যখন হঠাৎ বৃষ্টি নামল

আমার ছুটি হলো। এদিকে অস্ত্র মামলার আলোচিত এক আসামিকে তুলে নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে গেল এক প্রিজন ভ্যান। হেমন্তের মেঘলা দিন। প্রকৃতি যেন ঝিম মেরে বসে থাকা অবিনশ্বর জীবনানন্দ। খড়ের গাদার পাশে শজনের ডালে শীতল ভোর। ভিজে ভিজে খড়, একটা গিরগিটি পালাতে চায়। দৌড়ে পালাতে চায়...।

শালিকের ঘরে আসে রাত। ফিরে আসে সন্ধ্যার নরম নরম হয় হলুদ নদী। মনে হয় ‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি বছরের পার।’ একটি হলুদ রঙের নতুন ছাতায় অটোস্টেশনে পৌঁছালেই ওখানে সারি সারি অটো। আমাকে পৌঁছে দেবে বুঝি কীর্তিনাশার পাড়ে। আমিও গুটিয়ে নিব যতগুলো হিসাবের হালখাতা। ও নদীর জলে তাঁর ছায়া যদি ভেসে ওঠে ফের! দামদস্তুর শেষ করে একটি হলুদ রঙের অটোর সঙ্গে শহরে ঢুকি। বৃষ্টিতে ভিজে যায় নীল শহরের শেষ তোরণ। ভাড়া মেটাই। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। জলের গায়ে বাতাস বয়। পার্কে বাগান বিলাসের ঘরে ফিরে চড়ুই পাখি। বোরকার খোলসের বাইরে আসে রাতের শরীর। পদ্মপাতার আড়ালে অন্য রকম এক রাত। জলাধারে শেষ ডুব দেয় পানকৌড়ি। শুনেছিলাম আকাশও গর্জন করে। ভয়ংকর সে গর্জন। গর্জন শুনব বলে শূন্য আকাশে কান পেতে রই। সুপার ক্লাস্টারের সেই শব্দদূষণের পৃথিবীতে পৌঁছে না আর। অথবা পৌঁছে হয়তো, আমি তার নাগাল পাই না। আমাকে হতাশ করে পাখা ঝাপটায় রাতকানা চামচিকে। আলো জ্বেলে জ্বেলে বহুদূর চলে যায় উড়ন্ত বিমান। এখানে চেনা শব্দ, চেনা সুর আর চেনা চেনা দৃশ্য। কোথাও কোনো অচেনা প্রাণের দ্বৈত স্লোগান মেলেনি। মানুষের ভেতর শুধু মানুষের মেলা। বিভেদের মশাল জ্বলে সে মেলায়। আদি হতে সে মশাল বয়ে চলছে কোনো এক অন্তের সীমানায়। সেই শিকড় ধরে মিত্রশক্তি অভিমুখে সেতু পার হয় অক্ষশক্তি। 

সেই জীবন কাঁধে নিয়ে পৃথিবীর চারণভূমিতে জোছনা দেখতে দেখতে সবুজ ঘাসে ক্ষুধা মেটাই। কবে থেকে মানুষের জিনে বোনা আছে সুপারির বন। হিজল ফুলের গাছ। মাঝে মাঝে টের পাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই। রাত জেগে বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করতে করতে ম্যালেরিয়ার কাঁপুনি উঠেছে কতবার। স্নান করতে করতে আর একবার জার্নি বাই বোট রিভিশন দিয়ে গেছে পরীক্ষার সেদিন সকালেও। আর তার মৎস্যগন্ধা মাতা লাকড়িতে আগুন দেয়। বাল্মীকি জীবন বিদ্যালয়ে কাটিয়ে মাঝ বয়সে ছাপোষা কেরানীর চাকরির আর স্যাঁতসেতে বারান্দায় ভাঙা ডাটের কাপে লিকার চায়ে চুমুক দিয়ে জীবনের ব্যর্থতার হিসাব কষে। স্টেশনের সেই মেধাবী তরুণ! মাঝে মাঝে হেমন্ত এলে সে ঘাসের কবিতা লিখত। পাশে ধীরে বয় পাহাড়ি নদীর সূক্ষ্ম স্রোতের শব্দে কবিতার খেলাঘর। লেখকের কলমের ঘাম শ্রমিকের কাস্তের মতো বড় সস্তায় বেচাকেনা হয়। তবুও অন্য জীবনে আর মানুষ নয়। নদী হতে চাই। নয়তো বৃক্ষ। আইনের পাতায়ও হাবিল শিকদারের জন্য পূর্বসূরির হিস্যা থাকে না। ইংরেজদের হাতে মৃত্যু হয়েছিল তার নীল বিদ্রোহী পিতার। দাদা তখনো বর্গীর জন্য উদোম গায়ে ফের রসুন বুনে। এখনো কোনো এক ইংরেজ ঘোড়া দৌড়ায় বাংলার রেসের মাঠে। আলগোছে ছুড়ে দেয় তুরুপের তাস। ধারালো কুড়ালের আঘাতে কাটা পড়ে মানুষের হৃদয়। কতবার পেরেশানি হয় যুগল ভূমি। ফিলিস্তিনের উঠানে লাশের সংখ্যা হয় অগুনতি। উখিয়ায় রোহিঙ্গা অভিবাসন চলে। তারও আগে আমাদের উঠানের সীমানা ভাগ হয় ভিনদেশি হুলো বিড়ালের নখের আঁচড়ে। কাপালীপাড়ায় হামেশা ছোঁয়াছুঁয়ির অশৌচে একঘরে হয় নাটোরের বনলতা। সিন্ধু নদের সভ্যতার সিংহাসনে চির আসন গেঁড়েছে ব্যাসদেবের মহাভারতের অমীমাংসিত ব্যাখ্যা। দূর দেশ থেকে ঝুলিতে ঈশ্বর বয়ে আনে যুদ্ধে কাঁচামাল। যুদ্ধ বাঁধে দেশে দেশে, ঘরে ঘরে। আর আমার জন্মভূমিতে কবে থেকে সন্দেশের বাটিতে মেটে ইঁদুর মরার পচা গন্ধ! খোয়াব নামার গল্পের মতো এক ধাঁধার ভেতর আমাদের অনুমান লুকিয়ে থাকে সন্তর্পণে। তবু ধরে রাখা রক্ষণশীলতার বেড়াজাল টপকাই না কখনো। রাত ভোরে ফের বৃষ্টি নামে। পতিতালয়ের নারীরা নদীতে স্নানে নামে। ক্লান্ত শরীর শীতল জলে ধুয়ে নেয়। এবেলা সে ঘুমোবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh