মাকড়সা ও অন্যান্য গল্প

এনরিকে আন্দেরসন ইমবের্ত (১৯১০-২০০০): আর্হেন্তিনীয় ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক। শব্দতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ে লেখাপড়া করেন বুয়েনস আইরেস বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা করেন কুইয়ো বিশ্ববিদ্যালয় এবং তুকমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ সাল থেকে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন হিস্পানি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। তার বইগুলোর মধ্যে আছে- জাগরণ, চেশায়ারের বিড়াল, প্রতিগল্প : নিরীক্ষাধর্মী গল্প সঙ্কলন, রাজকীয় বার্তা, বিজয়, বিশ্বের প্রথম গল্পগুলো ইত্যাদি। অনূদিত গল্পগুলো আন্দেরসনের গল্প সংগ্রহ সময়ের তাঁতে বুনোনো বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন কার্লেতন ভাইল এবং পামেলা এডওয়ার্ডস-মনড্রাগন। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। ভাষান্তর: রায়হান রাইন

মাকড়সা
মনে হলো, আমার হাতের উপর কিছু একটা আছে। দেখলাম একটা মাকড়সা। 
আমি তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে কী করছ?’
মাকড়সা লাফিয়ে কিছুটা সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখানে কী করছ?’ 
আমি আবারও তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু এটা আমার জগৎ এবং তোমার উচিত চলে যাওয়া...।’
মাকড়সা আবারও লাফিয়ে এলো আমার সামনে এবং বলল, ‘আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না, কিন্তু এটা আমার জগৎ এবং তোমার উচিত চলে যাওয়া।’ 
আমি বুঝলাম, তার সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই আমি আমার হাতটাকে রেখে চলে গেলাম। 

রাজপুত্র
যখন রাজপুত্রের জন্ম হলো, আয়োজন করা হলো এক বিশাল জাতীয় উৎসবের নাচ-গান, আতশবাজি পোড়ানো, ঘণ্টা বাজানো, কামান দাগা- এরকম নানাকিছু হলো।গোলাগুলির আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সদ্যোজাত শিশুটি মারা গেল। 

শেষ বিচার 
রাউল তার গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলের বন্ধু হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে তারা দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ করে ইতিহাস, শিল্প কিংবা দর্শন নিয়ে...। এই স্বর্গদূত ছিলেন ফাঁপা এবং অসংবেদনশীল, তাই কোনো একদিন ফাঁস করে দিলেন গোপন কথা- যখন শেষ বিচারের দিন আসবে, বেজে উঠবে শিঙা, কিন্তু সেটা বাজবে ধীরলয়ে। সব কমলালেবু হয়ে উঠবে আদর্শ কমলালেবু। সব পান্না হয়ে উঠবে নিখাদ পান্না। সব মানুষ সমবেত হবে মানবের প্রত্নপ্রতীক হয়ে... এবং অন্য সবকিছুর ক্ষেত্রে ঘটবে একই রকম ঘটনা। যখন অগণিত বস্তুপুঞ্জ, শ্রেণিবদ্ধ সব কিছু হয়ে উঠবে অনন্য দৃষ্টান্ত, তখন ঈশ্বর একটা জাদুঘর হিসেবে সবকিছুর দেখভাল করবেন। 

গরিব 
রাজা মারা যাচ্ছিলেন এবং রাজকুমার বুঝতে পারলেন তাকে রাজাসনে বসতে হচ্ছে শিগগিরই। এ কারণে উত্তরাধিকারী রাজকুমার ঘোষণা করলেন, তিনি রাজ্যের সবচেয়ে গরিব লোকটির সঙ্গে দেখা করবেন (তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সহানুভূতি আদায় করা), কিন্তু রাজ্যে কোনো গরিব লোক ছিল না। পরে মন্ত্রীরা যথেচ্ছভাবে ধরে আনলেন এক লোককে। তাকে চাকরিচ্যুত করলেন। কেড়ে নিলেন বাড়িঘর। দুর্ব্যবহার করলেন তার সঙ্গে এবং তার দেহে জীবাণু প্রবেশ করিয়ে দিলেন...। 

স্বর্গদূত
‘দেখ, ওই দিকে একজন স্বর্গদূত আছে,’ লুইস আমাকে বলল এবং কামরার অন্য দিকটা দেখাল যেখানে এক তরুণীকে দেখা যাচ্ছিল- দীর্ঘদেহী, তন্বী, স্বর্ণকেশী, রমণীয় ও হাস্যময়ী। মেয়েটি কথা বলছিল কয়েকজন অতিথির সঙ্গে। 
প্রথমে দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, মেয়েটি কথা বলার সময় ঘন ঘন হাত নাড়ছিল। ‘বেচারি!’ আমি ভাবলাম, ‘তার ডানা দুটোকে তারা কেটে রেখেছে, এ কারণে তাকে বেশি বেশি হাত ঝাপটাতে হচ্ছে।’
কিন্তু, না। ডানা তার ছিল ঠিকই, যদিও আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না। অবশ্যই ডানা ছিল তার, কারণ যখন ভোজসভা ছেড়ে বেরোল, বাইরের আঙিনায় গিয়ে সে উড়তে শুরু করল রাতের ভেতর। 

মিতব্যয়
স্বর্গদূত তাকে বললেন, 
‘মন দিয়ে শোনো, ক্রিস্তোবালোন। তুমি যা চেয়েছ, আমি দিয়েছি; এখন থেকে এবং ঠিক এখান থেকেই তুমি চাইলে অলৌকিক ঘটনাগুলো ঘটাতে পারো। যা-ই হোক, প্রতিটি অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর পর তোমার আয়ু কমে যাবে। আর এ রকম ঘটনা তুমি ঠিক কতগুলো ঘটাতে পারবে আমি তা জানি না।’ 
ক্রিস্তোবালোন সন্তুষ্ট হলেন এবং ভাবলেন, তাহলে তো মিতব্যয়ী হতে হবে। তিনি মারা গেলেন নব্বই বছর বয়সে, একটিও অলৌকিক ঘটনা না ঘটিয়ে। 

ঘুষ
কার্লোসের বয়স সাত বছর। হঠাৎ সে তার প্লেট থেকে একটা হাড় সরিয়ে তার ঘাড়ের উপর দিয়ে ছুড়ে দিল কুকুরটার সামনে, কাজটা সে করল খুব দ্রুততার সঙ্গে যাতে মা-বাবা দেখতে না পান। 
‘না না! এরকম কোরো না, কখনো এরকম কোরো না,’ তার মা বললেন। ‘তোমার রক্ষক দেবদূতের গায়ে গিয়ে লাগতে পারে, হয়তো এখনই তুমি তার চোখে লাগিয়ে ফেলেছ। একজন একচোখা দেবদূতকে সঙ্গে নিয়ে চলাটা ভালো হবে ভাবছ?’
কার্লোস পেছন ফিরে হাওয়ার গতিবিধি লক্ষ করল, কেমন অস্থিরতা সেখানে। এটা দেখে সে বুঝতে পারল, তার পেছনে সব সময় একজন রক্ষক দেবদূত থাকেন। তারপর থেকে সে বেড়ে উঠতে থাকল অনুগত, হতাশ আর বিষণ্ণ হয়ে। সারাক্ষণ তার পেছন পেছন চলেন এক দেবদূত। যখনই সে খারাপ কিছু করতে যায়, একটা আওয়াজ ভেসে আসে, ‘ওটা কোরো না, ওটা কোরো না।’
একবার, তার বয়স যখন পনেরো, সে একগুচ্ছ আঙুর কেটে নিচ্ছে দেখে বাড়ির মালিক বেরিয়ে এলো এবং তার গালে একটা চড় কষিয়ে দিল। কার্লোস সাপের মতো ক্ষিপ্রতা নিয়ে তার চাকুটা ঢুকিয়ে দিল লোকটার হৃৎপিণ্ডের ভেতর। 
হায় প্রিয়, এখন কী হবে?
সে পেছন ফিরে তার রক্ষক দেবদূতকে বলতে শুরু করল, ‘বেশ, আমি জানি তুমি আমার পাশে আছ। আমি জানি তুমি আমার উপর নজরদারি করে যাচ্ছ, আর এ ঘটনা তুমি ঈশ্বরকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু দেখেছ এই জিনিসটা?’
কার্লোস তাকে চাকুটা দেখাল। 
‘দেখ এটা একদম নতুন, ইস্পাতে বানানো, রক্তমাখা। এরকম একটা জিনিস তোমার কখনোই ছিল না, তাই না? ঠিক আছে, এটা আমি তোমাকে দিয়ে দেব, যদি তুমি ঘটনাটা গোপন রাখো।’
রক্ষক দেবদূত ঘুষটা নিলেন এবং চাকুতে পড়া প্রতিবিম্বের সঙ্গে খেলতে খেলতে খুশি মনে চলে গেলেন। 
ঈশ্বর কার্লোসের অপরাধ সম্পর্কে কখনো জানতে পারেন নাই, (এমনকি একজন দেবদূত যে কখনোই স্বর্গে ফেরেননি, এটাও তার মনে পড়ে নাই)।
কিন্তু কার্লোস তবু অনুতাপের যন্ত্রণায় কাতর হয়েছে, যদিও তার উপর ঈশ্বরের দৃষ্টি নেই এবং তার সঙ্গে কোনো রক্ষক দেবদূতও থাকে না। ঈশ্বর ও দেবদূত কি কোনো অপেরার পুলিশ? 
ঘুষ কোনো কাজই করেনি, তার অন্তঃকরণের একটা নিজস্ব আওয়াজ শুনতে পেত সে। 

ঈশ্বরের সৌজন্য
নিরিবিলি অন্ধকারে আজ যখন আমি বিশ্রাম নিচ্ছি, কারও পায়ের শব্দ পেলাম। আমার লুকিয়ে থাকার জায়গাটা আরও কেউ খুঁজে পেয়েছে, এবং এসেছে আরাধনা করতে। এবার আমি কিসে রূপান্তরিত হবো? আমি সোজাসুজি গলিপথের দিকে তাকালাম এবং হতচ্ছাড়া জীবটাকে দেখতে পেলাম। সারা গায়ে পশম, হাঁটছে দুই পায়ে ভর দিয়ে, ডুবু ডুবু চোখে ভয়, আশা আর ভালোবাসার অভিব্যক্তি এবং চওড়া নাকের কারণে দেখাচ্ছে বেশ হাসি হাসি। তাকে দেখতে পাওয়ার পর তার প্রতি সৌজন্যবশত আমি বড় একটা শিম্পাঞ্জির আকার ধারণ করলাম এবং দেখা করতে গেলাম তার সঙ্গে। 

দুই ভূত
সেই কালো, বিষাদভরাতুর গ্রীষ্মরাতে আমি শুয়ে থাকতে গিয়েছিলাম এক জম্বুগাছের নিচে। আমি যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি, একটা শব্দ শুনলাম, যেন একটা গাভী ডেকে উঠল। চিঁ চিঁ করা কোনো কব্জার এক দীর্ঘ জং ধরা আওয়াজ। প্রান্তর জুড়ে কালো, কালো আর কালো-একই রকম চিঁ চিঁ শব্দে একটা চওড়া দরজা খুলে গেল, আর সে বেরিয়ে এলো সেই দরজা দিয়ে, যেন ভূতের আগুন। 
‘ওহ, ক্ষমা করবেন,’ আমাকে দেখতে পেয়ে সে বলল। তার উজ্জ্বল আলোয় আমাকে দেখতে পাওয়া খুব সহজ ছিল অবশ্যই। 
আমি কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে এবং শুকনা গলায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কে আপনি জনাব?’
‘আমাকে মাফ করবেন। আমার ভুল হয়ে গেছে।’
‘আপনি কী চান?’
‘আমি? কিছুই চাই না। বিদায়! আপনাকে তো বলেছি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এটা আরেক জগৎ, তাই না?’
‘নাহ! আরেক জগৎ মানে কী? এটাই জগৎ।’
‘আচ্ছা। আপনারা তাই বলেন নাকি?’
এবং সে উধাও হয়ে গেল। 

ডানা
আমি তখন হুমাহুয়াকায়, একজন ডাক্তার। এক বিকালবেলা তারা এক আহত বালককে নিয়ে এলো আমার কাছে। সে পাহাড়ের কিনার থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি যখন পরীক্ষা করার জন্য তার গা থেকে আরোহীর পোশাক খুলে ফেললাম, দেখলাম দুটো ডানা। ডানা দুটো পরখ করে দেখলাম, জখম হয়নি। বালক যখন কথা বলতে পারছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 
‘বেটা, যখন বুঝলে যে পড়ে যাচ্ছ, কেন তুমি উড়তে শুরু করো নাই।’
সে বলল, ‘উড়ব? আর সবার হাসির পাত্র হবো?’

দারোয়ান 
গুস্তাভো একটা জরুরি ব্যাপারে প্রাসাদে ঢুকতে চাইল, কিন্তু দারোয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। গুস্তাভো দারোয়ানের সামনে বসে অপেক্ষা করল। ইতিমধ্যে অনেক লোক ভেতরে ঢুকল এবং বেরিয়ে গেল। 
যাওয়া-আসার সময় তারা দারোয়ানকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল হেসে হেসে। গুস্তাভো ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আমি কি ভেতরে যাব?’
‘এখনো সময় হয়নি।’
গুস্তাভো অপেক্ষা করতে থাকল। সে অপেক্ষা করল সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। একদিন দারোয়ান তাকে অনুরোধ করল কিছুক্ষণের জন্য তার দায়িত্ব নিতে। তারপর, শিগগিরই সে ফিরে এলো। 
অন্য একদিন দারোয়ান তাকে একই অনুরোধ করল আবারও। কিন্তু এবার সে উধাও হয়ে গেল, আর ফিরল না। গুস্তাভো তার অপেক্ষা অব্যাহত রাখল, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস। যাওয়া-আসার সময় লোকেরা তার সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠল এবং তাকেও হেসে শুভেচ্ছা জানাতে থাকল। 
গুস্তাভো অবশেষে বুঝল, সে-ই এখন দারোয়ান। কিন্তু সে জানে না তার উচিত হবে কিনা নিজেকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া, যেখানে যাওয়া এখনো দরকার তার, একটা জরুরি ব্যাপারে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //