হাঙ্গেরিয়ান গুইয়াশ

২২ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার রাতে জেএফকে থেকে বুদাপেস্টের প্লেন ধরি। সঙ্গে আমার সহকর্মী দেগেমু আন্দেতা, আবিসিনিয়ার মানুষ। পদমর্যাদায় সহকারী হলেও ওর চালচলনে বস বস একটা ভাব। আবিসিনিয়রা এ কথা বলে গর্ব করে যে, ওদের দেশ কখনো পরাধীন হয়নি। অন্য কোনো জাতি ওদের শাসন করেনি; কিন্তু আমি জানি ইতালীয়রা কিছুকাল এই দেশটিকে উপনিবেশ করে রেখেছিল। এ কথার উত্তরে ওরা বলে না, না, ওরা ইরিত্রিয়ায় এসেছিল, ইথিওপিয়ায় নয়। তখন তো আমাকে মুখ খুলতেই হয়, বলি স্বীকার করছ তাহলে ইরিত্রিয়া আলাদা ভূখণ্ড। তখন ওদের ধারালো মুখ ভোতা হয়ে যায়। ওরা যে পরাধীন ছিল না এই গর্ব ওদের হাঁটার ছন্দে, দৈনন্দিন কাজে-কর্মে। কোনো কাজের হুকুম দিলে প্রথমে নেতিবাচক সাড়া, পরের বার কোনোরকমে মেনে নেয়। আওয়াশ ভেলির হেদার গ্রামে ১৯৭৪ সালে লুসির ফসিল আবিষ্কৃত হওয়ার পরে তো ওদের আর মাটিতে পা-ই পড়ে না। পৃথিবীর প্রথম মানুষের জন্ম আবিসিনিয়ায়। গর্ব তো করবেই। আমেরিকার বিখ্যাত কফিশপ স্টার বাক্স ইথিওপিয়াকে কফির রয়্যালটি দেয়। কেন দেয়? কারণ কফির জন্ম ইথিওপিয়ায়। গর্ব করার তো অনেক কিছুই আছে। আবিসিনীয় সুন্দরীদের কথা না হয় না-ই বললাম। 

আমার আগেই দেগেমু বিমানে গিয়ে উঠল। হাতে এক লিটারের ব্যাকার্ডি গোল্ড। ওকে দেখলে ততটা আফ্রিকীয় মনে হয় না। গায়ের রঙ বাঙালিদের মতোই, উচ্চতা অবশ্য একটু বেশি, পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। বিজনেস ক্লাসের ঠিক পেছনেই ওর আসন, আমার আসন বিমানের একেবারে পেছনে, মাঝখানের রো-এর তিন আসনের মাঝখানে। আমার দু’পাশে দুই মোটাসোটা শ্বেতাঙ্গ নারী। ওদের দু’জনের মাংসের ধাক্কায় আমার অবস্থা যখন বেশ সঙ্গিন তখন দেগেমু এসে হাজির। স্থান-কাল-পাত্র চিন্তা না করেই সে আমার অবস্থা দেখে হো হো হো হো করে বিমান কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সবাই যখন ওর মুখের দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে তখন সে, যেন কিছুই হয়নি, এমন একটি ভঙ্গি করে খুব নিচু গলায় বলে, ‘হোয়াটএভার’? ও লজ্জা না পেলেও আমি খানিকটা লজ্জা পাই, আর লজ্জা পায় আমার ডানদিকের জার্মান বুড়ি। সে লজ্জা পেয়ে উঠে লেভেটরির দিকে হাঁটতে থাকে। দেগেমু এগিয়ে এসে আমাকে কানে কানে বলে, 

সামনে চলে আসুন, আমার পেছনে একটি আসন খালি আছে। 

সুইস এয়ার তখন অতলান্তিকের নীল জলরাশি অতিক্রম করছে।

ওখানে গিয়ে আরেক ফ্যাসাদ। দেগেমুর পাশের আসনে এক ইথিওপীয় যুবতী। দু’জনের মধ্যে চলছে অনর্গল আমহারিক ভাষায় কথোপকথন আর মদ্যপান। ননস্টপ রেডিও চলছে। এখন বুঝতে পারছি পেছনের আসনটি কেন খালি। আমি গলা বাড়িয়ে বলি,

দেগেমু তোমার স্ত্রী যে সঙ্গে যাচ্ছে তা-তো আগে বলোনি, 

ওকে কোনো উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে আমি মেয়েটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলি, 

হাই ম্যাডাম, আমি কাজী, দেগেমুর সহকর্মী। 

মেয়েটি আমাকে যুগপৎ অবাক করে দিয়ে বলে, 

মি. ইসলাম, আমি তো আপনাকে ভালো করেই চিনি। আমি জাতিসংঘের কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে কাজ করি। আমার নাম এস্থার। 

লে হালুয়া, দেগেমুকে অপ্রস্তুত করতে গিয়ে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ওপরে থু থু ফেলার যে কি বিপদ আরও একবার টের পেলাম।

সাড়ে ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ হলেও সময় যেন একদমই কাটছে না। আমিও এবার গলা বাড়িয়ে ওদের রেডিও স্টেশনে যোগ দিই। ওদের মাথার ওপরের এটেন্ডেন্ট ডাকার বাতিটা কিছুতেই নিভছে না। পানি এলে ওয়াইন চাইছে, ওয়াইন এলে খাবার, আবার পানি, এরপর কফি। নির্ধারিত খাবার, পানীয় শেষ করেও ওরা বার বার এটেন্ডেন্ট ডাকছে। সুইস এয়ারের ক্রুরা অতিশয় ভদ্র। যা চাইছে মুহূর্তেই তা হাসিমুখে এনে হাজির করছে। এমিরাটস হলে বুঝতো ঠেলা। আজকাল এমিরাটসের বিমানবালাদের আমার কাছে বেশ ঝগড়াটে মনে হয়। একবারের বেশি দুইবার কিছু চাইলেই কেমন রাগী রাগী চোখ করে তাকায়। 

দেগেমু আর এস্থার মাঝে মাঝেই বিমান কাঁপিয়ে হেসে উঠছে। হঠাৎ ওরা নীরব হয়ে যায়, তখন দেগেমু ঘড়ড় ঘড় করে নাক ডাকতে শুরু করে। এস্থার তখন আমার চেয়ে বেশি বিরক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে দেগেমুকে ধাক্কা দেয়। ও ধড়ফড় করে লাফিয়ে ওঠে। উঠেই বলে, 

মি. ইসলাম একটা জোকস বলুন। 

আমি জোকস বলতে শুরু করি। 

ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসাইয়াস এবং জিউদে রাজি হলো ইথিপিয়াকে লোহিত সাগরে করিডোর দেওয়ার বিষয়ে মিটিংয়ে অংশ নিতে; কিন্তু মিটিং হবে কোথায়? ইসাইয়াস যাবে না আদ্দিস আবাবায় আর জিউদে যাবে না আসমারায়। তখন ট্রাম্প প্রস্তাব দিলো মিটিং হবে আকাশে, উড়ন্ত বিমানের ভেতর। মিটিং শুরু হল। দুই পক্ষই হার্ড লাইনে। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। ইসাইয়াস সমুদ্রে করিডোরের বদলে পাঁচগুণ জমি চাইছে, আর জিউদে কিছুতেই বাড়তি জমি দেবে না। দু’জনই অপরপক্ষকে এই বলে আক্রমণ করছে যে তাদের দেশের লোকদের মধ্যে বর্তমান নেতৃত্বের কোনো জনসমর্থন নেই। বিমান চলছে আদ্দিস আবাবার ওপর দিয়ে। হঠাৎ জিউদে তার স্যুটকেস খুলে পাঁচ মিলিয়ন বির জানালা দিয়ে ফেলে দিল। সবাই তো অবাক, ট্রাম্প জিজ্ঞেস করে, কি করলে হে, এতগুলো টাকা ফেলে দিলে। জিউদে হাসতে হাসতে বলে, ফেলে দিলাম কোথায় বস, আমার দেশের জনগণকে দিলাম। ওরা আমাকে এত ভালোবাসে, তাই এই সামান্য কয়টা টাকা। ওদের অনেক উপকার হবে। কিছুক্ষণ পর বিমান আসমারার আকাশে প্রবেশ করলে ইসাইয়াস তার স্যুটকেস খুলে দশ মিলিয়ন নাকফা জানালা দিয়ে ফেলে দিল। ট্রাম্প আবারও বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, কি করলে ইসাইয়াস? ইসাইয়াস মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, ওরা আমাকে এত ভালোবাসে, এই টাকাগুলো পেলে ওদের অনেক উপকার হবে। ততক্ষণে ওরা লোহিত সাগরের ওপর। পাইলট তখন সিদ্ধান্ত নিল বিমানটিকে লোহিত সাগরে ফেলে দেবে। বিমান যখন সোজা নিচের দিকে নামছে তখন তিনজনই চিৎকার করতে করতে পাইলটকে বলছে, পাগল হয়েছ? কী করছো তুমি? পাইলট হাসতে হাসতে বলে, ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়ার মানুষের অনেক উপকার হবে, সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানুষেরও। 

তখন সুইস এয়ার এসে জুরিখ বিমান বন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করল। ওরা এমনভাবে চমকে উঠল যেন ইসাইয়াস এবং জিউদের বিমানে চড়ে ওরাও লোহিত সাগরে নেমে গেছে। 

হাঁটতে হাঁটতে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। দেগেমু গজরাতে গজরাতে ‘মূর্খ, মূর্খ’ বলে কাকে যেন খিস্তি করছে। ইমিগ্রেশনের লাইনে ও আমার ঠিক পেছনেই। আমি বলি, 

কাকে মূর্খ বলছ? 

ওই সুইস বুড়িটাকে।

যে তোমার ছবি তুলে দিল?

শিটম্যান। দেখো এসব কী তুলেছে?

আমি ওর সেল ফোনের এলসিডি স্ক্রিনের ওপর আঙুল বুলিয়ে স্ক্রল করে করে ছবিগুলো দেখে সত্যিই না হেসে পারলাম না। একটি ছবিতেও ওর মাথা নেই।

আমি হাসতে হাসতে বলি, 

দেগেমু, বুড়ি তোমার কামানো মাথা পছন্দ করেনি, অন্য কিছু পছন্দ করেছে। দেখো ওই জিনিস কিন্তু সব ছবিতেই আছে। 

দেগেমু আবার স্ক্রিনে চোখ রেখে বলে, ও মাই গড।

বুড়ি ওর বেল্টের নিচের অংশের একটি ক্লোজ আপও নিয়েছে। এতক্ষণ ভেবেছিলাম, বয়স হয়েছে, হয়তো ঠিক মতো চোখে দেখতে পায়নি, এখন বুঝতে পারছি বুড়ি ইচ্ছে করেই এসব করেছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ কার অন্তরে কীভাবে প্রোথিত তা মুখ দেখে কী আর বোঝা যায়। 

সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর এবং বাণিজ্যিক রাজধানী জুরিখ। এই শহরের দাপ্তরিক ভাষা জার্মান হলেও মানুষের মুখে মুখে যে ভাষা প্রচলিত, তা হচ্ছে আলেমানিক বা জুরিখ-জার্মান। আজ থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। মধ্যযুগ থেকেই জুরিখ একটি স্বাধীন জনপদ।

ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আমরা অতি পরিচ্ছন্ন একটি রেলগাড়িতে চড়ি। এটি দুই টার্মিনালের মধ্যে যাত্রী পারাপার করে। প্রতি মিনিটে এসে হাজির হয়। ট্রেনের দরোজা বন্ধ হতেই মো..করে গরু ডেকে উঠলো, এরপর কক কক করে মুরগী। কোথায় যেন মাঠে কাজ করছে কিষাণ-কিষাণী, পাকা গমের আঁটি নিয়ে যাচ্ছে কেউ, ঝম ঝম ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। ট্রেনের ভেতরে এইসব শব্দের এমন নিখুঁত পরিবেশন আমাকে দূরের কোনো ফসলের মাঠে নিয়ে গেল মুহূর্তেই। 

জুরিখ খুব ব্যস্ত বিমানবন্দর। ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র এবং আকাশপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ জংশন। ইউরোপের অন্যান্য বিমানবন্দরে পৌঁছেই আমার মনে হয়েছে কোনো এক নির্জন গ্রামে এসে পৌঁছেছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন আমাদের পরবর্তী জাহাজে চড়ার গেটের কাছে এসে পৌঁছলাম, সেই নির্জন গ্রামের কথাই আবার মনে পড়ল। কাচের ওপাশে কয়েকটি বিমান চিতল মাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে, এপাশে হাতে গোনা কয়েকজন বুদাপেস্টের যাত্রী। 

বিমানবন্দরের রানওয়ের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের ফাঁকা মাঠ, আল্পসের ঢেউ। এই শহরে শিল্প-সাহিত্যের তেমন বিখ্যাত কেউ না জন্মালেও এখানে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন ইউলিসিস উপন্যাসের লেখক জেমস জয়েস। বিশ্বখ্যাত এই আইরিশ লেখক ১৯৪১ সালের ১৩ জানুয়ারি এই শহরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জেমস জয়েস বিশ শতকের খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক ছিলেন। ইউলিসিস লিখে তিনি বিশ্বখ্যাত হলেও তার রচিত কবিতা, গল্প এবং শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা বিশ শতকের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। জেমস জয়েস একজন বিখ্যাত লেখক একথা তো আমরা সবাই জানি, তাকে চিনি লেখক হিসেবেই, কিন্তু তার মানবিক দিকটি নিয়ে কাউকে কখনো কথা বলতে শুনিনি। জুরিখে থাকাকালীন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, তিনি তার খ্যাতির সুবাদে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ১৬ জন ইহুদি বন্দিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর এই তাড়না তাকে নিঃসন্দেহে একজন বড় মাপের মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে। 

জুরিখে পা দিয়েই আমার সব সময় যা মনে হয় তা হচ্ছে দাদাবাদ। শিল্প-সাহিত্যে এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে দাদাবাদের জন্ম ও বিকাশ। দাদাবাদের প্রবক্তা রোমানিয়ান-ফ্রেঞ্চ কবি ত্রিস্তান জারা, যিনি মলদোভিয়ার ইহুদি পরিবারে জন্মেছিলেন, এই শহরে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছেন। দাদাবাদের জন্ম ও বিকাশের জন্য তিনি জুরিখকেই বেছে নিয়েছিলেন।

এ ছাড়া ভ্লাদিমির লেনিন, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরাও জুরিখ শহরে তাদের জীবনের কিছু সময় অতিবাহিত করেন। আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী সুইস কৃষ্ণাঙ্গ গায়িকা টিনা টার্নার জীবনের অনেকটা সময় এই শহরে কাটান। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে একক অ্যালবামের বিক্রি-তালিকায় তিনি এক নম্বরে ছিলেন, যার ঝুলিতে ছিল ১২টি গ্রামি এওয়ার্ড। 

দূরে যে আল্পসের ঢেউ, ছোট ছোট বাড়িঘর, পত্র-পল্লবহীন বৃক্ষরাজি, ধূসর পাহাড় আর বিচিত্র বর্ণের টিউলিপসারি, এসবের ভেতরে লুকিয়ে আছে এইসব বিখ্যাত মানুষের হাজারো স্মৃতি, হাজারো গল্প। আজ হয়ত বিমানবন্দর থেকেই উড়াল দিতে হচ্ছে কিন্তু এর আগে বহুবার এই শহরে এসেছি, এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটেছি, খুঁজেছি তাদের জীবন, মেলাবার চেষ্টা করেছি কত, কত কিছু। তাদের চরণচিহ্ন কী আমাকেও উৎসাহ দেয়নি, কানে কানে বলেনি, হে কবি, হাঁটো, হাঁটতে থাকো, হেঁটে যাও দূর থেকে আর দূরে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে ওই তো হেঁটে যাচ্ছেন ত্রিস্তান জারা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, গলায় কালো টাই, পরনে কালো ওভারকোট, এক চোখে হাই পাওয়ারের গ্লাস।

আমাদের একটি বাসে তোলা হলো, জনা চল্লিশেক যাত্রী। নিশ্চয়ই ছোটো প্লেন। সাধারণত ছোটো প্লেনগুলোকে বিমানবন্দরের গেইটের সঙ্গে ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত করা যায় না। তাই এই প্লেনগুলোতে উঠতে হয় হেঁটে হেঁটে অথবা প্লেন দূরে থাকলে বাসে চড়ে।

এবার কিন্তু আমার আসন একেবারে সামনে। ছোট্ট এই বিমানটিতে বিজনেস ক্লাস বলে কিছু নেই। আমি দ্বিতীয় সারির ডানদিকে, জানালার পাশে বসেছি। দেগেমুর আসন বেশ অনেক পেছনে। আমার পাশের আসনে ২৫/২৬ বছরের এক উর্বশি এসে বসলেন। সাদা নারীর কালো চুল, নীল চোখ, অপূর্ব। বেশ বিরল কম্বিনেশন। খুব বেশি লম্বা নয়, সাড়ে পাঁচফুট হবে, খুব শুকনোও নয় আবার নাদুসনুদুসও বলা যাবে না, এমন ফিগার। সাধারণত পাশের আসনের কারো সঙ্গে আমি শুরুতেই পরিচয়টা করে নিই, এতে ভ্রমণকালীন অপরিচিতের সঙ্গে বসে আছি এমন অস্বস্তি থেকে বাঁচা যায়। আমি খুব ভালো করে লক্ষ করেছি পাশের আসনে যদি কোনো নারী বসেন, তিনি সাদা, কালো, এশিয়ান, উন্নত-অনুন্নত দেশের, যে-ই হোন না কেন, প্রথম কিছুক্ষণ আলাপ জমাতে পারেন না, জড়তা কাটতে বেশ খানিকটা সময় লাগে; কিন্তু এই মেয়েটি অন্যরকম, বসতে বসতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে 

সোফিয়া, আপনি? 

আমি বলি, 

কাজী। 

মেয়েটি বারবার গলা বাড়িয়ে জানালায় চোখ রাখার চেষ্টা করছে দেখে আমি বলি, 

তুমি চাইলে উইন্ডো সিটে বসতে পারো, আমার আইলে আপত্তি নেই। 

সোফিয়া সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে গেল। আমরা আসন বদল করলাম। এই বদল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা কি নিজের অজান্তেই পরস্পরের সাংস্কৃতিক দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে ফেললাম? হয়তো। 

সোফিয়া যখন আল্পসের ঢেউ দেখছে, মুগ্ধ হয়ে দেখছে ধূসর পর্বতশৃঙ্গের মাথায় জুইশ পুরোহিতের ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছোট ছোট টুপির মতো শুভ্র তুষারের চাকতি, আমি তখন খুঁজছি ত্রিস্তান জারাকে। জারার কিছু কবিতা আমি পড়ার চেষ্টা করেছি, খুবই অদ্ভুত এবং উল্টো-পাল্টা, কী কাঠামো, কী বিষয়, বেশ বিরক্তিই লাগে, তবুও এই মানুষটিকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। তিনি কবিতার গীতলতাকে ভেঙে, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে একটি মতবাদ দাঁড় করিয়েছেন। ভালোমন্দ যাই হোক, এই যে নতুন কিছু করার তাড়না, এটাকে আমি সমীহ করি। দাদাবাদীরা বিষয়বস্তুর দিক থেকে সভ্যতায় উল্টো হাওয়া বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বিজ্ঞানই একদিন এই পৃথিবীকে ধ্বংস করবে এই বিশ্বাস মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছেন। আমি অনুমান করি ইওরোপের এই দাদাবাদী আন্দোলনের কারণেই স্কুলের বিজ্ঞান ক্লাসে আমরা এই বিতর্ক নিয়ে উপস্থিত হতাম, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। কবিতা হিসেবে দাদাবাদীরা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু উপহার দিতে পারেননি বলে এই ধারাটি দাঁড়াতে পারেনি, কিন্তু এরই হাত ধরে আসে পরাবাস্তবতা এবং তা আজো বিশ্বসাহিত্যের একটি বড় অংশজুড়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। আজো পৃথিবীর বড় লেখক/কবিরা পরাবাস্তব গল্প/কবিতা লিখছেন। শিল্পসাহিত্যে দাদাবাদের প্রবর্তন জার্মান অধ্যুষিত এই অত্যাধুনিক জুরিখ শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আজকের জুরিখ কিন্তু দাদাবাদের বলয়কে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে পুরোপুরি বিজ্ঞানের আশির্বাদের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। তবে দাদাবাদীরা কবিতাকে কবিতার চেয়ে বেশি কিছু করে তুলতে চেয়েছিলেন, কবিতাকে তারা শিল্পের এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। শুধু পাঠে নয়, দর্শনেও যেন তা শিল্প হয়ে ওঠে সেজন্য তারা উল্টোপাল্টা লাইন লিখে, অক্ষর বড়-ছোট, আঁকাবাঁকা করে কবিতা লিখেছেন। সেই ঐতিহ্য আজো ধরে রেখেছে জুরিখ। এখনো জুরিখে কবিতার উৎসব হয় এবং সেখানে এমন স্লোগান দেখা গেছে, ‘পোয়েট্রি উইথ এভ্রিথিং’, মানে সবকিছু দিয়ে কবিতা। তোমার হাতের কলম, পানির গ্লাস, কাঁটা চামচ, বিন ব্যাগ, যা আছে সব দিয়ে তৈরি করো কবিতা। আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ। এমন উল্টা-পাল্টা ভাবনাই আসলে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। আর উল্টাপাল্টা ভাবনার জন্য দরকার সাহস। সকলের সেই সাহস থাকে না। 

আল্পস পর্বতমালা দেখতে দেখতে সোফিয়া মাঝে মাঝেই উত্তেজনায় দেহ ঝাঁকাচ্ছে এবং মুখে খুব দৃঢ় কিন্তু আস্তে ওর উচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে, পাছে অন্য যাত্রী বিরক্ত হয়। আমি ওর এই উচ্ছ্বাসকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে জানালার দিকে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছি। আমার আগ্রহ ওকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ধারাভাষ্যকারে পরিণত করে।

ইউরোপ-আমেরিকার তরুণ প্রজন্ম কবিতার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায় না; কিন্তু সোফিয়া দেখালো। আমি যেহেতু ত্রিস্তান জারা আর জেমস জয়েসের কথাই বারবার বলছি, মেয়েটি হয়তো বুঝে থাকবে কবিতার প্রতি বা সাহিত্যের প্রতি আমার অতি আগ্রহ রয়েছে তাই সে আর্জেন্টিনার কবি হোর্হে লুই বর্হেসের ‘এলিজি’ কবিতার কথা আমাকে জানিয়ে দিল। সেই কবিতায় বর্হেস জুরিখের কথা বলেছেন। তিনি তার গন্তব্য খুঁজছেন সারাদুনিয়ায়, প্রথমেই এডিনবরা এবং জুরিখের নাম নিয়েছেন। সোফিয়ার কাছ থেকে বর্হেসের ‘এলিজি’ কবিতার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সেলফোনের মেমো অপশনে গিয়ে তা টুকে রাখলাম, ইন্টারনেট কানেকশন পেলেই কবিতাটি খুঁজব, যদি অনলাইনে পাওয়া যায় পড়ে ফেলা যাবে।

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সোফিয়া বারবার মুখ ঘুরিয়ে দেখছে আল্পসের রূপ। ১২০০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত আল্পস পর্বতমালা অতিক্রম করেছে ইউরোপের ৮টি দেশ। আফ্রিকা এবং ইউরেশিয়ার টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই পর্বতশৃঙ্গমালা তৈরি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। ঢেউয়ের মতো দুলতে দুলতে ছুটে চলা আল্পস পর্বত শৃঙ্গমালার শতাধিক চূড়া (ঢেউয়ের মাথা) তৈরি হয়েছে যেগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে। সর্বোচ্চ চূড়াটির নাম মন্ট ব্লাঁ, যেটির উচ্চতা ১৫ হাজার ৭৮১ ফুট। এই ধুসর শীতল পর্বতশৃঙ্গ কিন্তু বৃক্ষ এবং প্রাণীশূন্য নয়। বিশাল শিংওয়ালা বুনো-ছাগল জাতীয় প্রাণীদের এই শৃঙ্গমালায় চড়ে বেড়াতে দেখা যায়। ইংরেজিতে ওদেরকে বলে আলপাইন আইবেক্স। আলপাইন শৃঙ্গমালার কঠিন পাথর থেকে রস নিয়ে যে ফুল ফোটে তার নাম এইডেলভাইজ, এটি সূর্যমুখী পরিবারের একটি ফুল। রঙ শাদা, সারা গায়ে তুলোর মতো ফ্রস্ট, দেখলে মনে হবে ওর গায়ে তুষারের চাদর জড়ানো আছে। ছুঁয়ে দেখলে মখমলের মত অনুভূত হয়। শুভ্র এইডেলভাইজ ফোটে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই সময়কালের মধ্যে। যারা ষাটের দশকের সাড়া জাগানো সিনেমা রবার্ট ওয়াইজ পরিচালিত ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই সেই গানটির কথা মনে আছে, ‘এইডেলভাইজ এইডেলভাইজ/ এভরি মর্নিং ইউ গ্রিট মি/ স্মল অ্যান্ড হোয়াইট/ ক্লিন অ্যান্ড ব্রাইট/ ইউ লুক হ্যাপি টু মিট মি’। কী যে মিষ্টি গান আর কী যে অসাধারণ পারফর্মেন্স। অস্কার হ্যামারস্টেইনের লেখা ছোট্ট এই গানটি কোটি দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে এখনো শিহরণ জাগায়। আল্পস পর্বতশৃঙ্গমালা হচ্ছে সেই এইডেলভাইজ ফুলের জন্মভূমি। 

অস্ট্রিয়ার সলসবার্গের পাহাড়ে পাহাড়ে চিত্রিত ‘সাউন্ড অব মিউজিক’ সিনেমার অসাধারণ গানগুলো এখন খুব শুনতে ইচ্ছে করছে। ১৯৬৫ সালে নির্মিত একটি আমেরিকান ছবি ‘সাউন্ড অব মিউজিক’। যারা সিনেমাটি দেখেছেন তাদের পক্ষে এর পরিচ্ছন্ন নির্মাণ, জুলি এন্ডরুজ এবং ক্রিস্টোফার প্লামারের অনবদ্য অভিনয় ভোলা অসম্ভব। সাউন্ড অব মিউজিক প্রথমে ছিল একটি মিউজিকাল ব্রডওয়ে শো, যেটিকে আমরা গীতিনাট্য বলি, প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। লিখেছেন অস্কার হ্যামারস্টেইন এবং মিউজিক কম্পোজ করেছেন রিচার্ড রজার্স। আমি প্রথম সিনেমাটি দেখি ২০০০ সালে, কসোভোর রাজধানী পৃস্টিনাতে বসে। একবার দুবার নয়, বহুবার দেখি। আমার ধারণা যিনিই এই সিনেমাটি দেখেছেন একবার দেখে তৃপ্ত হতে পারেননি, অবশ্যই একাধিকবার দেখেছেন। গ্রীষ্মের পাহাড়ি কসোভো অনেকটা সলসবার্গের মতোই, আর যুদ্ধের অনুষঙ্গগুলো তো ছিলই। যখন পাহাড়ে পাহাড়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়াতাম, মনে হতো সলসবার্গের পাহাড়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, আমিই ক্যাপ্টেন ভন ট্রাপ, আর ওই তো মারিয়া ও সাতটি শিশু, সলসবার্গের পাহাড়ে ফোটা যেন আটটি শুভ্র এইডেলভাইজ ফুল।

সোফিয়ার কোলের কাছে মাথা নিয়ে মাঝে মাঝেই যখন আলপাইনের ঢেউয়ে চোখ রাখছি, মাথার ভেতর বেজে উঠছে, ‘এইডেলভাইজ এইডেলভাইজ/ এভরি মর্নিং ইউ গ্রিট মি’। 

হাওয়াই জাহাজ আল্পস পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত সমতলের আকাশে, সোফিয়া চোখ ফেরাল জানালা থেকে। 

মে আই আস্ক ইউ অ্যা কোয়েশ্চেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

আপনার বাড়ি কি ইন্ডিয়ায়?

না, বাংলাদেশে।

সোফিয়া কিছুটা আহত হলো। বাংলাদেশ শুনে নয়, নিজের অনুমান ঠিক না হবার কারণে। ও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এবার আমি প্রশ্ন করি।

তুমি? সুইস?

না।

এবার ও হাসে। হাসে এজন্য যে আমার অনুমানও ভুল হয়েছে। ভুলে ভুলে ‘আপসেট’ কাটাকাটি। সোফিয়া একটি রহস্যের হাসি দিয়ে বলে,

কমপ্লিকেটেড। মা রোমানিয়ান, বাবা হাঙ্গেরিয়ান। দাদা হাঙ্গেরিয়ান হলেও দাদি ছিলেন অস্ট্রিয়ান। নানা ছিলেন রোমানিয়ান, নানি স্লোভাকিয়ান।

সবই তো পাশাপাশি দেশ। আর এক সময় তো সবই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

আপনি ঠিক আমার দাদার মতো কথা বলেন, বাবাও মাঝে মাঝে একই কথা বলে। বলে, একটাই তো দেশ, মানুষ তার স্বার্থে ভাগ করেছে।

আমি বলি, এখন তো আবার এক হয়ে যাচ্ছে, ইউরোপ। এক সময় হয়ত পুরো ইউরোপই একটি দেশ হয়ে যাবে। আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে না, ওদিকে চায়নাও আছে প্রতিদ্বন্ধী, বেশ বড় দুটি দেশ, পুরো ইউরোপ এক না হলে তো তোমরা পারবে না ওদের সঙ্গে।

মেয়েটি তখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমিও কিছুটা চিন্তায় পড়ে যাই। কে না কে, বেশ পলিটিক্যাল মন্তব্য করে ফেললাম। বলা তো যায় না কত দেশের গোয়েন্দা কতভাবে ঘুরে বেড়ায়।

কি করেন আপনি? মানে পেশা কি?

সোফিয়া বুঝতে পারে এই প্রশ্নটি ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে যায় না। তাই কিছুটা অ্যাপোলজি ওর মুখের আভাসে, হয়ত ক্ষমা চাইতেই যাচ্ছিল, আমি থামিয়ে বলি,

ইটস ওকে। আমি লেখক। 

জাতিসংঘে কাজ করার বিষয়টি চেপেই গেলাম। তাছাড়া আমি মিথ্যে বলেছি, এই অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। মনে-প্রাণে আমি তো একজন লেখকই।

কি লেখেন, ফিকশন?

না, কবিতা, আর ভ্রমণ। সময় পেলেই ঘুরে বেড়াই। আচ্ছা বলো তো গুইয়াশ পাবো কোথায়? কসোভো-মেসিডোনিয়া ভ্রমণকালে গুইয়াশ খেয়েছি, গ্রিসেও খেয়েছি, তবে শুনেছি হাঙ্গেরিয়ান গুইয়াশই সেরা।

গুইয়াশ, আমাদের উচ্চারণে, ইংরেজরা এটাকে গুলাশ বানিয়েছে। সবখানেই পাবেন, তবে রেস্টুরেন্টগুলো ট্যুরিস্টদের রুচি অনুযায়ী গুইয়াশকে কাস্টমাইজ করে নেয়। যদি কোনো গ্রামে যেতে পারেন, তাহলে আসল গুইয়াশ পাবেন। রেস্টুরেন্টে নয়, কারো বাড়িতে। 

তোমার বাড়িতে যেতে পারি, কি বল?

আমার বাড়ি তো গ্রামে নয়, বুদায়, শহরে। ভেবে দেখতে হবে, আমার হাজব্যান্ড স্ত্রীর পরিচিত একজন লেখককে কীভাবে গ্রহণ করে।

তখনই চোখে পড়ে, ওর বাঁ হাতের অনামিকায় একটি খুব শাদামাটা আংটি।

জুরিখে কেন গিয়েছিলে, বেড়াতে?

না, আমি তো ওখানেই থাকি, কাজ করি।

আর স্বামী বুঝি বুদাপেস্টে, উইক এন্ডে স্বামীর কাছে যাচ্ছ?

সোফিয়া তখন ফিক করে হাসে।

সে তো এখানেই, এই প্লেনে, পেছনে বসেছে। একসঙ্গে আসন পাইনি। আমরা দু’জনই জুরিখে থাকি। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা হাঙ্গেরিতে থাকে ভেবেছেন? সব পশ্চিমে পাড়ি জমায়। আচ্ছা বাংলাদেশের জনপ্রিয় ডিশ কি?

অনেক কিছু। আমাদের একটি মাছ আছে, নাম ইলিশ। খুব সুস্বাদু। ইলিশের যে কোনো প্রিপারেশনই বাঙালির প্রিয় খাবার।

কোথায় পাবো এই মাছ, আমাকে শেখাবেন কীভাবে রান্না করতে হয়?

রান্না তোমার প্রিয় শখ বুঝি? 

আস্তে আস্তে প্রিয় হয়ে উঠছে। আমার স্বামী নানান দেশের নানান রকম খাবারের প্রিপারেশন খুব পছন্দ করে। আপনি শুনে অবাক হবেন, আমরা সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়াই শুধু বিচিত্র খাবারের স্বাদ গ্রহণের জন্য। তবে রান্না আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ নয়। আমার প্রিয় হচ্ছে হাইকিং, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরা।

আই সি। এবার বুঝেছি অমন তন্ময় হয়ে আল্পসের দিকে তাকিয়ে ছিলে কেন। নিজের ট্রেইলগুলো খুঁজছিলে?

অনেকটাই, আল্পসের পাহাড়ে পাহাড়ে আমার পায়ের চিহ্ন আছে। প্রচুর ট্র্যাকিং করেছি। এই উইক-এন্ড বুদাপেস্টে থাকবো, পরের উইক এন্ডেও ট্র্যাকিংয়ে যাচ্ছি, জেনেভায়।

তোমাদের ঝামেলা হয় না? তোমার প্রিয় হাইকিং, আর স্বামীর প্রিয় নানান দেশের রান্না?

না হয় না। কারণ ওর জন্য যেমন আমি দেশে দেশে ঘুরি, আমার জন্যও ও পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরে। 

একটি বড় সড় জলাশয়ের ওপরে তখন সুইস বিমান। চোখ বড় বড় করে সোফিয়া তাকিয়ে আছে নিচে। আমি বলি,

জলেও তোমার আগ্রহ কম নয় মনে হচ্ছে।

যখন পাহাড়ে পাহাড়ে হাইকিং করি, প্রায়শই আশে-পাশে স্বচ্ছ জলের লেক পাই, তখন অন্যরকম আনন্দে মন ভরে যায়। আসলে প্রকৃতির সবই আমার ভালো লাগে। এই মেঘ, আকাশ, পাহাড়, লেক, অরণ্য সব। 

ভাবছি, লেখক আমি না তুমি?

আমরা দু’জনই তখন হেসে উঠি। সোফিয়া আবার ধারাভাষ্য শুরু করে। 

এর নাম বালাতন, হাঙ্গেরির একমাত্র লেক। খুবই ছোট, তবু হাঙ্গেরিয়ানরা দল বেঁধে এই লেকের পাড়ে বছরে একবার যাবেই। 

এই উইক-এন্ডে বুদাপেস্টের কোনো পাহাড়ে যাবে নাকি, হাইকিংয়ে?

না, না, একদম না। বুদাপেস্ট তো দূরে, পুরো হাঙ্গেরিতেই কোনো পাহাড় নেই। আছে ছোট ছোট কিছু টিলা। ওগুলোতে আর কী হাইকিং করবো, হেঁটেই ওঠা যায়।

তোমাকে একটা বাংলাদেশি ডিশ শেখাই। আসলে বাংলাদেশি না বলে বলা উচিত আমার নিজস্ব ডিশ।

বলেন কি? আপনি শেফ?

না, না, আমি মোটেও শেফ না। তবে মাঝে মাঝে রান্না করতে ভালোবাসি। আমার কাছে রান্নাকে খুব ক্রিয়েটিভ কাজ মনে হয়।

এগজাক্টলি, আমার হাসবেন্ডও তাই বলে। আর আর্ট, রান্নায় ও আর্ট খোঁজে। পরিবেশন ভালো না হলে ও খেতেই বসে না। আপনার রেসিপিটা কোথায় পাবো? অনলাইনে আছে?

না, নেই। আমি তোমাকে বলছি। এর নাম মাস্তুরি। 

বাংলা নাম?

হ্যাঁ। ফিশ অ্যান্ড ভেজিটেবলের মিশেলে বানিয়েছি। ফিশ মানে মাছ আর ভেজিটেবল মানে তরকারি। দুইয়ে মিলে মাস্তুরি।

ভেরি ক্রিয়েটিভ। 

এটা মাছ এবং তরকারির প্রিপারেশন। বৈশিষ্ট হচ্ছে মাছ ও তরকারির রঙ ও স্বাদ যতটা অবিকৃত রাখা যায়। 

আর কোনো উপকরণ লাগবে না?

লাগবে। উপকরণগুলো বলছি। একটি দুই কিলো ওজনের মাছকে তিন টুকরো করবে। একটি আস্ত বাঁধাকপি চার টুকবো করবে। আস্ত বড় আকারের ৪/৫টা আলু। বড় গোল বেগুন ২/৩টা, আস্ত রাখবে। কিছু আস্ত ঢেঁড়স, হালাপিনো, ক্যাপসিকাম, আর কিছু খুব ঝাল এবং লাল রঙের মরিচ। এই হলো উপকরণ। 

কোনো স্পাইস?

ও হ্যাঁ। এই দেখো, মসলার কথাই ভুলে গেছি। আসল শেফ না হলে যা হয়। মসলার মধ্যে আধা কিলো পেয়াজকুচি, এক টেবল চামচ ধনিয়ার গুঁড়া, পরিমাণমতো লবণ, এক চা চামচ মরিচের গুঁড়া, এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া। 

সব একসঙ্গে মিশিয়ে দেব?

সোফিয়ার চোখে ব্যাপক আগ্রহ। 

বলছি। বড় একটি পাত্রে দেড় কাপ তেল ফুটিয়ে তাতে পেয়াজকুচি ৫/৬ মিনিট ভাজবে, তারপর লবণ, হলুদ, মরিচ এবং ধনিয়ার গুঁড়া ঢেলে দেবে। আরো ৫/৬ মিনিট মসলাটা তেল- পেঁয়াজে কষাবে। এরপর প্রথমে মাছ, পরে তরকারিগুলো ঢেলে দেবে। পরিমাণমতো পানি ঢালবে, এরপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেবে। অল্প আঁচে এক ঘণ্টা রান্না করবে। ব্যাস, হয়ে গেল মাস্তুরি।

এবার ও চুপ করে সেলফোনে কিছু একটা টাইপ করছে। প্লেনে নেটওয়ার্ক নেই। নিশ্চয়ই মাস্তুরির কথাই লিখে রাখছে। 

দু’মিনিট পর মুখ তুলে একটি তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে, 

লিখে রাখলাম। আশা করি এই মসলাগুলো জুরিখে পাবো।

হ্যাঁ পাবে, ইন্ডিয়ান গ্রোসারি শপে গেলেই পাবে।

জুরিখে ফিরে আমার কিচেনের প্রথম রান্না হবে এই বাংলা ডিশ।

তুমি বাংলা ডিশ বলো আমার আপত্তি নেই কিন্তু এর নামটা ভুলো না, মাস্তুরি। তোমার হাজব্যান্ডকে নামটা বলবে কিন্তু। আর কীভাবে এটা শিখলে তাও। 

নামটা অবশ্যই বলবো তবে কীভাবে শিখলাম তা বলবো কিনা ভেবে দেখতে হবে।

আমার ধারণা সেটাই নিরাপদ হবে, অন্য কিছু বলতে গেলে একটু বেশিই বিপদে পড়তে পারো। আর যাই হোক প্লেনে বসে বিপজ্জনক কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই এটা সে ভালোই বুঝবে। 

মেয়েটি আমার রসিকতা বুঝলো, আমরা দু’জনই হো হো হি হি করে হেসে উঠলাম। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //