নিপীড়নবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিবিধ কুকুর

‘এসো ভাই এসো বোন গড়ে তুলি আন্দোলন’-চিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে স্লোগান দিচ্ছে নুসরাত। মিছিলের শেষ অংশ থেকে স্লোগান ভেসে আসছে যেন নদীর স্রোতের কলকল স্বাভাবিক ধ্বনির মতো-চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার। তুমি কে, আমি কে রাজাকার রাজাকার।

আয়রনিটা অনেকেই ধরতে পারল না ভেবে নুসরাতের মেজাজটাই গেছে বিগড়ে। আরে বাবা তোমার শব্দ তোমাকেই ফেরত দিচ্ছি বলেই তো বলছি-তুমি কে? আমি কে?/রাজাকার রাজাকার। বরিশাল শহরের অলিতে গলিতে ছাত্র-জনতা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলছে পথঘাট। মিছিল কালুশাহ সড়কের মুখে এসে গেলে রাকিবের গলার স্বর উঁচুতে উঠে যায়। বাড়িতে দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর পোষেন মেয়র। একটু খুটখাট অতিরিক্ত শব্দ রাস্তায় হলেই এরা গর্জন করে। রাকিবের মনে হয় মেয়রের মতো হিংস্র এই কুকুর দুটো। তবুও কুকুর তো মানুষ নয়, এই ভেবে মায়া হয়। এই তো গত নির্বাচনের কথা, ভোটকেন্দ্রে নেতারা ঢুকে ইচ্ছা মতো ব্যালটে সিল মেরেছিল। এমনটা না করলে সেবার বরিশালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নারী নেতৃত্ব পেতে পারত বরিশাল সিটি করপোরেশন। সেই আক্ষেপ আর এ জীবনে ঘুচবে না রাকিবের। মনে মনে রাকিব কুকুরকে ক্ষমা করতে পারলেও মানুষকে পারে না।

সেদিন ৩১ জুলাই। মল্লিকা কিন্ডারগার্টেনের রাস্তা দিয়ে ঊষা চক্রবর্তীর বাসায় ঢুকতে ঢুকতে রাকিব বলছিল, দিদি এই বাগানবিলাসটা তোমাদের বাড়ির দরজাটার অনেক অংশ দখল করে বসে আছে, এটা কেটে ফেললেই পারো। 

কেন রে, রাকিব-কাটব কেন? দেখ তো বিপ্লবের রাঙা লাল আলোর মতো ফুলগুলো ফুটে আছে। নিক না খানিকটা জায়গা। মানুষ যদি বস্তিতে গাদাগাদি করতে পারে তাহলে এই বাগানবিলাসের দোষটা কোথায়? তুই এখনো সমাজতন্ত্র বুঝলি না, হাসতে হাসতে রাকিবকে এ কথা বলতে থাকে ঊষা। হঠাৎ আঙিনা থেকে দৌড়ে আসে বাঘা। বাঘার সাথে রাকিবের সম্পর্ক চিরচেনা। দেখতে পেলে এসে মাথা ঘষবে, লেজ নাড়বে, গায়ে পড়বে এমন অবস্থা। রাকিব ব্যাগ থেকে যতক্ষণ একটা রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওকে না খাওয়াবে ততক্ষণ একই ন্যাওটা কাজ করতে থাকবে বাঘা। দুবছর আগের নির্বাচনে বাঘাকে রাস্তায় পেয়েছিল ঊষা। গত দুবছর ধরেই বাঘা আনুগত্যের সঙ্গে চোর তাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের জালিয়াতির কাছে টিকতে না পারলেও, কুকুর ঠিকই চোরকে তাড়িয়েছে।

তারিখের হিসেবে সেদিন ৫ আগস্ট। উত্তাল জনতা কারফিউ ভেঙে বরিশাল শহরের রাজপথ ও অলিগলিতে নেমে পড়েছে। সাধারণ একটি ছোট্ট আন্দোলন ধীরে ধীরে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ক্ষুদ্র বীজাধারে যেভাবে বটবৃক্ষের মতো মহীরুহ লুকিয়ে থাকে ঠিক তেমনটি আন্দোলনেও লুকিয়ে ছিল। বিকাল ৫টা বাজতে তখন পনেরো মিনিট বাকি। খবর এলো স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের প্রধান পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই খবর বরিশালে ছড়িয়ে পড়েছিল কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো। মুহূর্তে চারিদিকে আনন্দ মিছিল শুরু হয়েছিল সেদিন। বিরোধী পক্ষও নানাভাবে ক্ষুব্ধ মানুষজন এতদিনের ক্ষমতাসীন মেয়রের বাড়িতে সুযোগ বুঝে হামলা ও লুটপাট শুরু করে। মেয়র বাড়ি ছেড়ে তার নেতা-কর্মীদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে বাংলা সিনেমার নায়কের আচরণ করতে থাকেন। এই গোঁয়ার্তুমি আর হিরোগিরি কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। আজকাল গোঁয়াররাই রাজনীতি করে মেয়র-এমপি হয়; এই ঘটছে সারা পৃথিবীতে। তবুও কাণ্ডজ্ঞান বলে কারও কারও কিছু জ্ঞান থাকে, আর কোনো রাজনীতিবিদের সেটুকুও থাকে না। মেয়র ঘরে লুকিয়ে ভেবেছিলেন হামলার পর উচ্ছৃঙ্খল জনতা সরে পড়লে তিনি বাড়ি ছাড়বেন; কিন্তু জনতা তার উপস্থিতিতে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, লুটপাট করে। রাকিব আনন্দ মিছিল থেকে বের হয়ে মেয়রের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। না সে আগুন দেবে না, লুটপাটও করবে না। এ বাড়ির জার্মান শেফার্ড দুটোর ওপর তার লোভ। জার্মান শেফার্ড নিয়ে রাকিবের ভালো লাগা অনেক পুরনো। যে যার মতো যা নিয়েছে; কিন্তু কুকুর দুটোকে কেউ নেয়নি দেখে এ দুটো হাত করে সে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে রাকিব দেখে বাড়িতে কিসের যেন জটলা। তার বাবার সাথে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে প্রতিবেশীরা। এই কুকুর বাড়িতে থাকলে মানুষজন এই বাড়িতেও হামলা করতে পারে। যেমনই হোক এ-তো মেয়রের কুকুর! জটিলতা এড়ানোর জন্য ঊষা চক্রবর্তীকে রাকিব বলে, দিদি তোমার বাড়িতে কুকুর দুটো রাখো না, আমি তো এদের এনে বিপদে পড়লাম। কুকুরের গায়েও মেয়রকে দেখছে এরা, বড্ড বিপদ হয়ে গেল।

ঊষা সেদিন রিকশা শ্রমিকদের সাথে সকাল সকাল মিটিং করছে। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল বাইরে। একনাগাড়ে এত বৃষ্টি যে ঘরের বাইরের শব্দ কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। হঠাৎ বৃষ্টি কমে এলো, যেন বিয়ের বাদ্য একটানা বেজে থেমে গেলে যেমন অন্য ছোট শব্দগুলো কানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠিক তেমনটা। কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে সকলে দৌড়ে বাইরে আসে। বাঘাসহ বেওয়ারিশ কিছু কুকুর রক্তাক্ত করে ফেলেছে জার্মান শেফার্ড দুটোকে। বাঁচার আশা মোটেও নেই। ঊষা দিদি ডাক্তার ডেকেছিলেন। ডাক্তার বললেন, আপনি সমাজতন্ত্রী হয়েও জিততে পারেননি; কিন্তু আপনার বাঘা মনে হয় জিতে গেল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //