নারী গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়া

মানব সভ্যতার শুরু থেকে একদল মানুষ অমসৃণ পথগুলোকে মসৃণ করার জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর সাথে লড়ে গিয়েছেন; কিন্তু কখনো প্রতিজ্ঞা থেকে সরে যাননি, লড়াইয়ের পর ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়ের লাল সূর্য। 

মানুষ আজকের দিনে যে সভ্যতার গল্প বলেন বেশ রসিয়ে রসিয়ে, কখনো তা রূপকথার কেচ্ছার মতো শোনায় কখনোবা তা হয় শ্বাসরুদ্ধকর। এসবের প্রতিটি গল্প তৈরি হয়েছে প্রাণের বিনিময়ে। সভ্যতার প্রতিটি ধাপে ধাপে এসে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপীয় গোঁড়া ধর্মালয়গুলো।

গির্জার পাদ্রিরা একদা সমাজ প্রথার সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। সাধারণ মানুষেরাও সেই মতো জীবন পরিচালনা করত। আবার ধর্মালয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তাদের ভুগতে হতো চূড়ান্তভাবে। 

সে সময়ের ধর্ম ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান যা শুধু সত্য উন্মোচনের পথে বাধাই প্রদান করেনি বরং যারাই সত্যকে উদ্ঘাটন করে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছে, তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। নিকোলাস কোপার্নিকাস, জর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও, সক্রেটিস, আইনস্টাইন, লিসে মাইটনারসহ আরো অসংখ্য বিজ্ঞানী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি ধর্মের একটি প্রতিক্রিয়াশীল দিক। শুধু তাই নয়, সে সময় নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া তো দূরের কথা, মানুষ বলেই মূল্যায়ন করা হতো না। ধর্ম আর পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব যেন একই সুতায় গাঁথা। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। 

নারীদের ভাবা হতো নিচু জাতের প্রাণী। আসলে শুধু সে সময় নয়, আধুনিক যুগেও কতজনই বা নারীর অবদানকে স্বীকার করে নেন বা নিয়েছেন? অথচ সভ্যতার শুরু হয়েছিল নারী-পুরুষের যৌথ কাজের সমন্বয়ে। পুরুষের পাশাপাশি নারীও অবদান রেখেছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায়; কিন্তু পুরুষত্বের বলে নারীদের অগ্রাহ্য করা হয়েছে চিরকাল। 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস ঘেঁটে সে তথ্য আমরা পেয়ে যাই খুব সহজে। 

ইতিহাসে এমন কর্মদীপ্ত নারীর সংখ্যাও কম নয়, যারা তাদের স্বীয় কর্মে বেঁচে থাকবেন আজীবন। লিসে মাইটনার, রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন, মাদাম কুরি, লরা বেসি, সোফিয়া কোলেভাস্কা, লিস মিন্টার, ক্যারলিন হার্সেল, মেরি অ্যানি ল্যাভয়শিয়ে, লিজা রান্ডলের মতো অসংখ্য নারী বিজ্ঞানীর অবিস্মরণীয় আবিষ্কার সব সময় অগুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে পুরুষতন্ত্র। এমনকি নারী হওয়ার কারণে অনেক নারীই নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যদিও পরবর্তী সময়ে নানা আলোচনা, সমালোচনার মুখে মাদাম কুরিকে নোবেল কমিটি পুরস্কার দিতে বাধ্য হয়েছিল। নারীর অবদান বিষয় ও সামাজিকভাবে অবহেলার কথা উঠে এসেছে অটোম্যান স্ট্যানলির ‘মাদারস অ্যান্ড ডটার অব ইনভেনশন’ গ্রন্থে। 

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন অথচ অবহেলিত এর শিকার হয়েছেন ধর্মীয় আক্রোশের এমনই এক নারী- যিনি ছিলেন ইতিহাসে প্রথম নারী গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক। তার নাম হাইপেশিয়া। তিনি বলতেন, ‘নিজের চিন্তা করার অধিকারকে সংরক্ষণ কর। কারণ, কিছু চিন্তা না করা থেকে ভুলভাবে চিন্তা করাও ভালো। মানুষ একটি সত্যের জন্য যতটা না লড়াই করে- তার থেকে বেশি কুসংস্কারের জন্য লড়ে। কারণ কুসংস্কার সবসময়েই অস্পৃশ্য ও অসার; কিন্তু সত্য হচ্ছে আলাদা, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। তাই এটি পরিবর্তনশীল।’

হাইপেশিয়া- আনুমানিক ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম থিওন। তার বাবা ছিলেন একজন গণিতজ্ঞ। কাজ করতেন আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। ছিলেন বিখ্যাত আলেক্সান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালকও। হাইপেশিয়ার মৌলিক শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার পেছনে তার এই মহর্ষি বাবার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ধর্মীয় করালগ্রাস, পুরুষতান্ত্রিকতার চরম বর্বর যুগেও তার বাবা চেয়েছিলেন হাইপেশিয়া শুধু নারী না হয়ে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। তার কন্যা বিজ্ঞানমনষ্ক, দর্শন ও যুক্তিসম্পন্ন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। অবশ্য তিনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ তো হয়েছিলেন-ই, একইসাথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ইতিহাসের একজন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হিসেবেও। তার অসম্ভব মেধা, যুক্তি, বাগ্মিতা, আবিষ্কারের সঙ্গে সৌন্দর্য মিশিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ৪০০ সালের একজন শ্রেষ্ঠ নব্য প্লেটোবাদী দার্শনিক।

বাবার পরামর্শে তিনি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে পুরো রোমান সাম্রাজ্য ঘুরতে থাকেন। তিনি চলে যান এথেন্সে। সেখানে গিয়ে গ্রিসের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। হাইপেশিয়া এখানে শিক্ষক ও পণ্ডিত হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একদা তার খ্যাতি গ্রিসকে ছাড়িয়ে আলেক্সান্দ্রিয়ায় পৌঁছায়। এ সময় তিনি আলেক্সান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বিখ্যাত গণিতবিদ দায়োফ্যান্তাস রচিত এরিথমেটিকা বইয়ের ওপর তিনি ১৩ অধ্যায়ের একটি আলোচনা লেখেন যার কিছু অংশ পরবর্তীতে দায়োফ্যান্তাইন বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া তিনি এপোলোনিয়াসের কৌনিক ছেঁদ ও টলেমির জ্যোতির্বিদ্যার কাজের ওপর বেশ কিছু আলোচনা প্রকাশ করেন। বিখ্যাত স্যুডা বইটিও তার রচনা বলে অনেকের অভিমত আছে। 

বাবার সুবাদে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়া মিউজিয়াম ও লাইব্রেরিতে অবাধে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। টলেমি, এরিস্টটল, প্লেটোর কাজের ওপর তিনি লাইব্রেরির একটি কক্ষে আলোচনা করতেন নিয়মিত। তার আলোচনা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসত। আজকের দিনের মতোই হাইপেশিয়ার বক্তব্য শুনে শ্রোতাদের অর্থ দিতে হতো। তিনি ছিলেন অসামান্য মেধার অধিকারিণী, যুক্তিনির্ভর ও সুস্পষ্ট বক্তা। তার জ্ঞানের পরিধি অসীম ছিল। তিনি যেমন নিজে কাজ করতেন, ক্লাস নিতেন, বক্তব্য দিতেন শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তেমনি করে বাবার প্রতিটি কাজে সাহায্য করতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের শেখাতেন দায়োফ্যান্তাস ও এরিথমেটিকা আর আলোচনা করতেন টলেমি, প্লেটোর বিষয় নিয়ে। তিনি সর্বদা বাস্তব জ্ঞানে বিশ্বাসী ছিলেন। 

হাইপেশিয়া বলতেন, ‘রূপকথাকে রূপকথা হিসেবে, পুরাণকে পুরাণ হিসেবে ও অলৌকিকতাকে অলৌকিকতা হিসেবেই শেখানো উচিত। কারণ শিশুর মন সেগুলো বিশ্বাস করে নেয় ও পরবর্তীতে কোনো বড় আঘাত বা দুর্ঘটনাই সেগুলো মন থেকে মুছতে পারে।’ এ কারণেই তিনি হয়তো তার শিক্ষার্থীদের বাস্তবজ্ঞানে উৎসাহী করতেন বেশি করে।

বিদুষী এই নারী গণিতজ্ঞ কেবল জ্ঞানে-গুণে-ব্যবহারে সেরা ছিলেন না, তিনি রূপেও ছিলেন সেরা। ফলে তাকে জীবনসঙ্গী রূপে পাওয়ার জন্য অনেকেই এসেছিলেন; কিন্তু তার জ্ঞান সাধনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে তিনি বরাবরই বিবাহ থেকে দূরে থেকেছেন। 

কিন্তু মৃত্যু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল কে জানতো! সে সময়ে খ্রিস্টানরা আলেক্সান্দ্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে। তারা নানাভাবে প্যাগান, ইহুদিদের ওপর নির্যাতন ও জুলুম করছে। হাইপেশিয়াও ছিলেন একজন প্যাগান। ঘটনার শুরু হয়েছিল ৩৮০ সালের শুরুর দিকে। সম্রাট থিওডোসিয়াস তখন প্যাগানবাদ ও অরিয়ানবাদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু নীতি চালু করেছেন। ৩৯১ সালে তিনি আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফিলাসের এক চিঠির জবাবে মিসরের সমস্ত ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করে দেয়ার আদেশ জারি। গণহারে তখন সব ধ্বংস করা হচ্ছিল। এরপর ৩৯৩ সালে আইনসভার এক আইনের কারণে এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ হয়। তখন কিছুদিন শান্তিতে বসবাস করে মিসরের মানুষ।

এরপর ৪১২ সালে এসে যান নতুন বিশপ যার নাম ছিল সিরিল। যিনি হাইপেশিয়ার বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন এক সামান্য নারী পুরো আলেক্সান্দ্রিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এ হতে পারে না। সিরিল ভয় পেতেন জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা ও দার্শনিকতা। তিনি ভাবতেন গির্জার কর্তৃত্ব শেষ হয়ে যাবে। ফলে তিনি শুরু করেন নতুন করে হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ।

এই ধ্বংসযজ্ঞের এক সময়ে বিশপ তার নিজের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্যই শেষে তার সহচরদের দিয়ে হত্যা করান এই মহীয়সী নারী গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়াকে। সক্রেটিসের স্কলাসটিকায় থেকে হাইপেশিয়ার মৃত্যুর বর্ণনা রয়েছে- ‘পিটার নামের এক আক্রোশী ব্যক্তি নজরে রেখেছিল, অবশেষে সে হাইপেশিয়াকে কোনো এক জায়গা থেকে ফেরার সময় আটক করে। এরপর তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে টেনে হিচড়ে, কেসারিয়াম নামের একটি চার্চে নিয়ে যায়। সেখানে তারা হাইপেশিয়াকে বিবস্ত্র করে। এরপর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তার চামড়া কেটে নেয়, শরীর চিরতে থাকে। এভাবেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাইপেশিয়া। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পর তার দেহ টুকরো টুকরো করে তা পুড়িয়ে ছাই করেছিল।’ 

হাইপেশিয়ার মৃত্যুতে গোটা ইউরোপ থমকে দাঁড়ায়। ধর্মীয় কূপমণ্ডূক সমাজ যুগে যুগে এভাবেই বুঝি জ্ঞানকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর ১০০০ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

মানুষ ভুলে গিয়েছিল ওই নারীকে, কিন্তু ১৭২০ সালে জন টোল্যান্ড নামের এক লেখক তুলে ধরেন সাগরের অতলে ডুবে যাওয়া গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়াকে নিম্নের শিরোনামে-

‘Hypatia: Or, The History of a Most Beautiful, Most Vertuous, Most Learned, and Every Way Accomplish'd Lady; who was Torn to Pieces by the Clergy of Alexandria, to Gratify the Pride, Emulation, and Cruelty of Their Archbishop, Commonly But Undeservedly Styled St. Cyril’

তথ্য সহায়িকা:

1| Hypatia of Alexandria

2| Hypatia, Ancient Alexandria’s Great Female Scholar by Sarah Zielinski

3 | Biographies of Women Mathematicians by Ginny Adair



সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //