কিংবদন্তির প্রস্থান

এভারেস্টের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করলেও মন হয় ঠিকমতো হলো না! টেনিস খেলায় যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা জানেন কি অমূল্য রত্ন কোর্ট থেকে বিদায় নিচ্ছেন। সুইজারল্যান্ডের রজার ফেদেরার ২৪ বছরের পেশাদার খেলোয়াড়ী জীবনে দেড় হাজার ম্যাচ খেলেছেন। তাঁর নিজের ভাষায় বিদায়ী বক্তব্য, “টেনিস আমাকে কল্পনার থেকেও বেশী সন্মান দিয়েছে। তবে, আমাকে বুঝতে হবে কখন ক্যারিয়ারের ইতি টানতে হয়। আসন্ন লেভার কাপই (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুরু হতে যাওয়া) হবে আমার শেষ প্রতিযোগিতা। ভবিষ্যতে আমি আরো টেনিস খেলবো তবে, কোনো গ্র্যান্ড স্ল্যাম বা ট্যুরে নয়। এটি ছিল আমার জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত।”

বিশ্বের অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড় ও ক্রিড়াবিদের আদর্শ রজার ফেদেরার। তাঁদের মধ্যে আছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মাইকেল জর্ডন, সেরেনা উইলিয়ামস, এন্ডি মারে এবং আরো অনেকে। তিনি মোট কুড়িটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম প্রতিযোগিতা জিতেছেন। সর্বোচ্চদের তালিকায় তিন নম্বরে। তাঁর উপরে আছেন রাফায়েল নাদাল (২২) এবং নোভাক জোকোভিচ (২১)। রেকর্ড তৈরীই হয় ভাঙ্গার জন্য। কিন্তু, সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠতম টেনিস খেলোয়াড়দের তালিকায় তাঁর নাম হয়তো থাকবে সবার উপরে। অন্তত গত চল্লিশ বছর ধরে যারা এই খেলাটি দেখছেন, তাঁদের কাছে তিনি নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম।    

আমার সৌভাগ্য হয়েছে গত চার দশকে বেশ কয়েকজন বিরল প্রতিভাধর টেনিস খেলোয়াড়দের খেলা দেখার। তাঁদের মধ্যে বিয়র্ন বোর্গ, জন ম্যাকেনরো, বরিস বেকার, জিমি কনোর্স, আদ্রে আগাসি, স্টেফি গ্রাফ এবং মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করলে তিনজনের নাম মানস্পটে ভেসে ওঠে – বিয়র্ন বোর্গ, রজার ফেদেরার এবং স্টেফি গ্রাফ। এই তিনজনের খেলার মধ্যে কোনো খুঁত খুঁজে পাইনি। অধিক সংখ্যক ট্রফির মালিক হওয়া সত্ত্বেও নাদাল ও জোকোভিচকে এই গ্রুপে রাখতে অপারগ হলাম। কারণ শ্রেষ্ঠতম তিনজনের খেলায় উপভোগ করা ধ্রুপদী সৌন্দর্য আমি পরের দুজনের মধ্যে খুঁজে পাইনি। তাঁদের অর্জন কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই তবে, সেই প্রানভোলানো আবেশটি অনুপস্থিত। বলা যায় তাঁরা অনেকটা পাওয়ার টেনিস খেলেন। বোর্গের অস্বাভাবিক ঠান্ডা মাথার খেলা, স্টেফি গ্রাফের শেষ পর্যন্ত প্রাণপণ লড়ে যাওয়া এবং ফেদেরারের চোখজুড়ানো সিঙ্গল-হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড কখনো ভুলে যাবার নয়।            

ফেদেরারের একমাত্র তুলনা তিনি নিজে। তাঁর সেরা সময়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, উইম্বলডন এবং ইউএস ওপেনে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একমাত্র ফ্রেঞ্চ ওপেনে অজ্ঞাত কারনে তিনি নাদালের সঙ্গে পেরে উঠতেন না! তথাপি তাঁর ছন্দময় খেলা সে’দেশের দর্শকরা প্রাণভরে উপভোগ করতেন। সাঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি সর্বশেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেন ২০১৮ সালে। তিনি উইম্বলডন জেতেন আটবার যা এখনো কেউ ছুঁতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ছয়বার, ফ্রেঞ্চ ওপেন একবার এবং ইউএস ওপেন জেতেন পাঁচবার। কোর্টে ফেদেরারের উপস্থিতি মানেই ভিন্ন কিছু। ঠান্ডা মেজাজ, স্মিত হাসি, খেলায় শতভাগ মনোযোগ, শৈল্পিক মুভমেন্ট সব মিলিয়ে একটি গভীর তৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা।

ফেদেরারের ব্যাকহ্যান্ডটি বিশেষ আলোচনার দাবী রাখে। বলা হয়ে থাকে টেনিসের সুন্দরতম ব্যাকহ্যান্ডটির মালিক রজার ফেদেরার, যেটি তিনি একটি হাত ব্যবহার করে মারতেন। কাজটি দুরূহ। অন্য কাউকে এভাবে শটটি নিতে দেখা যায় না। তাঁকে জিগেস করা হলে তিনি বলেন, ফুটওয়ার্কের মাধ্যমে স্ট্রোকটি শুরু হতে হবে। শরীরকে অনেকখানি ছড়িয়ে দিয়ে সেটি খেলতে হয়। আমি এটি নিয়ে বিস্তর অনুশীলন করেছি। তিনি এই ভঙ্গীতে স্লাইস, টপস্পিন এবং ফ্ল্যাট সব ধরনের শটই খেলতেন। নয়ন-মনোহর এ দৃশ্যটি ইউটিউব ভিডিওতে দেখা যেতে পারে। তাঁর ব্যাকহ্যান্ডটি যদি হয় সুন্দরতম, ফোরহ্যান্ডটি শ্রেষ্ঠতম। তীব্র গতির টপস্পিন বা ডানে-বাঁয়ে বাঁক নেয়া স্পিন অথবা হালকা রিভার্স স্পিনে কখন কোথায় বল ফেলবেন তা বুঝে ওঠা সহজ ছিল না। সেগুলো ফেরানো ছিল অত্যন্ত দূরুহ। এ’ছাড়াও জরুরী মুহূর্তে সার্ভের তীব্রতা বাড়াতে পারতেন, প্রতিপক্ষের শক্তি বুঝে খেলার কৌশল পাল্টাতে পারতেন এবং পুরো ম্যাচে মেজাজ ঠান্ডা রাখতে পারতেন। মোটকথা তাঁর উল্লেখযোগ্য কোনো দুর্বলতা ছিল না। তবে, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষকরা বলেন; ফেদেরারের শ্রেষ্ঠতম গুন হচ্ছে তাঁর মন ও মানসিকতা।

সমীক্ষায় দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে রজার ফেদেরার ইতিহাসের সর্বাধিক জনপ্রিয় টেনিস খেলোয়াড়। তার অসংখ্য কারণ রয়েছে। মাঠের ভিতরে এবং বাইরে রজার একজন অত্যন্ত বিনীত মানুষ এবং নিপাট ভদ্রলোক। তিনি নিজকে একজন সাধারণ মানুষ মনে করেন,  তাঁর আচরনও সেরকম। প্রশস্ত মন। একবার একটি ট্যুরে তিনি হোটেলে উঠে দেখেন তাঁর কোচদের রেগুলার ডাবল রুম দেয়া হয়েছে আর তাঁকে দেয়া হয়েছে একটি বিলাসবহুল স্যুট। তখন তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে কোচদেরও একই ধরনের রুম দিতে অনুরোধ করেন। যখন জানতে পারলেন আর সে ধরনের রুম নেই; তিনি সেই স্যুট ছেড়ে একটি রেগুলার ডাবল রুমে চলে যান। তিনি প্রতিপক্ষকে সবসময় সমীহ করেন, তাঁদের বিজয়কে পুরোপুরি অর্জিত মনে করেন। ভুল কল, গ্যালারীর কোলাহল বা অসুস্থতাকে কখনো পরাজয়ের অজুহাত হিসেবে দাঁড় করান না। সর্বোপরি তাঁর খেলার সাবলিল স্টাইলটি সাধারণ মানুষের বড্ড পছন্দ। তিনি খেললে মনে হয় টেনিস কতো সহজ! তিনি যখন স্পেনে নাদালের বিরুদ্ধে খেলেন, সে দেশের দর্শক তাঁকে সমর্থন করে থাকে। ইংল্যান্ডের দর্শকরাও এন্ডি মারেকে ছেড়ে ফেদেরারকে সমর্থন করে।

পেশাদার টেনিস খেলে এবং বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহন করে ফেদেরার জীবনে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন অথচ, তিনি বিলাসী জীবনে গা ভাসিয়ে দেননি। উপার্জিত অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি ভাগ্যবিড়ম্বিতদের কল্যানে ব্যয় করে চলেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কল্যানমুখি কার্যক্রম প্রায় দশ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে। আফ্রিকায় শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য ব্যাপক চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরদিকে নিজ দেশে স্বল্প উপার্জনকারী পরিবারের শিশুদের জন্য শিক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন বাড়তি কার্যক্রমের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে যেগুলো তারা স্বচ্ছল পরিবারের শিশুদের মতো পেতে অপারগ। ফেদেরার জানিয়েছেন এই কাজগুলি তাঁকে তৃপ্তি দেয় তাই করে যাচ্ছেন। এ থেকে অন্যরা উৎসাহিত হতে পারেন এটিও তাঁর একটি আশা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //