এজেম খরাদি

গ্রামের নাম কয়ড়াবাড়ি। এই গ্রামেরই একজন এজেমুদ্দিন। বয়স ৪০/৪২, কিন্তু দেখে মনে হয় ৫৫/৬০। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ, মাথায় টুপি, নামাজি, নিপাট ভালো মানুষ। পড়াশোনা মানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল সে। বউ ছইতন্নেসা আর মেয়ে রাহেলা- দুই প্রজন্মের এই দুই নারীকে নিয়েই তার সংসার। রাহেলা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে এখন শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতির বয়সে আছে।

এজেমুদ্দিনের প্রধান পেশা দুটি। বর্ষা মৌসুমে সে মাঝিগিরি করে বলে তাকে অনেকেই এজেম মাঝি বলে ডাকে, আবার শুকনো মৌসুমে গ্রামে গ্রামে চুড়ি, মালা, স্নো, পাউডার ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করে বলে তাকে এজেম খরাদি বলেও ডাকে। যারা ফেরি করে এসব পণ্য বিক্রি করে উত্তরবঙ্গের পাবনা অঞ্চলের গ্রামের মানুষেরা তাদের খরাদি বলে ডাকে। নামের পরে খরাদি উপাধিটা সেজন্যই। এজেম খরাদি নামটাই তার বেশি পরিচিত। গ্রামে একসময় বাপ-দাদার নামডাক ছিল বলে পরের বাড়ি কামলাগিরি না করে নিজের স্বাধীন পেশাটা এখনো বজায় রেখেছে সে। অবসরে সে পুঁথিপাঠ করে। পুঁথিপাঠের সময় মেয়ে রাহেলা বাবার পাশে বসে তন্ময় হয়ে শোনে।

এখন শুকনো মৌসুম। গৃহস্থ বাড়িতে ফসল উঠেছে ভালো এবার। এজেম খরাদি এক গেরস্ত বাড়ির দেউড়িতে নিজের পণ্যের পসরা ঘিরে বসে আছে। বেশ কয়েকজন মহিলা সেগুলো থেকে পছন্দ করছে। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে এজেম খরাদি। কেউ কাচের চুড়ি কেনে, কেউ ফিতা, কেউবা আলতা। যে বাড়ির দেউড়িতে বসেছে সেই বাড়ির মেয়েরাই যে শুধু কেনে তা নয়, আশেপাশের বাড়ির বউ-ঝিয়েরাও আসে। কেউ কেনে কেউ দেখে। ঘরের দেউড়িতে এজেম খরাদিকে বসিয়ে আশপাশের বাড়ির মেয়েরাও কিনে নেয় চুড়ি, মালা, ফিতা, সুগন্ধি তেল, সাবান, গয়না- আরও কত কী। শুধু টাকার বিনিময়েই যে সব বিক্রি হয় তা নয়, ধান, চালের বিনিময়েও বেচাকেনা হয়। কখনো আবার বাকিও রাখতে হয়। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন রকম সম্পর্ক হয় এজেম খরাদির। বেচাকেনা শেষ হলে গুছিয়ে রওনা দেয় আরেক গ্রামের উদ্দেশে।

ছইতন্নেসা রান্না চড়িয়েছে। আর রাহেলা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। চুলার জ্বালটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েকে এক বালতি পানি দিতে বলে। রাহেলা বালতি নিয়ে কলতলা থেকে এক বালতি পানি নিয়ে আসে। পানি দিয়ে আবার সে যায় উঠান ঝাড়– দিতে। ময়লাগুলো একটা ঝুড়িতে করে বাইরে ফেলে দেয়।

রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরছে এজেম। পথে ২/১ জনের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। পশ্চিম আকাশে সূর্যটাকে মনে হচ্ছে হাঁসের ডিমের গাঢ় লাল কুসুমের মতো। মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। এজেম একটু জোরে হাঁটতে থাকে।

সন্ধ্যাবেলা ছইতন্নেসা রান্না করছে। রান্না শেষের দিকে। কিছু গুঁড়ামাছ রান্না করে ছোট ডিশে রেখেছে। রাহেলা হাত মুখ ধুচ্ছে। এর মধ্যে এজেম বাড়িতে ঢোকে। জিনিসপত্তর ঘরে রাখে। রাহেলা বাবার জন্য হাতমুখ ধোয়ার পানি আর গামছা এগিয়ে দেয়। তারপর এজেম হাতমুখ ধোয়। রাহেলা পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে বাবার সঙ্গেআব্বা আইজ কোন গিরামে গিছালা?

এজেম ওজুু করতে করতে জবাব দেয়- আইজ গিছিলাম দক্ষিণ দিক। কামার গাঁও, পারগোবিন্দপুর, বলবাইড়ি, বাসিদাপপুর, হাইমচেপুর। তোর মনে আছে ছোটকালে তোক সাতে লিয়ে গিরামে গিরামে যাইতিম।

রাহেলার সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে। বাবার সঙ্গে হেঁটে সে পারত না, দৌড়াত মাঝে মাঝে। হাতে থাকত ছোট পুঁটলি। অস্ফুট স্বরে রাহেলা বলে- হয় মনে আছে। আমাক আবার কবে লিয়ে যাইবে আব্বা।

মেয়ের কথা শুনে এজেম হাসে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে- তুই এহন বড় হইছিস না, তোক কি আর লিয়ে যাওয়া যায় মা? যাই মাগরিবের নামাজটা পড়ে লেই। দেরি হইয়ে গেল আইজকে।

এজেম টুপিটা বের করে ফুঁ দিয়ে মাথায় পরে। ঘরের মধ্যে চলে যায়। রাহেলা হাত-মুখ ধোয়। বারান্দায় খেজুরের পাটি পাতে। 

ছইতন্নেসা ভাতের পাতিল থেকে সিদ্ধ আলুগুলো বের করে। ডাকে রাহেলাকে- এ রাহেলা ধর ভাত আর তরকারি বাটি লিয়ে পাটিত রাখ। আমি আলুটা ছেনা করে আসতিছি। পানি দিস জগে।

রাহেলা পাটিতে সব খাবার সাজিয়ে রাখে। এজেম আসে। সবাই এক সঙ্গে রাতের খাবার খায়। সংসারের কিছু কথাবার্তাও হয়।

মালঞ্চী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রহমত। তার গ্রামের নাম হামচিয়াপুর। আঞ্চলিক নাম হামচেপুর। সে জনদরদি জনপ্রতিনিধি। তার একমাত্র আদরের মেয়ে পুষ্প। পুষ্পর মা রোজিনা বেগম। রহমত চেয়ারম্যান মোবাইলে কথা বলতে বলতে উঠানে রাখা চেয়ারটাতে এসে বসে। বসার সঙ্গে সঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে পুষ্প আসে। তার এভাবে আসা দেখে মোবাইলে কথা শেষ করে রহমত চেয়ারম্যান। একমাত্র মেয়ে বলে মেয়ের সব বায়না বাবার কাছে।

পুষ্প-দেখ আব্বা, মা কী সব কয় উল্টা-পাল্টা।
চেয়ারম্যান-কী হয়ছে মা।
পুষ্প- কোন ঘটক না ফটক আইছিলি, মা কী সব কথা কয়। আমি কিন্তু এসবের মইদ্যে নাই।
চেয়ারম্যান-আচ্ছা মা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও, তুমার মাক পাঠায়া দেও।

পুষ্প গজ গজ করে চলে যায়।

চেয়ারম্যানের নম্বরে আবার ফোন আসে। কথা বলতে বলতে রোজিনা বেগম আসে।

রোজিনা বেগম মাথার ঘোমটা দিয়ে আঁচলটা টেনে বলে, ডাকছেন কেন, কী হইছে?
-কী কইছো মেয়েরে?
-ওই যে জহির ঘটক একটা সমন্ধ লিয়ে আইছিলি। আপনে তো সারাদিন কামে ব্যস্ত থাহেন, মিয়িডা বড় হচ্ছে সে খবর তো রাখেন না। 

চেয়ারম্যান বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে- দেহো, আমি সব খবরই রাহি। ও তোমার চিন্তা করা লাগবিনানে। মিয়ের বিয়ে আমি আগে থেকেই ঠিক করে থুইছি।

রোজিনা বেগম অবাক হয়, ও আল্লা, কোনে? আমি তো কিছুই জানিনে। আমাক তো কিছুই কন নাই।
চেয়ারম্যান- সময় হোক সব জাইনবেনে। আটঘরে পৌরসভার চেয়ারম্যান আছে না। হোসেন চেয়ারম্যান। তার ছাওয়াল ঢাকায় বড় ব্যবসা করে, তার সঙ্গে।
রোজিনা বেগম- তাই নাকি। সে তো অনেক বড় ঘর।
চেয়ারম্যান- হুঁ। এখন কাউরে কিছু কইয়ো না। তোমার প্যাটে তো আবার কথা থাহে না। 
রোজিনা বেগম- আইচ্ছা হইছে। আর কওয়া লাগবিনানে।
চেয়ারম্যান- মিয়িকো কিছু কয়ে না কিন্তু কয়ে দিলিম।
রোজিনা বেগম- সে চিন্তে আপনের করা লাগবিনানে। 
রোজিনা বেগম খুশি মনে চলে যায়। আরেকটা ফোন আসে। কথা বলতে বলতে বাড়ির বাইরে যায় রহমত চেয়ারম্যান।

রাহেলার বয়স ১৭, মন উচাটন থাকে সবসময়। এই নিয়ে সদা দুশ্চিন্তায় থাকে তার মা ছইতন্নেসা। কিন্তু মেয়েকে কিছু বলতে পারে না। ইতিমধ্যে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবও এসেছে বেশ কটি। রাহেলার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে ছইতন্নেসা। তেল দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েকে নানা উপদেশ দেয়। 
ছইতন্নেসা-এখন বড় হচ্ছিস। আগের মতো ওত ঢ্যাং ঢ্যাং কইরে পাড়া বেড়াসনি। মাইনসে খারাপ কবি।
রাহেলা- কগ্গা।
ছইতন্নেসা- দেকিচ্যাও মিয়ির কতা। তোর বিয়ির সমন্ধ আসতেচে বিভিন্ন জাগা থেন। এখন একটু আদব-কায়দা নিয়ে চলিস।
রাহেলা- তুমরা আমাক পর কইরে দিবির চাও মা। আমি কি এতই ভারী হইয়ে গিচি।
ছইতন্নেসা- মিয়ির কতার ছিরি দেকিচ্যাও। আমি কি তাই কচ্চি। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া তো লাগবিই মা। এডিই জগতের নিয়ম।
রাহেলা- আমি বিয়ি কইরবো না। যাও তুমার ত্যাল দেয়া লাগবিনানে। আমি একাই লিবির পারবোনে।

মাকে সরায়ে দিয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে নিজেই তেল নেয় রাহেলা। ছইতন্নেসার মনটা খারাপ হয় একটু। 
ছইতন্নেসা- ওরম করে না মা।
রাহেলা- তুমার আর লেকচার দিয়া লাগবিনানে। হেনতেন যাও তো।

রাহেলা একটুখানি তেল মাথায় ঘষতে ঘষতে দেউড়ির পাশে গাছতলায় গিয়ে বসে। ছইতন্নেসা পিঁড়ি, তেলের শিশি ইত্যাদি গোছাতে গোছাতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে- মিয়িডাক একটা কতা কওয়া যায় না। কতা কলিই ফস করে ওঠে। এই মিয়িক লিয়ে যে আমি কী করব!

বেশ কিছুদিন হামচিয়াপুর যাওয়া হয় না এজেম খরাদির। পুষ্প তার মেয়ে রাহেলার বয়সী। মেয়েটা খুব চঞ্চল, বাড়ি মাতিয়ে রাখে সবসময়, আদরের মেয়ে তো। মা-টাও ভালো। এই বাড়িতে ঢুকলে জিনিসপত্র খুব ভালো বিক্রি হয়, বিশেষ করে দামি আর ভালো জিনিসগুলো পুষ্প নিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে অর্ডারও দেয় কী কী আনতে হবে নতুন। দুজনের মধ্যে এমন স্নেহ আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক দেখে বোঝার উপায় নেই কারো মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। রোজিনা বেগম প্রতিদিনই কিছু না কিছু মুখে না দিয়ে আসতে দেয় না। এই বাড়িটির আকর্ষণেই এজেম খরাদি এই গ্রামে ঢোকে।  

চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বাইরে যাচ্ছে। বউকে চাদর দিতে বলে। পুষ্পকে ভালো করে পড়াশোনা করতে বলে। রোজিনা বেগম চাদরটা চেয়ারম্যানের হাতে দেয়। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বের হয়। গেটের সামনে ২/৩টা মোটরসাইকেলে কয়েকজন তরুণ নেতাকর্মী। দেখা হয় এজেম খরাদির সঙ্গে। কথাবার্তাও হয়। 
রহমত চেয়ারম্যান- কী এজেম বাই ক্যাম্বা আছও? তুমার ব্যবসা ক্যাম্বা চলতেছে?
এজেম খরাদি- তা আপনের দুয়ায় ভালোই আছি। পুষ্প মা’র জন্যি কিছু জিনিস আনিছিলাম।
রহমত চেয়ারম্যান- যাও বাড়ির মদ্যি যাও। আমি ইকটু বারাচ্ছি।
এজেম খরাদি- জি আসসালামু আলাইকোম।
রহমত চেয়ারম্যান- ওয়ালাইকুম সালাম।

এজেম খরাদি চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢোকে। চেয়ারম্যান একজনের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে। সবাই সবাই একসঙ্গে রওনা দেয়। চেয়ারম্যানকে বহনকারী মোটরসাইকেল আগে আগে যায়।

চেয়ারম্যানের বাড়িতে সওদা বিক্রি করছে এজেম। পুষ্প এটা নেয় সেটা নেয়। চেয়ারম্যানের বউ মেয়ের পাশে বসে। মেয়ের জিনিসপত্র কেনার ফাঁকে রোজিনা বেগম একটা পিরিচে করে দুইটা রসগোল্লা নিয়ে এসে এজেমকে দেয়।
রোজিনা বেগম- মিষ্টি দুইটা খান এজেম ভাই। আমার ছোট ভাই গোড়রী হাটের থেন লিআইছিলি। খুব ভালো মিষ্টি।
এজেম পিরিচটা হাতে নিয়ে বলে- কী দরকার ছিলি ভাবি। আসলিই খাওয়া লাগবি নাকি।
পুষ্প- খান তো চাচা। ফাইন মিষ্টি।
এজেম- তা তো জানিই। গোড়রী হাটের মিষ্টি সেই টেস।
এজেম গপগপ করে রসগোল্লা দুটি খায়। খাওয়া শেষ হলে রোজিনা বেগম টাকা দেয় এজেমের হাতে। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়।

হামচিয়াপুর গ্রামের প্রবেশমুখে তিন রাস্তার মোড়। একটা আসছে পাবনা শহর থেকে। নাক বরাবর রাস্তাটা গেছে হামচিয়াপুরে, বামদিকির রাস্তা ভবানীপুরে আর ডানদিকেরটা মালঞ্চীর দিকে। মোড়ে একটা বটগাছ। বটগাছের নিচে বিল্লালের চায়ের দোকান। বিল্লালের চায়ের দোকানে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। এজেম খরাদি সেখানে ঢোকে। বোঝাটা নামিয়ে রাখে একপাশে।
এজেম- বাপুরে একটা চা ধরো বালো করে। সঙ্গে একটা নুনতা বিস্কুট দিয়ো।

বিল্লাল একটা নোনতা বিস্কুট এগিয়ে দেয়। চা বানাতে বানাতে বলে- এজেম চাচা, বহুদিন বাদে আইসলা এদিক। শরীলটরীল বালো তো।

এজেম নোনতা বিস্কুটে কামড় দিয়ে বলে- হয় বালোই আছে।

বিল্লাল চা এগিয়ে দেয়- চাচা অনেক দিন তুমার পুঁথি পাঠ শুনিনি। এলাকায় সেরম আসরও বসে না আর আগের মতো।

এজেম চা খেতে খেতে কথা বলে- সেই মানুষ তো আর নাইরে বাপু। এহন সব যে যার ধান্দায় আছে। আল্লাহ রসুলের নাম নাই মুখে। যে যেমন পারে নিজের লাভ আগে দেহে। অন্য মাইনষির কী হইলি না হইলি কেউ দ্যাহে না। 

এজেম খরাদি চায়ের শেষ চুমুক দিয়ে টাকা দিয়ে নিজের বোঝাটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে আসে। 

বেশ কিছুদিন পর পুঁথির বইটা নিয়ে সন্ধ্যাবেলা এজেম খরাদি নিজের বাড়ির উঠানে বসে পুঁথি পাঠ করছে। রাহেলা গভীর মনোযোগে সে পুঁথি পাঠ শুনছে। ছইতন্নেসা রান্না ঘরে রান্না করছে। ডালে বাগার দিচ্ছে। বাগারে দেয়া ডালের লোভনীয় গন্ধে সন্ধ্যাটা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে যেন।

পরদিন এজেম বের হয়ে যাওয়ার পর রাহেলা বাবার ঘরে বসে বাবার ব্যবসার জিনিসপত্র নিয়ে সাজুগুজু করে। চুড়ি, মালা, ফিতা, স্নো মাখে সে। সুন্দর করে সাজে। গুনগুনিয়ে গান গায়।

বারান্দায় কুলোতে চাল বাছছে ছইতন্নেসা। রাহেলা তার কাছে আসে। মাকে দেখায় তার সাজুগুজু। তারপর নাচতে নাচতে বাইরে যায়। মা আশঙ্কায় থাকে তার স্বামী এই খবর জানলে বাড়ি মাথায় করবে। মেয়েকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলে।

গ্রামের রাস্তা। রাহেলা, তার বান্ধবী। বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। বান্ধবীকে নিয়ে সে খুশিতে মজা করে। তার হাত ধরে মাঠের মধ্যে নেচে নেচে গান গায় দুই বান্ধবী। 
আইলো দারুণ ফাগুন রে
লাগল মনে আগুন রে
একা একা ভালো লাগে না
বসন্তেরই এমন দিনে
ফুলের বাগান খালি
কোথায় গেলে পাবো বলো 
আমার সুজন মালী রে।
একা একা ভালো লাগে না ॥

বাড়িতে এজেম খরাদি কিন্তু নরম স্বভাবের মানুষ নয়। রাহেলা তার বাবার ঝাঁপি থেকে চুড়ি, ফিতা, গয়না নিয়ে সেজেছে বলে এজেম খরাদি রেগে আগুন। চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।

নাচতে নাচতে বাড়ি ঢোকে রাহেলা। এমন সময় বাবার চিল্লাচিল্লিতে দেউড়ির কাছে থেমে যায়। তার এতক্ষণের আনন্দ এবার আতঙ্কে রূপ নেয়। সে বাইরে থেকে সব শোনে। কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। তবুও আস্তে আস্তে পা ফেলে ভেতরে ঢোকে। 

মেয়েকে দেখে এজেম খরাদির মেজাজ চরমে ওঠে। সে মেয়েকে মারে। অপরাধ, সে বাবার ব্যবসার জিনিস নিয়ে সাজুগুজু করেছে। মেরে সে বাইরে চলে যায়। পরে মা সান্ত¡না দেয়। রাহেলা একসময় নিজের ঘরে চলে যায়। রাহেলা নিজের ঘরে গিয়ে শরীর থেকে সাজুগুজুর জিনিসিপত্র একটা একটা করে খোলে। চুড়ি খোলে, ফিতা খোলে, টিপ খোলে। তার ভেতরে কান্নার ঢেউ উথলে ওঠে। মা এসে পাশে বসতেই মাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। মা সান্ত¡না দেয়।

বেশ কিছুদিন হামচিয়াপুরের দিকে যাওয়া হয় না তার। এবার পুষ্পর জন্য বেশকিছু নতুন ধরনের জিনিস নিয়ে গেছে সে। তার মনে খুব উত্তেজনা, পুষ্প এগুলো দেখে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। কিন্তু চেয়ারম্যানের বাড়ির কাছে যেতেই বাড়িটা কেমন নীরব মনে হলো। কয়েকবার পুষ্প মা, পুষ্প মা বলে ডাকার পর বেরিয়ে এলো পুষ্পর মা। পুষ্পর মাকে দেখে খুশি হয় এজেম খরাদি, পুষ্পকে ডাকতে বলে, আরও বলে সে পুষ্পর জন্য নতুন কিছু জিনিস এনেছে। কিন্তু পুষ্পর মা পুষ্পকে ডাকে না। নীরব থাকে। নীরবতার কারণ জানতে চাইলে পুষ্পর মা বলে মাস খানেক আগে পুষ্পর বিয়ে হয়ে গেছে, জামাই শহরে থাকে বলে পুষ্পকেও শহরে নিয়ে গেছে। এজেম খরাদি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকল। পরে যখন জানতে পারল বিয়ের সময় পুষ্প তার এই এজেম চাচাকে স্মরণ করেছিল তখন এজেম খরাদির ভেতরটা হু-হু করে উঠল। পুষ্পর জন্য আনা একটি সুন্দর পুঁতির মালা উপহার হিসেবে পুষ্পর মায়ের হাতে দেয়, পুষ্প বাড়ি আসলে দেয়ার জন্য। এরপর এজেম খরাদি চলে যায়। পুষ্পর মা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল করে এইবার এজেম খরাদি চোখ মুছল। পুষ্পর মা-ও চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে।

গ্রামের চিকন রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে এজেম খরাদি। একটা গাছের নিচে বসল। কল্পনা করল তার মেয়ে রাহেলাও শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে তাদেরকে ছেড়ে, বিয়ের সানাই বাজছে, রাহেলার চোখে পানি। এটা ভেবে তার হৃদয়টা মুষড়ে উঠল। মেয়েকে সেদিন সে মেরেছিল একথা স্মরণ করতেই তার চোখে পানি চলে আসলো। কল্পনায় দেখে এজেম খরাদি মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে। মেয়ে বাবার গলা জড়িয়ে কাঁদছে। এ কথা ভাবতেই এজেম খরাদি গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। নিজের হাত দেখে যে হাত দিয়ে সে মেয়েকে মেরেছিল, চারপাশ দেখে। আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

পরদিন সকালে এজেম মেয়েকে ইচ্ছামতো সাজুগুজু করতে বলে। মেয়েটি প্রথমে বিশ্বাস করে না। পরে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। ছইতন্নেসা রান্নাবান্নার আয়োজন করে। সে-ও অবাক। নিজেকেই প্রশ্ন করে- মানুষটার কী হলো আজ। রাহেলা নিজের ঘরে বসে সাজুগুজু করছে।

বারান্দায় খাবার দেয় ছইতন্নেসা। এজেম গোসল করে খেতে বসে। পরম মমতায় স্বামীর পাতে খাবার বেড়ে দেয় ছইতন্নেসা।
ছইতন্নেসা- আইজ আপনের কী হইছে?
এজেম- ও তুমি বুঝবে না রাহেলার মা। আইজ মনে হইলো আমি বাপ হইছি।

ছইতন্নেসা কিছু না বলে স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। চোখে তার আনন্দাশ্রু ঝিলিক দেয়। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বউকে বলে- দ্যাও। আমার জিনিসপত্র একটু বাইর করে দ্যাও। আর মেয়েডারে ডাহো। ছইতন্নেসা খাবারের বাসনকোসন অদূরে চুলার পাড়ে রেখে এসে ঘরের মধ্য থেকে এজেমের জিনিসপত্র নিয়ে এসে উঠানে রাখে।

এজেম- কইরে মা, তাড়াতাড়ি আয়। দেরি হইয়ে যাচ্ছে।

রাহেলা ঘর থেকে উঠানে আসে। নতুন শাড়ি, চুলে ফিতা, পায়ে আলতা, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কপালে টিপ, চোখে কাজল। এজেম মেয়েটাকে প্রাণ ভরে দেখে। ছইতন্নেসাও দেখে। রাহেলাকে আদর করে খুশি মনে সবার কাছে বিদায় নিয়ে কাজে বের হয় এজেম খরাদি।

গ্রামের রাস্তা। এজেম খরাদি তার চলমান দোকানের পণ্য সামগ্রী নিয়ে খরিদ্দারের উদ্দেশে ডাকতে ডাকতে হেঁটে যাচ্ছে- এই চুড়ি-মালা-স্নো-পাউডার-আলতা-চিরুনি আছে। আছে লেসফিতা লেস।

রাস্তার মোড় পেরিয়ে একটা ঝাঁকড়া বটগাছের পাশ দিয়ে ডানদিকে অদৃশ্য হয়ে যায় এজেম খরাদি। শুধু শোনা যায় তার কণ্ঠের ধ্বনি- এই চুড়ি-মালা-স্নো-পাউডার-আলতা-চিরুনি আছে। আছে লেসফিতা লেস।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //