আমার চোখে কাশ্মীর

আচ্ছা টাইটানিক দেখেছেন? ২১ বছর বয়সী রোজ এর শুধু নীল হিরার লকেট পরিহিতা সেই বিখ্যাত ছবি আঁকার দৃশ্য? নগ্ন; কিন্তু এতটুকু অশ্লীল নয়। আমাদের প্রজন্ম, তার আগের প্রজন্ম আর আমাদের পরের প্রজন্মের মধ্যে কম-বেশি সিনেমা দেখে এমন মানুষের মধ্যে খুব কমই আছেন, যারা টাইটানিক আর ওই বিখ্যাত দৃশ্য উপভোগ করেননি। 

আমিও দেখেছি, বহুবার। বন্ধুদের সঙ্গে, একা-একা, এমনকি সিনেমা হলে গিয়েও। আর অনেক অনেক বার দেখা সিনেমাটির সব কিছুর মধ্যে রোজের ওই ছবি আঁকার দৃশ্যটিই আমার কাছে সেরা! এখন প্রশ্ন আসতে পারে, টাইটানিক সিনেমার ওই দৃশ্যের সঙ্গে কাশ্মীরের কি সম্পর্ক? হুম, খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন; কিন্তু সামঞ্জস্যটি 

কোথায়, বলছি... 

কারণ আর তেমন কিছু নয়, ওই ২১ বছর বয়সী অপরূপা কেট উইন্সলেট। কেটকে কখনো কেন যেন পুরনো, একঘেয়ে, পানসে লাগে না বা লাগেনি আমার কাছে। যদিও কেটকে তো বাস্তবে কখনো দেখিনি আর সেটি সম্ভবও নয় তবুও প্রতিটি সাধারণ মানুষের কিছু কিছু তারকার প্রতি যেমন মোহ থাকে, আমার তেমনি একটি সম্মোহন কাজ করে কেট উইন্সলেটের প্রতি! সবকিছু মিলেই দারুণ লাগে তাকে। ঠিক যেমনি লাগে সব সময় নানা রকমের, ধরনের আর সময়ের রঙ-বেরঙের কাশ্মীরকে দেখে। 

ঠিক কেটের মতো তকেও বাস্তবে দেখা হয়নি তখনো, তবে কাশ্মীরের সব ছবি-টবি দেখে তকে আমার সেই কেটের মতোই দুর্লভ, দুর্দান্ত আর চপলা মনে হয়েছে। যাকে চাইলেও ধরা যায় না। অনেক অনেক তপস্যা করতে হয় সেজন্য। করতে হয় অনেক বড় আর সময়ের পরিকল্পনা, সেই সঙ্গে অর্থের জোগান, এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কারণ এতই দুর্লভ আর কোমল সেই সবকিছু যাকে অনেক অপেক্ষার পরেই কাছে, সঙ্গে বা পাশে পেতে হয়। 

তো ২০০৯ এ, ভ্রমণের পাগলা নেশাটি মাথায় ঢোকার পর থেকেই মনে মনে কল্পনা করে চলেছি একদিন কাশ্মীর যাব। শুধু আমি কেন, যারা কম-বেশি ভ্রমণ করেন বা আগ্রহ অন্তত আছে তাদের প্রত্যেকেরই একটি সুপ্ত বাসনা থাকে একদিন না একদিন কাশ্মীর যাবেন। হয় বন্ধুদের সঙ্গে, নাহয় প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে, আর তা না হলে অন্তত একা-একা হলেও একবার কাশ্মীর যাবেন। 

আর কাশ্মীর এক এক সময়ে এক এক রঙের, এক এক রূপের, ভিন্ন ভিন্ন আকর্ষণের সব বয়সী মানুষের কাছেই, ঠিক টাইটানিক সিনেমা আর তার ছবি আঁকার সেই দৃশ্যের মতো। যে কারণেই কাশ্মীরকে পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলা হয়ে থাকে। তবে কি সত্যিই কাশ্মীর এত এত দুর্লভ? এতো এত আকর্ষণীয়? 

দেখি না আমিও পারি কিনা, লিওনার্দোর মতো করে রোজ/কেটের না হোক অন্তত কাশ্মীরের তেমন দুর্লভ কোনো ছবি আঁকতে? তবে অবশ্যই রঙ-তুলি দিয়ে কাগজের কোনো ক্যানভাসে বা আঁর্ট পেপারে নয়। আমি ছবি আঁকতে চাই আমার কাছে জমা থাকা সীমিত শব্দমালা দিয়ে, চোখ-মন আর অনুভূতির নানা রঙ ও বর্ণময় একান্ত আবেগ দিয়ে। নিজের আনন্দের, তৃপ্তির আর স্মৃতির আকাশে জ্বেলে রাখা অনেক অনেক সুখ তারার মতো আর একটি তারা জ্বালতে চাই। যেন বার্ধক্যের অবসরেও আমার সেই লেখা দিয়ে আঁকা ছবিতে খুঁজে পাই সিনেমার সেই রোজকে কাশ্মীরের মাঝেই। 

সুখ স্বপ্নের শ্রীনগর... (কাশ্মীর)
শ্রীনগর, বোধ হবার পর থেকে এই নামটি শুনলেই মনের মধ্যে একটি আতঙ্ক বিরাজ করত। কারণ পত্রিকায়, টিভিতে, নানাজনের মুখে মুখে আর অনলাইন নিউজে শ্রীনগর মানেই যেন আতঙ্ক আর ভয়ের কোনো নগরী হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। এমন কি কাশ্মীর যাব শুনে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, শুভাকাঙ্ক্ষীরা পর্যন্ত চোখ-মুখ কুঁকড়ে তাকিয়ে ছিল, আমরা কি পাগল নাকি এমন একটি অভিব্যক্তি নিয়ে। এমনকি অনেকে তো সামনা-সামনি বলেও বসেছে যে কীভাবে, কী ভেবে আর কোন সাহসে এই সময়ে কাশ্মীর যাবার মত দুঃসাহস করছি? শুনে বেশ হাসিই পেল, আরে আমি তো এমনিই দুঃসাহসী জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে, কাশ্মীর যাওয়া এমন আর কি? 

তার ওপর আমার ঘরের লোকের একটিই চাওয়া ছিল, গেলে এবারই কাশ্মীর নইলে কখনোই নয়! এভাবে বললে আর ফেলি কীভাবে? তাই শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরকেই বেছে নিতে হলো, সবরকম পারিপার্শ্বিক পরিকল্পনা বাদ দিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম পুরো ভ্রমণটি ট্রেন আর জিপে করবো, সেভাবেই বাজেট করেছিলাম; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতা আর দিল্লিতে অযথা থেকে হোটেল খরচ না দিয়ে প্রায় পুরোটিই প্লেনে করতে হয়েছিল, কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর আর ফেরার সময় প্লেনে করে দিল্লি ফিরে রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা। 

শেষ পর্যায়ে এসে দুটি টিকিট পরিবর্তন করে প্লেন করাতে খরচটি প্রায় ১৫০০০ বেড়ে গিয়েছিল; কিন্তু সেজন্য কাশ্মীরে সময় পেয়েছি পুরো ৮ দিন। যেটি খুব খুব প্রয়োজন ছিল। 

যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, শ্রীনগর যেন এক আতঙ্কের নগরী সবার এমন এক মনোভাব দেখেই মনে মনে নিজেদের মতো করে সাহস সঞ্চার করে রওনা হয়েছিলাম সপরিবারে, সঙ্গে অন্য একটি পরিবার আর দিল্লি গিয়ে আরও দুটি পরিবার একসঙ্গে হবে এমনভাবে পরিকল্পনা করে। 

ঢাকা থেকে বাসে করে বেনাপোল হয়ে কলকাতা। কলকাতা থেকে ইনডিগো এয়ারে দিল্লি পৌঁছে গেলাম রাত ১২ টায়। আমাদের শ্রীনগরের বিমান পরদিন সকাল ৬:৩০ টায়। তাই সে রাতে দিল্লিতে আর কোনো হোটেল না নিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে খেয়ে দেয়ে, ভেতরে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন শ্রীনগর যাবার প্লেনের ঘোষণা আসে? বিশাল এয়ারপোর্ট এর ঘুমের চেয়ারে গা এলিয়ে দিতেই ঘোষণা এলো শ্রীনগর যাবার এয়ার এশিয়ার বিমানের। বেশ লাল টুকটুকে এয়ার হোস্টেসদের আমন্ত্রণ নিয়ে উঠে পরলাম লাল টুকটুকে বিমানের একটি জানালার পাশের সিটে। 

কিছুক্ষণ পরেই বিমান চলতে শুরু করলো, তবে এবার আর আগের রাতের মতো করে লোকাল বাস আর ভাঙা রাস্তার মতো করে নয়, বেশ জোরে চলে কিছুদূর গিয়েই দিল উড়াল। পাশের সিটের পটিয়ে ফেলা কাশ্মীরিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কত সময় পরে স্নো মাউনটেন দেখা যাবে? বলেছিল প্রায় এক ঘণ্টা পরে, আর পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্লেন আরও প্রায় ৩০ মিনিট যাবে, একটু কম বা বেশি। বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম সেই সময়ে, একদিকে পাশে বসা কাশ্মীরি রূপ, বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশে সদ্য উদিত হতে থাকা টকটকে সূর্য, দূরের আকাশে হাজারো রঙের পাগলামি আর বিমানের পাশ দিয়ে অজানায় উড়ে যাওয়া সাদা সাদা মেঘের দল দেখে। 

কিন্তু আমার বৌয়ের আর সহ্য হলো না, একা একা সুখের আকাশে ভেসে বেড়ানো, সাদা মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, সামনে অসীম পাহাড়ের সারির জন্য অপেক্ষা আর পাশে কাশ্মীরির সঙ্গে মৃদু আলাপন; কিছু সময় পরেই পাহাড়ের সারির ফাঁকে মুখ লুকিয়ে রাখা অনেক সাধনার শ্রীনগরের অপেক্ষা, তাই তার ডাকে উঠে যেতেই হলো তার পাশে! ধুর, কি ভাবটাই না জমিয়ে ছিলাম সেই কাশ্মীরির সঙ্গে! এমন কি ঈদের দিনের দাওয়াত পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছিলাম! সব অংকুরেই বিনাশ করে দিলেন আমার পুত্রের জননী! 

মনে কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে তার পাশে বসতেই পাশের জানালায় উঁকি দিতে লাগলো উঁচু উঁচু বরফে মোড়া পাহাড় চূড়ারা! এই প্রথম এত উঁচু থেকে পাহাড়ের সারি দেখা, তাও একটি, দুটি নয়, শত শত পাহাড়ের সারি দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। নানান রঙের, ঢঙের আর আকৃতির, ছোট-বড়-মাঝারি যতদূর চোখ যায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সাদা-সবুজ-কালো পাহাড়ের মেলা। মুগ্ধ চোখে জানালায় তাকিয়ে, ক্যামেরায় অনবরত সাটার চেপে চলেছি, প্লেন থেকে দেখা অপূর্ব সব পাহাড়ের সারি, নদীর আঁকাবাঁকা পথ, দূরের ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, লেক, জলাশয়, সরু সরু রাস্তা ছোট ছোট বাঁক, পিপীলিকার মতো করে যানবাহনের ধীর লয়ে ছুটে চলা দেখতে দেখতেই এক সময় ঘোষণা এলো শ্রীনগর আর মাত্র ১৫ মিনিট! 

কিছুটা শিহরিত হয়েছিলাম ঘোষণা শুনে। এই সেই শ্রীনগর যার নাম কত শুনেছি, পড়েছি, গল্প শুনেছি, টিভিতে ছবি দেখেছি, আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই সাধনার সেই শ্রীনগরে পৌঁছে যাব আমরা! প্লেনের গতি কমে আসছে, ধীরে ধীরে প্লেন নিচের দিকে নামছে, পাহাড়গুলো কাছে চলে আসছে, নদীগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে, মেঘেরা প্লেনের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে চলেছে, নিচের রাস্তাগুলো পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে আর গাড়িগুলোর ছুটাছুটি, ঘর-বাড়িগুলো রঙিন থেকে বর্ণিল হতে শুরু করেছে, পাহাড়ের গা ছুঁয়ে প্লেন এখন পাহাড়ের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলেছে! হুট করেই যেন এক রঙিন ফুলের বাগানে আমাদের প্লেন নামতে শুরু করেছে! 

সিট বেল্ট বাঁধাই ছিল, তবুও শক্ত করে সিটের হাতল ধরে বসে ছিলাম, তবে চোখ এবার আর বন্ধ ছিল না, একদম খোলা আর বাইরের জানালায়। প্লেন ল্যান্ড করার পর ছুটে চলার সময়ই চোখে পড়লো, এয়ারপোর্ট না কি কোনো ফুলের অরণ্যে ঢুকে পড়েছিলাম বুঝতে সময় লেগেছিল। কারণ এত এত ফুলে সাজানো সেই মায়াবী, মোহময় আর পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে গড়ে ওঠা অনন্য শ্রীনগর এয়ারপোর্ট যে বিশাল কোনো ফুলের বাগান না সেটি বুঝতে বেশ সময় লাগে। রানওয়ের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামার পরে, প্লেন থেকে না নামা পর্যন্ত। 

প্লেন থেকে নামছি আর ভেতরে ভেতরে একটি দারুণ সুখের অস্থিরতা অনুভব করছিলাম, এই ভেবে যে সত্যিই কি তবে পৌঁছে গেছি সেই শ্রীনগর বা কাশ্মীরে? নিজের কাছে নিজেই যেন জিজ্ঞাসা করছিলাম। প্লেন থেকে নামতে না নামতেই জানিয়ে দেয়া হল, এই এয়ারপোর্টে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা পকেটে আর মোবাইল ব্যাগে ঢুকে গেল, সামনেই ভারী অস্ত্রধারী নিরাপত্তা প্রহরী দেখে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ই। ইস কি যে মায়া লাগলো, অমন মায়াবী চেহারা আর মায়াবী চাহনির রমণীর হাতে অতো ভারী অস্ত্র দেখে! মানে মানে কেটে পড়লাম রানওয়ে ছেড়ে। তবে আড়চোখে ঠিকই দেখে নিয়েছি, জ্যাকেটের ভারী টুপিরফাঁক ফোঁকর দিয়ে, চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, ফুলে ফুলে সাজানো, পাখিতে ভরপুর, মেঘ-কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত, সেনাবাহিনী দিয়ে নিরাপদ করে রাখা দারুণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের শ্রীনগর এয়ারপোর্টকে। মনটা খুশিতে ভরে গেল পুরোটাই।

এয়ারপোর্ট এর ভেতরটা বেশ ছিমছাম অল্প জায়গা নিয়ে আর তেমন কোনো জৌলুশ ছাড়াই, কিন্তু চমৎকার হিমহিম ঠাণ্ডা একটি পরিবেশ। খুব দ্রুতই লাগেজ এসে গেল, ঠিক সেই সময়েই চোখ পড়লো প্লেনে পাশের সিটের সেই মায়াবী কাশ্মীরির দিকে, আহা কী ছিল চাহনিতে কে জানে! ওদিকে বৌয়ের রক্ত চক্ষুর জ্বালাতনে চোখ নামিয়ে ট্রলি নিয়ে বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভারের কাছে ছুট দিতে হলো। 

বাইরে বের হতেই তার সঙ্গে আবার চোখা-চোখি আর ইশারায় বিদায় জানিয়েই, নির্ধারিত গাড়িতে ছুটলাম, ছুটলাম স্বর্গীয় কাশ্মীরের, মায়াময় ডাল লেকের পানে। 

ভাসমান শহর ডাল লেক 
ঢাকা থেকে কলকাতা আর কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর যেতে, প্রায় দুই রাত নির্ঘুম থাকার কারণে গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না চাইতেও। অনেক চেষ্টা করেও চোখকে বশ মানাতে না পারার কারণে ঘুমের কাছে সমর্পণ করেছিলাম। এসে গেছি, ওঠো বাবা, নামো তাড়াতাড়ি, ছেলের এমন অনবরত ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি আমাদের গাড়ি ডাল লেক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আর গাড়ি ঘিরে ধরে অনেক হোটেল আর হাউস বোটের দালাল। শ্রীনগর এই সময়ে (জুন) একদম ফাঁকা বা প্রায় টুরিস্টশূন্যই বলা যায়। তাই সবাই নিজের সুবিধামতো গন্তব্যে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

যাই হোক, সেসবে পাত্তা না দিয়ে আমাদের আগে থেকেই ঠিক করা হাউস বোটের পাঠানো সিকারায় উঠে পরলাম দলবেঁধে। সিকারায় উঠে আর ওঠার আগে সবার কথাবার্তায়ও বুঝে ফেললাম আমরা প্রথমেই একটি ধরা খেয়েছি তবে হালকা ধরনের। যেটি হাউস বোটে পৌঁছে আরও ভালো ভাবে বুঝলাম। যথেষ্ট ভালো আর আরামদায়ক হাউস বোট; কিন্তু কিছুতেই ১৬০০ টাকা দিয়ে থাকার মতো নয়। এর চেয়ে অনেক ভালো মানের হাউস বোটও পাওয়া যায় ১০০০ এর মধ্যে। 

কিন্তু পরিবার নিয়ে, সকালে হোটেল বা হাউস বোট খোঁজার ঝামেলা এড়াতেই আগে থেকে এই বুকিং করা হাউস বোট। যদিও পরে মালিক ১২০০ টাকাতেই রাজি হয়েছিলেন; কিন্তু আমরা মাত্র ১০০০ টাকায় বেশ ভালোমানের, লেক লাগোয়া হোটেল পেয়ে যাওয়াতে আর থাকিনি এক দিনের বেশি। তবে একটি আশা পূরণ হয়েছিল। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যে কাশ্মীরের হাউস বোটে যেদিন থাকব, সেদিন এমন একটি সময় উঠবো যেন একই দিনে সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা আর রাতের সব রকম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি। ঠিক তাই হয়েছিল, হাউস বোটের সব রকম রূপই সেদিন পেয়েছিলাম, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা আর রাত্রির। 

ডাল লেকে দিয়ে যখন সিকারায় করে আমাদের জন্য নির্ধারিত হাউস বোটে যাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল ধুর আর কিসের ডাল লেক, কি এমন আছে এখানে? এর চেয়ে তো আমাদের স্বরূপকাঠি কোনোভাবেই কম নয়! এমনকি এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনাও করেছি কম-বেশি। এমনকি যখন হাউস বোটে পৌঁছালাম তখনো এই মানসিকতার তেমন একটি পরিবর্তন হলো না কারও। মোট কথা প্রথম দর্শনেই মুগ্ধতায় ব্যাকুল হয়ে যাইনি আদৌ।

তবে এটি হতে পারে আগের টানা দুই রাত দুই দিন জার্নি আর নির্ঘুম রাত কাটানোর কারণে সাময়িক অবসন্নতার জন্যও হয়তো। কারণ ধীরে-ধীরে ফ্রেস হয়ে, নাওয়া-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে যখন হাউস বোটের সামনের খোলা কাঠের বারান্দা বা পাটাতনে চেয়ার পেতে বসলাম, তখন থেকে মুগ্ধতা ঘিরে ধরতে শুরু করল, ডাল লেকের চারপাশ থেকে। 

যখন হাউস বোটে উঠি তখন হয় খেয়াল করিনি, নয়তো মেঘে ঢাকা ছিল। ফ্রেস হয়ে আর বিশ্রাম নিয়ে ফিরে আসতেই এতদিন ধরে সিনেমায় দেখে আসা ছবিগুলো চোখের সামনে বাস্তব হয়ে ধরা দিতে লাগল, একে, একে...। 

নানান রঙের সিকারার শান্ত জলে বয়ে চলা, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-বেগুনি আর গোলাপি, বর্ণিল ফুলে, ফুলে ভরা সিকারাগুলো ভেসে চলেছে এক হাউস বোট থেকে আর এক হাউস বোটের সিঁড়ির কাছে, দূরে পাহাড়ের সূর্যের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, সঙ্গে নানা রঙের বদল ক্ষণে ক্ষণে, কখনো সবুজ, কখনো হলুদ আবার কখনো গোলাপির আভা, লেকের স্বচ্ছ পানিতে পাহাড়ের ছায়া, সিকারার রঙ-বেরঙের ছাদগুলোর পানির নিচের নাচন, আর নানা রকমের ফলের বিকিকিনি। 

সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে সূর্য হেলে পরতেই চোখে ভেসে উঠল ঝলমলে ডাল লেক। এক অপূর্ব লাল রঙে সেজেছিল সেদিন, সূর্য। পাহাড়ের গায়ে আর পানিতে পড়ে পুরো ডাল লেকই যেন হয়ে উঠেছিল এক লালের আধার! যেন শ্রীনগর বিয়ের সাজ পরেছে। একে, একে হাউস বোটের সামনে এসে ভিড়তে লাগলো শালের বহর, ফলের পসরা, নানা রকম গয়না, উপহার সামগ্রীর অনেক অনেক আয়োজন ছাড়াও, কাশ্মীরি পোশাকের নানা রকম মহড়া। এর মধ্যে কাশ্মীরি সেই বিখ্যাত ড্রেস পরে ছবি তুলে দেওয়ার নানারকম পাঁয়তারা তো চলছেই। 

অনেকে অনেক কিছু কিনলেও দোকানিদের মন ভরাতে পারলো না কেউ। সেই সঙ্গে দুপুরের আহারের সময় হয়ে গেল। দুপুরের খাবার শেষ করে সবাই হাউস বোট ছেড়ে চললাম পরী মহলের দিকে। সেই পরী মহলের গল্পটি অন্যদিন। আজ শুধু হাউস বোটের গল্পটিই বলি। পরী মহল থেকে হাউস বোটে ফিরে সবাই আবার বিশ্রামে চলে গেলাম। উঠলাম ইফতারির একটু আগে আগে। তখন আমাদের ঘড়িতে সাতটি বেজে গেছে কিন্তু এখানে সন্ধ্যা নাকি হয় সেই ৮টায়! আজান ৭টা পঁয়তাল্লিশে! কি আর করার হাউস বোটের সামনের লনে চলে এলাম। 

এসেই দেখি এক অন্য ডাল লেক। দুপুরে যেটি শুধু লালের ছোঁয়া ছিল, এখন সেটি শত রঙের খেলায় মেতেছে। এক এক জায়গায় সূর্যের এক এক রকম রঙ লেগেছে। সবুজ পাহাড় হয়েছে হলুদ, নীল পানি হয়ে গেছে মেরুন, দূরের সাদা পাহাড় হয়েছে গোলাপি আর লাল! কাছে-পিঠের গাছে গাছে অবর্ণনীয় আলোর ঝলকানি! সে এক অদ্ভুত রঙের খেলায় মেতেছিল পুরো ডাল লেক, পাহাড়, বরফে মোড়া চূড়া, নাম না জানা শত গাছের পাতা, লেকের পানি, আর হাজারো আলোর ঝলমলে বাতি জ্বলে উঠেছিল শত শত হাউস বোটের সামনের কাঠের বেলকোনিতে। 

সে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের অনিন্দ্য সুন্দর রূপ দেখেছিলাম সেদিন পুরো ডাল লেকের। সকালে এক সোনা মাখা হলুদাভ রূপ, দুপুরে সবুজ ছায়া, পানিতে সূর্যের শত রঙের খেলা আর বিকেলে শেষের সন্ধ্যা থেকে রাতে এক অবর্ণনীয় সাজে সেজেছিল ডাল লেক। কোনো রঙের কমতি ছিল না কোথাও, আর ওপরি পাওনা হিসেবে ছিল রমজান শেষের অন্ধকার আকাশের লক্ষ-কোটি তারা ভরা আকাশের অপার্থিব সম্মোহন। 

পুরোপুরি পরিপূর্ণ এক ডাল লেকের দেখা পেয়েছিলাম সেদিন, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম। হুবহু তেমন করে, উপভোগ করেছি সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা আর স্নিগ্ধ রাতের অপরূপ ডাল লেক। 

পরীমহল, শ্রীনগর কাশ্মীর
কাশ্মীর নিয়ে প্রথম গুগলে সার্চ করতে গিয়ে নানা রকম লোভনীয় আর চোখের সুখ হয়ে যায় এমন কতশত ছবির মধ্যে যে ছবিটি সবার প্রথমে আর একদম আলাদা করে আমার দৃষ্টি কেড়েছিল, সেটি হল চারপাশে বিশাল বিশাল সব সবুজ পাহাড়ের মাঝে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে এক পাহাড়ের সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজের মহিমা আর আভিজাত্য জানান দিচ্ছে একটি বনেদী আর বেশ পুরনো রাজমহল। বেশ অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। সেই সঙ্গে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যদি কোনোদিন কাশ্মীর যেতে পারি বা যাই তাহলে অবশ্যই আমার নিজের জন্য, নিজের কাছে প্রথম দর্শনীয় স্থান হবে এই পুরনো আভিজাত্যের প্রতীক, পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই বনেদী রাজমহল। যেভাবেই হোক সেখানে যাবো। দরকার হলে পাহাড় ট্রেক করে ওখানে যাবো; কিন্তু যাবই ইনশাল্লাহ। 

তবে তখনো সবুজ পাহাড় আর সাদা উড়ে বেড়ানো মেঘেদের মাঝে প্রতিনিয়ত নিজের আভিজাত্য জানান দিয়ে যাওয়া এই রাজমহলের নাম আমি জানতাম না। আর এটি যে আসলে কোনো রাজমহলই না সেটিও জানা ছিল না সেই সময়। এমনকি যখন কাশ্মীর যাই তখন পর্যন্ত আর কিছু জানতে পারিনি। এই রাজমহলের নাম জেনেছি আমি অনেক দিন পরে, তাও প্রায় দুই বছর পরে বারবার নানা জায়গায় গুগলের ছবি দেখতে গিয়ে জেনেছি যে এটির নাম পরীমহল আর এটি সম্রাট শাহজাহানের বড় ছেলে দারাশিকোর লাইব্রেরি ও একটি কয়েক স্তরের বাগান মাত্র! এটি তৈরি করেছিলেন সেই ১৭ শতকের মাঝামাঝি। তার মানে এক মুঘল রাজপুত্রের লাইব্রেরি ও বাগান বাড়ি বলা যায় এটিকে। 

তো সেই থেকে বিশাল সবুজ পাহাড়ের মাঝে নিজের রাজসিক উপস্থিতি জানান নিয়ে যাওয়া পরী মহল দেখতে যাওয়া কাশ্মীরে আমার একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল। 

সিকারায় করে নির্ধারিত হাউস বোটে গিয়ে পৌঁছাতেই আমার মনের মধ্যে পরীমহল দেখতে যাবার বাসনা; কিন্তু সবাই দারুণ ক্লান্ত বলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করা পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা করলাম; কিন্তু নাস্তা শেষ করতেই সবাই একটু নিজেকে এলিয়ে দিল হাউস বোটের নরম বিছানায়; কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না, আমার মন তো সেই কখন থেকে পরীমহলে যাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। 

কিছু সময় পরে, সকাল প্রায় ১০ টার দিকে সবার কাছে প্রস্তাব পেশ করা হল পরী মহল আর আশপাশের মুঘল গার্ডেনগুলো দেখে আসার। কারণ সারাদিনের জন্য ৩৩০০ রুপির গাড়ি ভাড়া করা আছে। এখন না গেলে ওই টাকাটা পুরো জলে যাবে বলে সবাইকে সম্মত করালাম। তারপর একটু ফ্রেস হয়ে, রেডি হয়ে ডাল লেকের নরম জলের, কোমল ঢেউ পেরিয়ে গাড়িতে করে ছুটে চলেছি কাশ্মীরে আমার নিজের কাছে অন্যতম আর প্রধান আকর্ষণ পরীমহলের দিকে। ভেতরে ভেতরে আমি দারুণ উত্তেজিত আর রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম কাক্সিক্ষত সেই পরীমহলের কাছে যাচ্ছি বলে। 

আহা প্রাণ ভরে, বিশাল সবুজ পাহাড়ের মাঝে, সাদা মেঘেদের সঙ্গে মিতালী করে রাজকীয় ভঙ্গিতে শতশত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে আভিজাত্যে ভরপুর এই পরীমহল। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোর তৈরি এই পরীমহল। আমাদের গাড়ি ডাল লেকের মাঝামাঝি গিয়ে ডানে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে চলতে শুরু করল। পথে যেতে যেতেই চোখে পড়ল দুটি মুঘল গার্ডেনের অপরূপ দর্শন। নিশাত গার্ডেন আর চশেমশাহী। পরী মহল দেখে ফেরার সময় এই গার্ডেনে বেরিয়ে যাব বলে ঠিক করে রাখলাম। আগে প্রধান আকর্ষণ পরীমহল। প্রায় ১০ বা ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমাদের গাড়ি পরীমহলের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছে গেল। ঠিক মনে নেই ২০ বা ৩০ রুপি করে টিকিট করে ঢুকে পড়লাম পরীমহলের অন্দরে। 

পরীমহলে ঢুকেই একরাশ মুগ্ধতা যেন স্বাগত জানালো সবুজের গালিচা বিছিয়ে, চারপাশের বর্ণীল ফুলের আপ্যায়ন। একটু এগোতেই এর সঙ্গে যুক্ত হল পরীমহলের ওপর থেকে ডাল লেকের টলটলে জলের শরবতের মত মিঠে জলের আহবান! একি দেখছি পরীমহলে এসে? এসেছিলাম শুধু একটি প্রাচীন রাজমহল দেখবো বলে। ইট, পাথরের কোনো এক পুরনো, বনেদী স্থাপনা দেখবো বলে; কিন্তু সেখানে এসে এমন রুক্ষ পাথরের কোনো এক স্থাপনার মাঝে এমন সবুজের গালিচা, ফুলে ফুলে সুশোভিত বর্ণীল বাগান আর সেই বাগানের পাশের দেয়ালে বসে নিচের টলটলে জলের অপূর্ব ডাল লেকের দেখা মিলবে স্বপ্নেও এমন করে ভাবিনি। 

আর শুধু কি তাই? শুধু কি সবুজের গালিচা, ফুলের সমারোহ আর ডাল লেকের হাতছানি? পুরো পরীমহলের চারপাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়ের দেয়াল, পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেদের ওড়াওড়ি, আর কাছের সবুজ পাহাড়ের সিঁড়ি পেরিয়েই যেন পৌঁছে যাওয়া যাবে হাত ছোঁয়া দূরত্বের তুষারে ঢাকা পাহাড় চূড়াদের ওপরে নিমিষেই। এমনই এক অপার্থিব পাহাড়ের দেয়ালে ঘেরা সবুজ পাহাড়ের মাঝে, মেঘেদের ছোঁয়া আর ডাল লেকের দৃষ্টি সীমায় দাঁড়িয়ে নিজের আভিজাত্যের সবটুকু জৌলুস ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে অবিরত এক অপার্থিব পরিবেশে অবস্থিত পার্থিব এক স্থাপনা পরীমহল। 

একটি চমৎকার মনে গেঁথে যাওয়ার মত ঝলমলে দুপুর কাটিয়েছিলাম পরীমহলের সবুজ গালিচায়, ফুলের মাঝে, ঝিরঝিরে বাতাসের স্পর্শে, ডাল লেকের দৃষ্টি সুখ, মেঘে ভেসে যাওয়ার মতো মিহি আর তুষার জড়ানো পাহাড় চূড়ার মতো অদ্ভুত আকর্ষণের সঙ্গে। প্রিয় আর কাশ্মীরের প্রথম আকর্ষণের পরীমহলে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //