মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভগুলো ঘুরে আসুন

জাতীয় স্মৃতিসৌধ : ১৯৭২ সালের কথা। কিছু দিন আগেই শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। ঠিক হলো একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। এ জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা চাই। ঠিক হলো সাভারেই হবে সৌধটি। ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে হলেও তা যেন বাংলাদেশের ঠিক হৃদয়ে। এখানে মানুষ স্মরণ করবে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের। ১৯৭২ সালের প্রথম বিজয় দিবস ছিল সে দিন। বিজয়ের এই দিনেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর। ১৯৭৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে স্মৃতিসৌধের নকশার প্রতিযোগিতা হলো। ৫৭টি নকশা থেকে বেছে নেওয়া হলো সৈয়দ মইনুল হোসেনেরটি। ১৯৮২ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। বিশ্বের বুকে স্পর্ধিত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেল সৌধটি- আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

বিজয়ের স্থাপনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় করতে স্থাপন করা হলো অগ্নিশিখা, ম্যুরাল। পরিকল্পনা নেওয়া হলো একটি গ্রন্থাগার স্থাপনের। ৮৪ একর আয়তনের এ সৌধ প্রাঙ্গণের সঙ্গে যুক্ত হলো একে পরিবেষ্টনকারী আরও ২৪ একর এলাকা। তাতে বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ একটি সবুজবলয় নির্মাণ করা হলো। সাত জোড়া ত্রিভুজাকার দেয়ালের মাধ্যমে ছোট থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সৌধটি। কংক্রিটের সাত জোড়া দেয়ালের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি সময়কাল।

সাতটি ত্রিভুজাকৃতি মিনারের শিখরদেশ মানেই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাতটি পর্যায়। প্রতিটি একই ভাব-ব্যঞ্জনায় প্রবাহিত। সাতটি পর্যায়ের প্রতিটি সূচিত হয় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। এরপর চুয়ান্ন, আটান্ন, বাষট্টি, ছিষট্টি ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যার চূড়ান্ত বিজয়। এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করে সৌধটি নির্মিত।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ : স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত সৌধটি বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত সৌধটির স্থপতি মোস্তফা হালি কুদ্দুস। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহায়তায় দেশের বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। তাঁদের মিরপুর এলাকায় ফেলে রাখেন হানাদার বাহিনী। সেসব বুদ্ধিজীবীর স্মরণে সেই স্থানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে।

স্বাধীনতা স্তম্ভ : রমনার রেসকোর্স, বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আমাদের স্বাধীনতার সঙ্গে এ নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পান। তাকে এখানেই সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার এই রেসকোর্সের মহাসমাবেশেই বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ৯ মাসের যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা এখানেই নতি স্বীকার করে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু আর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য দেন। সেই ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাবলি স্মরণীয় করে রাখতে এর আগে ১৯৯৯ সালে এখানে স্থাপন করা হয় শিখা চিরন্তনী। প্রায় ৬৭ একর জায়গাজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কেন্দ্রস্থল। এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। স্তম্ভের চারপাশে রয়েছে তিনটি জলাশয়। একপাশে শিখা চিরন্তন আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত দেয়ালচিত্র। এসব কিছুর মধ্যে মূল আকর্ষণ হিসেবে দণ্ডায়মান প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু গ্লাস টাওয়ার। রাতে এ টাওয়ারের আলোকরশ্মি দৃশ্যমান হয় বহুদূর থেকে। স্বাধীনতা স্তম্ভের ভেতরে রয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার নানা নিদর্শন সুরক্ষিত রয়েছে এখানে।

রায়েরবাজার বধ্যভূমি : ঢাকা শহরের পশ্চিমে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এই বাঁধের পাশেই শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের প্রখ্যাত সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এই স্থানে। হত্যার পর পরিত্যক্ত ইটভাটার পেছনের জলাশয়ে ফেলে রাখা হয় তাদের। সেসব স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ইটভাটার আদলে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। লাল ইট আর সিমেন্টের গাঁথুনির প্রাধান্যই বেশি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় খোলা আকাশের নিচে সৌধের একমাত্র দেয়ালটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, যেন নির্ভীক প্রহরী। সৌধটির স্থপতি ফরিদ উদ্দীন আহমেদ।

জল্লাদখানা বধ্যভূমি : মিরপুর ১০ থেকে ১১ নম্বরের দিকে কিছুটা গেলেই বেনারসি পল্লীর সড়ক। সড়কটি ধরে সোজা পূর্ব দিকের শেষ মাথায় জল্লাদখানা বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকাটি ছিল প্রায় জনমানবহীন। হানাদারের দোসররা তাই জায়গাটি বেছে নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার জন্য। সে সময় এখানে ছিল পরিত্যক্ত একটি পাম্প হাউস। ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এখানকার দুটি কূপের একটিতে ফেলা হতো খণ্ডিত মাথা, অন্যটিতে দেহাবশেষ। সে এক ভয়ংকর ও বীভৎস ব্যাপার। ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্থানটিতে খননকাজ শুরু হয়। ওই সময় পরিত্যক্ত পাম্প হাউসের কূপ থেকে উদ্ধার হয় ৭০টি মাথার খুলি আর পাঁচ হাজার ৩৯২টি হাড়। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয় মেয়েদের শাড়ি, ফ্রক, ওড়না, অলঙ্কার, জুতা, তসবিসহ শহীদদের ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র। জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি জাদুঘর নির্মাণ করে কিছু নিদর্শন রাখা হয়েছে প্রদর্শনের জন্য। পাম্প হাউসের অভিশপ্ত কূপটি বাঁধাই করে কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এটি এখন নৃশংসতার চিহ্ন। এখানেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘জীবন অবিনশ্বর’ নামের একটি  স্মৃতিফলক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দোসরদের বর্বর হত্যাযজ্ঞের স্মারকচিহ্ন এটি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //