‘খটখটে মেশিন’ কথাটায় বেশি আহত হয়েছিল মৃণ্ময়ী। জয়দেব হ্যান্ডলুমটাকে হেয় করে ‘খটখটে মেশিন’ বলে। মৃণ্ময়ী জয়দেবকে ‘তাঁতটার ওপর তোর এত রাগ কেন রে?’ বললে জয়দেব বলে, ‘আমাকে নয়, পেটের খিদেকে জিজ্ঞেস করো।’ ছেলের হেঁয়ালি কথা মা বুঝতে পারলেও তার কিছুই করার নেই। ছেলের রোজগারই যে তার রিজিক।

‘পরের হাতের নয় কিন্তু তোমার নিজের হাতের বোনা চাই।’- কথাটা মনে হতেই ফিক করে হাসল জয়দেব। জয়দেবের বাপ-ঠাকুরদাদের বালুচরি শিল্পী হিসেবে খ্যাতির কথা শুনে হবু বউ একটা দাবি করেছে। বেনারসি নয়, বিয়েতে তার বালুচরি শাড়ি চাই। সে ইচ্ছের কথা তার এক কাছের লোক মারফত জয়দেবের কাছে পাঠিয়েছে মেয়েটি। সে শুনেছে এ শাড়িকে নিয়ে নানান মিথ-প্রবাদের কথা। ‘বেহেশতে যাওয়ার আগে বালুচরি পরিয়ে দেওয়া হয়’, ‘নবাবদের আংটির মধ্যে ঢুকে যেত একটা আস্ত বালুচরি’- ইত্যাদি নানান লোককথা। হবু বউয়ের মনের ইচ্ছেটা জয়দেবের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এ কি মুখের কথা? দশ-পনেরো হাজার টাকার হ্যাপা। কাঁচামালের যা আক্রা, দরে খরচ আরও বাড়তে পারে। তাছাড়া হ্যান্ডলুমটাকে নিয়েও চিন্তার ভাঁজ আরও বেশি জয়দেবের। কতদিন ধোয়া-মোছা নেই। তেল-মবিল দেওয়া নেই। যন্ত্র কি আর সুতো কাটবে না বুনবে? সেসব বেঠিক-ঠিক করতে গেলে আরও গুচ্ছের খচ্চা। সব মিলিয়ে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার ফ্যাঁকড়া। কিন্তু এ ইচ্ছে যে হবু বউয়ের। কথাটা ফেলবে কী করে জয়দেব। তার তো ভেতরে ভেতরে একটা অন্য আনন্দ হচ্ছে। বউয়ের প্রথম ইচ্ছে পূরণ করতে পারলে যে সে কলির কৃষ্ণ হয়ে উঠবে। কিন্তু টাকা? হাতে যা ছিল টোটোর দেনাটা পরিশোধ করতেই তো শেষ হয়ে গেল। এখন দিন আনা দিন খাওয়া রোজগার। তারপরে টোটোর উপার্জনও কমেছে। যান কম বাহন বেশি। সব ঘাটের লোক যে এক ঘাটে এসে ভিড়েছে। হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে ঠাকুরদার পুরস্কারের পদকটায় চোখ পড়ল জয়দেবের। মাকুর পুরনো সুতোগুলো টান হয়ে যেখান দিয়ে ঝুলে আছে তার গা ছুঁয়ে দৃষ্টিটা ঢুকল। পদকটা দেখেই তার চ্যাপ্টা নাক ডাহুক চোখ আর মোটা টাক মাথায় একটা দুষ্টু মতলব খেলে উঠল।

দুই

ফেরিঘাটের ধাপিতে বসে দু দুটো বিড়ি ফুঁকল জয়দেব। একটা শেষ হলে আরেকটা। তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে ভাগীরথী। ওপারে আজিমগঞ্জ জংশন। ট্রেন আসা-যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে মিহি করে। নদীর জলের দিকে তাকাল জয়দেব। স্রোতস্বিনী নদীর বুকে খোঁজার চেষ্টা করল বাবা-ঠাকুরদার অস্থিভস্ম। এই ধাপিতে দাঁড়িয়েই বাবা ননী দাস চামারের অস্থিভস্ম ভাসিয়েছিল জয়দেব। সেসব অস্থিভস্মের কোনো কিছুই না দেখতে পেয়ে জয়দেব মনে মনে বলল, সবকিছুরই একদিন প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তারপর হয় ধুলো আর না হয় ভস্ম হয়ে যায়। জয়দেব, নদীর সামনের দিকে ভেসে চলে যাওয়া একটা স্রোতকে উদ্দেশ করে বলল, ওই স্রোতটা কি আর কখনো পেছনে ফিরে আসবে? আসবে না। মানুষকেও এভাবে সামনের দিকেই এগিয়ে যেতে হয়। অত পিছুটান থাকলে চলে না। হুট করে বিড়ির শেষাংশটা নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে পড়ল জয়দেব। পাড়ে উঠে হাঁটা দিল রাস্তায়। লুকিয়ে-ছুপিয়ে প্রথমে জৈন মন্দিরের গলিতে ঢুকল। তারপর শপিংমলটার পাশ দিয়ে বিশ্বনাথ আঢ্যর দোকানে। ‘আঢ্য জুয়েলারস’ এই সোনাপট্টির সবচেয়ে বড় দোকান। সেকরা বিশ্বনাথ আঢ্য সোনার বড় মহাজন। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করল জয়দেব। এই প্রথম তার হাত কাঁপল। কাঁপা হাতেই জিনিসটা বিশ্বনাথ বাবুর হাতে দিল জয়দেব। কাগজের মোড়ক খুলতেই বিশ্বনাথ বাবুর চোখ কপালে উঠে গেল! এ কী দেখছেন তিনি! তারপর চোখ কটমট করে জয়দেবের দিকে একবার তাকালেন। জয়দেব তার আগের চেনা। গুণী বাপের ফেরালি ছেলের কিত্তি দেখে চোখজোড়া আরও ট্যারা করলেন বিশ্বনাথ আঢ্য। জিজ্ঞেস করলেন, “কী করতে হবে বলো?” 

‘বেচব। কত দাম হবে দেখুন,’ বলল জয়দেব। এবার তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। জয়দেবের কথা শুনে, চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো বিশ্বনাথ বাবুর। তিনি ভেবেছিলেন, জয়দেব হয়তো বলবে, জেঠু কিছুদিনের জন্য এটা বন্ধক নিন। ধারদেনায় ডুবে গেছি। পরিশোধ করতে হবে। হাতে টাকা গুছলেই ছাড়িয়ে নেব। কিন্তু জয়দেব এ বলছে কী! সে তার বাপ-ঠাকুরদার এত বড় সম্মানকে বিক্রি করবে! বিশ্বনাথ বাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেচবে কেন গ?’ জয়দেব বলল, ‘টাকার দরকার।’

‘তাই বলে বাপ-ঠাকুরদার এত বড় সম্মান বেচবে?’ নাকের ডগায় নেমে আসা রিমলেশ চশমার ওপর দিয়ে হাঁ করা দৃষ্টিতে জয়দেবের দিকে তাকালেন বিশ্বনাথ বাবু। জয়দেব পাষাণের মতো বলল, ‘সম্মান কি ধুয়ে ধুয়ে খাব? পেটে খিদের টান পড়লে টাকা লাগে, টাকা। ওসব সম্মানটম্মানে হয় না।’

বিশ্বনাথবাবু আর কথা বাড়ালেন না। তিনি জানেন, এ সোনার পদকটা তিনি না কিনলে অন্যরা লুফে নেবে। তারপর সেটা ভেঙে নানান কিসিমের গয়না বানাবে। বারোছিরি দশা হয়ে পদকটার দুনিয়াদারি ঘুচে যাবে। বিশ্বনাথ বাবুর কাছে এ পদকটা যে নেহাতই কিছু  সোনা নয়? এ পদকটা হলো এ গঞ্জ-শহরের শান। মান ইজ্জত। এ জন্য তাদের কত গর্ব হয়। শশী দাস চামারকে নিয়ে তাদের কত অহঙ্কার। এ পদক তাদের এই জিয়াগঞ্জ, যার ভূতপূর্ব নাম বালুচর, সেই শহরের দেশ জোড়া পরিচিতি এনে দিয়েছে। সেই পদককে ননীর ফেরালি বেটা বাজারে বেচছে! হুট করে মাথায় কি একটা খেলতেই বিশ্বনাথবাবু বললেন, ‘দাও, ওজন করে কত দাম পড়ছে দেখি।’

তিন

ঝিম মেরে থাকা ঘরটায় হঠাৎ ‘খট’ ‘খট’ শব্দ ভেসে উঠল! সে শব্দ জানালা-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে অন্য ঘরেও গেল। সে শব্দ শুনে মৃণ্ময়ী ‘ধেই’ করে উঠল। তার ভেতর ধিন ধিন করে উঠল। এ তো হ্যান্ডলুমের শব্দ! এ শব্দ কি চিনতে কখনো ভুল হয় মৃণ্ময়ীর? এ শব্দ যে তার চিরচেনা। ননী দাস চামার যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুইয়ে থাকতেন তখন মৃণ্ময়ী বলত, ‘বাড়িটা কেমন মরা মরা লাগছে গ!’ মৃণ্ময়ী বলত, ‘আমার আত্মার দুটো শব্দ, একটা হার্টের আর একটা হ্যান্ডলুমের। যে কোনো একটা থেমে গেলেই আমার মৃত্যু হবে।’ মৃণ্ময়ীর মন আর স্থির থাকল না। ‘খট’ ‘খট’ শব্দটা যেখান থেকে আসছে সেখানে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। যেন তার হার্টের ভেতর ব্লক হয়ে যাওয়া মন্দ চর্বিটা কেউ ছাড়িয়ে দিয়েছেন! তরতাজা হয়ে উঠছে শরীর-মন। কলকব্জায় তেল-মবিল দিয়ে এক দশক পরে হ্যান্ডলুমটায় হাত দিয়েছে জয়দেব। তাঁতঘরের দরজায় ছুটে এলো মৃণ্ময়ী। ছেলের কিত্তি দেখে খুশিতে ডগমগ করে উঠল। মাটিতে থাকবে না আকাশে উড়বে ঠিক পেল না। তাহলে ছেলের মতি ফিরেছে? আবার কতদিন? রক্তে তো সেই তাঁত বুননই বইছে? মনে মনে মৃণ্ময়ী শর্মিষ্ঠাকে ধন্যবাদ দিল। হবু বউ দাবি করেছিল বলেই তো ছেলের আজ তাঁত মেশিনে হাত দেওয়া। মৃণ্ময়ী দেখল, ছেলের কাঁধের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন ঠাকুরদা শশী দাস চামার। হাত দিয়ে সুতো টেনে দিচ্ছেন বাপ ননী দাস চামার। ভোরের মিষ্টি রোদ জানালার ফাঁক গলে ঠিকরে পড়ছে ছেলে জয়দেবের মুখে। সে রোদে তার তামাটে মুখটা হিরের মতো জ্বলছে। সে রৌদ্র হাসি তখন মৃণ্ময়ীর চোখে-মুখেও।

রাত-দিন এক করে শাড়িটা বুনল জয়দেব। জিয়াগঞ্জের বালুচরি। পাড়ে রামায়ণের কাহিনি। আঁচলায় প্রকৃতির নিসর্গ। সে শাড়ি পরে বাড়ির বউ হয়ে এলো শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠাকে মনে হলো স্বর্গের কোনো দেবী। রূপে মোহিত হয়ে যাওয়া জয়দেব কিছু একটা বলতে যাবে অমনি শর্মিষ্ঠা আঁচলার ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে জয়দেবের চোখের সামনে ধরল। জয়দেবের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল! এ তো ঠাকুরদার সেই পদক! যেটা আমি কয়েকদিন আগে আঢ্য জুয়েলার্সে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। শর্মিষ্ঠার হাতে কী করে এলো! জয়দেব কিছু  জিজ্ঞেস করার আগেই শর্মিষ্ঠার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মৃণ্ময়ী বলল, ‘এটা শর্মিষ্ঠার কৃতিত্ব। তাছাড়া বিশ্বনাথবাবুরও উপকার অনেক। তিনি এটা আমাকে কোনো টাকা না নিয়েই ফেরত দিতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, এটা হলো আমাদের গঞ্জের ইজ্জত। একে সামলে রেখো ননীর বউ। আমি সেটা বিনামূল্যে ফেরত নিতে চাইনি। কিন্তু অত টাকাই বা পাই কোথায়। শেষে সব শুনে এগিয়ে এলো শর্মিষ্ঠা। ও বলল, মা, আমার কাছে কিছু টাকা আছে। বাকিটা আপনি দিয়ে সেকরার পাওনাটা মিটিয়ে দেন। আমি আমার কানের দুলটা বেচে দিলাম।’ চোখ ছলছল করে উঠল মৃণ্ময়ীর। ‘আমার কিন্তু আরও একটা দাবি আছে তোমার কাছে’, জয়দেবকে উদ্দেশ করে বলল শর্মিষ্ঠা। ‘আবার কী দাবি!’ কৌতূহলের সঙ্গে বলল জয়দেব। শর্মিষ্ঠা বলল, ‘একটা অদল-বদল।’

‘অদল-বদল!’ শর্মিষ্ঠার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না জয়দেব। শর্মিষ্ঠা ঠোঁটের ফাঁকে আলতো হাসি এনে বলল, ‘গুচ্ছের খরচ হবে কিন্তুক।’

‘খরচ!’ জয়দেবের ভ্রুগুলো টান হয়ে উঠল। বলল, ‘আর কী বেচব? শরীরের এই হাড়-মাংসগুলো ছাড়া বেচার তো কিছুই নেই?’

‘কিচ্ছু  বেচতে হবে না,’ শর্মিষ্ঠার ঠোঁটের হাসিটা কিছুটা রহস্যময় হলো। জয়দেব বলল, ‘এই বলছ অনেক খরচ আবার বলছ কিচ্ছু  বেচতে হবে না। তো টাকা কোথা থেকে পাব? কোনো শালা পাঁচ নয়া মাগনা দেবেন না।’ জয়দেব খিচখিচ করে উঠল। শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারল, মানুষটা রেগে যাচ্ছে। এবার আর হাসল না। পাকা গিন্নির মতো বলল, ‘হিল্লে করতে গেলে গিল্লা করতে হয় না। মগজ আর দেহ খাটাতে হয়।’ 

‘অত ভণিতা না করে আসল কথাটা বলো দেখি এবার,’ জয়দেব অধৈর্য হয়ে উঠল। ‘রাগবে না?’ শর্মিষ্ঠা বলল। ‘না’, জয়দেব ভার মুখে জোর করে হাসি নিয়ে এলো। ‘একটা পাওয়ারলুম,’ কোনো আমতা-আমতা না করেই কথাটা বলল শর্মিষ্ঠা। ‘পাওয়ারলুম!’ আকাশ থেকে পড়ল জয়দেব। বলল, ‘পাওয়ারলুমে কী হবে?’

‘তাঁত বুনবে,’ সহজ করে বলল শর্মিষ্ঠা। জয়দেব বলল, ‘একটা পাওয়ারলুমের দাম কত জানো? তোমার কোনো ধারণা আছে?’ নতুন বউ তাই মাথা ঠান্ডা রেখেই কথাগুলো বলল জয়দেব। দশ-পনেরো বছরের পুরনো বউ হলে এতক্ষণে কাঁচা খিস্তি দিত। সেরকম হলে, চুলের মুঠি ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দিত। ‘ধারণা ছিল না। ধারণা নিয়েছি,’ শর্মিষ্ঠা যেই বলল অমনি জয়দেব থড়বড় করে বলল, ‘ধারণা নিয়েছ! কোথায়? কার কাছে?’

-বাবার কাছে।

-তোমার বাবার কাছে!

-হ্যাঁ, ঘাড় হেলাল শর্মিষ্ঠা। জয়দেব জানতে চাইল, ‘আর কী কী জেনেছ তোমার বাবার কাছ থেকে?’

-বাঁকুড়ায় আমার বাবার এক আত্মীয় আছেন। তিনিই খোঁজটা দিয়েছেন।

-কীসের খোঁজ?

-পাওয়ারলুমের।

-বাঁকুড়ায় পাওয়ারলুম! তো আমি কী করব?

-তুমি চালাবে। এই তাঁতঘরে বসে চালাবে। তাঁতঘরটার দিকে তাকাল শর্মিষ্ঠা। তারপর বলল, ‘বাবা পাকা কথা বলে নিয়েছেন। দাম খুব বেশি পড়ছে না। হাফ দামে দিয়ে দেবেন বলে দিয়েছেন।’

-কী বলছ! আমি আগাপাস্তলা কিছুই বুঝতে পারছি নে। জয়দেব শর্মিষ্ঠার দিকে তাকাল। শর্মিষ্ঠা ঠোঁটের ফাঁকে আবারো সেই হাসিটা আনল। বলল, ‘বাবা ঠিক করেছেন, বাঁকুড়ায় সস্তা দামে পাওয়া পাওয়ারলুমটা কিনে আমাদের দেবেন। তুমি তো বিয়েতে কিছুই দাবি করনি। তাই ওটা তোমাকে দেবেন।’

-কিন্তু অত টাকা তোমার বাবা কোথায় পাবেন? জয়দেব প্রশ্ন করল। শর্মিষ্ঠা বলল, ‘বাবা, আমাদের গ্রামের বাড়ির জমিটা বিক্রি করে দিয়েছেন। এমনিতেই জমিটা পর হাতে থেকে থেকে বেহাতি হতে বসেছিল।’

-তুই আবার তাঁত বুনবি। তবে আর হ্যান্ডলুমে নয়, পাওয়ারলুমে। আমি যে এবার মরেও সুখ পাব রে। স্বর্গে গিয়ে তোর বাবাকে বলব, ওই দেখ, শুনতে পাচ্ছ, আমাদের তাঁতঘর থেকে মেশিনের ‘খট’ ‘খট’ শব্দ ভেসে আসছে! মৃণ্ময়ী আবেগি হয়ে উঠলেন। জয়দেব বলল, ‘তাহলে, হ্যান্ডলুমটার কী হবে?’

-ওটা কোম্পানির লোকেরা এসে নিয়ে যাবেন। বাবা বলেছেন, শর্মিষ্ঠা বলল। জয়দেব দেখল, মা মৃণ্ময়ীর পিছনের দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরদা শশী দাস চামার ঠোঁট টিপে হাসছেন। আর দেখল মা মৃণ্ময়ীর গাল বেয়ে নামছে অশ্রু। মৃণ্ময়ী অনেক দিন পর খুশিতে কাঁদল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //