দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে অনলাইন স্ক্যামিং

বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে অন্তর্জাল জগৎ তথা ইন্টারনেট। বিস্তর সুবিধার পাশাপাশি অন্তর্জালের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদও বিস্তৃত হয়েছে। এই ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে অর্থ খোয়ানোর তালিকায় একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে রয়েছেন জনপ্রিয় সেলেব্রিটি, বহুজাতিক কোম্পানির বড় কর্তা, ব্যাংকের সিইও, নিউরোসায়েন্সের একজন পিএইচডি গবেষক, গির্জার যাজক, এমনকি প্রতারণা ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা এফবিআই কর্মকর্তাদের স্বজনরাও। অনলাইন প্রতারণা অবৈধ মাদকের ব্যবসার মতোই বড় ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি আরো বিপজ্জনক। কারণ এটি ধনী-গরিব ভেদাভেদ ছাড়াই প্রতিটি সাধারণ মানুষের জীবনকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। 

প্রতারকদের প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল রয়েছে, যেখানে ধাপে ধাপে নির্দেশনা দেওয়া হয়- কিভাবে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রতারিত করা যায়। বিশ্বজুড়ে এই প্রতারণার সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত কৌশল হলো পিগ বুচারিং। ইকোনমিস্টের তথ্য অনুসারে, এই কৌশলেই হাতিয়ে নেওয়া হয় বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। পিগ বুচারিং এক ধরনের জালিয়াতি বা প্রতারণার কৌশল, যেখানে প্রতারক দীর্ঘ সময় ধরে ভুক্তভোগীর বিশ্বাস অর্জন করে তাকে বিনিয়োগ বা আর্থিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি আকৃষ্ট করে এবং শেষ পর্যন্ত তার পুরো অর্থ আত্মসাৎ করে। কৌশলটির নাম পিগ বুচারিং; এসেছে শুয়োর পালনের ধারণা থেকে, যেখানে শুয়োরকে ভালোভাবে খাওয়ানো ও মোটা-তাজা করা হয়; তারপর তাকে জবাই করা হয়। একইভাবে প্রতারকরা প্রথমে টার্গেটকৃত ব্যক্তির আস্থা অর্জন করে, ধীরে ধীরে প্রলুব্ধ করে, তার সম্পদ বা সঞ্চয় বিনিয়োগে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করে। একপর্যায়ে প্রতারণা করে পুরো অর্থ হাতিয়ে নেয়। স্ক্যামাররা ভুক্তভোগীকে টার্গেট করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ডেটিং অ্যাপ বা ভুয়া বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। 

বিশ্বজুড়ে এই প্রতারণা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কোনো সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল বা দেশে এই অপরাধ সীমাবদ্ধ নয়। তবে কিছু কিছু দেশে অপরাধীদের সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। সিঙ্গাপুরে এ ধরনের অপরাধ খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে শুধু কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে স্ক্যামিংয়ে প্রায় ২.৫ লাখ মানুষ যুক্ত ছিল। বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগ করা কঠিন। কারণ প্রতারকরা এমন জায়গা থেকে জাল পাতে সেখানে সাধারণত আইনের নাগাল থাকে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আগামী দিনে এই প্রতারণার জগৎকে ভিন্নমাত্রা দেবে বলে আশঙ্কা অনেকের। কারণ মাত্র ১৫ সেকেন্ডের একটি ভয়েস নমুনা ব্যবহার করে প্রতারকরা কণ্ঠস্বর প্রায় হুবহু নকল করতে সক্ষম হচ্ছে। এমনকি এআই-ভিত্তিক ভিডিও ডিপফেইকের মাধ্যমে প্রতারকরা করপোরেট নির্বাহীদের মতো সেজে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করছে। সীমান্ত পেরিয়ে অপরাধীরা যখন অর্থ ও মানবসম্পদ স্থানান্তর করে, তখন প্রচলিত আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা প্রায়ই তা দমনে ব্যর্থ হয়। 

চীনের অপরাধ সিন্ডিকেটগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে এবং চীন প্রতি বছর লক্ষাধিক সন্দেহভাজন প্রতারককে গ্রেপ্তার করছে। এই ধরনের স্ক্যাম মোকাবিলায় শুধু জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই বৈশ্বিক অপরাধ দমনে কাজ করা। বর্তমানে অনেক দেশের পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলেও অনলাইন প্রতারণাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। সিঙ্গাপুর এরই মধ্যে ব্যাংক, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং পুলিশের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্র চালু করেছে, যেখানে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা আটকে দেওয়া সম্ভব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh