পুনঃ পদক টেন্ডার

টেন্ডারের মতো করিয়াই একুশে পদকের জন্য আবেদনের একটি বিজ্ঞপ্তি সম্প্রতি পত্রিকায় দেখিলাম। 

বরকত-সালাম-রফিক-জব্বার-শফিউদ্দিনের নাম ভালো করিয়া বলিতে পারেন না, তেমন জানেন না, এমন অনেকেও যে একুশে পদক প্রাপ্তির জন্য নীরব-উন্মাদ হইয়া যান, তাহা প্রত্যক্ষ করিবার মহাসৌভাগ্য এই অধম বান্দারও হইয়াছিল! একবার নহে, অনেকবার।

কেননা তাহারা বুদ্ধি নিতে আসেন। কোথায়, কাহাকে, কেমন করিয়া কাহার পুচ্ছ ধরিলে ঐ পদক-মুকুট করতলে আসিয়া মস্তকের উপরে স্থান অধিগ্রহণ করে। চা-টা আপ্যায়ন করিয়া কহি, ভ্রাতঃ কিংবা ভগিনী, আমার একটি দৈশিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অবস্থান রহিয়াছে, যাহা পরিস্থিতি-পরিবেশ-সময়-অতিজ্ঞতা এবং জ্ঞানসংগ্রহ প্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল। তবে রাজনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট যে ‘নীতি’ অংশটুকু বিরাজমান, তাহা সাধ্যমতো অপরিবর্তনীয়। অতএব কোথায় কোথায় কাহাকে কিংবা প্রকারে কোন কোন প্রকারের হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয় তৈলং প্রদান করিয়া আপনাকে পদক পাওয়াইয়া দিয়া ন্যূনতম ছয় মাসের সংসার খরচ চালাইবার জোগান করিব, সেই বুদ্ধি এই টাক-ঘটে যে শূন্য হাহাকারে।

তাহারা তখন পিছাইয়া দ্বিতীয় অবস্থানে স্থান গ্রহণ করিয়া বলে, তবে পদক পাইবার আবেদন ফর্মে প্রার্থীর সপক্ষ কিছু লিখিয়া দেন। অবশ্য এক্ষেত্রে আমি বিশেষণের ভাঁড়ার উš§ুক্ত করিয়া দিবার মতো উদারতা প্রদর্শন করিয়া তাহাদের কৃষ্ণ বদনের ম্লান আভা কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল করিয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়া দিই।

একুশে কিংবা স্বাধীনতা পদকের প্রশ্নে অনুরোধসমূহ অনেকটা এইরূপ : স্বাধীনতা পদক হইলে ভালো হয়, তবে আমার রেকর্ডসমূহ যদি না কুলায় তাহা হইলে একুশের জন্যই আবেদনটি তৈরি করিয়া দিন। এই রকম একটি আবেদনপ্রার্থীর কাছে কহিলাম, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের বাহিরের নাগরিকেরা যেমন উজ্জ্বল ভূমিকা রাখিয়াছেন, তাহাদের মৈত্রী সম্মাননা পদক দেওয়া হইয়াছে। পরে জানা গেল, ঐ পদকের নকশায় যে স্বর্ণ ব্যবহৃত হইয়াছে সবই নাকি ভেজাল। দায়িত্বপ্রাপ্তরা কহিলেন, সর্বদোষ এই বুড়িগঙ্গার ঐ পারের কেরানীগঞ্জ। এই কাহিনি কহিলে আমার সম্মুখে ঠায় বসা পদকপার্থী কহিলেন, ইহাতে আবার শোরগাল কেন? ঐ কেরানীগঞ্জে গিয়াই ভেজাল স্বর্ণের বদলে সঠিক স্বর্ণের ডিজাইন জুড়িয়া দিব। পদক পদকই। উহার আবার ভেজাল-নির্ভেজালের কী হইলো! কহিলাম, ও হে, তাহাই করিয়া ফেলুন। তিনি কহিলেন, আরে বুঝিলেন না, এই যুগ মিডিয়ার যুগ। আগে রেডিও-টেলিভিশন-পত্রপত্রিকা-ইউ মিঁউ না কী যেন মিডিয়ায় খবর বাহির হইলে যেমন সাড়া পড়িয়া যায়, তাহা ভাবা যায় না। হায়! আমার এক বছরের নাতিও খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠে।

এই নেন, সঙ্গে রাখি, এক খিলি পান!

এইবার আসুন নোবেল পদকপ্রাপ্তদের কাছাকাছি জানা একটি সত্য কাহিনি বলি। এই মর্ত্যভূমিতে অমর্ত্য সেন বাঙালিকে অনেকেই জানেন। ভদ্রলোক পূর্ব বাংলার। কিন্তু ১৯৪৭ সাল ওনাকে মর্ত্যরে পশ্চিম বাংলায় পারিবারিক শান্তিনিকেতন এলাকায় স্থায়ী ঠিকানার নিধারিত ঠাঁই করিয়া দিলেন। মানিকগঞ্জের বিশ্বমানিক অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। মানিকগঞ্জের ‘জজবাড়ী’ ছিল অমর্ত্য সেনদের বাড়ির পরিচিতি। ঐ বাড়ি হইতে প্রভূত জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের উৎপত্তি ঘটিয়াছিল। ঐ বাড়িটি একটি পর্যটন রিসোর্ট হইলে একালের মূর্খরা হয়তোবা ধন্য হইতাম।

তা অমর্ত্য কাকুর কিঞ্চিৎ ত্রুটি রহিয়াছে। যাহা সত্য বুঝেন তাহা ফট করিয়া মৃদুভাষণে নম্রস্বরে বলিয়া থাকেন। তিনি তাহার দেশ ভারতের এক নম্বর ক্ষমতাবানের কার্যক্রমকে মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকারক মনে করেন। কেননা অমর্ত্য এই মর্ত্যভূমিতে অশান্তি-বিভাজন-ভেদনীতি-সাম্প্রদায়িকতা সহিতে পারেন না। ঐদিকে প্রধান ক্ষমতাবানজি আবার ভেদনীতির বিষ ঢুকাইয়া  ক্রমসাফল্য কুড়াইতেছেন। অমর্ত্য সেন তাই তাহার চোখের বিষ, অন্তরের জ্বালা, ভয়ংকর শত্তুর।

শান্তিনিকেতনে বংশানুক্রমে অমর্ত্য সেনের গৃহবাটি। আরও অনেকের। ইহা লইয়া কোনোদিন কেহ কিছু বলে না। কোনো অভিযোগও ওঠে না। বিশ্ব-উজ্জ্বল অর্থনীতিবিদ নোবেল পদক পাইবার পর যখন মহাক্ষমতাধরজির ভারত পরিচালনার নীতিতে ঝাঁকুনি দিলেন, অমনি অমর্ত্যবাবুকে কাবু করিবার জন্য মর্ত্যভূমিতে শান্তিনিকেতনে তাহার পূর্বপ্রজন্মের পরিবার বরাদ্দ হইতে বেশি জমি দখল করিয়া রাখিয়াছেন শতবর্ষ ধরিয়াঅতএব দখলদার অমর্ত্য তুমি ঐ জমি কল্য সকালেই বিশ্বভারতীকে বুঝাইয়া দাও। নোবেল পদক পাইয়া বিশ্বখ্যাতনামা হইবার হ্যাপা বুঝুন।

এইবার বলি আমাদের স্বদেশি নোবেল পদকজয়ী খ্যাতিমান মহান ডক্টর সাহেবের কথা। না, তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ হইলেও অর্থনীতিতে পদকটি পান নাই, পাইয়াছেন ‘শান্তি’ বিভাগে। প্রথমত আমরা দেশবাসী লম্ফ দিয়া উঠিলাম আমাদের এই অর্জনে। কিন্তু চট্টলার সওদাগর পুত্র সওদাগরী জানেন ভালো। দুনিয়া জুড়িয়া তাহার অশেষ প্রতিপত্তি ইত্যাদি। নানা দেশে ডাক পড়ে। সম্মান পান। কথা বলেন মূল্যবান। তাহার গ্রামীণ সাম্রাজ্য ক্রমবর্ধমান। ‘গ্রামীণ’ ব্র্যান্ডটি এতই পরিচিত হইয়াছে যে গাঁও গেরামে ‘এই গ্রামীণ বুটভাজা’ও নাকি দারুণ পসার জমাইয়াছে। ক্ষুদ্র ঋণে এমন বিশাল সাম্রাজ্য গড়িয়া তোলা সহজ কথা নহে।

কেন জানি আমাদের বাংলা অংশটুকুর উপর বিদেশিদের পেয়ারা নজর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একালের প্রিগোজিন মালিকানার মতো দেশে দেশে সৈন্য নামাইয়া করপোরেট ব্যবসা খুলিয়াছে। সেই বিদেশিদের ইহার-উহার নজরদারি কখনোই কমে নাই। পূর্ব বাঙালিদের জাতিসত্তার মেরুদ- ভাঙিতে রোমহর্ষক হত্যাকা- ঘটায়। অতঃপর একসময় এক-এগারো পিলিন বানায়। তাহাতে কী! মুশকিল হইল, হিলারি+ ক্লিনটন+ ইউ. সাহেব মিলিয়া নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গড়িয়া ১৫ বছরের জন্য সরকার বানাইয়া যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে হঠাৎ ক্ষমতা দখল করে। এই কোম্পানির নিভৃতের মহাপরিচালক হইলেন ইউ. সাহেব। অতএব দেশের বিদ্যমান ক্ষমতাশালী রাজনীতির ব্যক্তিবর্গের সহিত ইউ. সাহেবের বারংবার দ্বন্দ্ব বাধিল। মামলা হইল। মামলার গামলার সাফল্যের ফেন এখনও পাইলেন না ইউ. সাহেব। যিনি এখন এদেশের ‘সুশীল প্রিগোজিন’ নিভৃতে।

ইউ. সাহেবের নামে কিছু আন্তর্জাতিক এবং কিছু জাতীয় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রটিল, মামলা চলমান। 

শ্রমিক-কর্মচারীরা অভিযোগ ও আইনগত প্রতিকারের অধ্যায়ে প্রবেশ করিল! গ্রামীণ ব্যাংকে সরকার অংশীদার। ৬০ বছরের বেশি কেহ ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকিতে পারেন না। শক্তিমান বীর ইউ. সাহেব তবুও থাকিবেন। আইন তাহাকে আইনি পদ্ধতিতে ঐ পদ হইতে সরাইয়া দিল। তবুও বিশাল ইউ. সাম্রাজ্য এখনও দেশে একটি ‘জাতীয় সরকার’ গড়িবার পাঁয়তারা চালাইতেছে। ইউ. সাহেব হইবেন তাহার ‘পরধানিয়া’। ইহাই ক্ষমতার ছন্নছাড়া-ছন্দহারা দ্বন্দ্বের ভেদ বৃত্তান্ত। তবে অনেকেই জানেন তিনি আশ্রমবাসী শান্তির মহাপুরুষ! পূর্ব বাঙালির প্রথম নোবেল পদক জয়ী।

নোবেল হইতে এইবার ‘একুশে এবং স্বাধীনতা’ পদকে ফিরিয়া আসি। ইহকালে ‘একুশে পদক’ লাভ করিবার কপাল অধমের নাই। কারণ ‘একুশে’ বিষয়টির মর্ম আমি জানি। দেশের হাজার হাজার ব্যক্তি আমার চেয়েও অগ্রগণ্য একুশে পদকপ্রাপ্তির দৌড়ে। অবশ্য অধম ঐ দৌড়ে যোগ দেয় নাই। আবার উল্টোদিকে এমন এমন ব্যক্তি একুশে কিংবা স্বাধীনতা পদক পাইয়াছে, উহাদের কাতারে যদি কাতার দেশটির সর্ববিশুদ্ধ তেল সংগ্রহ করিয়া যুক্ত হইবার সুযোগ হয়, আল্লাহর কসম তাহাতে যোগ দিব না। লোকে ভাবিতে পারে, ‘ঈর্ষা’ নামক ভাইরাসে অধম আক্রান্ত। তাহা হইলেও হইতে পারি। মানুষের রিপুর গভীরেই এই ভাইরাসের বসবাস। তবে চারিপাশের বাস্তবের থাপ্পড় খাইতে খাইতে ঈর্ষা ভুলিয়া গিয়াছি। ঐ একুশে পদকের টেন্ডার নোটিশখানা পত্রিকায় দেখিয়া নানাবিধ পদক নিয়া মাথায় কথা জাগিল, কলমে কালি যুক্ত হইল।

লোকেরা কহেন, বাংলা উপন্যাস-কবিতায় বিভূতি-তারাশংকর-মানিক-জীবনানন্দ-নজরুল নোবেল সম্মানে সুরভিত হইবার যোগ্য ছিলেন। কলিকাতায় একবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাত-বউ কলেজ শিক্ষয়িত্রী অজয়ার (সম্ভবত) সহিত কথা হইয়াছিল। তিনি তো কথার ককটেল ফুটাইতেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নহে, নোবেল পাইবার কথা মানিকের। রবি ঠাকুর তাহার কবিতায় ইংরাজি মার্কেটিং করিয়া নোবেল বাগাইয়াছেন। ঐসব ধান্দাবাজি মানিকের ছিল না। 

তবে প্রতিবেশী ভারতে পদ্মভূষণ ইত্যাদি বহু পদক বিতরণ চলে। প্রবীণ এক সাংবাদিক বন্ধু কহেন, না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এতটা পচে নাই। ২৫% পায় যোগ্য লেকেরা, ২৫% পায় দলীয় লোকেরা, বাকি ৫০% পায় শক্তিশালী আমলা গোষ্ঠীর অনুমোদিত প্রতিভা তারকাবৃন্দ।

এই দেশে এখন পদক পাইবার নানাবিধ তরিকা চলিতেছে। যোগ্য তারকারা  কেহ কেহ তরিকা ছাড়াই পদক পাইয়া থাকেন! ‘আধাযোগ্য + তরিকাবিশারদ’দেরই রমরমা অবস্থা। এবারের টেন্ডারে যাহাদের কপালে আস্বাভাবিকভাবে পদকটি জুটিবে তাহাদের অগ্রিম অভিনন্দন। বাজারে তেলের দাম ইদানীং অতি সামান্য কমিয়াছে। একশত টাকা বাড়িয়া পাঁচ টাকা কমিয়াছে। 

অতএব জয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //