বেহাল

চাঁদপুর শহরের সব রাস্তাই ব্যস্ত আজকাল। একবার জ্যামে পড়লে রক্ষে নেই। আধঘণ্টার রাস্তা পেরোতে পেরোতে সময় চলে যাবে এক-দেড় ঘণ্টা। বসে আছি সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। কখন অফিসে যাব, বসের কতটা ঝাড়ি খেতে হবে আজ এসব ভেবে বিরক্ত হচ্ছিলাম। হঠাৎ গাড়ির সামনে এসে পড়ল বৃদ্ধ দম্পতি। সামনের গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাল মেলাতে আমার সিএনজিটাও সামনে আগাতে চেয়েছিল, থমকে গেল দম্পতি আর আমার সিএনজির চালকও। নেমে গিয়ে সিএনজির ভাড়া পরিশোধ করে দম্পতির হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলাম। কুঁচকে যাওয়া চামড়া, কুঁজো হয়ে হাঁটা স্বামী-স্ত্রী। শত কোলাহলের বিষণ্ণ শহরে এ যেন এক দেখার মতো ঘটনা। সত্যিই বলেছিলেন তিনি, যিনি বলেছিলেন, ‘এ শহরে সাত বছরের প্রেম টিকে না, কিন্তু সাত দিনের প্রেমও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়’...

দুই.

চৈত্রের শেষভাগ। তৃষ্ণার্ত চোখ-মুখ নিয়ে লাঞ্চ টাইমে বের হয়ে ঢকঢক করে পানি খেলাম। শত কোলাহলের মাঝেও কেমন এক নীরবতার শক্ত খোলস পরে আছে প্রকৃতি। খেতে যাব পাশের হোটেলে। অফিস থেকে মিনিট দুয়েকের রাস্তা। জ্যাম ঠেলে গাড়ির ফাঁকফোকর পেরিয়ে যেতে লাগবে পাঁচ মিনিট। এত্ত গাড়ি এ শহরের ছোট্ট রাস্তায়। শহরটাকে কেমন যেন বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে আসা এক কিশোরীর মতো লাগছে। যার লাল পদ্মের টিপ এখনো ঘুমিয়ে আছে, হরিণী চোখে বিশ্ব দেখা বাকি, মনভোলানো হাসি স্তিমিত হয়ে গেছে গরম চুলার আঁচে। যার এটুকু ছোট্ট কাঁধে পড়েছে সংসারের দায়িত্ব। হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে সবকিছুকে গুছিয়ে রাখতে। সৌন্দর্য ঢেকে পড়েছে কর্তব্যের কালো চাদরের আড়ালে... 

তিন.

‘পাখির মতো ডানা মেইল্যা আকাশে উইড়া বেড়ানোর সাধ্য যদি মানুষের থাকতো, তাইলে পৃথিবীর বিশাল আকাশেও জ্যাম লাইগা থাকতো’...বলেই হেসে উঠল রহিম চাচা। আমার অফিসের ঠিক নিচে সে রোজ বসে ভিক্ষে করে। অফিস শেষ করে আমি এসে বসি তার কাছে। কত কথা বলে। ‘বাবা, ভিক্ষা কইরা খাই, তাও মানুষ সুযোগ পাইলে থালার তে টেকা-পয়সা হাতাইয়া নিতে চায়’... বলে আবারও হা হা করে হেসে ওঠে।’ ‘কত ক্ষিদা মাইনসের, আমরা পান্তা খাই ওরা পোলাও খায়। তবু সুযোগ পাইলে আমগো পান্তাতে ভাগ বসাইতে ছাড়ে না’...বলে কিছু অশ্রাব্য গালি দিল। কেমন যেন যুক্তিসংগত মনে হলো গালাগালগুলোকে। ভদ্রতার মুখোশে থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যের ভালো থাকার সুযোগ নষ্ট করে নিজে বাঁচছে... শিক্ষার ঝুলি কাঁধে চাপিয়েছি বলে আমরা চিৎকার করে গালাগাল করতে পারি না। রহিম চাচারা পারে। ওরা স্বাধীন মানুষ। কবি সুকুমার রায়ের কবিতার মতো বিশ্বজোড়া পাঠশালার ছাত্র ওরা, ওদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ওরা গাল দিতে পারে আবার স্রষ্টার নামে আশীর্বাদও করতে পারে... 

চার.

ইট-পাথরের যে কৃত্রিম সাজে সেজে থাকে প্রকৃতি তাতে যেন তার লজ্জাহানিই হয়। ঠিক যেমনভাবে পণ্যের অ্যাডভার্টাইজমেন্টে কৃত্রিম সৌন্দর্যের আদলে লজ্জাহানি হয় আসল সৌন্দর্যের। আর এভাবেই ধীরে ধীরে নেমে আসে রুগ্নতা, কদর্যতা হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। পৃথিবী হারায় ভারসাম্য... স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায় কৃত্রিমতার আড়ালে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh