বিশ্বজুড়ে লাল-সবুজের পতাকা ওড়াতে চাই

নাজমুন নাহার। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ‘ফ্লাগ গার্ল’ ও ‘ডটার অব দ্য আর্থ’ উপাধি পেয়েছেন। পিচ টর্চ অ্যাওয়ার্ডসহ আরো অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। কখনো কখনো ভ্রমণে মৃত্যুর মুখেও পড়েছেন তিনি। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

সর্বশেষ ব্রুনাই সফরের মধ্য দিয়ে ১৪০টি দেশ ঘুরেছেন তিনি। যেতে চান বিশ্বের ২০০টি দেশে। দেশের পতাকা হাতে পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো নারী এত দেশ ভ্রমণ করেছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে সাড়া জাগিয়েছেন তিনি। পতাকার সম্মানকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরতে তাই হেঁটে চলেছেন পৃথিবীর পথে। শুধু নিজেকে নন, তিনি গৌরবান্বিত করেছেন বাংলাদেশকে।

বললেন, চোখ বন্ধ করলেই আমি এখন এক মিনিটে পুরো পৃথিবী ঘুরে আসতে পারি, ভালোবাসতে পারি। এত শক্তি কোথায় পান জানতে চাইলে অকপটে বললেন, ‘আমার ভাবনার মাঝেই সব শক্তি। এ পৃথিবীকে দেখার জন্য আমার স্বপ্নই ছিল একমাত্র সম্বল। তারপর ধীরে ধীরে স্বপ্ন আর ভাবনার শক্তিকে নিয়ে বাধার দেয়ালগুলোকে ভেঙেছি এক এক করে। বড় করে ভাবতে শিখেছি নিজের স্বপ্নকে। আমি নিজেকে এখন পৃথিবীর মতো করে ভাবতে পারি। এই ভাবনাগুলো আমাকে সবচেয়ে বড় সুখ দেয়।’ 

বিশ্ব ভ্রমণের উদ্দীপনা সম্পর্কে তিনি আরো বললেন, পারব না এই শব্দটিকে আমি কবর দিয়েছি। সব হবে, সব পারব এমন ইতিবাচক চিন্তা আমাকে ধাবিত করেছে প্রতিমুহূর্ত পৃথিবীর পথে পথে। কিছুটা পথ পার হওয়ার পর দেখলাম- কোন ভাবনাকে গভীরভাবে ভালোবাসলে সে ভাবনা ফুল হয়ে ফোটে। উনিশ বছর বয়সেই পর্যটক নাজমুন নাহারের পথচলা শুরু। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত দিয়ে স্বপ্ন যাত্রা, তাও আবার একাকী। তখন নিজেও জানতেন না যে একদিন সত্যি সত্যিই ১৪০টি দেশ ভ্রমণ করে ফেলবেন। 


বিশ্ব ভ্রমণের অর্থ সংগ্রহ প্রসঙ্গে জানালেন, প্রথমে ২০০০ সালে ভারতে বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে ইন্টারশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। তারপর নেপাল সিঙ্গাপুরসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশ সফর করি। এরপর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে ২০০৬ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সুযোগ পাই। সেখানে আসার পর থেকে কঠোর পরিশ্রম শুরু করি। থাকা খাওয়ার ন্যূনতম খরচ বাদ দিয়ে সবটা ভ্রমণের জন্য জমাতাম। কাজের পাশাপাশি পৃথিবীর ম্যাপের ওপর গবেষণাও চালাতে থাকি। কীভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়, সেসব নিয়ে ভাবতে থাকি। প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে কখনো কখনো টানা তিন মাস কাজ করেছি। কখনো প্রতিদিন টানা ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেছি। এভাবে ভ্রমণের অর্থ জোগাড় করেছি। 

তিনি আরো জানালে, আমি ভাবতাম কখন অল্প খরচে ভ্রমণ করা যায়। কখন সস্তায় টিকিট পাওয়া যায়। এসব যখন একসাথে মিলে যেত, তখন ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়তাম। ভ্রমণে কম খরচে থেকেছি পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে, কখনো তাঁবুতে, কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে। ভ্রমণের জন্য অর্থের চেয়ে ইচ্ছাটাই বড়। স্বপ্ন আর ইচ্ছা আমাকে পড়াশোনা আর ভ্রমণে আগ্রহী করেছে। পরিশ্রমী আর উপার্জনক্ষম করে তুলেছে।

পৃথিবীর পথে পথে দুঃসাহসিক অভিযাত্রা সম্পর্কে নাজমুন নাহার জানান, মধ্যরাতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছি। সাহারা মরুভূমিতে মরুঝড়ের মধ্যে পড়েছি, রক্তাক্ত হয়েছি। পোকামাকড়ের কামড় খেয়েছি। অন্ধকারে অচেনা শহরে, আফ্রিকার জংলী শহরে পথ হারিয়েছি। তিন মাস আফ্রিকাতে আলু খেয়ে ছিলাম। কখনো না খেয়ে থেকেছি। কখনো কাঠ, কখনো পাথরের ওপর ঘুমিয়েছি। কখনো আদিবাসীদের সাথে মাটির ঘরে ঘুমিয়েছি। কখনো রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করতে না পেরে অপরিচিত পরিবারের সাথে থাকতে হয়েছে। ১৪ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউনটেইনে অভিযাত্রায় আন্টিচুডের সমস্যার কারণে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে আটকা পড়েছিলাম। সে সময় ২৬ ঘণ্টা অনাহারে থেকেছি। আদিবাসীদের সাথে কাটানো সেই লোমহর্ষক ঘটনা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছিলাম আইভরি কোস্টের আবিদজান সমুদ্রসৈকতে। পাড় দিয়ে হাঁটছিলাম, ছোট ছোট ঢেউ আসছিল। আমার দিকে তেড়ে এলো বড় ঢেউ। আমি ভেসে গিয়েছিলাম। ভয়ংকর ঢেউ আমাকে আরো গভীরে নিল। কীভাবে যেন বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়।

কখনো ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়েছি। পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে; কিন্তু সবই মানসিক শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করেছি। সিয়েরা লিওন থেকে লাইবেরিয়া যাওয়ার পথে ১১টি ভয়ংকর কূপ পার হতে হয়েছিল। 


জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধির কথা জানালেন নাজমুন নাহার। বললেন, মানুষের জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত, বিধাতার আশীর্বাদ। যে পৃথিবীতে আসার সুযোগ পেয়েছি, যে গ্রহে জন্ম নিয়েছি, সেই পৃথিবীটা কেমন, তার ভিন্ন গোলার্ধের মানুষগুলো কেমন, তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি কেমন, এগুলো জানার ও দেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই ছিল। তাই এই ছুটে চলা। একজন নারী হয়ে আপনি এতগুলো দেশ কোনো নিরাপত্তা ছাড়া ঘুরেছেন, ভয় লাগেনি? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন প্রথমত, আমি কখনোই নিজেকে নারী হিসেবে ভাবি না। বাবা আমাকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, স্বপ্নের কোনো জেন্ডার ডিফারেন্স নেই। স্বপ্ন যে কোনো মানুষই দেখতে পারে আর সেই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্যই নির্ভয়ে পৃথিবীর পথে নেমেছি। নারী হিসেবে নয়, পৃথিবীর পথে পথে যে কোনো মানুষেরই সমস্যা হতে পারে।

এ ধরনের সমস্যাগুলো উতরে যেতে কী করেছেন, জানতে চাইলে বলেন, যেখানেই কোনো সমস্যা দেখেছি, সেখানে আমাকে কৌশলী হতে হয়েছে। যেখানে বিপদের আশঙ্কা দেখেছি সেখানে সতর্ক হয়েছি। ব্যস এটুকুই। 

সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের পতাকাকে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে পৌঁছে দেয়ার পরিকল্পনা তার। পাশাপাশি তিনি ভ্রমণবিষয়ক বই লিখে যাচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আবারো বাংলাদেশের পতাকা হাতে বেরিয়ে পড়বেন। জাতিসংঘের প্রতিটি দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর সাথে বাংলাদেশকে পরিচিত করিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখেন। প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়বে, সেখানে তিনি শান্তির বার্তা পৌঁছে দেবেন- এটাই তার প্রত্যাশা।

নাজমুন একজন ভূগোলবিদ, গবেষক, চিন্তাবিদ, লেখক ও শান্তির দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি তরুণদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //