রাত সাড়ে দশ কি এগারোটা। পিয়াসের দরোজায় ঠকঠক শব্দ। ভেতর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল-
-কে?
-আমি পাশের ঘরে আছি। একটু খুলবেন?
-এত রাতে, কেন? কে বলছেন?
-আমি পাশের ঘরে আছি। জরুরি প্রয়োজন।
এরই মধ্যে লেপের নিচে ঢুকেছিল পিয়াস। যা শীত পড়েছে। জমে যাচ্ছিল। বাইরে ঘন কুয়াশা। এর মধ্যে উটকো ঝামেলা। কে, তা কে জানে? আজকাল কত কিছুই তো ঘটছে। কে না কে। দরোজা খোলা ঠিক হবে কি না। চেনা নেই, শোনা নেই। অচেনা মানুষ। তার উপর বলছে, জরুরি প্রয়োজন। ইত্যাদি ভেবে একটু সময় নিল। এমনিতেই পিয়াস একটু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তারপর ইতস্তত করে দরোজা খুলে দিল। দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ে বড় গোঁফ-দাড়িওয়ালা এক অচেনা মানুষ। মাথায় লম্বা চুল। গায়ে কালো কোট। মাথায় টুপি। দেখলে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কোটের নিচে সাদা গেঞ্জি। বুকের উপর ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে নীল অক্ষরে লেখা TERRORISM। তা দেখে গলা শুকিয়ে এসছিল পিয়াসের। যা ভেবেছে তাই। ডাকাতটাকাত হবে বোধ হয়। কথা বেরোচ্ছিল না মুখ দিয়ে। স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। কী করা যায় ভেবে উঠতে পারছিল না। বুকে TERRORISM লেখা লোকটা বলল-
-ছোট্ট একটা সমস্যায় পড়েছি। একটা ফোন করা যাবে?
পিয়াস ভাবছে, এত রাতে কাকে আবার ফোন করবে? কোন ঝামেলায় ফেলবে, কে জানে? সবার কাছেই তো ফোন থাকে? তার কাছে কি ফোন নেই? হয়তো আছে। তাহলে আমার ফোন থেকে কথা বলতে চাইছে কেন? নাকি কৌশলে আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করার মতলব? কোনো ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা? মনটা খুঁতখুঁত করছে। আকাশ-পাতাল ভাবছে পিয়াস। লোকটা বলল-
-একটু আগে আমার ফোনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জও নিচ্ছে না। ফোন করা যাচ্ছে না। জরুরি একটা ফোন করা দরকার আমার বাড়িতে। নইলে সারারাত টেনশন করবে সবাই।
পিয়াস ভাবছে- এভাবেই তো মানুষ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আগে ভাব জমায়। তারপর ফোনের মাধ্যমে প্রতারণা করে। প্রতারণার কত কৌশল আয়ত্ত করেছে মানুষ আজকাল। বুকে গেঞ্জিতে লেখা TERRORISM। কী ভয়ংকর বিষয়? মানুষকে বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। আবার ভাবে, লোকটা সত্যি কথাও তো বলতে পারে? অনেক ভেবে-চিন্তে ফোনটা দিল লোকটার হাতে। ফোনটা নিয়ে ডিজিট চাপল, ০১৯৩...। স্পিক ফোনে কথা বলা তার অভ্যেস। রিং হতেই ওদিক থেকে বাজখাঁই কণ্ঠে বলে উঠল- ‘শোন, সব ঠিক আছে তো? এ বিষয়ে আগে কিছু বলবি না। কায়দা করে এগোতে হবে। যেকোনো কাজ পরিকল্পনামাফিক করতে হবে। যেভাবে বলছি, ঠিক সেভাবে কাজ করবি। তারপর অপারেশনে যেতে হবে।’ এসব শুনে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছে পিয়াসের। কী সর্বনাশ! ফোন দিয়ে তো বিপদ ডেকে এনেছে সে। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল পিয়াস। এখন উপায়?
কুষ্টিয়া জেলা পরিষদ ডাক বাংলোয় উঠেছে পিয়াস। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। অফিশিয়াল একটা কাজে এসেছে। দুই রাত থাকতে হবে এখানে। তা এক উটকো ঝামেলায় পড়া গেল। পিয়াস একটু ভিতু টাইপের মানুষ। যে কোনো বিষয় নিয়ে আতঙ্ক জাগে তার মনে। তিলকে তাল করে ভাবা তার স্বভাব। ফোনটা দেওয়াই ঠিক হয়নি। তার নম্বরটা চলে গেছে টেররিস্টদের হাতে। এরপর হয়তো তাকে ফলো করবে। তারপর কিডনাফ করবে। মুক্তিপণ চাইবে। আর ভাবতে পারছে না পিয়াস। এখন উপায়? পুলিশকে খবর দেওয়াই উত্তম মনে করল সে।
বুকে TERRORISM লেখা লোকটা তার ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকল। ঘুম আসছিল না। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছিল। কোথায় কল করবে, আর কল কোথায় চলে গেল। এ রকম উলটা-পালটা আজকাল হয় ফোনে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো, সে একটি ডিজিট ভুল চেপেছে। আর সেখানেই ঘটেছে বিপত্তি। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে আসে। ঠিক ঘুম নয়, ঘুমের মতো। তন্দ্রা। একসময় স্বপ্নের মতো মনে হয় কেউ তার দরোজায় কড়া নাড়ছে। ঘুম ভাঙলে শুনতে পায়-
-দরোজা খুলুন। আমরা পুলিশের লোক। দরোজা খুলুন।
এত রাতে হঠাৎ পুলিশ কেন? লোকটা ভেবে পায় না। ঘুমঘুম চোখে জেগে দরোজা খুলে দেয়। সামনে কয়েকজন পুলিশ। বলে ওঠে-
-আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো। থানায় চলুন।
-আমাকে অ্যারেস্ট করা হলো? কেন? কী কারণে?
-থানায় চলুন, সব জানতে পারবেন। আপনি সন্ত্রাসী দলের সদস্য।
-আমি? কী প্রমাণ আছে?
পাশেই দাঁড়ানো পিয়াসকে দেখিয়ে পুলিশ বলছে-
-এই যে, উনি প্রমাণ। উনিই আমাদের ফোন করেছেন। তাকে আপনি ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।
-ফাঁদে? কী ফাঁদে? দেখুন, কথাটা ঠিক নয়। এখানে একটা ভুল-বোঝাবুঝি ঘটেছে। আমার ফোনটা হঠাৎ কেন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও ওপেন হচ্ছিল না। ওদিকে বাড়িতে টেনশন করবে বলে ফোন করাটাও জরুরি ছিল। তাই তার কাছ থেকে ফোন চেয়ে নিয়ে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত নম্বরটা ভুল করায় অন্য কারো কাছে কল চলে যায়। ওদিক থেকে উলটা-পালটা কথা বলায় উনি ভুল বুঝেছেন।
-রাখেন ওসব বানানো গল্প। আমাদের ওসব জানা আছে। থানায় চলুন। দুই ঘা পড়লেই সব বেরিয়ে পড়বে।
-বিশ্বাস করুন। আমি বানিয়ে বলছি না। আমার ফোন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। আমি কোনো সন্ত্রাসী দলের সদস্যও নই।
-সে দেখা যাবে। আগে থানায় চলুন। পুলিশের কাছে ধরা পড়লে সবাই ও রকম বলে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমার বাড়িতে একটা ফোন অন্তত করতে দেন। তারপর না হয় থানায় নেবেন।
পুলিশের দয়া হলো সম্ভবত। বাড়ির নম্বর বললে পুলিশ কল করে লোকটাকে ধরিয়ে দিল। স্পিক ফোনে শোনা যাচ্ছিল কান্নাবিজড়িত কণ্ঠ-
-তোমার ফোনে কী হয়েছে? সারারাত জেগে রয়েছি আমরা। কোনো খোঁজ নেই, খবর নেই। ছেলেমেয়ে দুটোও ঘুমোয়নি। তুমি প্রেসারের রোগী। ডায়াবেটিস।
টেনশন হয় না?
-শোনো, হঠাৎ ফোনটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কল করতে পারিনি।
-অন্য কারো কাছ থেকেও তো কল করতে পারতে?
-সেটা করতে গিয়েই তো বিপত্তি ঘটেছে। এদিকে নিচে তালা বন্ধ থাকায় মোহাম্মদ আলীকেও খবর দিতে পারছিলাম না। বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম মোহাম্মদ আলীর দেখা পাই কি না। সে অসুস্থ মানুষ। হাঁটুতে ব্যথা। শীতের রাত। এদিকে আর আসেইনি হয়তো। তার দেখা পেলাম না।
ঘটনাটা পরিষ্কার হলো সবার কাছে। পুলিশ বলল-
-সরি স্যার, আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : টেররিজম সন্তোষ ঢালী সাহিত্য গল্প
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh