রাই

জ্ঞান হওয়া ইস্তক রাই শুনে আসছে, ও দেখতে ভালো না। রঙ ময়লা, মুখের গড়নটাও কেমন চৌকোপানা। চোখ, নাক, ঠোঁট, কান-সব মিলিয়ে মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। থাকার মধ্যে মাথায় বেশ ঘন কোঁকড়া চুল আছে। এতই কোঁকড়া যে গুটিয়ে কাঁধ অবধি হয়ে থাকে, টানলে পিঠ ছাড়ায়।

খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে রাই। ওর বাবা হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে কাজ করে। মা আগে হাতে সোয়েটার বুনে কিছু রোজগার করত। বাতের ব্যথার কারণে এখন আর পেরে ওঠে না। হাতের আঙুলের গাঁটে গাঁটে ব্যথা। ফলে উল বোনা ভেগে গেছে।

রাই একটাই সন্তান তাই রক্ষে। একাধিক সন্তান লালন-পালন করা সম্ভব হতো না রমেশের পক্ষে। সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করে রাই। সেকেন্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক পাস করে ইলেভেনে পড়ছে।

স্কুল ছুটি হলে চার-পাঁচজন বন্ধু একসঙ্গে ফেরে ওরা। রাইয়ের বন্ধুরা সবাই ওর তুলনায় দেখতে ভালো। কিন্তু বন্ধুরা কেউই কোনোদিন রাইকে এ বিষয়ে একটা কথাও বলেনি। ওরা খুবই ভালো।

সায়নী বরং অন্যান্য বিষয়ে উৎসাহ দেয় রাইকে। ভালো ছবি আঁকে রাই। স্কুল ম্যাগাজিনে সায়নী জোর করে রাইয়ের আঁকা ছবি নিয়ে জমা দিয়েছিল। সেই ছবি ছেপে বেরিয়েছিল। তারপর থেকে স্কুলেরই নার্সারিতে পড়া দুটো বাচ্চার ছবি আঁকা শেখানোর টিউশন পায় রাই।

প্রায়ই সায়নী রাইকে বলে, ‘তুই এরকম গুটিয়ে থাকিস কেন রে? তোর অসুবিধের কথা আমাকে বল না, আলোচনায় সব সমস্যার সমাধান হয়।’

রাই হাসে। বলে, ‘এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই রে। যত দিন বাঁচব, সমস্যা সমস্যাই থাকবে। শত আলোচনাতেও এর সমাধান হবে না, বুঝলি?’

‘বাব্বা, কী এমন সমস্যা রে যার সমাধান নেই! আমাকে বলে তো দেখ।’

“নাহ, বাদ দে। শোন না, শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’ এসেছে, যাবি দেখতে?”

‘টিকিট কত করে? ব্ল্যাক হচ্ছে তো শুনলাম।’

‘বাবাদের দোকানে একটা ছেলে কাজ করে যার বাবা চালচিত্র সিনেমা হলের টিকিট চেকার। ও নাকি বাকিদের বলে টিকিট লাগলে ওকে বলতে, ব্যবস্থা করে দেবে। তুই রাজি থাকলে বাবাকে বলব। একা একা সিনেমা দেখতে আমার ভালো লাগে না।’

‘চল তাহলে। ব্ল্যাক না হলেও টিকিটের বেশ দাম। গায়ে লাগে।’

সায়নীর কথায় ম্লান হেসে রাই বলে, ‘তোর তো গায়ে লাগে, আমার তো ফোস্কা পড়ে। অনেক দিন ধরে ভাঁড়ে টাকা জমাচ্ছি বুঝলি। মনে হয় টিকিটের দামটা উঠে যাবে। আজ বাড়ি ফিরে ভাঁড়টা ভাঙব। শাহরুখকে আমার বড্ড ভালো লাগে যে!’

‘ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোর যেন শাহরুখের মতো বর হয়।’

‘ধ্যাত! বহুত বাজে বকছিস কিন্তু সায়নী। তোর মনে হয় বিয়ের শখ হয়েছে। হিহিহিহি।’

‘তোর কথাটা একেবারে নাকচ করছি না, বিয়ের শখ তো আছেই। তবে এখনই নয়, আগে পড়াশোনা শেষ করে কিছু রোজগারপাতির ব্যবস্থা করি, তারপর বিয়ে করব। আমি বিয়ের কথায় তোর মতো ওরকম ধ্যাত ধুত করি না।’

‘এক কাজ করি বুঝলি, টিকিট কত করে পড়বে বাবাকে বলি জেনে আসতে। তারপর ঠিক করব যাব কি না।’ কথার অভিমুখ ঘুরিয়ে দেয় রাই। মনে মনে বলে, শাহরুখ খানের মতো দেখতে কোনো ছেলের বয়েই গেছে আমার মতো কুচ্ছিত দেখতে মেয়েকে পছন্দ করতে। ওসব দিবাস্বপ্ন না দেখাই ভালো।

বাড়ি ফিরে ভাঁড় ভেঙে রাই গুনে দেখে ২৪৭ টাকা জমেছে। সিনেমার টিকিট হয়ে কিছু টাকা বেঁচে যাবে। সায়নীর যদি দরকার হয় তো ওকেও ধার দিতে পারবে। আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে ভেতরটা।

পরদিন সময়ের আগেই ঘুম ভেঙে যায় রাইয়ের। বাইরে তখন গফুরচাচার মোরগটা সবে ডাকতে শুরু করেছে। এখন ওর ঠাকুমা ছাড়া আর কেউই ওঠেনি, জানে রাই। অন্যদিন রাইও মোটেই এই সময়ে ওঠে না, আজ ‘জওয়ান’ দেখতে যাওয়ার উত্তেজনায় ঘুম ভেঙে গেছে।

সিনেমা দেখে বেরিয়ে রাই খুব খুশি। দারুণ লেগেছে ওর। সায়নীর হাত খামচে ধরে জিগ্যেস করে, ‘কেমন লাগল তোর? দুর্দান্ত না?’

রাইয়ের কথায় হেসে ফেলে সায়নী। ‘প্রশ্নও তুই করছিস, উত্তরও তুই দিচ্ছিস। তাহলে আমি আর কী বলব বল!’

‘শাহরুখ কী অসম্ভব ভালো বল? এই বয়সেও কামাল করে দিচ্ছে। উফ্, পারি না আর!’ নিজের দু হাত জোড় করে বুকের কাছে এনে চোখ বন্ধ করে বলে রাই।

‘কাছে পেলে খুব আদর করতিস, না রে?’ সায়নীর কথায় থমকে যায় রাই। থমথমে হয়ে ওঠে চোখমুখ। বলে, ‘কী যে বলিস সায়নী। আমি পাব শাহরুখকে? ওর বাড়ির কুকুরও আমার দিকে তাকিয়ে দেখবে না।’

‘যা-ই বলিস রাই, শাহরুখ যে বড় অভিনেতা সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ঠিকই কিন্তু চেহারা খুবই সাধারণ। ওর থেকে আমাদের পাড়ার বাপ্পীদাকে দেখতে ঢের ভালো। তবে হ্যাঁ, নিজেকে প্রেজেন্ট করতে জানে শাহরুখ। কী কী করলে দর্শক পছন্দ করবে, সেটা খুবই ভালো বোঝে। আর জানে নিজেকে ভালোবাসতে।’

‘অ্যাঁ? নিজেকে ভালোবাসতে জানা আবার কী রে?’

‘নিজেকে ভালোবাসতে হয় তো, জানিস না? আমরা সব্বাই নিজেকে ভালোবাসি রে।’

‘ভাগ, বাজে কথা। আমার তো নিজেকে সহ্যই হয় না। আয়নায় নিজের মুখ দেখলেই বিরক্ত লাগে।’

‘ধর এখনই আমাদের সামনে একটা বোম পড়ল। তুই কী করবি? দাঁড়িয়ে থাকবি? মোটেই না, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালাবি। নিজেকে বাঁচাতেই তো পালাবি। তার মানে তুই নিজেকে ভালোবাসিস। সবাই বাসে রে।’

‘সেটা তো বিপদে পড়লে অটোমেটিক্যালি হয়, তার মানে কি নিজেকে ভালোবাসা? আমি তো একটুও বাসি না।’

‘তাহলে ভালোবাস নিজেকে। নিজেকে ভালোবাসলে বিরক্তি কমে যায়, ভালো থাকা যায়, অন্যদেরও ভালো রাখা যায়।’

‘বাব্বা, এত জ্ঞান তোর কোত্থেকে হলো রে? তুই যে এত পণ্ডিত তা তো জানতাম না।’

‘এগুলো আমার কথা নয় রে। আমার এক দাদু আছেন যিনি সন্ন্যাসী। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসেন। খুব সুন্দর কথা বলেন। এসব ওনারই কথা।’

দুর্গাপুজোর আর কুড়ি দিন বাকি। রাইয়ের বন্ধুদের সবার পুজোর বাজার কমপ্লিট। রাই কিছুই কেনেনি এখনো। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ওর জন্মদিন ছিল। মা পাঁচশ টাকা হাতে দিয়েছিল। রাইয়ের জমানো দুইশ টাকা মিলিয়ে লাল-সবুজের কম্বিনেশনে একটা সালোয়ার-কুর্তা কিনেছিল রাই।

কাপড়টা পুরো সুতি নয়, মিক্সড। ওই দামে পিওর কটন হয় না সেটা জানে রাই। এর বেশি কেনার ক্ষমতাও নেই, ইচ্ছেও নেই রাইয়ের। কী হবে সেজে! সাজলে কি আর চেহারা বদলাবে! সারাক্ষণ রাইয়ের এই কথাটাই মাথায় ঘোরে।

আজ মহালয়া। রাইদের পাড়ার ক্লাবে প্রতিবছরই মাইকে মহালয়া চালায়। সারা পাড়ার লোক শোনে। বেশ ভালো লাগে ব্যাপারটা। আজও ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ কানে আসতেই ঘুম ভেঙে গেল রাইয়ের। উঠে বসল বিছানায়। একেবারে গোড়ার শঙ্খধ্বনিটা মিস করে গেছে। মন দিয়ে শুনতে লাগল।

অন্যবার কিছুটা শোনার পর ঘুমিয়ে পড়ে। আজ যেন শরীর মনে একটা আলোড়ন হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন নিজেই দুর্গা। সম্পূর্ণ মহালয়ার গীতি আলেখ্য শুনল রাই। ভোরের আলো ফুটেছে। গফুরচাচার মোরগ ডাকতে শুরু করেছে।

বিছানা থেকে নেমে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল রাই। নিজের চোখের দিকে নজর গেল। চোখ দুটো তো খুব খারাপ নয় ওর। বেশ টানা টানা। অনেক পুরনো কাজল পেন্সিল টেনে বের করল টেবিলের ড্রয়ার থেকে। চোখে কাজল লাগাল। বাহ, ভালোই তো লাগছে। একটা টিপ আর লিপস্টিক হলে ভালো হতো।

ঠোঁটের গড়নটা অনেকটা বাংলার নায়িকা সুমিত্রা মুখার্জির মতো লাগছে। হেসেই ফেলল সে। দাঁতের সারিও তো সমান একদম। সর্বাণীর দাঁতগুলো কেমন এবড়োখেবড়ো। টিপ মায়ের কাছে পাওয়া যাবে কিন্তু লিপস্টিক...

‘অ্যাই রাই, ষষ্ঠীর দিন ঠাকুর দেখতে যাবি, কাছাকাছিই যাব, মানে পায়ে হেঁটে যতটা ঘোরা যায়। বাকি দিনগুলোতে ভয়ঙ্কর ভিড় হবে। যাবি?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব। সায়নী, তোর কাছে বাড়তি লিপস্টিক হবে? আমার তো একটাও নেই। আমি আবার ফেরত দিয়ে দেব তোকে।’

‘ও হরি! এ তো ভূতের মুখে রাম নাম দেখি! হবে হবে, দেব তোকে। সুন্দর করে সাজবি বলে দিলাম। না হলে কিন্তু...।’

লজ্জায় রাঙা হয়ে রাই জবাব দেয়, ‘সাজব।’ গতকাল ভোররাত থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শুরু করেছে রাই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //