অনলাইনে কেনাকাটা

দেশে ক্যাশ অন ডেলিভারি যে কারণে জনপ্রিয়

দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইনে কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে অনলাইনে কেনাকাটায় আগে দাম পরিশোধ করা হয়ে থাকলেও ক্রেতাদের পছন্দ হচ্ছে পণ্য হাতে পাওয়ার পর টাকা দেয়া।

ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধের কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তার সংখ্যা কম। অনলাইনের নিয়মিত ক্রেতা ধানমণ্ডির সোহানা ইয়াসমিন বলছেন, অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে তিনি 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' বা পণ্য হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করতে পছন্দ করেন। তাতে সুবিধা হলো, টাকা পরিশোধ করে কবে জিনিসটা পাবো, টাকা মার যাবে কিনা, ইত্যাদি দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় না। জিনিস বুঝে নিয়ে, ঠিক আছে কিনা দেখে আমি টাকা দিতে পারি।

তিনি বলছেন, পরিচিত কয়েকজন অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সম্প্রতি কয়েকটি বড় অনলাইন শপের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগও তিনি দেখতে পেয়েছেন। এ কারণে 'ক্যাশ অন ডেলিভারির' সুযোগ না থাকলে তিনি আর কোন পণ্যই কেনেন না। 

তবে আরেকজন নিয়মিত ক্রেতা নাজমুন নাহার অবশ্য উভয় পদ্ধতিতেই কেনেন। পরিচিত, নামী বা আগে কিনেছি, এমন অনলাইন শপ থেকে পণ্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনেক সময় আগে দাম পরিশোধ করি। তবে আমি স্বস্তি বোধ করি ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রেই। জিনিস পেলাম, টাকা দিলাম, সেটাই তো ভালো।

তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তিনি অবশ্য অনেকগুলো অর্ডারে আগে দাম পরিশোধ করে দিয়েছেন, যাতে ডেলিভারি ম্যানের সঙ্গে কথা বলতে না হয়। 

ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মূলত কয়েকটি কারণে 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' পছন্দ করেন। এর মধ্যে রয়েছে- পণ্য হাতে পেয়ে পরীক্ষা করে দাম পরিশোধ করা, প্রতারণা থেকে রক্ষা, অচেনা বিক্রেতা বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপর বিশ্বাসহীনতা, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা, ক্রেডিট কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার না করা, অনলাইন পেমেন্টে অনভ্যস্ততা ও অনাস্থা, নিরাপত্তাহীনতা।

বাংলাদেশে চালু থাকা অনেকগুলো অনলাইন প্রতিষ্ঠান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংক একাউন্ট, মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে মাধ্যমে সরকারি মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মূল্য ছাড় পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে 'ক্যাশ অন ডেলিভারি বা পণ্য হাতে পেয়ে পরিশোধের ব্যবস্থাও রয়েছে।

অনেক সময় বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান পণ্যটি সরবরাহ করে টাকা নিয়ে আসেন। প্রধানত ঢাকায় এই সেবাটি পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় কুরিয়ার সার্ভিস থেকে পণ্য বুঝে নেয়ার সময় টাকা পরিশোধ করতে হয়।

বাংলাদেশের ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনে নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে ১৩০০। তবে সংগঠনটির হিসাবে, অনিবন্ধিত ও ফেসবুক মিলিয়ে লক্ষাধিক ই-কমার্স ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চাল, ডাল, তেল, ডিম থেকে শুরু করে পারিবারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়, এমন একটি ই-কমার্স সাইটের কর্মকর্তা ইফফাত ই ফারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, 'আমাদের এখানে প্রায় সব গ্রাহকই 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' পদ্ধতিতে কিনে থাকেন।

তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, ক্রেতারা যে জিনিসটি কেনা হচ্ছে, সেটার মান কেমন, যা বলা হয়েছে, সেটা দেখা হয়েছে কিনা, সেটা যাচাই করে দেখে নিতে চান। আমরাও চাই না, সরবরাহ করার পর ক্রেতারা অভিযোগ করুক। কারণ একটা অভিযোগ আমাদের পুরো গুডউইল নষ্ট করে দিতে পারে। তাই আমরা চাই তারা জিনিস বুঝে পেয়ে, দেখেশুনে দাম পরিশোধ করুক।

তিনি মনে করেন, গত কয়েক বছরে ই-কমার্স এতো বড় হয়েছে, সেখানে সবাই মান ধরে রাখতে পারছে না। অনেকেই যেভাবে পারছে, নিম্নমানের জিনিসপত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। এ কারণে মানুষও এখন অন্ধভাবে ই-কমার্স সাইটগুলোকে বিশ্বাস করছে না।

তবে এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম নির্ভর একটি অনলাইন শপের মালিক আনিকা বুশরার।

তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে বেশিরভাগ মানুষ 'ক্যাশ অন ডেলিভারি নিতে চাইতেন। এখনো অনেকে নেন। কিন্তু গত কয়েকমাসে অনেকেই অগ্রিম পেমেন্ট করতে শুরু করেছেন। কারণ তারা ডেলিভারিম্যানের সংস্পর্শে আসতে চান না। তাই তারা আগেভাগে দাম পরিশোধ করে দেন যাতে তাদের মুখোমুখি হতে না হয়।

তিনি বলছেন, ঢাকার ভেতরে এখনো ক্যাশ অন ডেলিভারি রয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে পণ্য গেলে অন্তত অর্ধেক দাম আগে পরিশোধ করার জন্য তারা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিছু কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম বা প্রতারণার কারণে পুরো সেক্টরের প্রতি মানুষের আস্থা নিয়ে একটা সঙ্কট রয়েছে বলে তারা মনে করেন। কিছু মানুষের মনোভাব হচ্ছে, ই-কমার্স খুব ভালো, তারা বিশ্বাস করেন, আগে দাম দিতে চান। আবার কিছু মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে, তারা হয়তো খারাপ অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে, তাই এখন আর ই-কমার্স সাইটগুলোকে বিশ্বাস করেন না। পুরো বিষয়টা নির্ভর করে আসলে কে কেমন সেবা পেয়েছেন, সেটার ওপরে।

বাংলাদেশের ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স বাজারের আকার ছিল ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার অনলাইনে পেমেন্ট হয়েছে। অর্থাৎ ই-কমার্স ব্যবসা বলা হলেও, শুধুমাত্র পণ্যের অর্ডারটি অনলাইনে হচ্ছে। বাকি লেনদেন হচ্ছে নগদে।

ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলছেন, বাংলাদেশে এখনো বেশিরভাগ ই-কমার্স হচ্ছে নগদ লেনদেনের ভিত্তিতে। অ্যাডভান্সড পেমেন্ট বা কার্ডে পেমেন্টের হার এমনিতে কম, তবে এই মহামারির সময় সেটা বেশ বেড়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে অবশ্য অগ্রিম বা কার্ডে পেমেন্ট বেশি হয়, যদিও কিছু কিছু দেশে ক্যাশ অন ডেলিভারি চালু আছে।

তিনি বলছেন, সেসব দেশে কিছু সার্ভিস কাজ করে, যারা বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে নিরাপত্তা হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ ক্রেতার পণ্য নিয়ে অভিযোগ বা আপত্তি থাকলে তখন এসব প্রতিষ্ঠান সমাধানের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেটা তৈরি হয়নি। আবার সবার ব্যাংক কার্ডও থাকে না। অনেক সময় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ক্রেতারা অনলাইনে আগে দাম পরিশোধ করতে চান না। বিধিবিধান জনিত নানা সীমাবদ্ধতার কারণেও অনলাইন পেমেন্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি বলে তিনি মনে করেন। তবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কারণে আস্তে আস্তে অনলাইন পেমেন্টের হার বাড়ছে বলে তিনি জানান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //