তেরোই আগস্ট

শোভারানীর দেহটা জ্বলন্ত চুল্লির ভেতর ঢুকিয়ে সশব্দে ধাতব দরজাটা বন্ধ করতেই একটু কেঁপে উঠল ঐশীর পঁয়তাল্লিশ বছরের সুঠাম দেহটা। গত তিন মাস ধরে সবই তো নিজের হাতে করেছে ঐশী। তবে এখন কেন তুলে দিতে হলো মাকে অন্য কারও হাতে? রূপসা ঐশীর অন্তরঙ্গ বন্ধু, শরীরের সর্বশক্তি আর ভালোবাসার তীব্র আবেগ দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিল ঐশীকে।

জেলখানার গরাদের মতো লোহার গেটটা মুঠোয় ধরে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়েছিল ঐশী। তার একবুক যন্ত্রণা তীব্র অভিমান আর ক্লান্ত অবসন্ন মনের পরতে পরতে জমে ছিল গভীর বিক্ষোভ। নাহ্ পারেনি ঐশী নিজের ইচ্ছেপূরণ করতে। রক্ষণশীল সমাজ ধর্মান্ধ আত্মীয় পাড়াপড়শির বিদ্রুপ বাণ বাঁকাচোরা কটু মন্তব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজের মা’র পারলৌকিক কাজের সব সিদ্ধান্ত একার হাতে তুলে নিতে পারেনি ঐশী। পারেনি এতখানি বিদ্রোহী হতে। রূপসা বুঝিয়েছিল ঐশীকে, ‘এখন ওইরকম বিদ্রোহ করার সময় নয়। মেনে নে ঐশী।’

‘আশ্চর্য ! রূপসা তুইও বলবি মেনে নে? কোনটা মেনে নিইনি বল তো? জীবনের সব কিছু মানতে মানতে আমার তো নিজস্ব আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আপস করতে করতে নিজের জীবনটার মানেই যে খুঁজে পাই না মাঝে মাঝে। আমার গোটা অস্তিত্বটাই কি অন্যের মন রাখার জন্য? আমার মন কী চায় আমি কিসে খুশি হব জানতে চাইবে না কেউ কোনোদিনও?’ ঐশীকে খুব উদ্ভ্রান্ত আর অশান্ত দেখাচ্ছিল। রূপসা সবটুকু স্নেহ উজাড় করে আগলে রাখে ওকে। 

টানা সাতসাতটা দিন উদয়াস্ত হাসপাতাল-ঘর, রক্ত জোগাড়, ওষুধ-পথ্য, ডাক্তার বদ্যি করার পর ঐশী যেদিন বুঝল যে ডাক্তারদেরও আর কিছু করার নেই, সব চিকিৎসা ফুরিয়েছে সেদিনই মন শক্ত করে অফিসে গেছিল ঐশী। সকালেও অর্ধ-অচৈতন্য মাকে একবার চোখের দেখা দেখে এসেছিল। কিন্তু মরণশীল মানুষ বোধহয় এভাবেই পরম আপন আত্মজের মায়া কাটায়। ঠিক যে মুহূর্তে ঐশী চোখের আড়াল হলো শোভারানীর জৈবিক দেহ থেকে প্রাণবায়ুটি চিরতরে অন্তর্হিত হলো।

ইদানীং জড় সংসারের সব মায়া-মতিভ্রম পিছুটান অনেকটাই ফিকে করে দিয়েছিলেন শোভারানী। এখন সব বাঁধন ছিঁড়ে একলা পাড়ি দিলেন অন্তহীন শূন্যে। পেছনে পড়ে রইল তার প্রিয়জন, আত্মীয়-পরিজন, ভালোবাসার পাড়াপড়শি। প্রতিদিনের ঘর-গেরস্তালির সুখ-দুঃখের ওঠাপড়ার মানুষেরা। সুখের সংসার, দুঃখের গ্লানি, অনুশোচনার ভার সর্বস্ব মুছে দিয়ে চলে গেলেন চিরন্তন না ফেরার দেশে।

খবর পাওয়া মাত্র সব ফেলে ছুটে গেছিল ঐশী। সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপসা। হ্যাঁ। সাদা চাদরের ওপর স্থির অচঞ্চল হয়ে রয়েছে শোভারানীর নিথর প্রাণহীন দেহখানা। বুকের ওপর আছড়ে পড়ে ডুকরে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেসে গিয়েছিল ঐশী। কিন্তু তার তো এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। ঠিক যেমন শক্ত মন নিয়ে দিনরাত একাকার করে এতদিন মাকে ডাক্তার দেখানো, অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছোট্ট মেয়ের মতো ওষুধ-পথ্য খাওয়ানো, পায়খানা-পেচ্ছাব পরিষ্কার করা-সর্বস্ব করেছে ঐশী, এখনো তাকে তেমনিই শক্ত থাকতে হবে। হ্যাঁ, শক্তই থাকবে ঐশী। ছোটবেলা থেকে নানা কারণে বারবার মন শক্ত করতে হয়েছে তাকে। বাবা যখন অন্যায়-দুর্ব্যবহার করতেন, সৌম্যেন্দু যখন বিশ্রী অপমানসূচক ভাষায় কথা বলত, বুকের গভীর থেকে একরাশ কান্না উথলে উঠলেও দাঁতে দাঁত চেপে মন শক্ত করে রাখত ঐশী। সবচেয়ে বড় কথা ঐশী কখনো কারও কাছ থেকেই নিজের কাজের সমর্থন পায়নি। তখনো সহ্য করেছে সব প্রত্যাখ্যান, অপমান। একলা মুখ বুজে মন শক্ত করে। তাই মন শক্ত করা তার কাছে নতুন কিছু নয়। তার অভ্যাস আছে। সহানুভূতির প্রত্যাশী সে কোনোকালেই নয়।

মাঝবয়সী একজন সিস্টার বললেন, ‘আপনারা বিল-টিল মেটান, আমরা এদিকে ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করছি। এখনো চার ঘণ্টা লাগবে আমাদের বডি রিলিজ করতে।’ ঐশী ভাবে, আজ সকালেও মা ছিল ‘মা’। বেলা গড়াতে না গড়াতেই মা হয়ে গেল বডি।

কাঠ হয়ে শুনল ঐশী। মা, সেই মা এখন আর নেই। আর কোনোদিন অফিস যাবার সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়বে না মা। বেরোবার আগে টিফিন বক্স, জলের বোতল ব্যাগে গুঁজে দেবে না। কোনোদিনও আর রাতে বাড়ি ফিরলে বলবে না, ‘এত রাত করলি কেন?’ থালার ভাত হাঁড়িতে তুলে দিলে বলবে না কখনো, ‘আর খাওয়া কমাস না মামণি।’

মানতে মন চায়নি ঐশীর কিছুতেই। মা’র যখন মুমূর্ষু অবস্থা যখন ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছে, হাউস ফিজিশিয়ান অরুণদা যখন বলেছে, ‘আর হাসপাতালে মাকে পাঠাস না ঐশী, শান্তি করে যেতে দে এবার...’ ঠিক তখনই অবিনের সঙ্গে কথা বলে দেহদানের গোটা ব্যাপারটাকে ফাইনাল করে রেখেছিল ঐশী। 

ঐশীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবিন একটা সংগঠন চালায় অনেক দিন ধরে। সমাজসেবামূলক সংগঠন। নানা ধরনের ক্যাম্প সচেতনতাশিবির অনুষ্ঠান করে মানুষকে বোঝায় তারা, ‘রক্তদানে শরীর খারাপ হয় না। বরং রক্তদান একটি মহৎ পুণ্যকর্ম। ঠিক এরকমই দেহদান করলে ডাক্তারি পড়ুয়াদের উপকার হয়। কারণ আজকাল আর ডিসেকশন করার মতো যথেষ্ট সংখ্যায় ডেড হিউম্যানবডি পাওয়া যায় না। চোখ, কিডনি আরও বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও মৃত্যুর পর একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত দেওয়া চলে। তবে এতে বাড়ির লোকদের মানে মৃতদেহের মালিকের কনসেন্ট লাগে।’ অবিনরা দীর্ঘদিন ধরে চালাচ্ছে এই গণসচেতনতামূলক সংগঠন। উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে ঐশী কয়েকবার গেছেও সেখানে। কখনো কিছু সরকারি অর্থসহায়তার বন্দোবস্তও করে দিয়েছে। সময়ের নিয়মে ঐশীর সঙ্গে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে ‘চেতনা’ সংগঠনের। সংগঠনের হয়ে কত মানুষকে ঐশী উদ্বুদ্ধ করেছে দেহদান, চক্ষুদান করার ব্যাপারে। কিন্তু আজ? আজ কি ঐশী পারবে তার নিজের মা’র পরমপ্রিয় মরদেহখানা যথোপযুক্ত মর্যাদা আর সম্মান দিয়ে তুলে দিতে ভালোবাসার ‘চেতনা’র হাতে? 

অবিন খবরটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিল। ‘ঐশী লোক পাঠাব রে? চোখটা তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব...বডিটা না হয় তার পরে।’ 

কী যে লজ্জা করছিল ঐশীর অবিনকে বলতে, ‘অবিন হবে না রে। আমার বাবা চান না। আমার একার কথায় তো আর কিছু হবে না।’ 

‘কিন্তু তুই তো তার সন্তান ঐশী। তোর মতকেও তো গুরুত্ব দেওয়া দরকার’... অবিন বলে।

‘না। মা আমার বাবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিলেন রে। এখানে বাবার সিদ্ধান্তের বাইরে আমার করণীয় কিছুই নেই।’ কথাগুলো বলতে লজ্জায় মাটির সঙ্গে যেন মিশে যাচ্ছিল ঐশী। কত বড় বড় বুলি আউড়ে আঁধার সমাজের বুকে আলো ফোটানোর চেষ্টা করে সে, অথচ তার নিজের ঘরখানাই শোচনীয়ভাবে অন্ধকার। 

অথচ এই কদিন আগেও অফিসে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল ইউনিয়ন। ব্লাড ব্যাংক সাফ বলে দিয়েছে, বড় গাড়ি, লোকজন, ডাক্তার নিয়ে যাওয়া-আসার যা হ্যাপা তাতে অন্তত পঞ্চাশ বোতল রক্ত না পেলে তাদের পক্ষে শিবিরে আসা সম্ভব নয়। ঐশী সব্বাইকে জনে জনে বলছিল ‘রক্ত দিন’। বোঝাচ্ছিল প্রাণপণ, ‘রক্তদানে শরীরের ক্ষতি হয় না। বরং লাভই হয়। রোগ প্রতিষেধক শক্তি বাড়ে। তাছাড়া আমরা চাই বা না চাই শরীরের রক্তকোষ তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ভেঙেই যায়। জন্ম নেয় নতুন রক্তকণিকা।’ এত কিছু বোঝাবার পরও ঐশী খুব বেশি রক্তদাতা জোগাড় করতে পারেনি। কেন যে অমূলক ভয় চেপে ধরে রাখে কিছু মানুষকে! রক্তদানের মতো মহৎ দানে মানুষ কৃপণ, অথচ সেই মানুষই হয়তো নেশার দাস হয়ে আছে। নেশাবস্তুর জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ করছে।

মা যখন খুব ভুগছিল সেসময় ঐশী ঠিক করেছিল মা চলে গেলে মা’র সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সে দান করবে। যাতে কোনো অসমর্থ মানুষ উপকৃত হয়। মহত্তম দানের এক বুক তৃপ্তি নিয়ে সে ভাবছিল অবিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এই পুণ্যকাজটা সে করতে পারবে। কিন্তু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সব। অগ্রজের বিশ্বাস আর মূল্যবোধের সঙ্গে ধাক্কা খেল অনুজের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বাস। 

মা চলে যাবার পর যখন ঐশীর সব ইচ্ছেগুলো এলোমেলো হয়ে গেল তখন সে অবিনকে বলল, ‘অবিন জানিস আমি বাবাকে বলেছিলাম মা-র দেহদান করতে চাই আমি। মা-র চোখটা যেন একজন জীবন্ত অন্ধ মানুষকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে। চলে যাওয়া মার চোখদুটো দিয়ে মাও পৃথিবীতে থেকে যেতে পারে আরও বেশ কিছুদিন।’

কিন্তু বাবা তা চান না। বললেন, ‘ওতে মৃতের আত্মা শান্তি পায় না। তাছাড়া আমাদের বংশে ওসব কাজ কেউ কখনো করেনি।’

‘আমি পারলাম না রে অবিন। কত মানুষকে প্রতিদিন প্রাণিত করি আমি এই মহৎ কাজে কিন্তু পারলাম না নিজের পরিবারের অন্ধত্ব ঘোচাতে। আমায় তুই ক্ষমা করিস অবিন। তবে আমার এই দেহ মৃত্যুর পর তুই থাক বা না থাক দান করার থেকে কেউ রুখতে পারবে না, দেখে নিস।’

ঐশী দেখছিল মাকে সুন্দর কাচের গাড়ির নরম বিছানাটা থেকে মাটিতে নামানো হলো। সরু বাঁশের বাখারির খাঁচাটার মধ্যে শুইয়ে দেওয়া হলো। মা-র মাথায় বালিশ নেই। কঁকিয়ে উঠল ঐশীর পাঁজরটা। ধরা গলায় বলল, ‘রূপসা মা শক্ত বিছানায় শুতে পারত না জানিস? নরম বালিশ ছাড়াও ঘুম আসত না মা-র।’ রূপসা নিজের সবল মুঠোর মধ্যে ঐশীর হাতটা ভরে নেয়। চোখের জলে ভাসা ভেজা মুখখানা নিজের কাঁধে জড়িয়ে নেয় স্নেহভরে। 

পুরোহিত এলেন। হাতে কয়েকগোছা পাটকাঠি। একটার মুখে আগুন ধরিয়ে বাবাকে বললেন, ‘আপনি মৃতদেহ প্রদক্ষিণ করুন।’ বলেই মন্ত্র পড়তে লাগলেন। বাবা সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করার চেষ্টা করছেন। অস্পষ্ট। সব জড়িয়ে যাচ্ছে। বাবার উচ্চারণ সঠিক হচ্ছে কি না পুরোহিতের দেখার দরকার নেই। যথেষ্ট তাড়া আছে তার। এই বডির কাজ করে দিয়ে তিনি চলে যাবেন অন্য বডিতে কাজ করতে। দক্ষিণা পাবেন চলতি রেট অনুযায়ী।

ঐশীর মনে হলো, বাবা সেই মাকে বিয়ে করে আনার সময় মন্ত্র পড়েছিল আবার মাকে চিরবিদায় জানানোর সময় মন্ত্র পড়ছে। হয়তো প্রতিবারই ভুলভাল অস্পষ্ট। কিন্তু মন্ত্র বাবা পড়ল। অর্থ বুঝুক আর না-ই বুঝুক। 

ভিড়ের মাঝে কে একজন যেন ঐশীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আপনি মেয়ে না? তাহলে? ঠাকুরমশাই শুধু স্বামীটাকে দিয়ে বলাচ্ছেন, মেয়েটাকে দিয়ে বলাচ্ছেন না কেন? মেয়েও তো বলবে। তাকে দিয়েও বলান।’

আবার এক অব্যক্ত অসহায়তা। সুপ্রাচীন অন্ধপ্রথার দাস হয়ে দম দেওয়া পুতুলের মতো পুরোহিতকে অনুসরণ করে মন্ত্র বলতে শুরু করল ঐশী। আর্তনাদ করে উঠল ঐশীর অন্তরাত্মা। ‘রূপসা আমি সহ্য করতে পারছি না এসব।’ 

‘একটু মানিয়ে নে ঐশী, সোনা আমার। এখন এসব বলার পরিস্থিতি যে মোটেই নেই’...রূপসা কাতর হয়ে বোঝায় ঐশীকে। 

 শান্ত হয় ঐশী। পুরোহিতের নির্দেশ মতো বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে আগুন নিয়ে মরদেহ প্রদক্ষিণ করে। শেষে মুখে আগুন ছোঁয়াতে গিয়ে বলে, ‘ওই মুখে তো মা আমায় কত চুমু খেয়েছে রূপসা আমি সেই মা-র মুখ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেব?’ 

নিয়মমাফিক কৃত্য শেষ হওয়ার পর শোভারানীর দেহ ঢুকে গেল চুল্লিতে। প্রায় কুড়ি মিনিট। সব শেষ। শোভারানীর জৈবদেহ একমুঠো ছাই হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল। 

ওদিকে তখন আরও অসংখ্য মৃত মানুষের মিছিল এসে পৌঁছেছে শ্মশানে। আলো-আঁধারিতে ‘বলহরি-হরিবোল’ ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে শ্মশানের শান্ত সমাহিত ভাবগম্ভীর পরিবেশ। গাড়ির পর গাড়ি আসছে মৃতদেহ নিয়ে। ‘বলহরি হরিবোল’ ধ্বনি দিয়ে চলছে মৃত্যুর চিৎকৃত ঘোষণা। কোথাও শ্রদ্ধা নেই, প্রেম নেই। ভালোবাসা নেই। একজন মানুষ পৃথিবীর সব আলো-বাতাস-সৌন্দর্য ছেড়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে ত্যাগ করে চিরকালের জন্য অমৃতলোকে চলে যাচ্ছে, তার অন্তিম যাত্রায় এ কোন বন্য বর্বর উৎসবের ভঙ্গি? কী যন্ত্রের মতো ঘটে যাচ্ছে সবকিছু। কোমরে গামছা বাঁধা লোকেরা হিঁচড়ে বডি নামাচ্ছে। ঝাঁকুনি দিতে দিতে একরকম প্রায় ছুড়ে বডিটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে চুল্লিতে। লাইনে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে উঠছে প্রিয়জনেরা। কিছু মানুষ আছে যারা মৃত্যু নিয়েও ব্যবসা করে। কোনো নৈতিকতার তোয়াক্কা না করেই বহু অবৈধ কাজও চলছে জীবনের শেষ পর্ব এই মৃত্যুপরবর্তী ঠাঁই শ্মশানেও। পাগল-মাতাল-গেঁজেল ভবঘুরের দল শ্মশানে বিরাজ করছে। মানুষ আসছে। চলেও যাচ্ছে। বিরাম নেই শুধু ‘বলহরি হরিবোল’ ধ্বনি-প্রতিধ্বনির।

অবাক হয়ে এসব দেখছিল ঐশী। বকরূপী ধর্মের কথা তার মনে হচ্ছিল... মানব অস্তিত্বের সব থেকে বড় বিস্ময় হলো জীবন। জন্ম হয়েছে যখন মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সব কিছুর অবসান হবে জেনেও মানুষ আর এক মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসে। নিজে হাজার কৃচ্ছ্রসাধন করেও সন্তানকে আঁকড়ে ধরে মা। 

ঐশীকে যেতে হলো চিতাভস্ম আনতে। অবশিষ্ট অদগ্ধ দেহাবশেষটি গঙ্গায় বিসর্জনও দিতে হলো। আদি গঙ্গা। অপরিচ্ছন্ন কর্দমাক্ত মলমূত্র মলিন এক স্থানে মা-র নাভি বিসর্জিত হলো। ঐশীর মনে হয় মা যে কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিল। রূপসাকে বলে ঐশী, ‘ভয়ানক পিটপিটে ছিল মা। আর এই নিয়ে আমার সঙ্গে ঝামেলা লেগেই থাকত। বিশেষ করে বাইরে বেড়াতে গেলে হোটেলের বাথরুম যদি একটু নোংরা হতো মা থাকতে চাইত না সেখানে কিছুতেই। তখন কত রাগ করেছি মা-র ওপর। বেড়াতে এসে একটু অ্যাডজাস্ট করতে হয় মা। সবকিছু কি বাড়ির মতো হবে? তাহলে তো বাড়িতে থাকলেই হয়। বেড়াতে আসার দরকার কী?’

নোংরা, ময়লা, দুর্গন্ধ পছন্দ করত না মা একদম। কিন্তু মা-র সেই নরম তুলতুলে আদুরে গাল আর সুগন্ধি শরীরটা থেকে নির্গত বস্তুটি ফেলতে হলো এই পুরীষের মধ্যে! ঐশী ভাবছিল এক অদ্ভুত পর্ব। পর্বান্তর। প্রতিটি মানুষ যুগের পর যুগ এই ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণবাদ পালন করে চলেছে বিনাপ্রশ্নে। 

ঐশীরা কখনো কখনো প্রশ্ন তুলতে আসে। কিন্তু বহুযুগের সনাতনী প্রবহমান ধারার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেরে উঠতে পারে না। 

নিয়ম মেনে মা-র শ্রাদ্ধশান্তি কিছুই করল না ঐশী। পুরোহিতের নিদান নিয়ে বাবা করলেন সব আচার-অনুষ্ঠান। আর ঠিক যেমনভাবে মা-র সেবাযত্ন করত ঐশী সেভাবেই অন্তরাল থেকে নিখুঁত করে সাজিয়ে দিল মা-র সবকিছু উপচার। 

এরপর... দিনটি ছিল ১৩ আগস্ট। শোভারানীর একটি চমৎকার ছবি জুঁইফুলের সম্ভারে সাজিয়ে রাখল ঐশী। মধ্য কলকাতার অনাড়ম্বর অথচ রুচিসম্মত একটি প্রেক্ষাগৃহের দুয়ার অঙ্গন যূথীগন্ধে মাতাল হয়ে উঠল। আজ তেরোই আগস্ট। বিশ্ব অঙ্গদান দিবস। মা-র উদ্দেশে একটি শান্ত সৌম্য বিনীত নিরুচ্চার স্মরণসভার আয়োজন করেছে ঐশী। গান-কবিতা-কথা দিয়ে নানাভাবে শ্রদ্ধায় স্মৃত হলেন শোভারানী পরম প্রেমে। অনুরাগে। ভালোবাসায়। 

সভামুখ্য ঐশীর পরম বন্ধু অবিন। শোভারানীর জন্য নীরবতা পালন হচ্ছিল। আর ঐশী তখন ধ্যানের মধ্যে দেখছিল মা শুয়ে আছেন মেডিক্যাল কলেজের মর্গের ল্যাবরেটরির সাদা চাদর পাতা ডিসেকশন টেবিলে। তার চোখটা সাদা ব্যান্ডেজে সুন্দর করে বাঁধা। তার চোখ দুটি পেয়ে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে কোনো অন্ধমানুষ। শায়িত মা-র দেহে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে উজ্জ্বল আলো। প্রফেসর ডাক্তার মা-র শরীর দেখিয়ে কত কী বোঝাচ্ছেন। ব্যাখ্যা করছেন। তাকে ঘিরে রয়েছে ডাক্তারি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা। সবাই মন দিয়ে স্যারের কথা শুনছে। 

নীরবতা পালনের একটি মিনিট অতিক্রান্ত হলো। অবিনের গলা থেকে অস্ফুটে ভেসে এলো, ‘আপনারা বসুন।’ ঐশীর ধ্যান ভাঙল। চোখের কোল থেকে গড়িয়ে নামল কটি মুক্তোদানা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //