পাশের বাড়ির লিনুর যেদিন বিয়ে হয় সেদিন সন্ধ্যা থেকে ছিল ঝুমবৃষ্টি।
সাদা আর নীল রঙের ছোট ছোট বাতি দিয়ে পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সবাই গিয়েছিল বিয়েতে। আমি যাইনি। যেতে ইচ্ছা করেনি। বড় ভাই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন, সেটা বুঝেছিলাম ভাবির কথায়। আমাদের ঘরে সদ্য আসা ভাবি বলেছিলেন, ‘দীপু খুব কষ্ট হচ্ছে না?’
আমি বলেছিলাম, ‘কিভাবে বুঝলা ভাবি?’
‘তোমার ভাইয়া বলেছে।’
আমি আর কথা বাড়াইনি। আমার ঘরে চলে গিয়েছিলাম।
লিনু আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। কিন্তু ছোট থেকেই বন্ধুর মতো আমাদের মেলামেশা। তুই-তোকারি সম্পর্ক। ঝগড়া-ফ্যাসাদ, এক সপ্তাহের জন্য কথা বন্ধ, আবার কখনো কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়ও চলত আমাদের মধ্যে।
কিন্তু কখনোই আমাদের মধ্যে এমন কোনো কথা
আদান-প্রদান হয়নি, যেগুলো দিয়ে কিশোর প্রেমের অব্যক্ত অনুভবের উদয় হওয়া বোঝায়। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ার, লিনু সেকেন্ড ইয়ার। হুট করেই এক বিকেলে বলল, ‘জানিস, আমার না বিয়ে ঠিক হয়েছে।’ আমি খুব হেলায়ফেলায় বলেছিলাম, ‘যা চাপা কম মারিস। বললেই হলো বিয়ে ঠিক হয়েছে?’ উত্তরে লিনু বলেছিল, বললেই হলো মানে কি রে?
‘মানে পরিষ্কার। তোকে কোন শালা বিয়ে করতে আসবে? মেরে ঠ্যাঙ ভেঙে দিব।’ ‘কেন?’ দুই চোখ গভীর করে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল লিনু।
আমি ক’মিনিট কথা বলতে পরিনি। কী বলব? কী বলা দরকার? কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
আর কথা হয়নি, ওটাই আমাদের শেষ কথা। এর এক সপ্তাহ পরই বিয়ে হয়ে যায়। বেশ আয়োজন করেই।
আমাদের বাড়ি আর লিনুদের বাড়ি পাশাপাশি। মাঝখানে এক ইঞ্চিও গ্যাপ নেই। তিনতলার ছাদে মাঝখানে আড়াই ফিট উঁচু দেওয়াল দুটি বাড়িকে আলাদা করে রেখেছে। এই ছাদে আমরা গল্প করতাম। আড়াই ফিট দেওয়াল ডিঙিয়ে লিনুদের ছাদে যেতাম, লিনু আসত আমাদের ছাদে।
একদিন বাবাকে বলেছিলাম, ‘এই আড়াই ফিট দেওয়ালটা ভেঙে দিলে কী হয়? আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে কি আন্তরিক আর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক! এই দেওয়াল রাখার কোনো মানে হয়? খামোখা পা উঁচু করে দেওয়াল ডিঙিয়ে আসা যাওয়া করা লাগে। কখনো পা ছিলেও যায়।’
বাবা বলতেন, ‘তোর কথা পুরোই ঠিক। তার পরও থাক না। দুটি বাড়ির সীমানারেখা থাকা দরকার।’
বৃষ্টিসন্ধ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। রাত ১১টায় আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম বরের পাশে বসে লিনু গাড়িতে চড়ে চলে গেল। তখনো টিপ টিপ করে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছিল। বাবা-মা-ভাইয়া-ভাবি ঘরে ফিরলেন। ভাবি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, খেয়েছি কি না। আমি বলেছিলাম, ‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’ আর কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন ভাবি নিজের ঘরে।
বিয়ের ১০ দিন পর লিনু বরকে নিয়ে ওদের বাড়িতে এসে কয়েক দিন থেকেছিল। এক বিকেলে ছাদে ওঠে লিনু। আমি তখন ছাদে ফুলের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলাম। আমাকে দেখেও না দেখার ভাণ করল লিনু। বরকে দূরে হাত দিয়ে কী যেন দেখাচ্ছিল। একসময় নিচে নেমে গিয়েছিল।
নীলের ভেতর সাদা জামদানি শাড়িতে লিনুকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। লিনু যদি সেদিন আমার সঙ্গে কথাও বলত, তবে শাড়ি পরে আড়াই ফিট উঁচু দেওয়াল ডিঙিয়ে আমাদের ছাদে আসতে পারত না হয়তো।
আড়াই ফিট দেওয়ালটা বাবাকে বলেছিলাম ভেঙে দিতে। বাবা বলেছিলেন, ‘থাক না, দুটি বাড়ির সীমানারেখা থাকা দরকার।’
ছাদে এখন যখনই উঠি আড়াই ফিট দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াই। চোখ বন্ধ করে সেই ঝুমবৃষ্টি পড়া সন্ধ্যার কথা ভাবি। বরের পাশে বসে লিনুর চলে যাওয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh