যে জীবন দায়ের

হঠাৎ করে নয়, পাড়ার চেহারাটা খোলনলচেসহ ভেতর থেকেও ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে গত কয়েক বছরে। এমন পাল্টেছে যে এদের জীবন সংশ্লিষ্ট মূল যে জীবিকা, সেই পরিচয় ধীরে ধীরে লীন হতে হতে পাড়ার বিশেষত্বটা টলটলে পুকুর থেকে মজা ডোবায় পরিণত হয়েছে। যে ডোবায় যে কোনো সময় যে কোনো অজুহাতে কয়েক ঝাঁকা মাটি ঢেলে দিলেই ডোবাটিরও আর কোনো নাম নিশানা থাকে না। ধুঁকতে ধুঁকতে যে কয় ঘর এখনো পাড়ায় আছে যে কোনো অজুহাতে যে কোনোদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে পরদিনই পাড়াটির কথা সবাই বেমালুম ভুলে যাবে। মনে রাখার জন্য সঙ্গত যে কারণ দরকার তার কিছুই নেই এদের।

পাড়ার মুখে যে রায় সাহেবের মাঠটা পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়েছিল পাড়াটাকে আগলে, সেখানে যখন ইট-সিমেন্ট-সুরকি এসে টিলার মতো উঁচু হতে থাকে তখনো এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে কেউ তেমন চিন্তিত ছিল না। বরং এই উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া থেকে শেষ পর্যন্ত যে তাদের পাড়াটাও বাদ পড়েনি, ইট-সিমেন্ট জমাট বাঁধছে, দালান উঠছে-এই গর্বে স্ফীত হয়েছে পাড়ার মানুষদের বুকের সিনা। তারা হাটে যেতে যেতে, পাড়ার মোড়ের টং দোকানে কনডেন্সড মিল্কের চা খেতে খেতে ভেবেছে, যাক শহরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের বেমানান জরাজীর্ণ পাড়াটাও অবশেষে ইটের গাঁথুনির অহংকার অর্জন করতে পারছে। 

এ নিয়ে আফিয়ার উত্তেজনা ছিল সবচেয়ে বেশি। আফিয়া সবসময় নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে বড় অধৈর্য। যেন নিজের ভেতরে জন্ম নেওয়া আকাঙ্ক্ষার দাস হয়ে যায় সে নিজেই। কোনোভাবেই একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বংশানুক্রমে পাওয়া জমি-জিরাতের বৈভব গ্রামে রেখে, শুধু শিক্ষিত হওয়ার জন্য শহরে এসে উঠেছিল আফিয়াদের পরিবার। শহরের দামি জায়গা কিনে দস্তুরমতো ঘর-সংসার সাজিয়েছে। সেই পরিবারের কলেজপড়ুয়া মেয়ে কিনা প্রেমে অন্ধ হয়ে ঢাকি পাড়ার ছেলেকে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলল!

পাড়ার চেহারা আগলে এই ইট-পাথরের গাঁথুনি সুউচ্চ হতে থাকলে সবচেয়ে খুশি হয় সে। বাপেরবাড়ির মানুষজন তার বিয়ে মেনে নেয়নি, মেনে নেওয়ার কথাও নয়। মুসলমান ঢাকিদের আঞ্চলিক নাম ‘নাগারসি’। সমাজে এদের অবস্থান পতিত। নেহায়েত প্রয়োজন না পড়লে পারতপক্ষে কেউ পাড়া মাড়ায় না। কোথাও দেখা হলে নিজের আত্মীয়-স্বজন যে বিক্ষুব্ধ বিরক্তির চোখে তাকায়, লজ্জায় আর অনুশোচনায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে আফিয়ার।

হিন্দু বিয়ে বাড়ি কিংবা গানের আসরে বাজনা বাজানো বিদাত কাজকাম। এই বিদাত কাজ করে তার স্বামী ছালু মিয়া। শুধু বাপের বাড়ি কেন, বন্ধু-বান্ধব পরিচিত সবাই তাকে ঘৃণা করে ঘরের ভেতর মরে-পচে ফুলে ওঠা ইঁদুরছানার মতো। পারলে এই আত্মীয়তার পরিচয় তারা ছুড়ে ফেলে দিত নর্দমায়। কিন্তু এই রক্তের সম্পর্ক যে চাঁদনি রাতের জোছনার মতো, ছোঁয়াও যায় না, অস্বীকারও করা যায় না। কিন্তু সবাই এমন রূঢ় বিরক্তিতে চোখ ঘুরায় যেন শুধু পচা ইঁদুর নয়, কীটে কিলবিল করছে তার শরীর। এমন পরিণতি কল্পনাতেও ছিল না তার। কাঁচা বয়সের প্রেমে তখন তৃণের মতো ভেসে যাচ্ছিল সে। উন্মাতাল নেশায় ছালু মিয়াকে আঁকড়ে ধরার সময় কিচ্ছু তলিয়ে ভাবেনি আফিয়া, মনে হয়েছিল ছালু মিয়াকে ছাড়া জীবন কাটানো আর মরে যাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু এই জীবন কাটানোর আবশ্যিক অনুষঙ্গ যে সামাজিক জীবন, জীবনের নৈমিত্তিক প্রয়োজন সব মিলেই যে যাপন এসব কিচ্ছু ছিল না অপরিণত মস্তিষ্কে।

এই পেশার মানুষদের নিত্য অনটন সংসারে। চাল কেনা হয় তো মাছ হয় না, মাছ হয়তো তেল হয় না। এমন অভাবী দিনের সঙ্গে জীবনেও পরিচয় হয়নি আফিয়ার। অবশ্য ছালু মিয়াকে দোষ দেওয়ারও সুযোগ নেই। আহার, নিদ্রাহীন উন্মাদ উন্মাদ সময়ে আফিয়া যখন ঘুমের মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠত ছালু মিয়াকে স্বপ্ন দেখে, তখন ছালু মিয়া বারবার নিরস্ত করেছে তাকে। বারবার বুঝিয়েছে এই সমাজে কতটা অচ্ছুত তারা। যার চোখের দিকে তাকালে ভেতরের শিহরণ সামলে ঠিকমতো কথা বলতে পারত না আফিয়া, তার কোনো যুক্তিই তখন গ্রাহ্য মনে করেনি সে। ছালুও তো তাকে ভালোবেসেছিল, কাঁহাতক আর নিজের আকাঙ্ক্ষা অগ্রাহ্য করা যায় অপরাপর যখন এমন উন্মাদ আহ্বানে বারবার কাছে টানে! অনস্বীকার্য আকর্ষণেই ছালু মিয়া আগলে নিয়েছিল আফিয়াকে।

এতগুলো বছর এই অচ্ছুত দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করেও আফিয়ার সাংসারিক বুঝ-বিবেচনা যে খুব একটা পরিণত হয়েছে তা নয়। প্রতিদিনের টানাপড়েন জাত অশান্তিতে জাগতিক ও সামাজিক রূঢ়তা বোঝার মতো দূরদর্শিতা তার মধ্যে জন্ম নেয়নি, জন্ম নিয়েছে শুধু এর থেকে মুক্তি পাওয়ার ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা। 

এই ইট-পাথর কাঠের গাঁথুনির সঙ্গে সঙ্গে আফিয়ার চোখে স্বপ্ন জাগে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, বুঝি এই অবকাঠামোতেই গেঁথে থাকে সব সম্ভ্রম। কিছু উপড়ে কিছু রোপণ করলেই হয়। কিন্তু শেকড় বসার জন্য যে উপযুক্ত মাটি লাগে আর সে মাটি যে যুগ-যুগান্তরে অনড় জগদ্দল হয়ে বসে যায় এটা বোঝার মতো গভীরতা নেই আফিয়ার। বরং ইট-সিমেন্টের স্তূপের উপর যখন দুপুরের নির্দয় রোদ খাঁখাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে সে ভাবে, সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। স্বামী-সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওরি যাবে সে। বন্ধু-বান্ধব পরিজনদের সঙ্গে সম্পর্ক হবে। ছোট খালার মেয়ের গায়েহলুদে যাবে। বড় ফুফুর নাতিনের জন্মদিনে যাবে। এ নিয়ে ছালু মিয়ার সঙ্গে তার বিস্তর ঝগড়াঝাঁটিও হয়।

-তুই কিতা ভাবছিলে তরে বিয়া কইরা আমি ঢাক বাজানি বাদ দেলামু? 

-হ বাদ দেওন লাগ্লে দিবায়। পরকালের ভয়ডর নাই?

-শোন আফিয়া ঢাক বাজানি বাদ দিলেও আম্রারে কেউ ভদ্রলোক কইত নায়। তুই জাইন্যা বিয়া করস নাই আমি যে ঢাকী, আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী ঢাকি! আমি বারবার কইছি না?

বাড়ির সামনে বড় রাস্তার মোড়ে সুন্দর আলীর মুদি দোকানে সমবয়সীদের সঙ্গে সাদাকালো টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখত ছালু মিয়া। ঘরের জানালা দিয়ে দেখত আফিয়া, ছক্কা ছক্কা বলে সেকি নাচ ছালু মিয়ার। একবার ঈদের দিনে ডেক সেট বাজিয়ে রাস্তায় নেচেছিল ছালু মিয়া, তুম পাস আয়ে, কিও মুসকারায়ে...। সম্ভবত সেদিনই তুলেমূলে ডুবে গিয়েছিল আফিয়া। এমনই ডুবা ডুবল, সব বাস্তবতা তুচ্ছ করে পালিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলল। 

ছালু মিয়া সত্যি বড়ো ভালোবেসেছিল আফিয়াকে। সামাজিক অবস্থানে দুজনের আকাশ-পাতাল ফারাকের কথা ভেবেই কোনোদিন নিজ থেকে প্রকাশ করেনি। আফিয়াই চিঠি লিখে পাঠিয়েছিল ওকে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না প্রিয়তম। ‘প্রিয়তম’ যে কেবল একজনকেই বলা যায় এটা বুঝতে পেরে প্রথমেই ছালু মিয়ার মাথায় কাজ করেছে বিপুল বেদনা। আহা সে তো ঢাকী সমাজের মানুষ। ভদ্র সমাজে পতিত। সে জানে তার পূর্বপুরুষ কেউ হিন্দু ঢাকি সমাজ থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে, কিন্তু পেশা ছাড়েনি। আফিয়াকে এটাই বলেছে সে, কী করে সম্ভব। আফিয়া তখন কিচ্ছু শুনতে রাজি হয়নি। ছালু মিয়ার সঙ্গে গাছতলায় থাকবে, থাকতে রাজি আফিয়া। লবণ-ভাত খাবে। ছালু মিয়া বিশ্বাস করেছিল। নিজের অন্ধ প্রেমকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। অথচ এই গাছতলায় থাকা, লবণ-ভাত খাওয়া যে কেবল কথার কথা বুঝতে তার সময় লাগেনি মাস দুয়েকও। মোহের ফিনফিনে জাল বাস্তবের রুক্ষ পাথরে ঘষা খেয়ে মিইয়ে যাবার পর আফিয়া হয়তো ফিরেই যেত, যদি পথ খোলা থাকত; কিন্তু পথ বেয়ে নামা যত সহজ, ওঠা যে কত কঠিন! কঠিন বললে বরং ভুল বলা হয়, বলা যায় অসম্ভব। সবার কথায় আলোচনায় ব্যবহারে বোকার মতো তার মনে বিশ্বাস জন্মেছিল ঢাক বাজানো ছেড়ে যদি অন্য পেশা নেয় ছালু মিয়া, ধর্মেকর্মে মতি ফেরে তবে হয়তো তাকে মেনে নেবে ভদ্র সমাজ।

ইট-পাথর-সুরকিতে সুসজ্জিত দালান উঠতে থাকলে দেয়ালে দেয়ালে বাহারি নকশার টাইলস বসে জ্বলজ্বল ঔজ্জ্বল্যে যখন ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল ঢাকি গ্রামটির মলিন জীবন, আফিয়ার মনে তখন বিশ্বাস সত্য হওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ততদিনে ঢাকী পাড়ায় আফিয়ার ১৭টি বছর পার হয়েছে। তিন-তিনটি সন্তান জন্ম দিয়েছে। বড় মেয়েটারও ১৬ বছরের শরীরে যেন কুড়ি-বাইশের ঢলঢলানি। আফিয়া তাকিয়ে দেখে নিজের মা-খালাদের গড়ন মেয়েটার, এ পাড়ায় বড়ই বেমানান। কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি কম ঢ্যাঙা মেয়েটা তখনো বয়সে ছোটদের সঙ্গে মাঠে ময়দানে খেলে বেড়ায়। মনের ভেতরে সে বয়স পাঁচেকের বালিকা। 

আলী লন্ডনীর ছোট ছেলে তখন ঘনঘন এলাকায় আসে। নামাজের ঘর বানানোর তদারকি করে। আর সন্ধ্যায় পিডিবির লাইন থেকে তার এনে বাঁশের মাচায় বেঁধে আলো জ্বালায়। সে আলোতে তফসির করে, এই দুনিয়াদারি দুদিনের ঝকমারি। আসল জীবন পরকালে। সেই আসল জীবনের জন্য আমল জমাও মিয়ারা। সময় থাকতে দ্বীনের পথে আস। বড় দয়ার শরীর তার। পাড়ায় দালানের কাজ করতে করতে মাঠে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলতে থাকা আফিয়ার এই মেয়েটিকে মনে ধরে গিয়েছিল রাজমিস্ত্রি কুদ্দুসের। হয়তো প্রকাশও করেছিল আলী লন্ডনীর ছেলের কাছে। আলী লন্ডনীর দয়ালু ছেলে নিজ খরচে রাজমিস্ত্রি কুদ্দুসের সঙ্গে নিকাহ পড়িয়ে দিয়েছিল ছালু মিয়ার কন্যার। ছালু মিয়াকে বুঝিয়েছিল, সময় থাকতে পুরুষের হাতে না দিলে মেয়েমানুষ রাস্তার গাছে ঝুলে থাকা আমের মতো হয়ে যায়। আসতে-যেতে সব পথচারী ঢিল দেয়। মেয়ে তার ঢ্যাঙা, বয়সের তুলনায় বুদ্ধিশুদ্ধি কম। সমবয়সীদের সঙ্গে মাঠে-ময়দানে খেলে বেড়ায়। বাপের ওপর ঠ্যাং তুলে ঘুমায়। সংসারের ‘স’-ও যে বোঝে না তাকে সংসারের কারাগারে বন্দি করে দিতে ভেতরটা পিতৃত্বের অক্ষম যন্ত্রণায় টনটন করছিল ছালু মিয়ার। কিন্তু আফিয়ার তীব্র সম্মতিতে পলিথিনের ফেলনা ব্যাগের মতো উড়ে যায় তার আপত্তি।

প্রতিদিনই তফসির থেকে ঢাকি পাড়ার কেউ না কেউ তওবা করে ফিরে আসে। ঘরের ঢাক ভেঙে কাছের পুকুরে ঢিল ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের পেশা অস্বীকার করে। পরদিন অনভ্যস্ত হাতে অন্য জীবিকার সন্ধানে যায়।

শুধু ছালু মিয়া পারে না। বাপ মালু মিয়া ছিল পাঁচ গাঁয়ের বিখ্যাত ঢাকী। আশেপাশে এমন কোনো হিন্দু পরিবার নেই নাতি-পুতিসহ কয়েক প্রজন্মের বিয়েশাদি মালু মিয়ার ঢাক ছাড়া হয়েছে। ছয় ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে ছালুকেই সে ঢাকঢক্কি বুঝিয়ে দিয়ে গেছে মৃত্যুর আগে। তার বিশ্বাস ছিল একমাত্র ছালুই পারবে বাপের নাম রাখতে। ছালু ছোট থেকেই বাপের সঙ্গে সঙ্গে থাকত। কাছের শহরতলি থেকে দূর-দূরান্তের গ্রাম, বায়না পেলেই সঙ্গে নিত ছালুকে। সঙ্গে যেতে যেতে কেবল বাপ নয়, বাপের পেশাটাকেও ভালোবেসে ফেলেছে সে। কিন্তু আফিয়ার নিত্য এক ঘ্যানঘ্যান। এই কাম ছাড়েন নয়তো আমারে ছাড়েন।

আমারে ছাড়েন-আফিয়ার এ বক্তব্যে কত আত্মপ্রতারণা ছালু মিয়া যেমন জানে, আফিয়া নিজেও জানে। ছাড়লে আফিয়া যাবে কই, কে আশ্রয় দেবে তাকে! তবু একই ঘ্যানঘ্যান। কাঁহাতক সহ্য হয়! আফিয়ার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এক গভীর রাতে সবাইকে ঘুমে রেখে নিজেকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্দেশে ভাসিয়ে দেয় ছালু মিয়া। কই যাবে, কী করবে কিচ্ছু পূর্বনির্ধারিত নেই। অবিমৃষ্যকারীর মতো গ্রাম ছাড়ে সে। নও কিশোরের মতো অভিমানী মনে ভাবে, একদিন এই ঢাক বাজিয়েই দেখিয়ে দেবে সে। ঢাকটা সঙ্গে নিতে ভোলে না। এটি দিয়েই আফিয়াকে একদিন বুঝিয়ে দেবে তার দিন ফুরিয়ে যায়নি।

এমনিতেই অভাবের সংসার পাড়ার সবারই। তবু নিজস্ব পেশা ছিল যখন ব্যাটাছেলেরা ঘর-সংসারেই থাকত। বায়না থাকলে কাজে যেত, না থাকলে সবাই উঠানে বসে মিলেমিশে চর্চা করত। সানাই ধরতো ওই ঘরের দিদার, মঙ্গল দীপ জ্বেলে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু। বাঁশিতে সুর তুলতো নেহার, দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না...। হয়তো পেটে ভাত নাই। তবু খোলা উঠানে বসে সবার এই জোটবদ্ধ চর্চা মন ভরিয়ে দিত। এই সুরে এই ঢুম ঢুম ঢুম ঢ্রিম, ঢুম ঢুম ঢ্রিম, ঢুম ঢুম ঢ্রিম আওয়াজের রেশে অনটনের জীবনেও একটা উৎসবের সুর বাজত। অনেক অভাব অনটন, ঝগড়াঝাঁটি মিথ্যা মনে হতো। আলী লন্ডনীর ছোট ছেলে এলাকায় আসার পর থেকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে সব বন্ধ হতে হতে এখন কিছুই নেই।

সবাই পেশা ছেড়ে দিয়ে নানা জীবিকা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় আছে। ঢাক বাজানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ জানে না তারা। ফলে আধখেঁচড়া পেশায় সেই অভাব আরও পোক্ত হয়েছে তাদের জীবনে। উৎসবের রং লাগা তাল লয় সুরের সুখও হারিয়ে গেছে। 

ছালু মিয়া নিরুদ্দেশ হলে অভাব যেন অচল পাথর হয়ে দখল করে নেয় আফিয়ার সংসার। আফিয়া পথ খুঁজে হয়রান হয়। বাচ্চাগুলো নিয়ে দুবেলা পেটপুরে খাবারের বিনিময়ে শহরে গিয়ে মানুষের বাসায় ঝিগিরি করার কথাও ভাবে সে। কিন্তু তার বাপের পরিবারে তো ভদ্রলোকের সিল মারা। তাদের তো সম্মান যাবে। চুলায় চড়ানোর মতো এক মুঠো চাল নেই ঘরে, সকালে ঘুম থেকে জেগে যখন সে এই নির্মম সত্যটার মুখোমুখি হয় তখন এসব মান-সম্মান বিষয়গুলোকে বাজারে বিক্রি করা ফাঁপা বেলুনের মতো মনে হয়। প্রয়োজনের একটা সুইয়ের খোঁচাই যথেষ্ট হাপিস করে দেওয়ার জন্য।

এমন আকালে আফিয়া বিবির মেয়েজামাই কুদ্দুস হঠাৎ একদিন ব্যাগ ভর্তি চাল-ডাল-আলু-মুলা নিয়ে দাওয়ায় উঠে এলে আফিয়া বিবির রাজকপাল নিয়ে পাড়ায় বিস্তর গবেষণা আর আলোচনা জমে ওঠে। এর ঘরের বউ আড়চোখ গোপন করে ওর ঘরে যায়। পান সুপারি আর তামাক পাতার আপ্যায়নে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওরা আফিয়া বিবির বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। দূরে কোথাও একটা কানাকুয়ো ডাকে। অভাবী মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস আফিয়ার বন্ধ দরজায় হুমড়ি খায়। তারা একসঙ্গে একমত হয় অমঙ্গল পাড়াটাকে আর ছাড়বে না। 

ছালু মিয়া যেমন ভেবেছিল তেমন আর হয় না। এ শহর সে শহর ঘুরে বেড়ায় সে। দল তৈরির চেষ্টা করে। হয় না। কোথাও আর গান বাজনা নেই। যাত্রা, পালাগানের দল নেই। যাওবা মন্দিরে মন্দিরে কীর্তনীয়া দল আছে তারা মুসলমান ছালু মিয়াকে দলে ভিড়তে দেয় না। কয়েকজন দলনেতার সঙ্গে আলাপ করে একই উত্তর পেয়ে পরিচয়হীন বিপন্ন লাগে নিজেকে। হায় বাজনাদার জীবন! হিন্দুরা দলে নেয় না ধর্মের কারণে। বাজনার কারণে নিজের ধর্মেও ঠাঁই মেলে না।

চৌদ্দ বছর বয়সে আফিয়া বিবি যখন এই পাড়ায় বউ হয়ে আসে তখন পাড়ার মুরব্বি মালু মিয়ার বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। তার ছয় ছেলে, নাতি-পুতি মিলিয়ে ১৫-১৬টা ঘর পাড়ায়। ছোট ছেলের বউ আফিয়া। বিয়ে হওয়া নাগাদ সে জেনেছে এই পুরা ময়াল আলী লন্ডনীর। বেদখল যেন না হয় সেজন্য উদ্বাস্তু মালু মিয়াকে ঘর বানিয়ে থাকতে দিয়েছে এখানে। পুকুর কেটে, ডিপ টিউবওয়েল বসিয়ে মালু মিয়ার পরিবার পরিজনদের নানান সুবিধা করে দিয়ে গেছে সে। 

শোনা কথা মাঝে মাঝে শ্বশুরের কাছে ঝালিয়ে নিত আফিয়া, আব্বাজান মাইনষে যে কয় আপনেরা আগে হিন্দু আছিলেন। মালু মিয়া অস্বীকার করে না। তার বাবা হিন্দু ছিল। হিন্দু বিয়ে বাড়িতে বাজনা বাজানো পেশা ছিল তার। কিন্তু মুসলমান ঘরের মেয়ে নিশিচান বিবিকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছিল মালু মিয়া। অনেক দিন হিন্দু বিয়েশাদিতে ডাকত না তাকে। আয় রোজগার নেই, থাকার জায়গা নেই। এ অবস্থায় আলী লন্ডনীর সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল বাজারে চালের আড়তে। মূল শহর পেরিয়ে অনেকটা দূর, সরকার থেকে লিজ নেয়া ভাস্টেড প্রপার্টির জায়গা। সে নিজে দেশে থাকে না। দখলে রাখার জন্য মালু মিয়ার বাবাকে ঘর বানিয়ে থাকতে দিতে পারে সে। প্রস্তাবটা লুফে নিয়েছিল মালু মিয়ার বাবা। নতুন এলাকায় কেউ হয়তো ব্যাপারটা জানবে না। পুরনো পেশায় ফিরে যেতে পারবে সে। গিয়েওছিল। নিজে তো নিজে বংশানুক্রমে ছেলেপুলে, নাতিগুলোও এই ঢোল বাজানো ছাড়া শেখেনি তেমন কিছু। অথচ ততদিনে বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রাদলে ডাক পড়া। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাক বাজিয়ে রোজগারের অন্য অনেক পথ-ঘাট। ঘরে ঘরে স্থায়ী বাস হয়েছে অভাবের। 

ততদিনে আলী লন্ডনী আর মালু মিয়ার বাপ দুজনের কেউই আর নেই। আলী লন্ডনীর ছেলে এসে মসজিদ বানানোর উদ্যোগ নেয়। ঘনঘন পাড়ায় এসে এসব হারাম কাজ না করার পরামর্শ দেয়। পুকুরে বৌ-ঝিদের গোসলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাস্তার পাশে উঠতি মেয়েদের এক্কাদোক্কা খেলা বন্ধ হয়। এরা অখুশি হয় না। সম্ভ্রমের এই নিষিদ্ধতা তাদের যেন সম্ভ্রান্ততায় আশ্রয় দেওয়ার স্বপ্ন দেখায়।

পুরুষ কুলের জীবিকাহীন জীবনে, নিত্য অনটনের জীবনে তাদের বাঁচিয়ে রাখে অচ্ছুত জীবনের অভিশাপ থেকে বিমুক্ত হওয়ার নেশা। কোনো কোনো বেলায় চুলায় ভাত চড়ে না, পুকুর পাড় খুঁজে তুলে আনা শাকপাতা সেদ্ধ করে খায়, তবু কেউ মুখ ফুটে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করে না। ঘর থেকে বের হলেই এই নাজায়েজ পেশার কারণে কী বিড়ম্বনার জীবন এদের। এবার যদি মুক্তি মেলে। সবচেয়ে বিপদে পড়ে ঘরের বউরা। না পারে স্বামীদের এই নাজায়েজ কাজে উৎসাহ দিতে, না পারে সন্তানদের দিনমান না খাওয়া শুকানো মুখ দেখতে।

প্রয়োজন নানা পথ খুলে দেয়, গোপন কিংবা প্রকাশ্য। এদের কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে শহরের বাড়িতে বাড়িতে আয়ার কাজ নেয়। ভোরে পথ দেয় আর মাগরিবের আগে আগে ফিরে আসে। ঝি-চাকরানির কাজ করেও যখন তাদের দুবেলা পেটের নিশ্চয়তা জোটে না তখন সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আফিয়ার মেয়েজামাই কুদ্দুসের ওপর। একখান জামাই পেয়েছে বটে আফিয়া। মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই ঢ্যাঙা। অথচ জামাইটা! প্রায় প্রতিদিন ব্যাগ ভর্তি করে বাজার দিয়ে যায় শাশুড়ির সংসারে। 

গত কয় বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেদার রোজগার হয় ছালু মিয়ার। প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠান আর শোভাযাত্রা। আজ এর তো কাল ওর। প্রতিদিন বায়না। নানা জায়গা থেকে নানাজন এসে জুটে যায়। কেউ সানাই, কেউ বাঁশি। দেখতে দেখতে দেশটা স্বাধীন হওয়ার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল। ছালু মিয়ার অস্পষ্ট মনে পড়ে যুদ্ধের সময় মালু মিয়ার হাত ধরে চা বাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল সে। বাপ মালু মিয়া সেদিনও আর কিছু নয়, ঢাকটাই সঙ্গে নিয়েছিল। 

টাকাগুলো একসঙ্গে করে অনেক টাকা হয়। প্রাণভরে বাজার করে সে। তিন কেজি ওজনের বড় একটা কাতলা মাছ, এক কেজি গরুর মাংস, জেতা কৈ মাছ, ভালো করে দেখে নিয়েছে চাষের মাছ নাকি গাঙের। বেকারির বিস্কুট, চানাচুর। একটা কেক, দুই লিটারের ঠান্ডা। পোলাওয়ের চাল। যা পড়েছে চোখের সামনে। তার কল্পনারা যেন অপেক্ষা করতে পারে না। এতদিন খোঁজখবর না রাখার জন্য আফিয়া হয়তো প্রথমটায় খুব রাগ দেখাবে, কিন্তু ছালু মিয়া জানে আফিয়া তারে কতটা ভালোবাসে। বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতেই পারবে না। কাল সকালে উঠেই মেয়েটাকে নাইওর নিয়ে আসবে সে। কয়েকটা গাঁটরি, পোঁটলা হাতে বাড়ির পথ ধরে ছালু মিয়া। 

গভীর রাতে মেয়ের জামাই কুদ্দুসকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফেরার সময় মোবাইল ফোনের টর্চে ছালু মিয়াকে বিভ্রান্তের মতো দাওয়ায় বসে থাকতে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে আফিয়া। এই গভীর রাতে মেয়ের জামাইকে দেখে নিশ্চয়ই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে ছালু মিয়া। কী জবাব দেবে সে! জবাব তো দিতেই হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে তীব্র ঝাঁজে উত্তর দেয় সে, ব্যাটা মানুষ নিরুদ্দেশ হতে পারে, পরিবারের খোঁজ না নিয়া দিন কাটাতে পারে, এদের কলিজা পাথর। কিন্তু মেয়ে মানুষ পারে না। পেটের সন্তানকে খাওয়ানো-বাঁচানোর দায় মেয়েমানুষ এড়াতে পারে না। বাঁচবার পথ খোঁজার দায় খালি মেয়ে মানুষের...।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //