মৃত ব্যক্তিকে কি বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব!

মস্তিষ্ক হলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অংশ, যা করোটির অভ্যন্তরে অবস্থিত এবং দেহের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। মস্তিষ্ক শব্দটি মাথায় এলেই তিনটি শব্দ ঘিরে ধরে: নিউরন, যেটি মস্তিষ্কের কোষ; অ্যাক্সোন, ডেন্ডড্রাইট, সিন্যাপস যোগাযোগের তিন ব্যবস্থা। প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মস্তিষ্কের আয়তন ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার, গড় ওজন ১.৩৬ কেজি এবং এতে প্রায় ১ হাজার কোটি নিউরন থাকে। এর মধ্যে এমন এক যোগাযোগের জটিল আবর্ত গড়ে ওঠে, যা এখনো আমাদের কাছে খুব একটা স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞানীরা এখন ভাবছেন শুধু জীববিজ্ঞানের সূত্রাবলি দিয়ে এই চেতনার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলি দরকার হয়ে পড়েছে। ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত ইসরায়েল ইউনিভার্সিটি এক গবেষণায় সাড়া ফেলেছে। একটি প্রাণী মারা যাওয়ার চার ঘণ্টা পর মস্তিষ্ক কোষের (নিউরন) একাংশকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে তারা। পুরো মস্তিষ্ক ব্যবস্থাকে নয়, কোনো কোনো কোষকে, কেবল নিউরনকে জাগাতে চেয়েছেন তারা। ফলে এটা বলাই যায়, গবেষকরা মৃতকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টায় নামেননি। জীবনের সচলতা বা জীবনের সক্রিয়তা নির্ভর করে সার্বিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ওপর। হার্টবিট, রক্ত সংবহন ও শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহযন্ত্র শুধু সচল থাকে না, মস্তিষ্ককেও উদ্দীপ্ত করে, কোষগুলোকে জীবিত রাখে। আর আমরা খাদ্যগ্রহণ ও অক্সিজেনের মধ্যে দিয়ে দেহযন্ত্রকে কার্যক্ষম রাখি, এক ধরনের শক্তি ব্যবহারের কার্যকর ভারসাম্য গড়ে ওঠে।

মৃত্যুর কতক্ষণ পর্যন্ত মস্তিষ্ক নিউরনসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বন্ধ হয়, তা স্পষ্ট না হলেও শুধু নিউরনকোষকে কাজের উপযোগী করা গেছে মৃত্যুর চার ঘণ্টা পর। অর্থাৎ মৃত মস্তিষ্কের কোষকে কাজের উপযোগী করণে, রক্তের মতো যে-তরলের সহায়তায় অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করা হয়, তাতে তারা এমন একটি উপাদান মিশ্রিত করেন, যা নিউরনগুলোকে ‘ইলেকট্রিক সংকেত’ তথা ‘কনসাসনেস’ তৈরি করা থেকে বিরত রাখতে পারে। কারণ মস্তিষ্ক যদি তার চেতনা ফিরে পায়, তাহলে তো তারা মৃত ও জীবিতের মাঝখানে অবস্থান করবে, যা পরীক্ষণটির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে এবং ‘ডেথ গাইড প্রটোকল’ এর আইন ভঙ্গ করতে পারে।

মার্চে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’-এ আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মানবমস্তিষ্কের বেশ কিছু রহস্যময় কোষ শুধু সক্রিয়ই থাকে না, মৃত্যুর পর তাদের কর্মক্ষমতা আরও বেড়ে যায়, বেড়ে যায় তাদের কাজকর্মের গতিও। তারা এর নাম দিয়েছেন ‘জোম্বি সেল’। এগুলো আদতে মানবমস্তিষ্কের ‘গ্লায়াল সেল’। গবেষণা জানাচ্ছে, মানুষের মৃত্যুর পর ২৪ ঘণ্টা ধরে কাজ করে যায় এই কোষগুলো। মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টা পর শেষমেশ তাদের কাছে যেন নির্দেশ আসে ‘আর কাজ চালিয়ে যাওয়ার দরকার নেই’। তারপর সেই কোষগুলোও মরে যায়। তখন আর মানবমস্তিষ্কের চারপাশে ঘিরে থাকা মৃত কোষ, কলাগুলোর থেকে তাদের আলাদা করা সম্ভব হয় না।

বর্তমানে মৃত্যুর সংজ্ঞাও পরিবর্তশীলতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা যে অবস্থাকে মৃত বলে অভিহিত করছি, আগামী দিনে হয়তো সেটাকে সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখা হবে। যেমন-আমাদের চারপাশে দেখা যাচ্ছে ক্লিনিক্যাল ডেড; অর্থাৎ বায়োলজিক্যালি নিজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত হতে পারছে না; কিন্তু যান্ত্রিক সহায়তা দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। যেগুলো একসময় কল্পনা করাই সম্ভব ছিল না। 

অনেকে বলে থাকেন জীবন হলো একটি অতি জটিল প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে এভাবে বললে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়: জীবন হলো প্রোটিন নিউক্লিক এসিড সমাবেশের নিখুঁত গতিময় ছন্দ। ব্রিটিশ জীববিদ জে. ডি. বার্নাল (১৯৫১) তার দ্য ফিজিক্যাল বেসিস অব লাইফ গ্রন্থে জীবনের সংজ্ঞা দেন : ‘একটি নির্দিষ্ট আয়তন বা স্থানের মধ্যে স্বচালিত রাসায়নিক প্রক্রিয়াদির নাম জীবন। তিনি আরও বলেন, জীবন হচ্ছে এক অতি জটিল ভৌত-রাসায়নিক ব্যবস্থা, যা একগাদা সুসংহত বা একীভূত এবং স্বনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ভৌত বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার পরিপার্শ্বের বস্তু ও শক্তিকে স্বীয় বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে।’ 

এই হিসেবে জীবনের সংজ্ঞা এভাবেও দেওয়া যেতে পারে : প্রাণ বলতে আমরা এমন একটি ব্যবস্থাকে বুঝি, যার ভৌতভিত্তি নির্ভর করে শক্তি সংগ্রহ, সঞ্চয় এবং তা কাজে লাগানোর সামর্থ্যরে ওপর। আবার বলা যায় যেহেতু এনজাইম পরিচালিত রূপান্তরের জন্য খুব অল্প শক্তি প্রয়োজন। সে জন্য জীবের পক্ষে বিপুল রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব তাপের বিশেষ কোন পরিবর্তন না করে। সেই কারণে জীবনকে এক অল্প তাপের আগুনও বলা যায়। 

তাহলে দাঁড়াচ্ছে- যদি একবার জীবনের উৎপত্তি ঘটে, তাহলে তা প্রাণপণে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করবে; কিন্তু লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে যেসব জীবনকে বাঁচানোর প্রয়াস, তা বাইরের যান্ত্রিক শক্তি ছাড়া নিজে কিছুই করতে পারে না। ফলে তাকে মৃত বলা যাবে কি-না জানি না। তবে জীবনও বলা যাবে না। পরবর্তীতে আমরা আবার জীবনের সংজ্ঞায় ফিরে আসব। 

জিন যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে সেখানে মস্তিষ্কের প্রয়োজন কেন?

পৃথিবীর প্রাণীগুলো জন্ম নিয়েছে অ্যামাইনো-এসিডের জটিল এক প্রকার অণু থেকে; এ অণুগুলো প্রথমে সরলপ্রাণ গড়তে এলোমেলোভাবে সংযোগে লিপ্ত হয়। শত শত কোটি বছর ধরে এ প্রাথমিক সরল প্রাণ, ক্রমশ উন্নত হতে থাকে। জটিল, বহুকোষী, মস্তিষ্কওলা প্রাণী হিসেবে রূপ নেওয়া পর্যন্ত। কেননা চারদিকের পরিবেশ-প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হলে টিকে থাকার জন্য পূর্বনির্ধারিত জেনেটিক এনসাইক্লোপেডিয়াও দীর্ঘমেয়াদি ও পর্যাপ্ত হয় না। এমন কি ৫০০ পৃষ্ঠার ১ হাজার খণ্ডের বইয়ের তথ্যসমৃদ্ধ জিন লাইব্রেরি, যা পূর্বে টিকে থাকার জন্য সঠিকভাবে কার্য সম্পাদন করেছে; কিন্তু বর্তমানে ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না, পরিবেশ, পরিস্থিতির পরিবর্তন কোনো প্রাণীকে দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। এই অসুবিধাগুলোর কারণেই আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে। মস্তিষ্কের বিকাশের কারণেই আমরা বলতে পারি যে, বুদ্ধিমত্তা মানে চারপার্শ্বের জগৎ থেকে শুধু তথ্য ধারণ করা নয়, সেইসঙ্গে জাজমেন্ট বা বিচারবুদ্ধিও বটে। যার মাধ্যমে তথ্যগুলোকে সমন্বয় সাধন ও ব্যবহার করা যায়, ভবিষ্যতের কোনো বিপদ সম্পর্কেই আগেই আভাস পাওয়া সম্ভব হয়-যা জিনের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির মতো প্রয়োজনের তাগিদে মস্তিষ্কেরও উদ্ভব ঘটেছে এবং লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তথ্য ধারণের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

মস্তিষ্কের বিকাশ শুরু হয়েছে স্পাইনাল কর্ডের স্ফীত উর্ধ্বাংশের মধ্য দিয়ে। স্পাইনাল কর্ডের এই স্ফীত ঊর্ধ্বস্থানে অবস্থান করছে সবচেয়ে পুরনো অংশ ‘ব্রেইন-স্টেম’, অর্থাৎ স্নায়ু ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয় মস্তিষ্ক। এই ব্রেইন-স্টেম পরিচালনা করে মূল জৈবিক প্রক্রিয়াগুলো, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে প্রাণের ছন্দ-হার্টবিট, রক্ত সংবহন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া। পল ম্যাকলিনের প্রভোকেটিভ ইনসাইট -মতানুসারে, মস্তিষ্কের উচ্চ ক্রিয়াকলাপের অংশগুলোর উদ্ভব ঘটেছে তিনটি ধারাবাহিক পর্যায়ে। প্রথম অংশটি ব্রেইন-স্টেমকে ঢেকে রাখে। এই অংশটিকে বলে আর-কমপ্লেক্স বা সরিসৃপ জাতীয় মস্তিষ্ক। আক্রমণাত্মক আচরণ, ধর্মীয় আচার আচরণ, অঞ্চল-সীমারক্ষা, সামাজিক যাজকতন্ত্রের জন্য এই অংশ দায়ী- যার উদ্ভব ঘটেছিল শত কোটি বছর আগে আমাদের সরিসৃপ জাতীয় পূর্ব-পুরুষদের মাঝে। আমাদের প্রত্যেকের স্কালের একেবারে ভিতরের দিক হলো কুমিরের মস্তিষ্কের মতো অনেকটা। এই অংশের কারণেই আমরা নেতা নামের ব্যক্তিটির পেছনে যুক্তিহীনভাবে অন্ধের মতো দৌড়াই। তাদের দানবসুলভ বক্তৃতাতে উল্লাসবোধ করি, আরেক দলের লোকদের পিটিয়ে মেরে ফেলি।

আর কমপ্লেক্স-কে ঘিরে আছে লিম্বিক সিস্টেম অথবা স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্ক নামের অংশটি, যার উদ্ভব ঘটেছিল কোটি কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে, যারা স্তন্যপায়ী ছিল; কিন্তু প্রাইমেট ছিল না। ‘লিম্বিক সিস্টেম’ হলো আমাদের মেজাজ-মর্জি, আবেগ ও উদ্বেগের এবং নবীনদের প্রতি স্নেহ-বাৎসল্যের একটা বড় উৎস। মস্তিষ্কের আগের আদিম অংশগুলোকে নিচে রেখে এবং তাদের সঙ্গে বৈরিতামূলক সহাবস্থান বজায় রেখে লক্ষ লক্ষ বছর আগে আমাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের (লেমুর, বানর, নরবানর, মানুষ যখন একই পূর্বপুরুষে নিহিত ছিল) মধ্যে অবশেষে বিকশিত হয়ে উঠেছিল সেরেব্রাল কর্টেক্স। সেরেব্রাল কর্টেক্স-যেখানে পদার্থ রূপ নেয় চেতনায়, এটা হলো আমাদের সমস্ত মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মূল উৎস। মস্তিষ্কের দুই-তৃতীয়াংশের অধিক হলো স্বজ্ঞা ও জটিল বিশ্লেষণের জগৎ। সেরেব্রাল কর্টেক্স এখানে আছে বলেই গণিতশাস্ত্র নিয়ে মাথা ঘামাই, সংগীত রচনা করি, কবিতা লিখি। কর্টেক্স আমাদের সচেতন জীবনযাপনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা হলো আমাদের প্রজাতির স্বাতন্ত্র্যতা, মানবিকতার আবাসস্থল। সভ্যতা হলো ‘সেরেব্রাল কর্টেক্সের’ একটি ফলাফল।

শত কোটি বছরের বির্বতনের তথ্য জেনেটিক কোডের মাধ্যমে জিনে লিপিবদ্ধ থাকে; কিন্তু যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানি, তা নথিভুক্ত থাকে এমন ধরনের কোষের মধ্যে, যাকে আমরা নিউরন বলি-আণুবীক্ষণিক বিদ্যুৎ-রাসায়নিক লম্বা নমনীয় সরু জাতীয় পদার্থ বিশেষ, সাধারণভাবে এক মিলিমিটারের কয়েকশতভাগের একভাগ। ফলে মস্তিষ্কের ভাষা আর জিনের ডিএনএ’র ভাষা এক নয়। আমাদের প্রত্যেকের আছে ১০ হাজার কোটি নিউরোন-মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নক্ষত্রের সংখ্যার সঙ্গে তুলনীয়। অসংখ্য নিউরনের তাদের পার্শ্ববর্তীগুলোর সঙ্গে হাজার হাজার সংযোগ রয়েছে। এভাবে হিসাব করলে মানুষের সেরেব্রাল কর্টেক্সে এক কোটি সংযোগ রয়েছে! আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। এমনকি আমরা যখন ঘুমাই তখনো মস্তিষ্কে অনুরণন হচ্ছে, থ্রবিং, ফ্লাসিং করছে মানবীয় জীবনের জটিল কর্মকা- নিয়ে-স্বপ্ন, স্মরণ, কোনো কাজ হৃদয়ঙ্গম না হওয়া পর্যন্ত চিন্তা করা ইত্যাদি।

মস্তিষ্ক স্মরণ করা ছাড়াও তুলনা, সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ এবং তৈরি করে বিমূর্তন। ফলে আমাদের জিনের চেয়ে মস্তিষ্ক অনেক বেশি জানে। এই কারণে জিন লাইব্রেরি থেকে মস্তিষ্ক লাইব্রেরি ১০ হাজার গুণ বড় হয়। যখন আমাদের জিন টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য সংরক্ষণ করতে পারলো না আমরা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের ব্যবহারকে আবিষ্কার করলাম। হকিং এর ভাষায় চারপাশটার প্রতি সাড়া দেবার সামর্থ্য অর্জনে, এমন কি পরিকল্পনা করার জন্যও প্রচুর পরিমাণ তথ্যপ্রক্রিয়াজাত করতে হয়। নিজের পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতম প্রাণীটিই হবে সবচেয়ে সফল প্রাণী। এক পর্যায়ে এ সফলতা এমন পর্যায় পৌঁছায়, এমন কি নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়ে প্রাণীটি এবং এ কারণেই আমরা, আত্ম সচেতন প্রাণী। গড়ে ওঠে শরীরছাড়া এক স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা। 

গত কয়েক দশকে অনেক ধরনের গবেষণা, পরীক্ষা হয়েছে। যেমন, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের সাইবারনেটিকসের অধ্যাপক কেভিন ওয়ারউইক ও ইরিনা ওয়ার উইক, যারা নার্ভাস সিস্টেম থেকে নার্ভাস সিস্টেমের যোগাযোগের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন ২০০৪ সালের মার্চে; নর্থ ক্যারোলাইনার ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দুটি ইঁদুরের মস্তিষ্কের মধ্যে এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা মানুষ ও ইঁদুরের মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। তবে রাজেশ রাও ও অ্যান্ড্রিয়া স্পোক্কো বিশ্বাস করেন, তারাই প্রথম দু’জন মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহযোগে সংযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। প্রফেসর হোয়াইটের দুটি বানরের মধ্যকার মস্তিষ্ক পরিবর্তনের কথাও স্মরণ করতে পারি। ২০১৩ সালে রুশ দিমিত্রি ইৎস্কভ এক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন তা আর হলো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব অটুট রেখে মানুষের মস্তিষ্ককে মেশিনে স্থাপিত করতে চাইছেন। 

প্রায় ৮০/৯০ বছর আগের লেখা এরকম একটি ধারণার সঙ্গে পরিচিত হই, আলেক্সান্দার বেলায়েভের হৈটি টৈটি গল্পে। এ গল্পটিতে দুর্ঘটনায় মরে যাওয়া এক বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখেন প্রফেসর ভাগনার। পরে হাতির করোটির মধ্যে তা স্থাপন করেন। খ্যাতনামা অনুবাদক ননী ভৌমিক অনূদিত রুশ প্রগতি প্রকাশনা গল্প সংকলনে কাহিনীটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কীভাবে মস্তিষ্ক স্থানান্তর বা ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের এত অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন, তা ভাবলে বিস্ময়ই জাগে। হাতিকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণের কথা বলা হয়েছে: একটা হলো উদার প্রাণী, সবল, দীর্ঘায়ু। অর্থাৎ মৃত রিঙের মস্তিষ্কটি একশ কি দুশ’ বছর বাঁচতে পারবে। খুব খারাপ কথা কি? মস্তিষ্ক অপারেশন ভাগনার নিজেই করেছেন। সব স্নায়ু মুখ শিরা, ধমনি এক একে বেছে সেলাই করতে হয়েছে। জন্তুর দেহক্রিয়া মানুষের মতো হলেও অনেক তফাৎ রয়েছে। এই দুই পৃথক ব্যবস্থাকে মিলিয়ে ভাগনার একত্র করেছেন, আর তা করেছেন আবার একটি জ্যান্ত হাতির ওপর। পরবর্তীতে মৃত রিঙের মস্তিষ্ক নিজের ব্যক্তি সত্তা হাতির কাঠামো নিয়ে জীবনযাপন করতে থাকে নানারকম সুবিধা ও অসুবিধার মধ্যে। 

ওই গল্প সংকলনেই আরেকটি গল্পের লেখক আনাতলী দনেপ্রভ ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণে জীবনের এক দারুণ সংজ্ঞা দিয়েছেন: 

‘জীবন হলো আমাদের দেহযন্ত্রের নিউরনের মধ্য দিয়ে কোডবদ্ধ বৈদ্যুতিক রাসায়নিক উত্তেজনার অবিরাম সঞ্চালন। যে সব সংবেদন দিয়ে তোমার আত্মিক অহং তৈরি হয়, সেটা আর কিছুই নয়, কেবল কতগুলো বিদ্যুৎ-রাসায়নিক প্রেরণ, গ্রাহক ইন্দ্রিয় থেকে তা বাহিত হয়ে পৌঁছায় মস্তিষ্কের উচ্চতম রেগুলেটরে, সেখানে জারিত হয়ে ফিরে আসে কারক ইন্দ্রিয়ে’।

বহির্জগতের সব সংবেদন স্নায়ুতন্তু দিয়ে পৌঁছায় মস্তিষ্কে। প্রতিটি সংবেদনের রয়েছে নিজস্ব কোড, ফ্রিকোয়েন্সি ও মস্তিষ্কের গতি। আর এই তিনটি জিনিসের ওপরেই নির্ভর করে তার চরিত্র, প্রখরতা ও স্থায়িত্ব।

অর্থাৎ শরীর আর মন বস্তুগত উপাদানে তৈরি হলেও, মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর অনবরত পরিবর্তিত অবস্থার উপজাত হলো আমাদের মন। আমাদের শরীর হলো একটা হার্ড-ওয়্যার; আর মন হলো সফটওয়্যার। মস্তিষ্ক স্থানান্তরের মাধ্যমে সে হাতির অ্যানাটমিক্যাল, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলোর শুধু নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে না, নিচ্ছে মানসিক পরিচালনার দায়িত্ব। দেকার্তের ভাষায়, মন শরীরের সঙ্গে যুক্ত ‘পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের মাধ্যমে, শিরদাঁড়ায় বসানো একটি লোব। এ ব্যাপারে স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, তিনি পুরোটা ঠিক না থাকলেও খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন।

জীববিদ্যাসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ডিজিটাল টেকনোলজি ইঙ্গিত করে যে স্নায়ু ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে শরীরবৃত্তীয়ভাবে আরেকটি দেহের সঙ্গে কৃত্রিম উপায়ে বাচিয়ে রাখা সচল মস্তিষ্ককে সংযুক্ত করা যায়, যদি না মস্তিষ্কহীন ওই দেহটির ফাংশনাল কোনো গোলযোগ থাকে। তবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতা গড়ে উঠবে মস্তিষ্কের গতিপ্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই।

এখন কথা হচ্ছে কিছু ‘মস্তিষ্কের কোষ’ কে জাগানো গেলে অন্যান্য কোষকেও জাগানোর একটা সম্ভাবনা থাকে। অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সরবরাহের মাধ্যমেই এই কাজটি করতে হবে। এভাবে শক্তি উৎপাদনে ‘মস্তিষ্ককে’ জাগাতে হলে মস্তিষ্কের কোষ নিউরনগুলোর সংযোগস্থল তথা সিন্যাপ্সে শক্তি সরবরাহ করে তাদের মধ্যে পুনরায় এমন একটি যোগাযোগ জাল তৈরি করতে হবে, যাতে সেখানে ‘ইলেকট্রিক সিগন্যাল’ উৎপন্ন হয়।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যখন মস্তিষ্কের কোনো অঞ্চলের সমস্ত নিউরন পারস্পরিক একটা যোগাযোগ জাল তৈরি করে এবং সেখান থেকে ক্রমাগত বৈদ্যুতিক সংকেত উৎপন্ন হয়, তখনই আমরা মস্তিষ্ককে জাগ্রত বলি। গবেষকরা উৎপন্ন এই সংকেতকে যাচাই করেই মস্তিষ্কের চেতনাবস্থা যাচাইয়ের কথা বলছেন। যদিও পরীক্ষাকালীন সময়ে তারা এরকম কোনো সিগন্যাল তৈরি হতে দেখেননি। তবে মৃত মস্তিষ্কের কিছু নিউরনকে তারা পুনরায় সক্রিয় করতে পেরেছেন, যেগুলো কিছু জটিল কাজ যেমন- শক্তি উৎপাদন করা, বর্জ্য নিষ্কাশন করা, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ গঠনকে মেইনটেইন করা-ইত্যাদি ফাংশন পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে।

গবেষকদের অনেকে বলেছেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে না পারলেও তাদের একটি ‘ইলেক্ট্রিক শক’ দেওয়া হলে হয়তো তারা নিশ্চিতভাবে সেই সংকেত তৈরিতে উঠে-পড়ে লাগতে পারে। ফলে আপাত ‘মৃত’ হতেও তখন ছলছল করা প্রাণ ঠিকরে বেরিয়ে পড়তো। 

তবে চেতনার ব্যাপারে হকিং একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। গবেষণাটি হলো: ১৯৭০ সালের দিকে, জন কনওয়ে নামের এক গণিতজ্ঞ বিষয়টির এক অপ্রত্যাশিত অগ্রগতি ঘটান। তিনি ‘গেম অব লাইফ, নামের সাধারণ এক যন্ত্র তৈরি করেন; একটা সাধারণ সিম্যুলেশন, যা আমাদের দেখায়, কি করে মনের মতো বা চেতনার মতো একটা জটিল জিনিস বেরিয়ে আসতে পারে, কেবল এক সেট মৌলিক নিয়ম থেকে। 

কৃতজ্ঞতা 

স্টিফেন হকিং এর বক্তৃতা, দ্য মিনিং অব লাইফ, অনুবাদ : সেলিম মোজাহার

কার্ল সাগানের পার্সিট্যান্স অব মেমরি; অনুবাদ : আসিফ

বিবর্তনের পথে ইতিহাসের বাঁকে-আসিফ


লেখক : বিজ্ঞানবক্তা ও সম্পাদক, মহাবৃত্ত (বিজ্ঞান জার্নাল)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //