বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ সম্প্রতি এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, তিনি প্রযুক্তি, আইনি সহায়তা এবং পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে আরো সহজলভ্য করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশের চলমান বিচারব্যবস্থা জনগণের কাছে সহজলভ্য, জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও গতিশীল করার লক্ষ্যে এখনো উল্লেখযোগ্যহারে প্রযুক্তি ব্যবহারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। যদিও রাষ্ট্রীয় অন্যান্য কার্যক্রমে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন ও প্রচলিত পদ্ধতির সংস্কার কিছুটা হলেও পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু আদালতের বেশির ভাগ বিচারিক কার্যক্রম অদ্যাবধি সেকেলে ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। উচ্চ ও অধস্তন- উভয় আদালতই একইভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থার আধুনিকায়নে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে মামলা-মোকদ্দমা দায়ের, বণ্টন, বিচার, বিচারপ্রার্থীদের মামলার বিভিন্ন বিষয়ে অবগতকরণ, সনদ দাখিল, উত্তোলন, সরবরাহ প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই সাধারণত প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয় না। আদালতকেন্দ্রিক সমৃদ্ধ কোনো ডাটাবেইস আজও গড়ে ওঠেনি। ফলে নিষ্পত্তিতে ধীরগতি এবং বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির অবসান হচ্ছে না। অবশ্য প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হলে বিদ্যমান আইনগুলোতে বেশ কিছু সংশোধন এবং পরিবর্তন আনতে হবে। সে ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিক থেকে উদ্যোগ অনুপস্থিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অথচ পৃথিবীর বহু দেশেই সময়, খরচ, আদালতের কাজে গতি বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনয়ন এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে অত্যাধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Al), বৃহৎ ভাষা মডেল (LLM), মেশিন লার্নিং (ML), প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ (NLP) ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। দেশগুলোতে আইনজীবী ও আইনি সহায়তা প্রদান করে এমন সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিচারকরাও দাপ্তরিক কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। এমনকি বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়ও এআই ব্যবহৃত হচ্ছে!
কলম্বিয়ায় আদালতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘এআই’ ব্যবহারের একটি নজির রয়েছে। একটি বীমা কোম্পানি একজন অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসার খরচ বহন করবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিচারক বহুল ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় জেনারেটিভ এআই টুল ChatGPT ব্যবহার করেছেন। ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দু-একটি আদালতেও স্বল্প পরিসরে এআই ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এআই ব্যবহারের মাত্রা আরো বাড়বে বলে গবেষকদের ধারণা। তবে বাংলাদেশের বিচারিক কাজে এআই ব্যবহারের ঘটনা এখনো ঘটেনি।
বিচারের ক্ষেত্রে আইনের উপযুক্ত বিধান খুঁজে বের করতে, আদালতের সামনে উত্থাপিত মামলায় সেটির প্রয়োগ এবং মামলা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে ও সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে এই প্রযুক্তি আদালতের কাজের নির্ভুলতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাই কেউ কেউ এটিকে সস্তা ও দ্রুতার দিক থেকে মানুষের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন।
২০২৩ সালের ইউনেসকো কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বিচারকদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ তাদের দৈনন্দিন কাজে এআই ব্যবহার করে। তারা এআই প্রযুক্তি মামলার সংক্ষিপ্তসার ও খসড়া তৈরি, ই-মেইল লেখা, নথি প্রস্তুত এবং আইনি গবেষণার জন্য এআইয়ের দ্বারস্থ হন।
বিচারিককাজে এআই ব্যবহারে প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিচারক যদি এআই ব্যবহার করে থাকেন, তবে তা বিচারকদের জবাবদিহির প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়ায় আপস বয়ে আনতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এআইয়ের সংমিশ্রণ ঘটানোর মাধ্যমে বিচারিক যুক্তি এবং সিদ্ধান্তের উপসংহারে পৌঁছানোর কারণে রায় দুর্বলভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। কেননা এখনো বিচারপ্রক্রিয়ার এআইয়ের ব্যবহার পরীক্ষামূলক। আদালতের যেকোনো আদেশ/রায়/ডিক্রিতে সিদ্ধান্ত প্রদানের ন্যায্যতা এবং যুক্তিসংগত কারণ প্রদান করা হয়ে থাকে, যা ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যেও অন্যতম। এআইয়ের হস্তক্ষেপে ন্যায়বিচারের সেই মূলনীতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ফলস্বরূপ এআই সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাপ্ত রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আপিল করার অধিকার এবং বিচারকের যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতার মতো প্রথাগত জবাবদিহি প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা হারাতে পারে।
আবার এআই সিস্টেম কীভাবে কাজ করে তা প্রায়ই অপারেশনাল গোপনীয়তার কারণে বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য প্রকাশ করা হয় না। অন্যদিকে কম্পিউটার প্রগ্রাম বুঝতে পারে এমন কোড, কমান্ড এবং ফাংশন আইনি ভাষাতে সঠিকভাবে অনুবাদ বা রূপান্তর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ আইন গাণিতিক যুক্তি মেনে রচিত হয় না। কিন্তু আইনের ধারা, বিধান বা ভাষাকে গাণিতিকভাবে প্রগ্রামিং কোডে রূপান্তর করার পরই তা এআই প্রযুক্তিতে ব্যবহার উপযোগী হয়। আইনি ভাষায় প্রায়ই দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। সুতরাং আইন কেবল সরল পাঠের বিষয় নয়, অধিকন্তু অনুধাবন এবং পারঙ্গমতার বিষয়ও বটে, যা প্রয়োগে প্রাসঙ্গিকতা আমলে নেওয়া অত্যাবশ্যক। আবার সময় সময় আইনে অনেক সংশোধনী আনা হয়, নতুন নতুন মামলার রায়ের মাধ্যমে উচ্চ আদালত থেকে নজির তৈরি করা হয়, ন্যায়বিচারের ক্ষেত্র সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে নানা কারণে আইনকে কম্পিউটারের কোড উপযোগী ভাষায় অনুবাদ করা বেশ জটিল। এ কাজে আইনি প্রজ্ঞার প্রয়োজন হয়, যা সাধারণত প্রগ্রামারদের থাকে না। আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোড নিয়মিত আপডেট করা না হলে সে বিচার ন্যায়বিচারের পরিপন্থি বলে বিবেচিত হতে পারে।
অতএব, বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অ্যালগরিদমিক ডিসিশন মেকিং (ADM) অন্তর্ভুক্ত করলে মৌলিক বিচারিক মূল্যবোধ যেমন- ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা, বৈচিত্র্যতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, আইনের শাসন, সমানাধিকারসহ সব নাগরিকের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার, গোপনীয়তার অধিকার ইত্যাদি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া এডিএম দ্বারা জাতি, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, বয়স প্রভৃতির ক্ষেত্রে বৈষম্যেরও প্রবল ঝুঁকি রয়েছে। বিচারকরা যদি বিচারিকপ্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করা শুরু করেন, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। দেখা যাবে একই ধরনের বিষয়ে একেক আদালত একেক ধরনের রায় দিচ্ছেন। যার ফলে বিচারাঙ্গণে ডিজিটাল বৈষম্য শুরু হবে।
এআই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানব বিচারকের মতো বিচক্ষণতা, ন্যায়পরায়ণতার প্রয়োগে এটি সক্ষম নয়। বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে আইনি কর্তৃত্ব সম্পর্কে জুরিসপ্রুডেনশিয়াল প্রশ্নও উত্থাপিত হতে পারে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আইনানুসারে কার? প্রগ্রামার, নীতিনির্ধারক, বিচারক (মানব সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী) বা কম্পিউটার নাকি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা নিজেরই? বর্তমান আইনি কাঠামোয় এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয়। আবার বিচার প্রক্রিয়ায় এআই কোনো ভুল করে থাকলে তার দায় কে নেবে, দায় কি ব্যবহারকারী বিচারকের, অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের, সফটওয়্যার প্রগ্রামারের নাকি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির?
এআইয়ের সাহায্যে বিচারের রায় দিলে সাধারণ জনগণ সে রায়ে কতটুকু আস্থা রাখবে, তাও ভাবনার বিষয়। উপরন্তু এআইতে সব সময় নিরাপত্তাঝুঁকি বিদ্যমান, অ্যালগরিদম যেকোনো সময় হ্যাক বা ম্যানিপুলেট হতে পারে, যা রায় ও বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
তবে সারা পৃথিবীতে এআই প্রযুক্তির যে জয়জয়কার ও বহুল ব্যবহার, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে এআই ক্রমান্বয়ে আরো উন্নত হবে এবং দ্রুতই মানুষের বিভিন্ন কাজের স্থান দখল করে নেবে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আইনাঙ্গনেও ক্রমান্বয়ে এআই ব্যবহারের ক্ষেত্র বিকশিত হবে। তাই বিচার কাজের মতো গুরুদায়িত্বে এআইয়ের যথাযথ, সুপরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত, জবাবদিহিমূলক, সংবেদনশীল ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিস্তারিত নির্দেশিকা প্রদান ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও বিচারপ্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh