অধ্যাপক সারওয়ার মো. সাইফুল্লাহ্ খালেদ
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:২৬ এএম
আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৯, ১১:০৯ এএম
সকালে কক্ষে বসেই হোটেল বয়কে দিয়ে আনিয়ে সামান্য নাস্তা খেয়ে দু’জনে বের হলাম। প্রথমেই গেলাম পাঞ্জাব সেক্রেটারিয়েটে। সেখানে সিএসপি অফিসার খালেদ সামস কর্মরত। আমি জানতাম না। মনজুর সাহেবই বললেন। আমার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। মনজুর সাহেবের সঙ্গে আছে।
মনজুর সাহেব একটি পাস যোগার করলেন আর আমাকে গেটে বললেন- ‘আপনি দাঁড়ান আমি ভেতরে গিয়ে আপনার পাস পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
এই বলে তিনি যে ভেতরে গেলেন, না আসলেন তিনি আর না এলো আমার পাস। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমি হোটেলে ফিরে এলাম। এর অল্পক্ষণের মধ্যেই মনজুর সাহেব হোটেলে এলেন। বললেন- ‘আপনার জন্য পাস জোগার করতে পারলাম না। দেরি হয়ে গেল। চলেন, মেয়ের কলেজের হোস্টেলে যাই। সেখানে আমার এক পরিচিত ছেলে আছে। ইন্টার উইং স্কলারশিপে মেয়ের কলেজে পড়তে এসছে। তাকে দেখে যাই।’
গেলাম। হোস্টেলটি বেশ বড়সড়ো। যতদূর মনে পড়ে, এল প্যাটার্নের চার তলা ভবন। সামনে প্রসস্ত মাঠ। ওই ছেলের সঙ্গে দেখা হলো। তার ওখানে দুপুরের গোসল সারলাম দু’জনে। মাঠের দক্ষিণ দিকে হোস্টেলের ছেলেদের বাথরুম এবং টয়লেটগুলো। প্রশস্ত খোলামেলা। পরিচ্ছন্ন। লুঙ্গি তোয়ালে ছেলেটি জোগান দিল। বুদ্ধিদীপ্ত শ্যামল বর্ণের কিশোর। তিন তলার একটি কক্ষে একাই থাকে। টেবিলের ওপর বইপত্রের সঙ্গে একটি টেবিল ফ্যান। সে নিজ খরচে বাইরে থেকে আমাদের খাবার এনে দিল।
মনজুুর সাহেব তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। পড়ালেখা ভালোই হচ্ছে জানালো। আমাদের হাতে সময় কম। বিদায়ের পালা। ছেলেটি হোস্টেলের গেট পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এলো। আমরা রিকশায় উঠলাম। করাচি এসে কিছুদিন পর মনজুর সাহেবের কাছে জানতে পারলাম ছেলেটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ট্রেনে কোথাও শিক্ষা সফরে যাচ্ছিল। চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বাইরে রেখে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার সময় বাইরের এক লোহার খুঁটিতে আঘাত লেগে মাথা চুরমার হয়ে যায়। এ শুনে তরতাজা এ কিশোর ছেলেটির শ্যামল কচি মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে লাহোর পাবলিক লাইব্রেরি দেখতে গেলাম। লাইব্রেরিটি আমার কাছে তেমন আকর্ষণীয় মনে হলো না। এক তলায় একটি ছোটখাটো লাইব্রেরি। এর তুলনায় ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিটি আমার কাছে সমৃদ্ধ মনে হলো। এখানে বেশিক্ষণ থাকলাম না। সেখান থেকে বেরিয়ে শালিমার গার্ডেনে চলে আসি। সবুজে আচ্ছাদিত একটি মনোরম বাগান। বাগানটি সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফোয়ারাটি ইতিমধ্যে বিকল হয়ে গেছে। বাগানের ভেতরের সুবিন্যস্ত রাস্তাগুলো পরিচর্যার অভাবে শ্রীহীন। বাগানটির সর্বত্রই অবহেলার ভাব সুস্পষ্ট। গাছগাছালির প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ মোগল সম্রাট শাহজাহানের এই মনোরম কীর্তিটি যত্নের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করলে আরও বহুশত বছর অক্ষত থাকত। বিভিন্ন বয়সের লোক দেখলাম এখানে সেখানে বসে আয়েশ করছেন।
বাগানটি ঘুরে ফিরে দেখে এর পশ্চিম পাশের একটি বিশালাকৃতির আম গাছের তলায় ফোয়ারাটির দিকে মুখ করে দু’জন চুপচাপ দাঁড়ালাম। মনজুর সাহেব কি ভাবলেন জানি না। আমি বিশাল মোঘল সাম্রজ্যের ঐশ্বর্য ও শৈল্পিক সুরুচির কথা ভাবলাম। আমার কল্পনার চোখে বিশাল ভারতবর্ষের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শৈল্পিক নিদর্শনগুলো ভেসে উঠল। এই ভারতে মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাকে বিমোহিত করল। এক সময় মনের অজান্তেই মনজুর সাহেবকে বললাম- ‘চলেন যাই।’
শালিমার গার্ডেন থেকে আমরা আনারকলি বাজারে এলাম। এটিও মোঘল আমল থেকেই লাহোরের একটি বিখ্যাত বাজার। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রেয়সীর নামে বাজারটির নামকরণ করা হয়েছে। বাজারটি ঘুরেফিরে দেখলাম। বাজারটি আকারে বড় হলেও খুব একটা গোছালো মনে হলো না। কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে রকমারি সব ধরনের সওদা এখানে মিলে। লোকও প্রচুর। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এক ফলের দোকানে বসে ফ্রুট সালাদ খাওয়া গেলো। আমরা প্রশস্ত সদর রাস্তায় বেরিয়ে এলাম।
রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে আসি। পরদিন সকালে শিশমহল দেখতে যাই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি। এক টাকার ট্রেজারি নোটের গায়ে এর চিত্র আছে। দেখলাম অবিকল তা-ই। কিন্তু মহলটি জরাজীর্ণ এবং স্যাঁতসেঁতে। শ্রীহীন। এই মনোরম মহলটি সংরক্ষণের বা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দুটি বালক এর মধ্যে লুকোচুরি খেলছে।
আমাদের দেখেও তারা খেলা বন্ধ করলো না। আমরা বালক দুটিকে ডাকলাম। কাছে এলে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তারা বাঙালি। তাদের বাবা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর লাহোর বেসে কর্মরত। বালক দুটি চলে গেল। তারা চলে যাওয়ার পর মনে হলো, শূন্য জীর্ণ শিশ মহল খা-খা করছে। জরাগ্রস্ত বার্ধক্যে তাকে দেখার মতো কেউ নেই বলে সে নিজেই এর মেঝে দেয়াল অশ্রুসিক্ত করে শ্যাম বর্ণের গুল্মের আচ্ছাদনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে। একদিন কি এক অপরূপ রূপ ঐশ্বর্যের দিব্য বিভা এ শিষ মহলের শরীর হতে ঠিকরে বেরিয়ে চারদিক আলোকিত মোহিত করত। আজ তা ম্লান নিষ্প্রভ।
এর একটু পূবেই দেওয়ানে আম, দেওয়ানে খাস। ঝোপঝাড় জঙ্গল এদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কাছে যাওয়ার রাস্তা নেই। পাশের রাস্তা থেকে যতদূর দেখা যায়, দেখলাম। আমার বিশ্বাস- এই উপমহাদেশ থেকে মোগলদের অস্তিত্ব মুছে যেতে দেওয়া উচিত নয়। ব্রিটিশরা এ দেশে না এলে মোগল সভ্যতা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়ে ভারতভূমিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তির মর্যাদায় উন্নীত করতে পারতো।
সেই অপরিমেয় সম্ভাবনা ব্রিটিশরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়। যে কারণে উপমহাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারাই আমূল পাল্টে যায়। উপমহাদেশের সভ্য সমাজের জীবনাচরণে নিজস্ব বলতে আর কিছুই রইলো না। পাশ্চাত্য থেকে সবই ধার করতে হলো। একটি জনপদের অধিবাসীদের জীবনে এ এক বিরাট মানবিক বিপর্যয়।
এর পর ফ্রিডম স্কোয়ারে এলাম। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে এ ফ্রিডম স্কয়ার। মাঝখানে সুউচ্চ কংক্রিটের মিনার। মিনারের পাদদেশের চারদিকে পাকিস্তানের সব প্রদেশের ভাষা ছাড়াও ইংরেজি এবং উর্দুতে লাহোর রিজলিউশন লিপিবদ্ধ।
১৯৪০ সালে এখানে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়। এ সেই প্রস্তাব। লিফটে করে মিনারের উপরে কিছুদূর ওঠা যায়। ছুটির দিন হওয়ায় আমরা সে সুযোগ পেলাম না। মনোরম চত্বরে বাহারি ফুল ও সবুজের শোভাময় সমাহার আর কংক্রিটের নির্মাণ শৈলী স্কয়ারটিকে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যমন্ডিত করেছে। এটি পাকিস্তানের জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh