লেখকের স্বাধীনতা

সাহিত্যকে বলা হয় ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীনতা; কিন্তু আসলেই কি তা সত্যি? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে মতপ্রকাশের জন্য, তা সে কথাসাহিত্য হোক বা কাঠখোট্টা প্রবন্ধ; অনেক লেখক নিষিদ্ধ হয়েছেন। 

সালমান রুশদিকে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার জন্য মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। তাতে তার লেখনী থামেনি। ঘাতকের হাতে আহত হয়ে একটি চোখ হারানোর পর তিনি যে বইটি লেখেন তার নাম ‘নাইফ’ বা ‘ছুরি’। সেখানে কল্পিত কথোপকথনের মাধ্যমে রুশদী ঘাতককে বোঝানোর চেষ্টা করেন তার অবস্থান, যা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশেও দেখা যায়, গত কয়েক দশকে বহু লেখক, কবি, ব্লগার দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন বা নিহত হয়েছেন, শুধু ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখালিখি করার জন্য। ইরান ও তুরস্ক থেকে বহু লেখক জীবন বাঁচাতে পশ্চিমে পাড়ি জমান। তবে সমস্যা কি শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই? না, কয়েকশ বছর পেছনে তাকালে দেখা যায়, ইতালিতে গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল; কারণ তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, যা বাইবেলের বিরুদ্ধে ছিল। নিজের বক্তব্যকে মিথ্যা স্বীকার করে কোনো রকমে প্রাণে বাঁচলেও, সেই সময়ে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে কোনো মতামত বা লেখা গেলে, সেই লেখককে বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। 

লেখকদের নিয়ন্ত্রণের জন্য রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে সেন্সরশিপ আরোপের উদাহরণ দেখা যায়। তখন পাণ্ডুলিপি সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে হতো এবং সেখান থেকে অনুমোদন পেলে তা প্রকাশ করা যেত। এত বাধা-বিপত্তির পরও লেখকরা থেমে থাকেননি। স্যাটায়ার সাহিত্য তখন প্রচুর লেখা হয়েছে। স্তালিনের সময়ে যারা কমিউনিস্ট ছিলেন না, তাদের গোপনে লেখা প্রকাশ করতে হতো। 

আমেরিকাতেও গত কয়েক বছর ধরে ‘ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন’ নিয়ে লেখকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। লেখকদের অভিযোগ- বেশ কিছু রাজ্যে সমকামী বা কালো আমেরিকান লেখকদের বই লাইব্রেরিতে রাখা হচ্ছে না, এমনকি সিলেবাস থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্র নিয়ে লেখা বইও বাদ পড়ছে। বই প্রকাশের কারণে লেখকদের জেল-জরিমানা, কোর্ট ট্রায়াল, মৃত্যুদণ্ড বা দেশ ছাড়ার উদাহরণ অনেক আছে। তবে এমন লেখকের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন, যারা সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন লেখনীর মাধ্যমে। আর বাকিরা? দেখা যায়, (বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসেও) লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশই সরকারের তোষামোদ করেন সুবিধার আশায় বা বিপদ এড়াতে। আর যারা লিখেন, তাদের একটি অংশ ফুল-পাখি-লতা-পাতা নিয়ে চুপচাপ লেখেন। অন্যদিকে যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখেন বা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে চান, তাদের লেখা অনেক সময় প্রেস ছাপতে চায় না। ফলে অনেকেই লেখার বা চিন্তার বেশ কাট-ছাঁট করে লেখেন, যাতে ওপরমহল রুষ্ট না হয়। লেখার বা চিন্তার সততার প্রশ্নটি অনেকক্ষেত্রে লেখকের আর্থসামাজিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- যে রাষ্ট্র মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেয়, সেখানেও এমন ঘটনা ঘটলে, তৃতীয় বিশ্বের দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে? রাষ্ট্র কখনই চিন্তাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। রাষ্ট্রে থাকতে গেলে আমাদের কি চিন্তা করতে হয় যে, আমরা কী লিখতে পারব আর কী পারব না? বাংলাদেশে থেকে কেন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করলে জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হয়? যখন এমন হয়, তখন লেখক কি প্রাণ খুলে লিখতে পারেন? সরাসরি লেখা বা রূপক অর্থেও লিখতে গেলে আমরা আসলে কতটা স্বাধীন? বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময় বলে দেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh