জীবন মরণ

জীবন পালের সব ভালো, একটা অভ্যাসই বড় খারাপ। কোথাও কেউ মরতে বসেছে শুনলেই সে দৌড়াবে। সোজা গিয়ে অক্কা পাচ্ছে বা পেয়েই গেছে এমন মানুষটার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তারিয়ে তারিয়ে দেখবে তার চোখ ওলটানো, পুরো উলটে গেলে গাঁদা ফুলে চন্দন লাগিয়ে সারা কপাল জুড়ে ছোপ লাগাবে, বড় তুলসীপাতা বেছে নিয়ে বোজা চোখের ওপর যত্ন করে লাগিয়ে দেবে। ঠোঁটের কোণে শেষ তেষ্টা মেটানোর পর গড়িয়ে পড়া গঙ্গাজলের ধারাটুকু পরম যত্নে নিজের ধুতির খুঁটেই মুছে নিল হয়তো। 

লোকে তাকে আড়ালে ডাকে যমদূত। বলাবলি করে, কী এক অলৌকিক শক্তির বলে জীবন পাল নাকি মৃত্যুর গন্ধ পায়। বাতাসে নাক উঁচু করে কী শোঁকে কে জানে; কিন্তু চেনা-অচেনা বাছবিচার না করেই সোজা পৌঁছে যায় মড়ার বাড়িতে। কালো জীবন ঘর্মাক্ত ভুঁড়ির নিচে ধুতির গিঁট নামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে আসছে দেখলেই আজকাল রোগীর বাড়ির লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেতর বাড়িতে কান্নার রোল ওঠে, অনেকে আবার ঘাড় ধাক্কা দিতে যায়। নির্বিরোধী জীবন পাল চুপচাপ বাড়ির বাইরে গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করে, শববাহকেরা বেরোলে পেছন পেছন শ্মশানমুখো হাঁটা লাগায়।

শ্মশানে পৌঁছে সে এটা-ওটা বয়ে দেয়, গেঁজে থেকে বিড়ি বের করে তৃষ্ণার্ত কারোর ঠোঁটে ঝুলিয়ে দেয়, দৌড়ে গিয়ে মুখাগ্নি করার পাটকাঠির বোঝা টেনে আনে, নাইকুণ্ডলী ভাসাতে গেলে শোকে থম মেরে যাওয়া মানুষটার পেছন পেছন নদীতে কোমর জলে নেমে যায়। সে কারণে অপছন্দ করলেও তাকে কেউ সেরকম দুচ্ছাই করে না। ভাবে, আছে থাক, পাগলা ছাতা, কাজেই তো লাগে, অনিষ্ট তো করে না। 

জীবনের এই স্বভাবে জ্বলে ওঠে একমাত্র একজন, সে ঘোষপাড়ার বুড়ি ঘোষ। নামে বুড়ি হলেও শরীরে-মনে সে দিব্যি সুন্দর মাঝবয়সী একটা মেয়ে। অপদার্থ স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে ভেগে গেছে বলে বাপের বাড়িতে থাকতে হয় তাকে। জীবন তার বড়দাদার বন্ধু বলে ছোটবেলা থেকে লোকটাকে সে চেনে। উদোম পাগল তো সে কোনোদিনই ছিল না, তাহলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ কোন ছ্যাবলামি তার ঘাড়ে চেপে বসেছে যে অশৌচের বা রোগবালাইয়ের ছোঁয়াচ লাগার ভয় না করে লোকটা মড়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়! বুড়ির খুব রাগ হয়। 

সেদিন পাকুড় তলা দিয়ে তাদের জমির দিকে যাচ্ছিল বুড়ি ঘোষ, সকাল হলে তার এই এক কাজ, পটোল ফুলে হাতে করে পরাগ ছোঁয়ানো, হঠাৎ দেখে উল্টো দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে জীবন আসছে। তার টাক বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। বুড়িকে দেখেই একটু অপ্রতিভ হেসে সে বলে, সোনাইপুর যাচ্ছি গো। ফিরতে অনেক বেলা হবে। তাই একটু মুড়ি-ফুলুরি নিলাম, খেতে খেতে হেঁটে মেরে দেব এই কয়েক ক্রোশ। 

জীবন ভালোই জানে বুড়ি তার স্বভাবের এই মড়া-শোঁকা ব্যাপারটা একেবারে পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে সে অবাক হয়ে ভাবে, তার ঘরে বৌ নেই, বাচ্চা নেই, মা-বাবা কবে মরে গেছে, সাতকুলে কেউ নেই তাকে নিয়ে ভাবার। ছোটবেলার বন্ধুর বোনের এত জ্বালা কিসের যে দেখা হলেই তাকে এত কথা শোনায়! 

আজও বুড়ির চোখ ধারালো হয়ে উঠল। আনাজ তোলার ঝুড়িটা আছড়ে মাটিতে ফেলে সে চেঁচিয়ে উঠল, জীবনদা, তুমি একটা ধেড়ে শকুন। নিশ্চয়ই সেখানে লাশ পড়ার খবর পেয়েছ। তা কটা পড়ল যে হাতে প্রচুর সময় নিয়ে মুড়ি চিবোতে চিবোতে যাচ্ছ! সবগুলোর গতি করে ফিরবে নাকি? 

বুড়ির এই ঝাঁজালো আক্রমণের সামনে অসহায় জীবন তোতলাতে থাকে, মানে কী বলছিস বুড়ি! একদিনে একসঙ্গে কত লাশ পড়ে! 

বুড়ির শাঁখা-পলা পরা হাত গালে উঠে যায়, ওমা তুমি কিছু শোননি জীবনদা? 

-কী শুনব? কী হয়েছে? আমি তো যাচ্ছি ফয়জল আলির বাড়ি। তার আব্বার ইন্তেকালের সময় হয়েছে শুনলাম। তোর দাদার মতো সেও তো আমার ছোটবেলার বন্ধু রে। তাই ভাবলাম যাই দেখি।

-হায় রে কপাল! তুমি কি কিছুই জান না! হে ভগবান, এ লোকটা লাশ তুলতে গিয়ে নিজেই কবে লাশ হয়ে পড়ে থাকবে! 

বুড়ি ঘোষ সত্যি সত্যি নিজের সিঁদুর পরা কপালে করাঘাত করে। সোয়ামী ছেড়ে চলে গেছে তো কী হয়েছে, সাতপাক যে সারা জীবনের বন্ধন এটা সে জানে এবং বিশ্বাসও করে। জীবনদার জন্য তার এত দরদ কিসের, নিজেও তা ভালোমতো জানে না। কখনো ভাবে, লোকটার চাল নেই, চুলো নেই, আপন বলতে কেউ নেই, সেই কারণেই বোধহয়, আবার কখনো ভাবে, দাদার বন্ধু বলে কথা। ছোটবেলা থেকে দেখছি না। ভালো-মন্দ দুটো কথা কইতেই পারি। 

এখন সে খরখরে গলায় আরও চেঁচিয়ে ওঠে, সত্যি তুমি কিচ্ছুটি জান না? 

জীবন কাঁদো কাঁদো হয়ে এদিক-ওদিক তাকায়, কী ছুঁয়ে কিরা কাটবে ঠিক করতে না পেরে নিজের চকচকে টাকের ওপরেই হাত রাখে, 

-মাইরি বলছি বুড়ি। কিছুটি জানিনি। দ্যাখ, নিজের মাথা ছুঁয়ি বলতেছি। আমি তো ফয়জলের বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমিরুল চাচা নাকি যখন-তখন! যদি কিছু হয়ি যায় সেই জন্য জানাজার সময় মাথা ঢাকার নতুন গামছাও নিয়িছি। চাচা আমারে যা ভালোবাসত সে আর কী বলব! কিন্তু এত লোক একসঙ্গে মরে কিসে? কী হয়িছে রে? ডেঙ্গু না ফের কোভিড? 

-ডেঙ্গু? কোভিড? দাঙ্গা গো দাঙ্গা! সেই সে সেবার লাগতি লাগতি বেঁচে গেল সবাই, সেই দাঙ্গা। এবারটি আর বাঁচতি পারবে কিনা জানিনে। তবে তোমার দিব্যি মজা হবেনে। আজ হেঁদুর মড়া কাঁধে নেবে, কাল মুসল্লির কবরে মাটি দেবে। দুই দলই মরবে কিনা। তা হ্যাঁ গো জীবনদা, কী সুখ পাও তুমি মড়ার গন্ধ শুঁকি? কত লোক যে জীয়ন্তে মড়া হয়ি ঘুরি বেড়াচ্ছে, তাদের তো একটু দেখভাল করতি পার! 

কেন সে মৃত্যুর খবর পেলেই তার মুদির দোকানের ঝাঁপ ফেলে দৌড় মারে, এ নিয়ে জীবন নিজেও অনেক ভেবেছে। কোনো কূল-কিনারা পায়নি। আসলে জীবন-মৃত্যুর মাঝখানের এই ধূসর আলোর মতো আবছায়াটা তাকে খুব ভাবায়। কী ভাবনাচিন্তা করে একটা মানুষ, কী মনে হয় তার, যখন সে মাঝখানের সাঁকোটা পেরিয়ে যেতে থাকে? 

তার মা যখন মরে যায় জীবন তো তখন বেশ বড়। দিব্যি মনে আছে উঠোন গোবর জলে নিকোতে নিকোতে হঠাৎ ছিটেবেড়ার দিকে তাকিয়ে সে বুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, মা, তুমি কোত্থেকে এলে গো? আবার দিদিমাকেও সঙ্গে নিয়ি এসিছ দেখি! পাল্লে তোমরা এতটা পথ হাঁটতি? তোমাদের না বেতো ঠ্যাং?  

এই বলে গোবর জলের ন্যাতাটা ছুড়ে ফেলে বেড়ার দিকে ছুটতে গিয়ে মা উঠোনেই উবুড় হয়ে পড়ল, আর উঠল না। তার আগে কয়েক দিন অল্পস্বল্প জ্বর আসছিল-যাচ্ছিল বটে। কিন্তু সে মরে যাবার মতো কিছু নয়। জীবন কুয়ো থেকে জল তুলছিল, দড়ি-বালতি ভেতরে ফেলে সে দৌড়ে গিয়ে মাকে চিত করে শোয়ালে। এখন বললে বিশ্বাস যাবে না কেউ, মায়ের মুখটা কী হাসি হাসি! যেন সত্যি সত্যি মা-দিদিমার হাত ধরে সে ছোটবেলার চেনা পথে হাঁটা দিয়েছে। 

হাতুড়ে ডাক্তার এসে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, সান্নিপাতিক হয়িছিল। আগে চিকিৎসা করাওনি। শ্লেষ্মা-পিত্ত-কফ তিনটিই মাথায় উঠি যাবার কারণে সে ভুলভাল দেখিছে, ভুলভাল বলিছে। 

তারপর থেকেই জীবন পালের রোখ চেপে যায়, সে মানুষের এক ভুবন থেকে অন্য ভুবনে যাবার ব্যাপারটি নিজের চোখে দেখে বুঝে নেবে। কিন্তু আজ অবধি সে সৌভাগ্য তার হয়নি যে কোনো মৃত্যুপথযাত্রী তাকে মরার আগে বলে গেছে, ‘বুইলে না বাপধন, ঐ দেখতি পাচ্ছি আলো ঝলমল অজানা স্থানের আবছা রেখা। দেখতি পাচ্ছি ঐখানে ভিড়ে দাঁইড়ে আছে আমার চৌদ্দ পুরুষের দল। তারা এসিছে আমারে সঙ্গে নিয়ি যাবে বলে। এবার তবে আমারে খুশি খুশি বিদায় দাও তোমরা।’ 

কিংবা যেতে যেতে যারা মায়া কাটাতে না পেরে ফিরে আসে, তারাও মৃত্যু নিয়ে জীবন পালের নিজস্ব গবেষণায় কিছু সাহায্য করতে পারেনি। সুস্থ হওয়ার পর তাদের কিছু মনেই থাকে না, অল্পস্বল্প মনে থাকলেও সেসব এত ছাড়া ছাড়া আর অসংলগ্ন যে কী বলছে কিছু বোঝাই যায় না! আর লোকে যতই বলুক জীবন পাল মরণের গন্ধ পায় বা তার অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে, জীবন নিজে জানে, ওসব ঠিক কথা নয়। রোগীর বাড়ির মানুষজনের হাবভাব দেখে সে কিছুটা আঁচ করে, কিছুটা পাড়াপড়শির হা-হুতাশ দেখে। তবে কেউ মুমূর্ষু এই খবর পেলে সে একেবারে দেরি করে না। সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়। তবু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে পৌঁছবার আগেই রোগী পটকে যায়, যদিও বা টিকে থাকে, তার আত্মীয়স্বজন জীবনকে এখন আর ঘরে ঢুকতে দেয় না। খারাপ আচরণ করে। জীবনের আর কিছু জানা হয় না। 

কিন্তু ব্যাপারটা এখন একটা নেশার মতো হয়ে উঠেছে। কেউ মরলে তাকে যেতে হবেই। এমনকি রাস্তায় পাগল বা ভিখিরির নাভিশ্বাস উঠলেও জীবন মাটির খুরিতে জল নিয়ে মাথার কাছটিতে বসে থাকে। চোখে-মুখে ছিটিয়ে তার কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করে। মুখের ভেতর দু ফোঁটা ঢেলে দেয়। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁট নড়লে নিজের কান নিয়ে যায় কাছাকাছি। কিন্তু তার জিজ্ঞাসার এ অবধি কোনো উত্তর সে কোথাও পায়নি, কারও কাছে পায়নি। 

আজ বুড়ি ঘোষের মুখে দাঙ্গার কথা শুনে সে ঘাবড়ে যায়। দেশভাগের অনেক পরে হলেও ছোটবেলায় দেশ ছেড়ে পালাবার সময় সে দেখেছে, দাঙ্গা হলো একচোখো এক দৈত্য, যার কোনো বিচার বিবেচনা বুদ্ধি থাকে না। নির্বিচার লুণ্ঠন হত্যা ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না। জীবন তাই বুড়িকে জিজ্ঞাসা করে, কী নিয়ি আবার গোলমাল লাগল? 

বুড়ি কলকলিয়ে বলে, জানো না, এক শ্যাখের বেটার সঙ্গে এক হেঁদু মেয়ের প্রেম। তাই নিয়ি গ্রামের পর গ্রাম তেতে উঠিছে। সে বেটা-বেটি তো পালিয়ে কোথায় গিয়ি বসি আছে, কেউ জানে না। এখন একদল বলে ওদের ধরি মার, আর একদল বলে এদের গলার নলি ফাঁক করি দে। হাওয়া খুব গরম গো, জীবনদা। বেশি ছটরফটর করি এদিক-ওদিকে গেলে নিজেই ঝামেলিতে পড়বে। 

বুড়ি গজেন্দ্রগমনে জমির দিকে চলে যেতে নিয়েও মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে জীবন কোনদিকে যায়। 

জীবন অনেকক্ষণ হাঁ করে রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে। তাহলে সে কি ফয়জলের বাড়ি যাবে না? কিন্তু আমিরুল চাচা যে তাকে বড্ড ভালোবাসত। হয়তো শেষ বেলায় কিছু তাকে বলে যেতেও পারে। আর ছোটবেলা থেকে সে এই এলাকায় বড় হয়েছে, কারও সাতে পাঁচে নেই, মড়া ঘাঁটা ছাড়া আর কোনো নেশা নেই। কেউ তার ক্ষতি করতে কেন চাইবে! বুড়ি ঘোষ চোখের আড়াল হলেই সে যেদিকে যাচ্ছিল সেদিকেই হনহন করে হাঁটতে লাগল। 

কপাল খারাপ জীবনের। সে পৌঁছবার অনেক আগেই চাচার ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল। এমনকি তার মুখটাও দেখা গেল না, কারণ বাড়ির মেয়েরা মৃতদেহটা নিমপাতা, কুলপাতা ভেজানো জলে গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দাফনের কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিয়েছে। সবাই মিলে দূরে বসে ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। গোসল একবার হয়ে গেলে, তারপর যদি পরমাত্মীয়ও কেউ আসে, ঢাকা খুলে আর মৃতের মুখ দেখতে পাবে না।

চাচাকে যখন গোর দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নতুন গামছায় মাথা ঢাকা জীবন বাঁশের চালির পেছন পেছন চলল। ফয়জলের মুখ খুব গম্ভীর। শোকে এমনই মুহ্যমান, জীবনকে দেখেও যেন দেখল না। আত্মীয়স্বজন যারা সঙ্গে যাচ্ছে তারাও তাই, শুধু আমিরুল চাচার খুদে নাতিটা কাদায় পা দেবে যাচ্ছে দেখে ছুটে এসে সবার মধ্যে জীবনেরই হাত ধরে চলতে লাগল। এইটুকুতেই জীবনের মন ভালো হয়ে গেল। কেউ তার সঙ্গে কথা বলুক না বলুক, বাচ্চাটার তাকে আপনজন মনে হয়েছে। 

কবর খুঁদতে গিয়ে বেলচাওয়ালারা হাঁপিয়ে পড়েছে দেখে জীবন আর থাকতে পারল না, লাফিয়ে নেমে গেল গর্তের ভেতরে। সবাই আরে আরে করে উঠলে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফয়জলের মুখের দিকে তাকাল। ফয়জল ভ্রু কুঁচকে বলল, ওহো জীবন, কী যে পাগলামি কত্তিছিস! উঠি আয়, উঠি আয় বলতিছি। 

জীবন উঠে এলে ফয়জল তার হাত ধরে ফাঁকায় নিয়ে বলল, ভাই রে, দিনকাল পালটি গেছে। নতুন মৌলবী এসিছেন গ্রামে। তিনি সবকিছু পছন্দ করেন না। তুই জানাজার নামাজের সময় সবার পিছনে দাঁইড়ে থাকিস। মাটি-ফাটি দিতি যাস না ভাই। জানিস তো নিশ্চয়ই কী গোলমাল চলতিছে। ছেলিমেয়ি দুটোকে পেলি দু তরফের লোকেরাই টুকরো করি ফেলবে। ভালোই হয়িছে, আব্বাকে এই সব দিন দেখি যেতি হলো না। 

ফয়জল পাঞ্জাবির হাতায় চোখের জল মোছে।

জীবন যখন ঘরে ফিরছে, সূর্যের তেজ কমে গেছে। গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির বেড়েছে। আর বাঁওড়ের দিক থেকে মিঠে বাতাস বেটে বেটে ধানগাছগুলোকে হেলিয়ে-দুলিয়ে একেবারে যা তা অসভ্যতামি করছে। 

শরীরটা তার খুবই খারাপ লাগছিল। ক্লান্ত জীবন মাথার গামছা খুলে পাকুড় গাছটার নিচে বসতে যায়, অমনি ধান ক্ষেতের ভেতর থেকে লাঠি হাতে চেঁচিয়ে ওঠে দুজন মদ্দা, কে রে কে ওখানে? অবাক হয়ে জীবন দেখে এদের কাউকে সে চেনে না। আর চিনবেই বা কী করে, মুখের অর্ধেক ঢাকা কালো কাপড়ে, তারই এক প্রান্ত মাথায় পাগড়ি করে পেঁচানো। দুজনেই লাঠি মাথার ওপর তুলে ধরে তার দিকে ছুটতে ছুটতে আসছে। 

একবার জীবন ভাবে ছুটে পালাবে। কিন্তু নধর ভুঁড়ি নিয়ে কি এই সাজোয়ানদের সঙ্গে পারা যাবে! তাছাড়া এতটাই খারাপ লাগছিল তার, মনে হচ্ছিল যেন উঠলেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাই হাতজোড় করে বলে, বাবারা আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। গিয়েছিলাম গোরস্তানে, মনটা ভালো নেই, শরীরটাও। তাই একটু জিরোতে বসেছি। 

মুখ-ঢাকারা পরস্পরের চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে, তারপর হেঁকে বলে, আসা-যাওয়ার পথে কোনো ছেলে মেয়িরে দেখিছ? মেয়িটা রাঙা আর ছেলিটা হ্যাংলাপানা। হাতজোড় করা অবস্থাতেই জীবন বলে, না বাবারা কাউরে দেখি নাই। তারা কি আর আছে এ তল্লাটে, দ্যাখো গে শহরে গিয়ে উঠেছে বোধহয়। 

লোক দুটো চলে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ায়, শহরে? কিন্তু সে কতা তুমি জানতি পেলি কী করে? 

জীবনের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কেন যে বলতে গেল শহরের কথা! এমন সময় হঠাৎ সাইকেলের ক্রিং ক্রিং। দূর থেকে কে যেন আসছে। লেঠেলরা অমনি জীবনের বাঁ দিকের ধানক্ষেতের মধ্যে ঢুকে হাঁটু মুড়ে বসে গেল। 

আলো আরও একটু কমে এসেছে, তবু সাইকেল কাছে এলে বোঝা গেল তাদের গাঁয়ের ধীরাজ সরকার। অল্প বয়সেই পার্টির হোমরাচোমরা। ধীরাজ তো জীবনকে দেখে অবাক, এইখানে একা বসে কী কত্তিছো জীবন কাকা? তোমার তো সাহস কম না, শোননি কিছু? 

জীবনের হাত-পায়ের সঙ্গে সঙ্গে গলাও কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বললে, তোমারও তো সাহস কম নয়। একা সাইকেল চড়ে যেতিছ? 

ধীরাজ সেয়ানার মতো হাসল, কে বললে একা! দ্যাখো তবে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল মুখের ভেতর পুরে বিকট জোরে একটা সিটি বাজায় সে। 

অমনি জীবনের ডান দিকের পাটক্ষেত ভেঙেচুরে একগাদা লোক বেরিয়ে এলো। সবার মাথা মুখ একই কায়দায় ঢাকা, হাতে হাঁসুয়া থেকে শুরু করে মাস্কেট, কী নেই! পান-খাওয়া দাঁত বার করে ধীরাজ হাসে, বলে, আরও আসছে পেছনে। 

জীবন ভয়ে ভয়ে বাঁদিকে চায়। অনেক দূর থেকে উবু হয়ে অনেক লোক যদি ধানক্ষেত বাইতে থাকে, তাহলে যেমন লম্বা একসারি ঢেউয়ের মতো দেখাবে, ঠিক তেমনি কাঁপন উঠছে সেদিকে। তার মানে আরও লোক আসছে দুদিক থেকেই। জীবনের বুক প্রচণ্ড ধড়ফড় করতে থাকে। নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট! গলা যেন কেউ চেপে ধরেছে হাঁটু দিয়ে। তার রক্তবর্ণ মুখ দেখে ধীরাজ সাইকেল থেকে নেমে আসে, অ কাকা, শরীর খারাপ লাগতিছে নাকি? 

জীবন তখন উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই। সারাদিনের রোদ লাগা, না খাওয়া, মন খারাপ, তারপর এই প্রচণ্ড আতঙ্কে তার প্রাণপাখি তখন খাঁচা ছেড়ে উড়তে চাইছে। কণ্ঠার হাড়ে থুতনি লাগিয়ে মাথা নিচু খানিকক্ষণ বসে থেকে জীবন বুঝতে চাইল, কেমন করে জন্ম-মৃত্যুর মাঝের সাঁকোটা পার হচ্ছে সে; কিন্তু কিছুই বোধগম্য হলো না, শুধু চোখের সামনেটা ব্যাপক সাদা হয়ে আসছে দেখে সে ঘড়ঘড় আওয়াজে ধীরাজকে বলল, বাপ, হেঁদু আর মুসল্লি, দুই তরফের কি মরণের সময় একই ভাব লাগে? পরানটা একই রকম খলবলায়? চোখের সামনেটা সাদা হয়ি যায়? মানে সব মানুষের মরণের ধারা তাইলে একই রকম? তবে কেন মিছিমিছি কথা শেষ করতে পারে না সে; কিন্তু নিজেই বোঝে, তার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে। তাই ঘাড় হেলে শরীরটা মাটিতে আছড়ে পড়বার আগে জীবনের মুখে তার মায়ের মতোই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তার জিজ্ঞাসার সব উত্তর সে কোনোদিনই পেল না ঠিকই; কিন্তু নিজের মরণের সময় এই একটি যে সার বুঝ সে বুঝে গেল, মৃত জীবন পালের মুখের হাসিতে সেই তৃপ্তি যেন ঝরে ঝরে পড়তে লাগল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //