মেথিমাখা চুল

সুজয় যতবার হিয়ার পাশাপাশি হেঁটেছে ততবার সেই ঘ্রাণটা ওকে মাতাল করে তুলেছে। 

এই হিয়া বলত, তোমার শরীর থেকে এমন ভুর ভুর করে কীসের ঘ্রাণ বেরয়। অন্য মেয়েদের শরীর থেকে তো এমন ঘ্রাণ বেরয় না!

সুজয়ের প্রায়ই মনে হয় হিয়াকে একবার জিজ্ঞাসা করবে। পরক্ষণেই নানা বিচিত্র ভাবনা ভেবে সুজয় আর হিয়ার কাছে এটা জানতে চায় না।

এই তো সেদিন যখন ক্যাম্পাসের বটতলার বুড়ো বটগাছের নিচে খুব সকালে ওরা মিডটার্মের নোটপত্র নিয়ে আলাপ করছিল সেদিন হিয়া খুব কাছাকাছি বসেছিল সুজয়ের। এত কাছাকাছি যে হঠাৎ যে কেউ দেখে ফেললে ঘনিষ্ঠতার ধরন দেখে নানা কিছু ভেবে নিতে পারে। এমনিতে বৈশাখের খরতাপের এই সময়ে ক্যাম্পাসের চারিদিকে জারুলের ঘন সবুজ সকালটাকে নিবিড় করে তোলে। এরপর নিস্তব্ধ সকালে হঠাৎ পাখির কলকাকলি। কোথাও হঠাৎ একটা ঘুঘু উড়ে যায়। হিয়া বলে ওঠে, সুজয় তুমি এটা জানো যে ঘুঘু জীবনে কখনো তার সঙ্গী বদল করে না। বছরান্তে একই সঙ্গীর সাথে সে বসবাস করে। সুজয় আনমনে কী যেন ভাবছিল। এদিনও হিয়ার ঘনকালো চুল থেকে ভুর ভুর করে সেই ঘ্রাণটা ভেসে আসছিল। সুজয় সেই ঘ্রাণে মেতেছিল।

এই সুজয়, সুজয়? তুমি তো দেখি পড়াশোনার ভাবনায় মগ্ন! আমার কথা কানেই নিচ্ছ না।

না না তা কেন, আমি ভাবছিলাম যে সেদিন স্যার মেঘদূত পড়াতে গিয়ে কতরকম ফুলের কথা বলছিলেন। ভুঁইচাপা দেখেছ হিয়া? অথবা ঝিঁন্টি ফুল। এসবের কোনো ঘ্রাণ আছে তুমি জানো? 

আরে কি যে বলো সুজয়, ভুঁইচাপা আর ঝিঁন্টি কোনোটারই ঘ্রাণ নেই।

তাহলে আর হলো কী, ঘ্রাণ না থাকার পরও কালিদাসের এসব ফুল পছন্দ হলো কীভাবে! 

মেসে ফিরে সুজয়ের মনে হয় যে ফুল দেখতে যতটা সুন্দর তার ঘ্রাণ তত কম। আর যে ফুল দেখতে ততটা সুন্দর নয় তার ঘ্রাণ তীব্র। এই যেমন ছাতিম, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা কোনোটাই দেখতে সুন্দর নয় অথচ ঘ্রাণ কতটা তীব্র! আর পলাশ, মান্দার, জারুল, শিমুল দেখতে কেমন নজরকাড়া অথচ ঘ্রাণ নেই একদমই। কালিদাস এসবই বিচার করেছিলেন কিনা কে জানে? হিয়াও বুঝি সেরকম। ওকে সুন্দরী বললেও অসম্পূর্ণই বলবে লোকে।

সারাদিন মেসের তেলচিটচিটে বালিশটাতে সুজয় গড়াগড়ি যায়। যে বালিশ থেকে সব সময় সে ময়লা আর নোংরা ঘামের বিশ্রী গন্ধ পেয়েছে এতদিন এখন কেন জানি তার মনে হয় এই বালিশে হিয়ার চুলের ঘ্রাণ লেগে আছে। ক্ষুধা লেগেছে। এক থালা সাদা কামিনী ফুলের মতো ভাত সামনে নিলে সেখান থেকেও সে হিয়ার চুলের গন্ধ পায়। 

সুজয়ের মেসের ছাদে দাঁড়ালে হিয়ার চিলেকোঠা দেখা যায়। প্রতিদিনই নানাভাবে সুজয় মেসের ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। হিয়া পড়াশোনার ফাঁকে কখনো সখনো চিলেকোঠার মুক্ত আকাশে এসে দাঁড়ায়। হিয়া যেদিন ঘরের পর্দাটাকে টেনে দিতে ভুলে যায় সেদিন সুজয়দের মেসের ছাদে দাঁড়ালে হিয়ার ঘরের প্রায় সবকিছু অবলোকন করা যায়। সুজয় অনেক দিন হিয়াকে বলেছে তুমি পর্দাগুলো ভালো করে টেনে দিও চারিদিকে যা বিশ্রী ছেলের দল।

সুজয় আজ সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সন্ধ্যাবেলা মেসের ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সবেমাত্র রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল। অন্ধকারটা এমন যে লাইট না জ্বালালে ঘরের ভিতরে ঠিক কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আবার বাইরে কিছুটা আলো এখনো রয়েছে। সুজয় ভাবছিল এই বুঝি শফিক স্যারের ভাষায় কনে দেখা আলো। 

হিয়ার চিলেকোঠায় তালা। এ সময় হয়তো টিউশনিতে গিয়েছে হিয়া। টিউশনি একটা শনি ঠাট্টা করে বলত হিয়া। এমনই শনি যে ভ্যাকেশনের দিনগুলোতে তোমার সাথে কাটানো যায়। মনে মনে এই কথা ভাবে আর হাসে সুজয়। যে করেই হোক কাল হিয়াকে বলতে হবে যে সুজয় হিয়ার মেথিমাখা চুলের ঘ্রাণের প্রেমে পড়েছে। তাহলে হিয়া নিশ্চয়ই বুঝবে যে সুজয় আসলে হিয়ারই প্রেমে পড়েছে। এটা বোঝার ক্ষমতা হিয়ার আছে। কেননা ছেলেদের থেকে মেয়েদের এসব ব্যাপারে বোধ বুদ্ধি অনেকটাই বেশি।

তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে হিয়া টিউশনি থেকে ঘরে ফিরে আলো জ্বালিয়েছে। জানালার দিকে মুখ করে গরমে ভেজা শরীর থেকে চট করে জামাটা খুলে বুকে জড়িয়েছে। এরপর কোনো আব্রু ছাড়াই ব্রাটা খুলে ফেলে ঢিলেঢালা টিশার্টটা পরে নেয়। হিয়ার মনে হচ্ছে এতক্ষণ দম খাটো হয়ে আসছিল, কেবল সে মনভরে শ্বাস নিতে পারছে। চমকে ওঠে হিয়া! সুজয়দের ছাদে অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সুজয়ের কথা ওর বারবার মনে পড়ে। কত দিনই সে বলেছে তুমি জানালার পর্দাগুলো টেনে রাখো না কেন? হিয়ার অতটা আব্রুভাব ভালো লাগে না। কিন্তু তাই বলে অন্য কেউ তার এই বিবস্ত্র অবস্থা দেখে ফেলবে সেকথা হিয়া ভাবেনি।

সুজয় ঘরে ফিরে আসে। এর আগে কতবারই সে হিয়াকে কাছে থেকে দেখেছে, দূর থেকে বিদায় দিতে দিতে দেখেছে। আজ যেন মনে হলো হিয়া অসম্ভব সুন্দর। দেহের গড়নটা যেন বর্ষার ঢেউয়ের মতো প্রাণোচ্ছল। কিন্তু সুজয় তো ঘ্রাণ খুঁজে ফেরে। কিন্তু সুজয়ের চোখে কেবল খোলা স্তন ভেসে ওঠে। 

পরদিন বুড়ো বটগাছটার তলায় হিয়া মনখারাপ করে বসে আছে। সুজয় কিছু বলতে পারছে না। কেবল গত দিনের সন্ধ্যার কথা ভেবে ভেবে হিয়া চুপ হয়েছিল। কীভাবে সে সুজয়কে বোঝাবে যে সে এমন একটা ভুল করে বসেছে। সুজয়ের শুধু মনে হচ্ছে হিয়া তাকে ভুল বোঝেনি তো যে হিয়া আবরণহীন হওয়ার অপেক্ষায় সুজয় ছিল না বরং হঠাৎই সুজয়ের চোখ পড়ে গেছে। পরস্পর নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলে নীরবতা হিয়াই প্রথম ভাঙে।

হিয়া অবলীলায় সুজয়কে ভালোবাসার কথা জানায়।

সুজয় চমকে ওঠে। তবে খুশির ঢেউ তার মনকে উদ্বেলিত করে যেন হঠাৎ শীতল কাঙ্ক্ষিত ঝড় আসে।

সুজয় আজ সব জড়তা ভুলে হিয়াকে জড়িয়ে ধরে। ওর চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে মেথির ঘ্রাণ নিতে থাকে।

সুজয় বলে তোমার সুডৌল উন্মুক্ত বক্ষ আমাকে আকর্ষণ করলেও আমি কেবল তোমার চুলের ঘ্রাণে পাগল হয়ে আছি। কেবল দেখা নয় তোমার কথার ঘ্রাণ আমি পাই, তোমার চলার ঘ্রাণ আমি অনুভব করি, আমার নিকবর্তী হও বা দূরে সরে যাও শরীরের ঘ্রাণ আমি অনুসরণ করি।

মনে মনে এসব বললেও সুজয় বলতে পারে না অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটি ছিল সুজয়। সুজয় তো ঘ্রাণ খুঁজে ফেরে, অতীন্দ্রিয় ঘ্রাণ।

এরপর সুজয় হিয়াকে যা বলে তাতে হিয়া প্রস্তুত ছিল না।

আমাকে তুমি ঘ্রাণ ফিরিয়ে দাও হিয়া। আমার সামনে কেবল ঘ্রাণ থাকুক। অতখানি সৌন্দর্য তুমি আমাকে কেন দেখালে! আমাকে ক্ষমা করে দিও যদি কখনো প্রেমের অনুভব শক্তি কমে যায়।

আজ ওরা দুজনই কিছুটা হলেও সংকুচিত। প্রেমের প্রকাশের বেলায় শুধু ছেলে কেন মেয়েরাও তো সংকুচিত হয়। প্রেম তো মানুষকে নত করে। 

মেসের গেটে হিয়া সুজয়ের নোটখানা ফেরত দেয়। সুজয় ধরতে ধরতেও নোটখানা পড়ে যায়। হিয়ার ডানহাতটা জন্ম থেকেই খানিকটা খাটো যার কারণে এমন বিড়ম্বনা মাঝেমধ্যেই ঘটে।

হিয়া বলে ওঠে তুমি আমাকে ভালোবাসো না বলে আজও বুঝতে পারলে না কতটা হাত বাড়ালে আমাকে ধরা যাবে।

সুজয় বলে, না তা একদমই নয়। তোমার ছোট হাতে তুমি প্রতিবারই যে প্রাণপণে আমার দিকে হাত বাড়াও সেটা দেখতে দেখতে আমি বেখেয়াল হয়ে পড়ি।

সুজয় ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবে হোক হিয়ার ডান হাতটা ছোট ও তো আসলে হিয়ার ঘ্রাণ খুঁজে ফেরে।   

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //