স্বপ্নেরা

লোকটার একঘেয়ে জীবনে হঠাৎ একটু রঙের স্পর্শ দেখা গেল। বিয়ে করা হয়নি বলে এই ৫৬ বছর বয়সে প্রায় নিঃসঙ্গই কাটে সারাক্ষণ। নিরন্তর বিষণ্ণতার ভেতর গত নভেম্বর থেকে অপ্রত্যাশিত মৃদু আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙে মনটায় কেমন একটা চাঙ্গা আর ফুর্তি ভাব, গত এক যুগে যা ছিল অসম্ভব।

জীবনটা নেহাত এক বিশাল বোঝা ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না, প্রকৃতি যতদিন ক্ষান্তি না দিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত মুক্তি নেই এই নচ্ছাড় জীবন থেকে; তা ছাড়া আত্মবিনাশের পথ গ্রহণের মতো যথেষ্ট যুক্তি কিংবা সাহস তার নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য- বোঝাটা বেশ লঘু হয়ে এলো হঠাৎ। নিজে হাতে চা করতে-করতে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে নিজেই অবাক হয়, এই সুর কি তার কণ্ঠ দিয়েই বেরুচ্ছে? প্রথম কয়েক দিন কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সেদিন প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিল, হঠাৎ জলের ভেতর একটা মাছ লাফ দিয়ে উঠল যেন, আর তখনই তার মনে এলো একটি শব্দ- ‘স্বপ্ন’। হ্যাঁ, রাতে-রাতে স্বপ্ন এসে তাকে জীবনের আনন্দসংগীত শোনায়। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না স্বপ্নগুলোর রং-রূপ-গন্ধ। লোকটা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে ধরবার চেষ্টা করে হারানো দৃশ্যগুলো, কিন্তু কিছুতেই ধরা দেয় না। এমনকি অস্পষ্ট ছায়াও নয়। চোখ বন্ধ করলে কেবল কিছু কুয়াশা আর মেঘ। ঘরে ফিরবার সময় বড় বাজারের কাছে এসে মাথায় একটা আইডিয়া এলো। সে খাতা-কলমের দোকানে গিয়ে দেড়শ টাকায় একটা নতুন ডায়েরি কিনল। মনস্থ করল খয়েরি রঙের ডায়েরিটা প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মাথার কাছে রাখবে। স্বপ্ন দেখে যদি কোনোভাবে ঘুমটা হালকা হয় তাহলে নিজেকে টেনে তুলে চট করে স্বপ্নের কথাগুলো টুকে রাখবে ডায়েরির পাতায়। আর দিনের বেলা সেসবের কার্যকারণ বুঝবার চেষ্টা করবে। 

সোম-মঙ্গল-বুধবার কিছুই ঘটল না কিংবা ঘটে থাকলেও তার কিছুই মনে করতে পারে না লোকটা। বৃহস্পতিবার রাতে মৃদু কম্পনসহ ঘুম ভাঙল তার। মাথার কাছটাতে হাতড়ে টর্চটা মিলে যায়। সেটার সুইচ টিপে দ্রুত ডায়েরি আর কলমটা হাতে নেয় সে এবং লিখতে শুরু করে,  ‘একটা মানুষ দৌড়াচ্ছে নির্জন মরুভূমির ভেতর দিয়ে। পশ্চিম দিকে সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই নেমে আসবে গভীর আঁধার। এখন তেমন গরম নয়, বরং হালকা শীতই, তবু লোকটা দরদর করে ঘামছে। জায়গাটা তার সম্পূর্ণ অচেনা। এখানে কীভাবে এলো তাও বলতে পারবে না। রাতে কি হিংস্র কোনো পশু এখানে ঘুরে বেড়ায়, জনবসতি কতদূর কোন পথে- কিচ্ছু জানে না সে। তবু কেবল দৌড়ে চলেছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। একসময় সে আর পা চালাতে পারে না। কারণ লোকটা শক্তিহীন হয়ে পড়েছে এমন নয়, বরং দৃষ্টিজুড়ে কেবল ঘোর অন্ধকার; অন্ধকারে তো দিগি¦দিগশূন্য চলে কোনো লাভ নেই। লোকটা প্রথমে বালুরাশির ওপর বসে পড়ে হাঁপাতে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পর চার হাত-পা মেলে নিজের শরীরটা ছেড়ে দেয় রুপোর গুঁড়োর মতো বালুকারাজ্যে। আকাশের দিকে তাকায়- নাহ, চাঁদের কোনো আভাস নেই। কয়েকটা তারা ফুটেছে বটে, কিন্তু সেগুলোর অক্ষম আলো ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায় না। শীতল বাতাসে লোকটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ে। আবার যখন চোখ মেলে তখন দেখে আকাশে একটা ক্ষয়ে যাওয়া হলদে চাঁদ। যাক, তবু তো এবার পথে নামা যাবে। কোমরে বাঁধা পাত্র থেকে দুই চুমুক জল খেয়ে একটা খেজুর মুখে দেবে ঠিক তখনই তার চোখের সামনে জ¦লজ¦ল করে উঠল একজোড়া চোখ। মানুষ নয়, কোনো হিংস্র জানোয়ারের। বুকের ভেতর ভীষণ হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল লোকটার।’ এর বেশি আর মনে করতে পারে না ডায়েরি-লেখক। সে এখনো সামান্য কাঁপছে বিষয়টি তার এলোমেলো হাতের লেখা দেখেই অনুমান করা যায়। 

পরের রাতে আবারও জেগে উঠে ডায়েরি লেখার সুযোগ পায় সে। ‘একঝাঁক নীল-হলুদ পাখি কোথায় যেন উড়ে চলেছে। এবারও ঠিক অন্ধকার হয়ে আসছে, সন্ধে নামবে। পাখিগুলোর মধ্যে একটির বাম ডানাটিতে ক্ষত। সে আর উড়তে পারছে না। পাখিটি বিশ্রাম নিতে চায়। কিন্তু সে জানে এখন দলছুট হওয়া মানেই মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া। পাখি তাই প্রাণপণ ডানাজোড়া চালিয়ে যায়। ঠিক তখনই একটা তীক্ষ্ণ তির ছুটে আসে তার হৃৎপিণ্ডের দিকে। তিরের গতিকে হার মানাবার শক্তি কি তার দুই ডানায় আছে?’  

লোকটা যখন স্বপ্নগুলো লিখে রাখবার কথা ভাবেনি তখন রাতের ওই দৃশ্যগুলো এমন ভয়ানক আর করাল ছিল না, ছিল স্নিগ্ধ-মায়াময়। কাজেই এসব লেখা কেবল তার যন্ত্রণাকে বাড়াবে বৈ কমাবে না। আর এমন তো নয়, স্বপ্ন বিবৃত করে সে জনতার কাছে কিংবা বোদ্ধাজনের কাছে একজন বিশিষ্ট মানুষ হয়ে উঠবে। তা হয়তো হয়ে উঠতেও পারে। একের পর এক এমন স্বপ্ন সে যদি লিখে প্রকাশ করে তো মানুষের কাছে তা পাঠ ও বিশ্লেষণযোগ্য কিছু হয়ে ওঠাও অবান্তর নয়। কিন্তু লোকটা এতকাল নিঃসঙ্গ থেকে জীবনের মানে যা বুঝেছে, তার ভিত্তিতেই সে সিদ্ধান্তটা নেবে। প্রথমে ঠিক করে ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলবে সে। কিন্তু খানিক বাদে সিদ্ধান্ত বদলায়। ভালো করে মোটা পলিথিনে মুড়ে বাড়িটার একখণ্ড উঠোনের পুব দিকটায় দুই হাত গভীর করে মাটি খুঁড়ে ডায়েরিটাকে সমাহিত করে ফেলে সে। এটা কখনো আর কোনো মানুষের হাতে পড়বে কি না সে জানে না। পড়লে পড়ুক। সেখান থেকে সৃষ্টি হতে পারে নতুন কোনো ভাবনার অঙ্কুর। বিষণ্নতা আর দীর্ঘশ্বাস থেকেও সৃষ্টি হয়েছে হাজারো কাব্য, অজস্র সংগীত। কিন্তু সেই পথ এখন আর তার জন্য নয়। 

পরদিন লোকটার ঘুম ভাঙে। ফুরফুরে মেজাজে গান গাইতে-গাইতে চা বানায়। গতকাল যেখানে ডায়েরিটা মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল, অনেকটা মানুষের কবরের মতো করে মাছের পিঠসদৃশ ছোট্ট একটা ঢিবির কথা ভাবতে-ভাবতে ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগেই সে পাখিদের নির্জন গ্রামীণ পথে কলকাকলির মধ্যে মিশে যায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh