রুক্ষ ভালোবাসার টানে!

সব রঙেরই আলাদা আলাদা অর্থ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়। লাল উচ্ছ্বাসের, সাদা শান্তির, সবুজ প্রশান্তির, নীল ভালোবাসার, ধূসর বেদনার, হলুদ তারুণ্যের, গোলাপি প্রেমের, কালো শোকের। কখনো কখনো সময়, অবস্থান, পরিস্থিতি ভেদে প্রতিটি রঙের অর্থ আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ পেতে পারে। তবে পরিবর্তন যাই হোক, সেটা একটিই। একটি রঙ, একটিই তার অর্থ। 

তবে একটি রঙের অর্থ আমার কাছে একটু ভিন্নভাবে ধরা দেয়, যে রঙটির কোনো একক বা মাত্র একটিই অর্থ আছে বলে আমার কখনো মনে হয় না। আমার মনে হয় এই রঙটির একইসঙ্গে অনেক অর্থ, অনেক আবেগ-অনুভূতি, ভালোলাগা-মন্দলাগা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্বপ্ন-বাস্তবতা, সত্য-মিথ্যা, চাওয়া-পাওয়া আর সবগুলো রঙের আলাদা-আলাদা অর্থ মিলে একটি যে রঙটি আছে সেটি পার্পল বা বেগুনি! 

২০১৪ সালের একদম প্রথমে গিয়েছিলাম স্বপ্নের এক অলসপুরী মানালিতে। প্রথম দু-দিন ইচ্ছামতো বরফে দাপাদাপি করে কাটালাম। পরদিন রোথাংপাস যাবো মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু জানা গেল খুব বেশি তুষারপাত হওয়ার কারণে রোথাংপাস যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। ওদিকে যেতে হলে আরও দুই একদিন মানালিতে থাকতে হবে; কিন্তু আমাদের সেই সময় ছিল না বলে বাধ্য হয়েই দিল্লির পথ ধরেছিলাম সেবার। সেবারই প্রথম এই স্বপ্নটা দেখেছিলাম যে এর পর যদি সুযোগ পাই, তবে শুধু রোথাং নয়, একেবারে লাদাখ যেতে চাই ওই পথ দিয়ে! 

কিন্তু সেই স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। একইসঙ্গে ২৫-৩০ হাজার টাকার জোগাড় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কখনো ধার করে টাকার জোগাড় করার মতো অবস্থা হলেও টানা ১৫ দিনের বেশি সময় বের করার মতো দুঃসাহস করে উঠতে পারি না। আবার কখনো টাকা-সময় দুটোর ব্যবস্থা করে ফেলার পরেও নানারকম বাধায় আটকে যেতে হয়েছে বার বার। কখনো অফিস, কখনো পরিবার, কখনো নানারকম সামাজিকতার বন্ধনে। হয়েই উঠছে না সেই লেহ-লাদাখের স্বপ্নের নদীতে, কল্পনার রঙিন জাল ফেলা। 

মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, সুযোগ পেলেই কলকাতা থেকে কালকা মেইলে যাবো কালকা পর্যন্ত। সেখান থেকে ট্রয় ট্রেনে চড়ে সিমলা। সিমলায় গিয়েও সিমলা দেখতে না পারার ক্ষতে প্রথমে প্রলেপ লাগাব। তারপর সিমলা থেকে লোকাল বাসে করে মানালি যাব। একদিন মানালি থাকব আর পরের দিনের লোকাল বাস বা শেয়ার জিপের টিকিট কাটবো কয়েক বছরের স্বপ্ন বোনা লেহ-লাদাখ যাবার জন্য। 

পরদিন বাস বা জিপের সিটের সামনে বসে দেখবো পাথুরে পাহাড়, বিয়াসের বয়ে চলা উন্মত্ততা, ঝুঁকিপূর্ণ ঝুরো পাথরের রাস্তা, ওপরে সাদা সাদা মিহি মেঘেদের উড়ে বেড়ানো, কখনো কখনো ছুঁয়ে যাবে আমাকে, আরও ওপরে ঝকঝকে নীল আকাশ পাগলের মতো ডাকবে হাতছানি নিয়ে, করে দেবে উন্মাদ। কাছে দূরে পাহাড়ের রঙ-বেরঙের খেলা, কোথাও একটু সবুজ, কোথাও কালো, কোথাও সোনালি রঙের কোনো পাহাড়, পাহাড়ের শত রঙের রঙ বদলের খেলা। 

একটু পরে শুরু হবে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এক মিহি পিচঢালা পথ। তখন জিপে বা বাসের সিটের সাধ্য থাকবে না আমাকে ভিতরে বসিয়ে রাখার। উঠে যাবো জিপ বা বাসের ছাদে। উপভোগ করতে লেহ-লাদাখের বহু বছরের লালিত স্বপ্নের সবটুকু, তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিজের মতো করে শুষে নিতে। যেন ফিরে এসে যখন পরের বইয়ের জন্য লেখা শুরু করবো তখন যেন লিখতে লিখতেই আবার হারিয়ে যেতে পারি স্বপ্ন-কল্পনা বাস্তবে ধরা দেয়া সেই লেহ-লাদাখের দিনগুলোতে। 

বিশ্বাস ছিল, ঠিকঠাক স্বপ্নটাকে দেখতে পারলে, স্বপ্নের পিছনে অবিরত ছুটতে পারলে, হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকলে, হাজারো বাঁধা উপেক্ষা করে নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারলে, সফলতা আসবেই, হ্যাঁ আসবেই। আজ, কাল বা পরশু, অল্প, অনেক বা পুরোটুকুই! হাতের মুঠোয় চলে আসবে আমার মতো সবার। চার বছর অপেক্ষার পরে এলো কাঙ্ক্ষিত সেই সুযোগ। একইসঙ্গে অফিস থেকে পেয়ে গেলাম ১৬ দিনের ঈদের ছুটি, সঙ্গে ছিল সেই ঈদের বোনাস আর দুই তিনজন সঙ্গী! ব্যস ঝটপট করে ফেললাম কলকাতা থেকে কালকা আর জম্মু থেকে কলকাতা ফেরার ট্রেন টিকিট! তারপর দীর্ঘ চার মাসের অপেক্ষা ঈদের ছুটি আর লাদাখের পথে যাত্রা শুরুর। নির্ধারিত দিন ঘনিয়ে এলে দুরুদুরু বুকে ব্যাকপ্যাক নিয়ে চিত্রা একপ্রেস ট্রেনে চড়ে বসেছিলাম পুরো ১০ জনের দল নিয়ে! ঢাকা থেকে বেনাপোল হয়ে কলকাতা যেতে। 

কালকা মেইলের দিন-রাত্রি।

কালকা মেইলে কলকাতা থেকে কালকা যাবো, হেলে-দুলে, থেমে-থেমে, রসিয়ে-রসিয়ে, নন এসিতে, গরমে ঘেমে, স্টেশনে থেমে-থেমে, রেল লাইনে বসে থেকে, হেঁটে হেঁটে, আইসক্রিম খেয়ে, গাছের তলায় শুয়ে-বসে থেকে, একেবারে সাধ মিটিয়ে, মনের মতো করে। এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল! সব সময়ই যে রাজধানী এক্সপ্রেসে করে রাজসিকভাবে যেতে হবে এটা আমি মানতে পারি না। তাই কলকাতা থেকে কালকা যাবার এই পাগুলে স্বপ্ন দেখেছিলাম এই রুক্ষ ভালোবাসার স্বপ্নের শুরু থেকেই। 

এবং সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার, ঠিক ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, ঠিক ঠিক তেমন- তেমন ভাবেই কলকাতা থেকে কালকা মেইলে করে কালকা পৌঁছে ছিলাম প্রায় ৩৮ ঘণ্টার জার্নি শেষ করে। আজকে কালকা মেইলের সেই দিন-রাত্রির গল্পটাই বলব। 

শুরুর দিকে পড়ে অনেকে ভাবতে পারেন, কি রে বাবা কেউ কি নিজ থেকে অমন করে ট্রেনে লেট, থেমে থাকা, দেরি করে যাওয়া উপভোগ করতে চাইতে পারে নাকি? 

আমি বলি কি, হ্যাঁ পারে। যদি ট্রেন ভ্রমণের প্যাশন থাকে, যদি ভ্রমণটা হয় একটা বিলাসিতা, সে যেমনই হোক, যদি সব কিছুতেই থাকে উপভোগের মানসিকতা তবে, সামান্য ট্রেন লেট কোনো ব্যাপারই নয়। আমার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটিই হয়েছিল। 

কলকাতা থেকে কালকা মেইল কালকার উদ্দেশ্যে ছেড়েছিল ঠিক ৭:৪০ মিনিটে। একদম সঠিক সময়ে; কিন্তু সকাল হতে হতেই প্রায় চার ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে নানা জায়গায় থেমে থেমে। সারারাত দারুণ ঘুমে থাকার কারণে রাতে ট্রেনের থেমে থাকা আর উপভোগ করা হয়নি কিছুতেই। সেই আক্ষেপ ঘোচাতেই অবিরত থেমে থাকা ট্রেনে সবটুকু উপভোগ করতে লাগলাম তাড়িয়ে তাড়িয়ে। 

গেঞ্জি গায়ে, গলায় গামছা পেঁচিয়ে, হাতে ব্রাশ আর ব্রাশে টুথ পেস্ট লাগিয়ে হেঁটে চললাম, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে এ মাথা থেকে ও মাথা। ব্রাশ করতে করতে প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় গিয়ে দেখা পেলাম একটি টলটলে জলে ভরা পুকুরের। সেখানে মুখ ধুতে ধুতে মনে পড়লো আরেহ এখানেই তো একটু গোসল করে নেওয়া যায়, সারা রাতের গরমের ক্লান্তি দূর করতে। মনে পড়তে দেরি হলেও, গোসল করতে আর দেরি করলাম না কিছুতেই। দারুণ একটা গোসল সেরে ফেললাম সকাল সকাল। ফ্রেশ হয়ে, সিটে ফিরে এসে বসলাম সকালের চা নিয়ে। সঙ্গে পাউরুটি আর বিস্কিট। ব্যস হয়ে গেল সকালের নাস্তা। 

একটু পরে ট্রেন ছাড়লো; কিন্তু খুব বেশি দূর না গিয়ে আরও একটি স্টেশনে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লাম আমি আর একজনকে সঙ্গে নিয়ে। পুরো প্ল্যাটফর্ম হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে, নতুন একটা জায়গা দেখে, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে বসলাম একটি গাছের ছায়ায়। সেখানে একটু পরে চলে এলো গ্রামীণ আইসক্রিম! আহা এটাই তো চাইছিলাম মনে মনে। একটি দুটি করে ৩০ মিনিটে তিনটি আইসক্রিম খেয়ে নিলাম, টপাটপ। 

আবার ট্রেন ছাড়লে, চড়ে বসলাম। থামল বেশ বড়সর একটা স্টেশনে। সেখান থেকে কেনা হলো, দারুণ মিষ্টি আপেল, কলা, জুস আর চিপস। সঙ্গে ছবি তোলা আর নতুন নতুন স্টেশন ঘুরে দেখা তো আছেই। এরই মাঝে খবর পাওয়া গেল, কোন কে উঠতি বাবার কেরামতির জন্য ভারতের নানা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর। সেটা ছিল একটা বাড়তি রোমাঞ্চ। ট্রেন দিল্লি যাবে কি যাবে না সেই নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। এক সময় দুপুরের দিকে খবর পাওয়া গেল যে এই ট্রেন কেন, কোনো ট্রেনই দিল্লি পর্যন্ত যাচ্ছে না। 

তখন সবাই মিলে নতুন করে প্ল্যান করতে বসলাম। যদি ট্রেন দিল্লী পর্যন্ত না যায়, তবে আমরা উত্তরাখ- যাবো বলে ঠিক করে রাখলাম। যে পর্যন্ত ট্রেন যাবে সেখান থেকে প্ল্যান বি শুরু হবে। তাতে করে সময়, দিন, খরচ আর এনার্জি সবই বেঁচে যাবে। সেই ভাবেই প্ল্যান করেই বসে থাকলাম ট্রেনে। ট্রেন কখনো চলে, কখনো থেমে থাকে, কখনো নতুন নতুন উড়ো খবর আসে। সেসব গায়ে না মেখে আমরা সবাই মিলেই দারুণ উপভোগ করছিলাম কালকা মেইলের দিন-রাত্রি। 

সন্ধ্যা নাগাদ ট্রেন বেশ ভালোভাবেই চলতে শুরু করলো। তখন নতুন খবর এলো যে ট্রেন দিল্লির আগের স্টেশন পর্যন্ত যাবে এরপর আর নয়। সেখান থেকে দিল্লি যেতে হবে বাসে, মেট্রোতে বা ট্যাক্সিতে। ট্রেন চলছিল কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত। এভাবে চলতে চলতে এক সময় ট্রেন দিল্লি পৌঁছে গেল রাত চারটায়, সকল অনিশ্চয়তা কাটিয়েই। দিল্লীতে কালকা মেইলের স্টপেজ এক ঘণ্টা। দ্রুত দিল্লি নেমে স্টেশন মাস্টারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ট্রেন একটু পরেই ছাড়বে এবং কালকা যাবে! জাস্ট ওয়াও। 

আবারও উঠে পড়লাম ট্রেনে এবং ট্রেন মাত্র ২৫ মিনিট পরেই ছেড়ে দিল চণ্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে। সবাই মিলে আর একটা ঘুম দিলাম আরাম করে। সকাল ৭টা নাগাদ চলে এলাম চণ্ডীগড়ে। সবাই দারুণ খুশি, কারন আর মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা চললেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কালকা পৌঁছে যাবো। চণ্ডীগড় থেকে আমাদের ট্রেনে দুই ভাগ হয়ে সামনের অংশ অন্য কোন দিকে চলে গেল। আর আমাদের পিছনের অংশে নতুন ইঞ্জিন লেগে চলতে শুরু করলো কালকার দিকে। উল্লেখ্য কালকা, চণ্ডীগড়েরই একটি শহর। 

ঠিক ৯ টায় আমাদের ট্রেনে এসে পৌঁছালো অনেক অপেক্ষার কালকা স্টেশনে। আর সেই আনন্দে তিন দিনের অম্ল-মধুর ট্রেন জার্নির ক্লান্তি নিমিষেই উধাও। ঝটপট খোঁজ নিয়ে টয় ট্রেনের টিকিট কেটে উঠে পড়লাম স্বপ্নের মতো সেই টয় ট্রেনে, কালকা থেকে সিমলার ৭ ঘণ্টার পাহাড়ি পথে...... 

স্বপ্নের টয় ট্রেনে...

সে বহু দিনের স্বপ্ন ছিল টয় ট্রেনে চেপে, ধীর লয়ে, হেলে-দুলে, গড়িয়ে-গড়িয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে অনন্ত সময় ধরে পাহাড়ে-পাহাড়ে জড়িয়ে থাকা রঙিন প্রজাপতির মতো ঘরবাড়ির বর্ণিলতা, ঝকঝকে নীল আকাশ দেখতে-দেখতে কালকা থেকে সিমলা যাবো। 

শুনতে অবিশ্বাস মনে হলেও আসলেই এটাই সত্যি, কালকা থেকে সিমলা যেতে টয় ট্রেনে খরচ করেছিলাম মাত্র ২৫ রুপি জনপ্রতি! ৯০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে সিমলা যেতে সময় লাগে ৬/৭ ঘণ্টা। মনে হতে পারে অনেক সময়, বিরক্তিকর কোন জার্নি হবে হয়তো; কিন্তু না মোটেই তেমন নয়, অনুভূতি হবে এক অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতার। যদি ভালোবাসেন পাহাড়, প্রকৃতি, সবুজ অরণ্য, নীল আকাশ, বর্ণিল চারপাশ। 

কালকা থেকে সিমলা যেতে বেশ কয়েকটি টয় ট্রেন আছে ভোর থেকে। সময়, আরাম, আপ্যায়ন আর শ্রেণিভেদে নির্ভর করে সেগুলোর ভাড়া। কোনোটা আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভাড়া পড়বে ৫৮০ রুপি খাবার সহ। আছে ৫০ বা ২৫ রুপি ভাড়ার হিমালয়ান কুইনসহ আরও দুই তিনটি টয় ট্রেনে। যা প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কালকা থেকে ছেড়ে যায় সিমলার উদ্দেশ্যে। 

এরমধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী হলো জন প্রতি ২৫ রুপির টয় ট্রেনটি। কালকা মেইল থেকে নেমেই আপনি পাশের স্টেশনের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কালকা মেইলের টিকিট কেটে নিতে পারেন ২৫ রুপি দিয়ে। এই ট্রেনের কোনো সিট নাম্বার থাকে না। যে যত আগে টিকিট কেটে, ট্রেনে উঠে নিজের পছন্দমতো সিট নিতে পারবেন সেটাই সেই মুহূর্ত থেকে সিমলা পৌঁছানো পর্যন্ত তার সিট। 

সবচেয়ে ভালো হয় ট্রেনের ডান পাশের সিট যদি পেয়ে যান। তবে সেক্ষেত্রে একটু রোদের উত্তাপ সহ্য করতে হতে পারে কিছুটা। তবে ট্রেন চলতে শুরু করলে, নরম শীতের মিহি বাতাসের স্পর্শ আপনার রোদের আকুলতা বাড়াবে বৈ কমাতে পারবে না। অবশ্য মনের মতো সিট না পেলেও খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। কারন পাহাড়, সবুজ অরণ্য, নির্মল প্রকৃতি, বর্ণিল ঘরবাড়ি, পাবেন চলতি পথের ডান আর বাম দুই পাশেই। 

কালকা থেকে সিমলা যেতে ৯০ কিলোমিটার পথের ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময়ের মাঝে ট্রেন আপনাকে থামাবে, নামাবে, ঘুরে দেখাবে, ছবি তোলার সুযোগ দেবে অনেক অনেক নান্দনিক ছোট ছোট পাহাড়ি স্টেশনে। অপূর্ব এক একটা পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা এক একটা স্টেশন! কোনোটা লাল, কোনোটা নীল আবার কোনোটা হলুদ রঙে সেজে হেসে স্বাগতম জানাবে আপনাকে। আপনি নামবেন, হাঁটবেন, একটু গা এলিয়ে দেবেন রঙিন বেঞ্চিতে, বাতাসে গা ভাসাবেন সেসব বৈচিত্রে ভরপুর এক একটা স্টেশনে। 

কখনো দেখবেন আপনাদের টয় ট্রেন অন্য আর একটা টয় ট্রেনকে সিগনাল দিয়ে যেতে সাহায্য করবে কোনো পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে! কি যে অদ্ভুত আর ঘোর লাগা, মায়াময় সেই দৃশ্য যা আপনি হাজার টাকার বিনিময়েও কখনো কোথাও পাবেন না। যা পাবেন ৬ ঘণ্টার কালকা থেকে সিমলা যেতে। 

মাঝে কোনো এক ঝকঝকে স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে আপনাকে চা বা কফি উপভোগের সুযোগ করে দিতে। কখনো ট্রেন দাঁড়াবে অন্য কোনো এক পাহাড়ের কাঁধে আপনাকে হালকা কোনো নাস্তা, ভাজিভুজি বা মুখরোচক কোনো খাবারের সুযোগ করে দিয়ে। কোথাও দাঁড়াবে আপনাকে একটু ঝর্ণার শীতল পানির সুখের পরশ বুলিয়ে দিতে। বোতলে পানি ভরে নিয়ে বাকি সময়ের তৃষ্ণা মেটাতে। 

কখনো দাঁড়িয়ে থাকবে ওর আলসেমিতে, হয়তো তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছেনা তাই! দাঁড়িয়ে গেছে আনমনে! তবে সেটা নিশ্চিত ভাবেই কোনো না কোনো পাহাড়ের সারির মাঝে। যেখান থেকে আপনি উপভোগ করতে পারবেন পাহাড়ের পর পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা, পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেপটে থাকা সাদা মেঘের ভেলা, কোথাও ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা নীল-সবুজ পাহাড়ের চূড়া, দূরে কোথাও হয়তো ঝরে পড়া দেখতে পাবেন এক পশলা বৃষ্টির আর অন্য কোনো পাহাড়ে ঝলমলে রোদের রঙিন খেলা! 

একই সঙ্গে পাহাড়ের এতো এতো বৈচিত্র্য আর বর্ণিলতা পেতে, গায়ের আর পায়ের পরিশ্রম না করেই ভেসে-ভেসে, সিমলা যেতে-যেতে, এমন ভাবে পাহাড়, প্রকৃতি, অরন্য উপভোগ একমাত্র টয় ট্রেনেই সম্ভব। এভাবে পাহাড়ে মেঘেদের মতো করে ভেসে ভেসে পৌঁছে গিয়েছিলাম সুখের শহর সিমলায়। 

সুখের শহর সিমলা...

সেই ২০১৩ থেকে সিমলা আমার কাছে এক আক্ষেপের নাম! আমার সুখ-দুঃখের ভ্রমণের কাছে অনেক বড় আর দগদগে একটা ক্ষতের নাম সিমলা। যে ক্ষতে কোনভাবেই কোনো প্রলেপ লাগাতে পারছিলাম না আরও একবার সিমলা না যাওয়া পর্যন্ত। কারন প্রথম ২০১৩ এর শেষে যখন সিমলা গিয়েছিলাম সেটা ছিল এক গভীর শীতের রাত। আর পরদিন সকালে উঠে যখন সিমলা ঘুরে দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই টিম লিডারই বলে বসলেন চল সোজা মানালি যাই? 

এরপর কয়েক বছর কেটে গেলেও, নানা জায়গায় যাওয়া হলেও, সিমলায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তাই সেই ভ্রমণ ক্ষতে প্রলেপও লাগেনি। এজন্য এবার যখন কলকাতা থেকে কালকা হয়ে সিমলা থেকে মানালি যাবার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন সিমলায় একদিন আর এক রাতের জন্য থাকার ব্যবস্থা রেখেই প্ল্যান করেছি। ক্ষতে এবার প্রলেপ লাগাতেই হবে যে। 

তবুও নানা জায়গায়, নানা কারণে ট্রেন লেট আর টয় ট্রেনের ৭ ঘণ্টা মিলিয়ে সিমলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল ৩টা। তড়িঘড়ি রুম নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে চললাম সিমলা দেখতে। বিশেষত সিমলার মল রোড ধরে হেঁটে হেঁটে যতটুকু পারা যায় পুরনো ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে। বেশ একটু সাজুগুজু করে বের হলাম, হেলে-দুলে আর প্রাণ খুলে সিমলার মল রোড ধরে হেঁটে বেড়াতে। 

হোটেল থেকে বেরিয়ে নিচ থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই অনেক দিনের পুরনো ক্ষততে প্রলেপ লাগতে শুরু করলো। সাজানো, গোছানো, ঝকঝকে, তকতকে আর ঝলমলে সিমলা দেখতে দেখতে। ইস কি যে সুন্দর করে সাজানো মল রোডের শুরু থেকে সবকিছু। যেভাবে ব্রিটিশরা তৈরি করে রেখে গিয়েছিল, ঠিক যেন সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে! অনেকটা যেন কোনো বনেদী ব্রিটিশ কোনো বাড়ির ড্রইং রুম! একটা শহরের বিশেষ একটা টুরিস্ট স্পটকে যে এভাবে বাসার আদুরে আর আহ্লাদি ড্রইং রুমের মতো সাজানো যায়, সেটা সিমলার মল রোড না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এতটাই পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। 

স্কুল, কলেজ, গির্জা, দোকান-পাট, হোটেল-মোটেল, এমনকি ফুটপাথের দোকান পর্যন্ত সাজানো, গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যেভাবে ইংরেজরা তৈরি করে গিয়েছিল, ঠিক সেই আদলে! কোথাও এতটুকু ময়লা আবর্জনা নেই। হাঁটছি আর তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছি, সিমলার প্রতিটি মুহূর্ত। পাহাড়ে পাহাড়ে রঙিন প্রজাপতির মতো বর্ণীল সব ঘরবাড়ি লেপটে আছে সবুজ পাহাড় গুলোর শরীরে। কোথাও কোথাও মেঘেদের দল লুকোচুরি করছে পাহাড় আর ঘরবাড়ি গুলোর সঙ্গে। কোথাও কালো মেঘ জমেছে কয়েক টুকরো বৃষ্টি ঝরবে বলে, আবার দূরে কোথাও ঝলমলে রোদ কোনো এক পাহাড়কে করে আলোকিত। 

কত রকমের খাবারের সমারোহ যে আছে রাস্তার দু’পাশের মনকাড়া দোকানগুলোতে, চোখ ফেরান দায় সেদিক থেকে আর জিভের জল, সেও শুকোবার সময় পায় না এতটুকু। একটার পড় একটা মজাদার খাবার দেখে কত সময়ই বা চুপ করে থাকা যায়, পকেটে হাত চাপা দিয়ে। বাঁধ যখন ভাঙল তখন আর তাকে বাঁধা দিয়ে কি হবে? তাই তো প্রথমে পিৎজা, তারপর পেষ্ট্রি এরপর আইসক্রিম খেয়েও সাধ না মেটায়, শেষ মেস আপেল আর স্ত্রবেরির জুস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ততক্ষণে সূর্য পাহাড়ের কোলে হেলে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। আর চারপাশে যেন বিয়ের সাঁজে সেজে উঠে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ আলোর রোশনাই। দিনের আলো শেষ হয়ে সন্ধ্যার শুরুতেই সিমলা যেন তার রূপ পরিবর্তন করে ফেলল মুহূর্তেই! দোকান গুলো যেন ওদের আলো দিয়েই আপনাকে ডেকে নেবে ভিতরে। কি নেই, কোন ব্র্যান্ডের দোকান নেই সেখানে, একটি দুটি নাম বলে বোঝানো যাবেনা। সব রকম প্রসাধনী থেকে শুরু করে, খাবার এমনকি পানীয়র সব ব্র্যান্ড সেখানে সবসময় প্রস্তুত আপনার জন্য। 

একটু এগিয়ে কয়েকটা দোকানে ঢুঁ মারতেই জিভের জল টপটপ করে পড়তে শুরু করলো আমার! পাশের দোকানে গরম গরম গোলাপ জামুন ফুটতে দেখে স্বচ্ছ ওভেনে আর তার পরিবেশন দেখে। কোনো কথা নাই, ঝটপট খেয়ে নিলাম দুইটা গরম গোলাপ জামুন! একটু কেটে মুখে দিতেই নিজের অজান্তেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল নিমিষেই! তার যে কি স্বাদ? ওহ সেই স্বাদে সব ভুলে গেলাম আশপাশের। যতক্ষণ মুখে গোলাপ জামুন ছিল, চারপাশ তখন নীরব, নিস্তব্ধ আমার কাছে! খাওয়া শেষে আর নড়ার সাধ্য ছিল না! 

তবুও ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে বসলাম মেঘে-কুয়াশায় মাখামাখি এক যায়গায়। নিয়ন আলোর মাঝে, ঝকঝকে পাথরের বেদীতে। ঠান্ডা হিম শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আপনাকে ক্ষণে ক্ষণে। কি যে এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হবে মন, বলে বা লিখে বোঝানো মুশকিল। এটা শুধু নিজেকে অনুভব করতে হয়, নিজের মতো করে। 

সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে, হালকা হয়ে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম আরও দুই স্তর ওপরের মল রোডের মূল আকর্ষণ আর একদম চূড়ায় সেখানে গির্জা আছে আর যেখানে তুমুল জনপ্রিয় থ্রি ইডিয়টস মুভির শুটিং হয়েছিল। সেখানের রাস্তার বিস্তার এতটাই যে কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট, কেউ ভলিবল, কেউ স্কেটিং করছে অনায়াসে। শত শত নারী-পুরুষ আর শিশুরা আয়েশ করে সময় কাটাচ্ছে নিজেদের মতো করে। দারুণ ঝলমলে রঙে সেজে আছে চারদিক। যার চারপাশে যেদিকেই তাকাইনা কেন শুধু সুখ আর সুখ! সিমলা যেন এক সুখের শহর। 

অলস শহর মানালিতে

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল সবার। আগের রাতে মন ভরে সিমলার মল রোড দেখার আর রাতে চমৎকার ডিনার শেষে, শীতের ভিতরে উষ্ণ কম্বলের নিচে। তিনজন মিলে গেলাম সিমলা থেকে মানালি যাবার গাড়ি ঠিক করতে। গাড়ি ঠিক করার পাশাপাশি একটু সিমলার বাজার, বাসস্ট্যান্ড, লোকালয়ও দেখা হয়ে গেল, হেঁটে হেঁটে। বেশ কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেল ৫৫০০ এর নিচে কোনো ভাবেই গাড়ি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অবশেষে নিয়ে নিলাম ৫৫০০ দিয়েই। গাড়ি আসতে আসতে সবাই প্রস্তুত হয়ে গেছে, সিমলা থেকে মানালি যাবার জন্য। 

গাড়িতে ৯ জনের কিছুটা কষ্ট হলেও, মনে ভীষণ আনন্দ থাকার কারনে সেটা একটু কষ্টকে কেউই তেমন পাত্তা দিলাম না। চারপাশের যতটা পাহাড় আর নানা রকম রূপ দেখতে দেখতে, মুগ্ধ আর মসৃণ রাস্তা দিয়ে যাবো ভেবেছিলাম ততটা আর পেলাম না, যেটা পেয়েছিলাম প্রথমবার সিমলা থেকে মানালি যাবার সময়। রাস্তা বেশ ভাঙা-চোরা, জ্যামও ছিল বেশ সিমলা থেকে বের হবার সময়, আর ছিল খুবই অনাকাক্ষিত ধুলোবালি, বেশ কিছুটা পথে। কারন সেবার যে পাহাড়ি হাইওয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম এবার সেই পথে না গিয়ে অন্যপথে গিয়েছিল গ্রাম ও শহরের মাঝখান দিয়ে। কিন্তু ঘণ্টা খানেক যাবার পরেই, দারুণ রাস্তা, চারপাশের অপরূপ পাহাড় আর অরণ্যের প্রকৃতি দেখে সবাই মুগ্ধ হতে শুরু করলো। 

মাঝে বেশ কয়েকবার নিজেদের ইচ্ছেমতো বিরতি দিয়ে শেষ বিকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম কুল্লু। তবে সেখানে রাস্তা ভীষণ খারাপ থাকায় কুল্লুতে আর থামা হলোনা। সোজা চলে এসেছিলাম প্রায় মানালি। কুল্লু থেকেই সবার নজরে প্রথমবার পড়তে লাগলো আপেলের গাছ, বাগান আর লাল-সবুজ-গোলাপি আপেলের থোকা। এক একটি বাগান ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলে আর সবাই মিলে চিৎকার করে উঠি, আপেল বাগান, আপেল বাগান বলে! এক সময়তো ড্রাইভারের ওপরে সবাই বেশ বিরক্তই হয়ে পড়লো কোনো আপেল বাগানে থামছে না দেখে!

অবশেষে ড্রাইভার থামলো, বিশাল এক আপেল বাগান ঘেঁসে তেলের পাম্পের কাছে। সেখানে বেশ অনেক সময় নিয়ে আপেল দেখা, ছবি তোলা, গাছের তলায় ঝরে পরে থাকা আপেল কুড়িয়ে খেয়ে উপভোগ করেছিলাম সেই অপূর্ব গোধূলিটা। এক একজন যায় আর কয়েকটি করে আপেল কুড়িয়ে নিয়ে আসে নিজের ইচ্ছেমতো; কিন্তু কটা আপেলই বা খাওয়া যায়? একটির বেশি আপেল কেউই একবারে খেতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না। দুই একজনকে তো দেখলাম বড় একটি আপেলে বিশাল একটি বা দুটি কামড় বসিয়ে দিব্বি ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের পাহাড়ের খাঁদে! যেন ঢেল ছুঁড়ছে আপেল দিয়েই! আহারে সেটা দেখে বেচারা দুর্লভ আপেলের জন্য একটু মন খারাপই হলো। 

আপেল কুড়িয়ে, খেয়ে, ছুঁড়ে ফেলে, ছবি তুলে তৃপ্ত হয়ে আবারও চড়ে বসলাম আমাদের গাড়িতে। প্রায় ২০-৩০ মিনিট পরে পৌঁছে গেলাম আমার ভীষণ প্রিয় এক অলস শহর মানালিতে। এখন নিজেদের পছন্দমতো হোটেল খুঁজে নেবার পালা। তবে সবার একটাই আবদার, ভাই হোটেলটায় যেন ওয়াইফাই থাকে! কয়েকদিন হলো ঠিকঠাক মতো কোনো আপডেট নেই। তেমন কোনো যোগাযোগও নেই, তাই ইন্টারনেট সংযোগকে বাধ্যতামূলক করা হলো, হোটেলের রুম খুঁজে নেবার ক্ষেত্রে! বেশ কম খরচে চমৎকার একটা হোটেল পেয়েছিলাম মানালিতে থাকার জন্য। 

মানালি টু লেহ (স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু)

ভোর পাঁচটায় সবাই ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে আগের দিন ১৭০০০ রুপি দিয়ে ঠিক করে রাখা টাটা সুমোর ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে চলে আসতে বললাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ড্রাইভার আসবে জেনে সবাই রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম টগবগ করতে করতে। মল রোডের কর্নারে গিয়ে দাঁড়াতেই চলে এলো আমাদের আগামী দুই দিনের পথ চলার সাথী টাটা সুমো। প্রাথমিক কথা হয়ে আছে আজ আমরা কেলং বা জিসপাতে গিয়ে রাতে সেখানে থাকবো। 

মানালি জুড়ে তখন পর্যন্ত গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরে চলেছে। তার মধ্যেই সবার ব্যাকপ্যাক তোলা হলো গাড়ির ছাদে। সবাই মিলে উঠে পড়লাম গাড়িতে। বসলাম বেশ জাঁকিয়ে। আমাদের সামনে অনেক দিনের লালন করা স্বপ্নের সেই পথ। মানালি থেকে লেহ যাবার দুর্র্ধষ সব পাহাড় আর পাহাড়ের রোমাঞ্চকর সব বাঁক। 

তখনো সকালের আলো ফোটেনি। সূর্য যে উঠবে না সহসা সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল গুমোট, মেঘলা আকাশের সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি দেখেই। কয়েক মিনিট পথ চলার পরেই, বিয়াসের বুকের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা লোহার সেতু পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম, যেদিক দিয়ে সোলাং ভ্যালি যাওয়া হয়। এর আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একবার এই পথে গিয়েছিলাম সোলাং ভ্যালি পর্যন্ত। তখন পাশের পাহাড় ছিল পাথুরে কালচে আর রুক্ষ। যেগুলো এখন অনেকটা সবুজাভ। ছোট ছোট গাছ আর গুল্মের আলতো আবরণে। আর দূরের যে পাহাড়গুলো তখন ছিল ধবধবে সাদা ঘোমটার আড়ালে! সেগুলো এখন সবুজের সমুদ্রে হারিয়ে গেছে, অনেক পাইন আর আপেল গাছের অরণ্যে। 

প্রায় ২০-৩০ মিনিট চলার পরেই ভোরের সঠিক আলো ছড়াতে শুরু করলো, মানালির পাহাড়, অরণ্য আর ঝর্ণাজুড়ে। একে একে চোখের সামনে এসে ধরা দিতে লাগলো, দূরে সবুজ পাহাড়গুলোর মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে অগনিত ঝর্ণাধারা। পাইনের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা রঙের ছোট ছোট কটেজ বা রেস্ট হাউজ। ওগুলো দেখতে দেখতে নতুন একটা ইচ্ছে রেখে গেলাম মানালিতে, আবার কখনো এদিকে এলে ওই পাইন আর আপেলের অরণ্যর মাঝের কোনো এক রঙিন কটেজে থাকবো দুই একদিন। এই ইচ্ছা রোপণ করতে না করতেই আমাদের গাড়ি হুট করেই ডানে বাঁক নিয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। বামে সোলাং ভ্যালীকে রেখে। 

উঠতে শুরু করলো তো একেবারে খাঁড়াই উঠতে শুরু করলো। আর সেই সঙ্গে সবুজ পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে আমাদের বিদায় জানাতে শুরু করলো যেন। হুট করে সবুজ কমতে থাকায় একটা ধাক্কা লাগলো মনের মধ্যে। সামনে যত এগোতে লাগলাম পাহাড়ের খাঁড়া রাস্তা যেন আরও বেশি খাঁড়া হতে লাগলো আর সেই সঙ্গে বাঁকগুলোও তার ভয়ানক রূপ মেলে ধরতে লাগলো। এক একটা বাঁক আসে আর এক একটা নানা আকারের ঝর্ণাধারা দিতে লাগলো, যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের অভিভূত করে যেতে থাকলো। 

আরও প্রায় ৩০ মিনিট পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে চলে, বেশ অনেকটা উচু পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পরে প্রথমবারের মত সূর্য হেসে উঠেছিল আমাদের দিকে তাকিয়ে। সূর্যের নরম উষ্ণ ছোঁয়ায় আহ্লাদি হয়ে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছিলাম ঝটপট। এক অবাক করা পাহাড়ের খাঁজে। যার সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড়ে পাহাড়ে পাইনের গভীর অরণ্য চোখে পড়ে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সাদা মেঘেরা বিশ্রাম নিচ্ছিল থমকে থেকে। যেন আর একটু সূর্যের উষ্ণতা ছড়ালেই ওরা ভেসে বেড়াতে শুরু করবে। সেখানেই প্রথমবারের মতো ছবি তোলা হলো বেশ কিছু। সাথী করে থমকে থাকা মেঘ, গম্ভীর সবুজ পাহাড়, গহীন পাইনের অরণ্য আর সূর্যের আলতে হেসে থাকা সবুজ পাহাড়দের সঙ্গে করে। 

এক একটা পাহাড় ডিঙিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছি আর এক একরকম পাহাড় সামনে আসতে লাগলো, একটু পরপর। কখনো কখনো দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাবার সময় সামনে পড়তে লাগলো কোনো এক পাহাড়ের একদম শেষ বিন্দু, যা দেখে শরীরের রক্ত কণিকারা চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকলো। ইচ্ছে হচ্ছিল যদি ওই পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে গিয়ে বসে থাকা যেত কিছু সময় তবে কতই না রোমাঞ্চকর হত সেটা? যদিও সেটা একেবারেই অসম্ভব। একটু পরে আমাদের সকালের প্রথম চা বিরতি দেওয়া হলো। তখন একদম সকাল। চারদিকে বেশ ঝলমলে সূর্যের হাসি আর আরামের উষ্ণতা। সামনেই এই যাত্রার প্রথম মাইল ফলক, রোথাং পাস। যেখানে আগেরবার যেতে পারিনি তুষারে রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে। 

কেলং-জিসপা না সারচু?

যাত্রা শুরুর আগে কথা ছিল প্রথম রাতে কেলং বা জিসপাতে থাকব; কিন্তু কেলং যখন পৌঁছালাম তখন মাত্র দুপুর ১২টা! আর জায়গাটাও তেমন একটা পছন্দ না হওয়াতে ছুটে চললাম জিসপাতে থাকবো বলে। জিসপা চলে এলাম এক ঘণ্টার মধ্যেই। এই জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। চারপাশে সবুজ আছে, দূরে পাথুরে পাহাড়ের ওপরেই বরফের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাশে বয়ে চলেছে সিন্ধু, সায়ক বা ইন্দাস নদীর কোন একটা শাখা বা প্রশাখা। চারপাশটা বেশ সবুজে ছাওয়া, আছে নানা রকম ফুলের সমারোহ আর দুই একটি ঝর্ণাও! পাশাপাশি কটেজগুলোও বেশ মনোরম লোকেশন আর বর্ণিল সাজে সেজে আছে। 

সবকিছু মিলে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে জিসপা। থাকার জন্য দরদাম করে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলাম কটেজ প্রতি ১০০০ টাকা। তিনজন আরামে থাকতে পারবে এক একটি কটেজে; কিন্তু তখন মাত্র দুপুর একটা বাজে। তাই এখানে না থেকে আর একটু এগিয়ে থাকা যায় কিনা সেটা ভাবতে লাগলাম। তার ওপর কেউ কোনোরকম খারাপ বোধ না করাতে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো সামনের ৯০ কিলোমিটার পরে সারচুতে রাতে থাকব। 

যদিও ড্রাইভার বারবার করে বলেছে, সারচুর উচ্চতা অনেক। প্রায় ১৪০০০ ফুট! ওখানে নিশ্বাসের সমস্যার পাশাপাশি, প্রচণ্ড ঠান্ডা আর তুমুল বাতাস মকাবেলা করতে গিয়ে নানা রকম সমস্যা হতে পারে; কিন্তু আমরা সবাই আমাদের সিদ্ধান্তে অটল যে সারচু গিয়েই রাতে থাকব। শুরু হলো সারচুর দিকে যাত্রা। যদিও উচ্চতা, শীত আর কখন কে হুট করে অসুস্থ হয়ে যায় এটা নিয়ে বেশ ভাবনায় ছিলাম। 

কিন্তু তবুও সবাই মিলে যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই এগিয়ে যাওয়াটাই মনস্থির করে চললাম। প্রায় ৪০ মিনিটের পাথুরে মাটির আর বালির রুক্ষ পথ পেরিয়ে আসার পরে, প্রথম বারের মতো আমরা পেলাম হাজারো বার টিভি আর নানা রকম ছবিতে দেখা, সমতল আর পাহাড় মিলিয়ে তৈরি করা আঁকাবাঁকা কিন্তু দারু দৃষ্টি সুখের সেই রাস্তার মতো মনোরম রাস্তার রূপ। যা দেখে সবাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম অপলক! ছবি তোলা হলো গাড়ি চলতে চলতেই। মাঝে ছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি তাই আর গাড়ি থেকে নামা হলো না। কিন্তু মন ভরে উপভোগ করেছি সেই অপরূপ রাস্তার রূপ সেটাই আনন্দের আর তৃপ্তির। 

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক চলার পরে, যে জায়গা থেকে চারচুর শুরু, সেখানে বেশ কয়েক জায়গায় তাবু খাঁটিয়ে রাখা হয়েছে পথের টুরিস্টদের জন্য। সাদা আর হলুদের সমন্বয়ে খোলা মাঠের মধ্যে একটি জায়গায় দাঁড়ানো হলো সেই রাতে থাকা যায় কিনা পরখ করার জন্য; কিন্তু দামে আর মানে মিল না হওয়ায় সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু ড্রাইভার কিছুতেই আর সামনে যেতে চাইছেনা! কারন স্পষ্ট বোঝা গেল এখানে থাকলে তার কিছু একটা আয়ের ব্যবস্থা আছে, আমাদের থাকা-খাওয়ার কমিশন হিসেবে। সেটা বুঝতে পেরেই ড্রাইভারের মতামতকে পাত্তা না দিয়ে সামনে সারচু বাজারে বা ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। 

পাশের এক ঘোলাটে নদী, ঝুরো পাথরের আর মাটির পাহাড় পেরিয়ে সামনে দেখা মিলল মূল সারচুর। একটি ব্রিজ পেরোতে হবে। এখানে এসে আর একটি কারন জানতে পারলাম কেন ড্রাইভার রাতে মূল সারচুতে থাকতে চায়নি বা আসতে চায়নি। কারন হলো এই ব্রিজ পার হবার সময় ১০০ বা ২০০ রুপি রাখা হয়, লাদাখ প্রবেশের বেসরকারি চাঁদাস্বরূপ! যেটা দেওয়া লাগতো না যদি ওখানে রাতে থাকতাম, কারন তখন খুব ভোরে রওনা দেবার কারনে এই ব্রিজের কাছে চাঁদা নেবার জন্য আর কেউ থাকতো না। 

যাই হোক ব্রিজ পার হতেই প্রথমবার চোখে পড়লো লাদাখের সাইনবোর্ড! তার মানে সারচু আসলে লাদাখ বা জম্মু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত! মানে আমরা হিমাচল প্রদেশ থেকে এখন লাদাখে চলে এসেছি! জেনেই অন্য রকম একটা আনন্দের অনুভূতি হলো সবার ভেতরে। ব্রিজের ওপারে হিমাচল প্রদেশ আর এপারে লাদাখ। বাহ বেশ তো! দুই-তিন যায়গায় থাকার যায়গা দেখে জন প্রতি ২০০ রুপি করে একটি ধাবায় উঠে পড়লাম ব্যাকপ্যাক রেখে। দুপুরে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি বলে সবার জন্য প্রাথমিকভাবে ম্যাগির অর্ডার দেয়া হলো। 

গরম গরম ম্যাগি খেয়ে বের হলাম প্রায় ১৪০০ ফুট উচ্চতার সারচু দেখতে। 

সারচুর সোনা পাহাড় ও নির্ঘুম রাত।

সারচু পৌঁছেই আমাদের টিমের সবচেয়ে সবচেয়ে বিনোদন দানকারী বন্ধু প্রচণ্ড অসুস্থতা বোধ করতে লাগলেন। মাথা ব্যথা আর নিঃশ্বাস জনিত সমস্যায়। তাকে গরম পানি নাপা খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হল গায়ে মোটা কম্বল চাপিয়ে। আর বারবার করে বলা হলো যেন কোনো কিছুতেই এই বিকেলে বিছানা থেকে আর না ওঠে। আমরা সবাই ম্যাগি শেষ করে যখন ধাবা থেকে বের হলাম, বাইরে তখন শেষ বিকেল আর সন্ধ্যার আগমনি গান। সূর্য হেলে পড়েছে পাহাড়ের কোলে। 

শেষ বিকেলের আলোতে পশ্চিমের পাহাড়ে যেন সোনা ঝরে পরছিল পুরো সারচু জুড়ে! পাহাড়ের এমন সোনালি রং আর এমন সোনা ঝরা রূপ আগে কখনো দেখা হয়নি। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সোনায় মোড়ানো পাহাড় আর নীল আকাশের দিকে। সঙ্গে চা চলতে লাগলো একের পর এক ঠান্ডা থেকে একটু আরাম পেতে। চার পাশের রুক্ষ মরুভূমি আর ঝকঝকে পিচ ঢালা রাস্তায় গিয়ে ছবি তোলা হলো ইচ্ছামত। হুটহাট করে দারুণ গতিতে ছুটে চলে যায় এক একটা জিপ বা পাহাড়ি ট্রাক। কখনো কখনো দল বেঁধে রয়েল এনফিল্ড! 

কিন্তু বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারছিলাম না এই আকাশ ও পাহাড়ের এই অপার্থিব রূপ। কারন শীত আর বাতাসে টিকে থাকা মুশকিল। অবশেষে শীতের হাত থেকে কান আর মাথা গরম করতে প্রিয় লাল-সবুজ-হলুদ টুপি বের করতে হলো সঙ্গে হ্যান্ড গ্লোভস। মোবাইল আর ক্যামেরার চারজার নিয়ে নেওয়া হলো পাশের আর্মি ক্যাম্পে চার্জ দেবার জন্য। আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে চার্জে দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখা হলো চারচুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। উষর প্রান্তরে চষে বেড়াতে লাগলাম। পুরো পাথর আর মাটির প্রান্তর জুড়ে ছোট ছোট সবুজ দুই একটা গুল্মলতা বা কাটা ও হলুদ ফুল জাতীয় কিছু একটা। তবে এটা না গাছ না ঘাস কোনো পর্যায়ে পরে সেটা বোঝা গেল না। 

আর একটু এগিয়ে পাওয়া গেল বেশ গভীর; কিন্তু অল্প পানি বয়ে যাওয়া এক নদী। কি নাম সেটা আর জানা হয়নি, নদীর চেহারা পছন্দ হয়নি বলে। বেশ অদ্ভুত ধরনের এক নদী পানি আছে কি নেই বোঝা যায় না হঠাৎ দেখায়। কারন পানি, পাহাড় আর মাটির রঙ প্রায় একই রকম বালু আর পাথরময়। খুব গভীর ভাবে তাকালেই শুধু মাত্র বোঝা যায় যে ওটা নদী আর সেখান থেকে ধীর লয়ে বয়ে চলেছে কাঁদা আর পাথর-বালুযুক্ত পানি। এসব দেখতে দেখতেই সন্ধ্যা নেমে এলো সারচু জুড়ে। আমরাও আর ঠান্ডা সহ্য করতে না পরে ঢুঁকে পড়লাম আমাদের খোয়াড়ে! 

খোয়াড়ে গিয়ে বেশ গল্পগুজব হতে লাগলো। ধাবার মালিক, আমাদের ড্রাইভার আর অন্য সবার সঙ্গে। সঙ্গে চায়ের অর্ডার দেয়া হল। ১৫ টাকা করে লিকার চা; কিন্তু ভীষণ ঠান্ডা, ১৪০০০ ফুট উচ্চতা আর ভীষণ বাতাসে বেশ কয়েক জনের নানা রকম সমস্যা হতে শুরু করলো। বিশেষ করে মাথা ব্যাথার অসহ্য একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়লো পুরো টিমের প্রায় সবার মাঝেই। যে মাথা ব্যাথা আর ঠান্ডায় কাতর হয়ে কয়েকজন রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। 

কিন্তু শুয়ে পরলে কি হবে? ১০ মিনিট ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তো মাথা ব্যাথায় ঘুম আর আসে না। শীতে টিকে থাকার জন্য প্রত্যেকেই তার সোয়েটার, জ্যাকেট, হাতমোজা, কানটুপী পরে তার উপর ডাবল কম্বল চাপিয়ে দিয়েছি; কিন্তু তারপরেও কোথা থেকে যেন কিভাবে ঠিক বাতাস ঢুঁকে পড়ছিল হুহু করে আর সেই সঙ্গে মাথা ব্যথা বাড়তে লাগলো। এতোটাই খারাপ লাগতে লাগলো যে ওষুধ পর্যন্ত খেতে ইচ্ছা করছিল না কষ্ট করে। শুধু মাঝে মাঝে একটু গরম পানি খেতে পারছিলাম। এভাবে ১০ মিনিট শুয়ে থাকি তো ২০ মিনিট জেগে থাকি। এর মাঝেই ঘুম না আসাতে কয়েকজন উঠে বাইরে গেল আকাশের তারা দেখতে! কিন্তু ক্লান্তি আর ভীষণ মাথা ব্যথায় অনেকেই সেটা পারলোনা। তবে দুই একজন বেশ ভালো ঘুমিয়েছে মনে হলো। 

এভাবে কখনো শুয়ে, কখনো বসে থেকে, কখনো গল্প করে, কখনো গরম পানি খেয়ে সময় কাটছিল; কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হল সে যেন থমকে আছে এক জায়গায়! কারন ভেবে ছিলাম রাত তিনটা বা চারটা হবে হয়তো; কিন্তু না ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত মাত্র ১১ টা! হায় এখনো যে সন্ধ্যা সবেমাত্র! পুরো রাত শেষ হয়ে সকাল হতে হতে তো অনন্তকাল কেটে যাবে! 

ভর সন্ধায় শুয়ে পরলে আর ঘুম না এলে যে অবস্থা হয় আর কি! তার সবটুকু একই সঙ্গে ঘটছিল সঙ্গে রয়েছে নিদারুণ মাথা ব্যাথার যন্ত্রণা। এভাবে প্রায় বসে বসেই এক সময় কখন যেন একটু ঘুমিয়ে পড়লাম কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ না। আবারো জেগে, আবারো ঘুমিয়ে বা শুয়ে থেকে কাঁটিয়ে দিলাম এক অসহ্য যন্ত্রণাময় নির্ঘুমরাত। মাথা ব্যাথাটাই সবচেয়ে কাহিল করে দিয়েছিল। এমনকি সকালে উঠেও মাথা ব্যথা কমার কোন লক্ষণ দেখা গেল না! তবুও এতটুকু সান্ত্বনা যে রাতটা তো অন্তত পার হয়েছে! দিনের আলো তো দেখা গিয়েছে, সূর্য উঠেছে, মানুষ দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি চলছে, পাহাড়-নদী আর আকাশের নীল দেখা যাচ্ছে এই নিয়েই নাহয় এগিয়ে যাবো আজকের বাকি পথটুকু। সারচু থেকে লেহ এর দিকে। মাঝে একটা বিরতি দিয়ে একটানে চলে গিয়েছিলাম লাদাখের লেহ শহরে। অসুস্থতা আর ঘুমকে সাথী করে। 

রুক্ষ ভালোবাসার শহর!-লেহ

রুক্ষ ভালোবাসার শহর! অদ্ভুত না নামটা? ভালোবাসা কি কখনো রুক্ষ হয় নাকি? হ্যাঁ হয়, লেহ শহরের গল্পটা ঠিক এমনই। রুক্ষ একটি শহর কিন্তু ভালোলাগা, ভালোবাসা, আকর্ষণ, মায়ায় ভরপুর একটা শহর। যে শহরে গিয়ে প্রথমেই আপনি বেশ অবাক হয়ে যাবেন শহরের রুক্ষতা, ধুলো-বালি, সরু পথ-ঘাট, গলি-ঘিঞ্জি আর জ্যাম দেখে! 

কিন্তু যতই সামনে এগোবেন এবং ভিতরের দিকে যেতে থাকবেন ততই তার রঙ-রূপ-রস আপনাকে বিমোহিত করতে শুরু করবে, যেটা এক সময় রূপ নেবে ভীষণ ভাললাগা, ভালোবাসা আর মায়ায়। ছেড়ে আসতে মন চাইবেনা কিছুতেই। ঠিক এমনই অনুভূতি হয়েছিল আমার লেহ শহরের তিনদিনে। তবে সেই গল্পটা বলি... 

আমরা যখন মানালি থেকে লেহ এর দিকে যাত্রা শুরু করি তখন মানালি-লেহ হাইওয়েটাই ছিল আমাদের মূল আকর্ষণ। শুধু আমাদের কেন, যারা কমবেশি ভ্রমণ করেন আর ভ্রমণ ভালোবাসেন এবং ভ্রমণ নিয়ে অল্প বিস্তর ভাবেন তারা মাত্রই জানেন যে মানালি-লেহ হাইওয়ে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় আর রোমাঞ্চে ভরপুর একটি পথ। যে পথে যাওয়ার স্বপ্ন বুনে থাকেন হাজারো-লাখো ভ্রমণ ভালোবাসা মানুষ। এখন শুধু লেহ শহরের গল্পটা। 

রঙ-বেরঙের পাহাড় আর ভয়ানক সব রোমাঞ্চকর বাঁক পেরিয়ে লেহ শহরের বাস স্ট্যান্ডে আমাদের গাড়ি যখন নামিয়ে দেয়, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আমরা যাব আপার কারজু। প্রায় ১০ মিনিট গাড়ি চলে, বাজার পেরিয়ে আমাদের গাড়ি আপার কারজুর পথে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলো। আর সেই সঙ্গে মনের মধ্যে জমে যাওয়া হালকা কালো অভিমানের মেঘ কেটে যেতে থাকলো সুখের বাতাসের পরশে। দেখে আপার কারজুর বাঁকে বাঁকে হেসে থাকা অপরুপ সৌন্দর্য আর ভালোবাসায় ঘিরে ধরা এক-একটা বাড়ি, হোটেল আর গেস্ট হাউজ দেখে! 

প্রতিটি বাড়ি, হোটেল, কটেজ বা গেস্ট হাউজই এক একটি ছোট ছোট সুখের স্বর্গ! প্রতিটি বাড়ির গেটের দুই পাশের আপেল গাছ আপনাকে হেসে স্বাগত জানাবে! গেট দিয়ে ঢুকতেই হয়তো পাবেন ঝুলে থাকা আঙ্গুরের আহ্বান! লাল-গোলাপি আর সবুজ আপেলের বাগান, গাছের তলায় সবুজ ঘাসে পরে আছে অগনিত আপেল! আখরোট, হলুদ আর ভীষণ মিষ্টি সুস্বাদু কোন নরম-কোমল ফল! 

প্রতিটি বাড়ির রুমের দেয়াল জোড়া সচ্ছ কাঁচের জানালা। যে জানালার ভারী পর্দা সরাতেই আপনি চোখের সামনে পাবেন এক অপার্থিব পৃথিবী। বাড়ির বেলকোনি, জানালার কার্নিশ, সামনের লন সব জায়গা জুড়ে রয়েছে রঙ-বেরঙের নাম না জানা শত রঙের ফুলের টব! আর বাগানজুড়ে ফুটে আছে নানা রকমের, বর্ণের গোলাপ থোকা থোকা। সূর্যমুখী, ডালিয়া, কসমস এবং নাম না জানা আরও অজস্র ফুলের সমারোহ। 

এবার নিচ থেকে ওপরের দিকে চোখ তুললে এঁকে এঁকে আপনার চোখে পড়বে, সবুজ চারদিকের রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট সবুজ ভ্যালী আর বর্ণীল বাড়ি-ঘর। আর একটু ওপরে তাকালে ধীরে ধীরে সবুজ পাহাড়ের শেষ শত শত রুক্ষ সোনালী পাহাড়! কোনোটা পাথরের, কোনোটা মাটির আর কোনোটা সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো। আরও একটু দূরে আর ওপরে তাকালে সেদিক থেকে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করবেনা কিছুতেই! কারন সেখানে নীল আকাশের সঙ্গে মিতালী করে মাথা তুলে গৌরবে দাঁড়িয়ে হেসে আছে বরফে বরফে মোড়া পাহাড়ের চূড়া! একটি, দুইটি, তিনটি... নাহ গুনে শেষ করতে পারবেন না! 

এই সবকিছুর মায়াবি আকর্ষণ আপনাকে এতোটাই মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলবে যে ফিরে আসার কথা মনে পরতেই মন খারাপ হয়ে যাবে নিজের অজান্তেই। লেহ শহরের আশে পাশেই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি! ৩০-৪০ মিনিটের ড্রাইভ শেষ করে পাবেন ইন্দাস আর জান্সকার নদীর অপূর্ব মিলন মোহনা। যেখানে পাবেন পাহাড়ি উত্তাল জান্সকার নদীতে রাফটিং এর অনন্য রোমাঞ্চ। একই সঙ্গে পাহাড়ের ভয়ানক বাঁক, উত্তাল পাহাড়ি নদীর ডাক আর মাটির পাহাড় কেটে কেটে বানানো বৌদ্ধদের উপাসনালয় বা স্তুপা। 

সেদিক থেকে আবার লেহ শহরের দিকে ফিরে এসে লেহ-মানালি হাইয়েওর ২০-২৫ কিলোমিটার গেলেই পাবেন কয়েক শতাব্দী আগের বিখ্যাত হেয় প্যালেস, থ্রি ইডিয়টস মুভির জনপ্রিয় র্যা ঞ্চস স্কুল, পাহাড়ি ঢলকে কিভাবে ক্ষুদ্র নদীর মতো বানিয়ে কিভাবে সাধারন মানুষের কাজে সেই পানি ব্যাবহার করা যায় তার এক অনন্য উদাহারন পুরো শহরের বাঁকে বাঁকে। আপার কারজুর পাশেই পাবেন আর একটি স্তুপা, শান্তি স্তুপা। যেখানে হেঁটে হেঁটেই ঘুরে আসতে পারবেন অনায়াসে। এছাড়া আছে বিভিন্ন যুদ্ধের সৃতি যাদুঘর হল অফ ফেম, পাহাড়ের খাঁজে ছোট্ট লেহ এয়ারপোর্ট সহ আরও নানা নান্দনিক স্থাপনা। 

কখন যে এসব দেখে এই রুক্ষ শহরকে ভালোবেসে ফেলবেন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না। কখন যে আপনার কাছে এই রুক্ষ শহর এক মায়ার বাঁধনে বাঁধা ভালোবাসার শহরে রুপান্তরিত হবে জানতেই পারবেননা! যতক্ষণ না ফেরার সময় হয়ে আসবে। ফেরার সময় দেখবেন কেমন বিষন্ন লাগে, ঠিক প্রিয়জনকে ফেলে দূরে চলে যাবার মতো করে এক অব্যাক্ত অনুভুতির মতো। যেটা শুধু নিজে বুঝতে পারবেন, কাউকে বোঝানো দুঃসাধ্য। তখন মনে মনে ঠিক বলবেন.....

লেহ-এক রুক্ষ ভালোবাসার নাম! 

স্বর্গের বিছানা থেকে শুভ সকাল!!

আচ্ছা, যদি রাতের নির্মল ঘুম শেষে, তুলতুলে নরম কম্বলে ভেতর থেকে, আলতো করে চোখ খুলে, পর্দা সরানো কাঁচের জানালায় চোখ মেলে দেখতে পান, বাগানে ফুটে আছে রঙ-বেরঙের বর্নিল ফুল, ডালিয়া, সূর্যমুখী, কসমস, গোলাপ, গাঁদাসহ আরো অনেক ফুল, একটু ওপরে চোখ তুলে তাকালেই দেখছেন সামান্য সবুজে ছাওয়া পাহাড়, পাথর আর মাটির রুক্ষ সোনা ছড়ানো পাহাড়, আর একটু দূরে আপনার দিকে তাকিয়ে হাসছে অগনিত শুভ্র পাহাড়ের চূড়া সূর্যের আদর মেখে! 

বিছানায় শুয়ে থেকে পাশ ফিরে তাকালের অন্য পাশের জানালায়। জানালার কপাট খুলতেই হিম শীতল একটা বাতাস আলতো স্পর্শ করে যাবে আপনাকে, দেবে আবেশে ভাসিয়ে। ইচ্ছে হলেই কাঁচের জানালার স্লাইড সরিয়ে ছিঁড়ে নিতে পারেন লাল-গোলাপি বা সবুজ একটি-দুটি আপেল! অথবা কস্ট করে না ছিঁড়ে বিছানায় শুয়েই কুড়িয়ে নিন সবুজ ঘাসের নিচে গাছ থেকে ঝরে পরা থাকা কয়েকটি আপেল!!

বিছানা থেকে উঠবেন কি, উঠবেন না? কি করবেন বুঝতে না পেরে যখন নির্বোধের মতো অপলক তাকিয়ে থাকবেন, ঠিক তখনই আপনার খুব কাছের, কোন প্রিয়জন আলতো করে গালে ছুঁইয়ে দিয়েছে, ধোঁয়া ওঠা কফির মগ!

তখন সেই সুখে মরে যেতে ইচ্ছে হবে নিশ্চিত ভাবেই! এই সুখের রেশ যেন শেষ না হয়, সেই শঙ্কায়! ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি বা আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষদের একজন! বিধাতার বিশেষ আশর্বাদে এমন সকাল আসে! পার্থিবতায় এমন অপার্থিব সুখের স্পর্সে মরে যেতে ইচ্ছে করে, স্বর্গের বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হয়না! লাদাখের, লেহ শহরের থুপপুঙ গেস্ট হাউসে বসে সেদিন ঠিক এমনই অনুভূতি হয়েছিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //