লিসোটোর সেলাবাথেবে উপত্যকায়

সেলাবাথেবের বিপুল প্রান্তরে

ড্রাইভার কেতেলেটসো খুব সাবধানে র‌্যাংলার জিপখানা নামিয়ে আনছে পাথর ছড়ানো দীর্ঘ ঘাসের ভেতর দিয়ে। আমরা নেমে আসছি পাহাড়ের প্লাটো থেকে নিচের উপত্যকায়। খুব ভোরবিহানে রওয়ানা হয়ে ঘন্টা কয়েক হলো জিপ হাঁকাচ্ছি আমরা। ড্রাইভারের পাশের সিটে স্তূপ করে রাখা আমাদের খাবার-দাবার ব্যাকপ্যাক ও নানা রকমের সামানাদি।

কবি নাকাতুলের সঙ্গে আমি বসেছি পেছনের সিটে। জার্কিং হচ্ছে প্রচুর। আর আমরা আধোঘুমে ঢলে পড়ছি বারবার পরষ্পরের গায়ে। লিসোটোর মেয়ে নাকাতুলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় কয়েক বছর আগে জিম্বাবুয়েতে আফ্রিকার পোয়েট্রি সম্মেলনে। তখন সে ছিল ষোল বছরের কিশোরী। বর্তমানে এ তরুণী কবি আফ্রিকার আকাশ রাজ্য বলে পরিচিত লিসোটোর রাজধানী মাসেরু শহরে বাস করছেন। সে গুড টাইম নামে একটি ক্যাফেতে নৃত্যগীতের মাধ্যমে পালা গানের মতো করে তার কবিতার পারফরম্যান্স করে। কয়েক বছর পর আমি দ্বিতীয় বারের মতো মাসেরু শহরে এসেছি। পর্যটকদের মধ্যে যারা তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করতে ভালোবাসেন- সেলাবাথেবে উপত্যকা তাদের আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। মাসেরু শহরে আমার হাতে আছে অঢেল সময়। তাই এ সুযোগে কবি নাকাতুলেকে নিয়ে যাচ্ছি সেলাবেথে উপত্যকায়।

যেতে যেতে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, সেলাবাথেবে প্রান্তরের নিসর্গ পট। ঘণ্টা খানেক আগে আমরা চরাচরে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বিরাণ একটি গাঁয়ে হাত-পায়ের খিল ছুটানোর জন্য থেমেছিলাম। কালচে বাদামি রঙের গোলাকার কুটির থেকে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকটি গায়ে কম্বল জড়ানো ছোট্ট ছেলে-মেয়ে। তারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে জিপের চকচকে ধাতব চেসিসে প্রতিফলিত তাদের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর এ দিকে উপত্যকা ভরে আছে সবুজ ঘাসে।

নাকাতুলে পর্টেবোল সিডি ওয়াকম্যানে কী একটা গান শুনছে। তার ধ্বনি-তরঙ্গ উচ্চাসের মতো ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে। এ কয়েক বছরে নাকাতুলের পরিবর্তন হয়েছে বিগত। বেনোজলে উছলে ওঠা নদীর চরের মতো ভরে ওঠেছে তার শরীর। আগের মতো সারাক্ষণ কথা বলে থেকে থেকে খিল খিল করে হেসে ওঠে না সে। তার মধ্যে এসেছে এক ধরনের মগ্নতা। প্রচুর কনসেনট্রেসন নিয়ে সে গান শুনে। অথবা এক মনে কিছু ভাবে, তখন তার অভিব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে গাঢ় ডেপথ। একটু আগে আমরা তার জননীর মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিলাম। রোগ সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো তথ্য সে দেয়নি। তবে আলামতের বর্ণনা থেকে মনে হয় মহিলার সমাপ্তি এসেছে এইডসের সংক্রমণে। নাকাতুলে বর্তমানে তার দিদিমার সঙ্গে বাস করছেন। তার বাবা সাউথ আফ্রিকার পিটার্সমারিটসবার্গের দিকে একটি খনিতে ঠিকাদারের কাজ করেন। তিনি ওখানে লিসোটোর বাসোটো সম্প্রদায়ের শ্রমিক সরবরাহ করেন। তার মায়ের তীব্র অসুখের খবর তিনি জানতেন। পরিবারে রেগুলার টাকার পাঠানোর যে প্রক্রিয়া বছর কয়েক ধরে চালু ছিল, এ সময় তিনি কী কারণে তা বন্ধ করে দেন। তখন দেশওয়ালী খনি শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায় যে, তার পিতা পিটার্সমারিটবাগে দ্বিতীয় যে জুলু নারীর সঙ্গে বসবাস করতেন তার সঙ্গে সেপারেশন নিয়ে ঝামেলায় আছেন। একইসঙ্গে কম বয়সী শংগান গোত্রের আরেকটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন।

জিপ থেমে যেতেই আমরা নেমে আসি। ক্ষিধা পেয়েছে। তাই নাকাতুলে কুলার থেকে বের করে আনলেন- হ্যাংরি লায়ন রেস্তোরাঁ থেকে নিয়ে আসা কোফতা, পনির ও অলিভের পুর প্যাঁচানো লেবানিজ রুটি। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে সেলাবেথের উচ্চতা ২ হাজার ৫০০ মিটারের মতো। এখানকার শীতল হাওয়ায় আছে কনকনে অনুভূতি। নাকাতুলে স্কিনটাইট জিন্সের সঙ্গে লেদার জ্যাকেট পরে আছে বলে তাকে মারদাঙ্গা সিনেমার নায়িকার মতো দেখাচ্ছে। সে রুটির রোল খেতে খেতে অন্যমনষ্কভাবে দেখে সামনের প্রান্তরে জগদ্দল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের বিশাল এক প্রাকৃতিক স্থাপত্যকলার দিকে। খয়েরি রঙের এ রক ফর্মেশনকে দেখায় হাজার বছরের পুরনো পাথুরে প্রাসাদের ভগ্ন দেয়ালের মতো। তা সৃষ্টি করেছে বৃত্তের মতো এমন এক নৈসর্গিক আর্চ, যার ভেতর দিয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে- দূর দিগন্তে আত্মসমাহিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আরও কয়েকটি শীলা পাহাড়।

আমি ব্রেডরোল খেতে খেতে দেখি সবুজ ঘাসে ফুটেছে থোকা থোকা হলদে ফুল। ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি বিপুল ওজনের বোল্ডার। ড্রাইভার কেতেলেটসো ভাজা কাঁচকলা খেতে খেতে বলে, হাঁটাচলা করার অভ্যাস আছে এ পাথরগুলোর নিশুতি রাতে। তাতে নাকাতুলে ভ্রুকটি করে কিন্তু আগের মতো খুনসুটিতে মাতে না হাল্কা উচ্ছলতায়। আষাঢ়ে আলোচনা জমছে না দেখে কেতেলেটসো ফিরে যায় জিপে। তখন নাকাতুলে মৃদু স্বরে বলে, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মাই ফাদার। তার তো আরেকটা সংসার হয়েছে, এখন আর টাকা-পয়সা পাঠাতে পারে না; কিন্তু আমাকে ভুলে যায়নি একেবারে। কয়েক দিন আগে পিটার্সমারিতসবার্গ থেকে মাসেরুতে ফিরে আসলো এক খনি শ্রমিক। তার মাধ্যমে সে আমাকে এ লেদার জ্যাকেটটি পাঠিয়েছে।’ বলে নাকাতুলে জ্যাকেটের চামড়ার স্লিভ হাত বুলিয়ে স্মুদ করতে করতে বলে, ‘মায়ের যেদিন মৃত্যু হলো, বাবার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে চেয়েছি। তার মোবাইল বন্ধ ছিল। পরে তার এক বন্ধুকে রিং করি। উনি বললেন, ‘জাস্ট ফরগেট এবাউট হিম লিটিল গার্ল। তোমার বাবা আজ খুব গুছিয়ে শাংগান মেয়েটিকে বিয়ে করছেন। তিনি জাঁকিয়ে মেতেছেন পার্টির আয়োজনে।’ কাহিনী সম্পূর্ণ না করেই নাকাতুলে জিপে ফিরে গিয়ে নিয়ে আসে পোর্টেবল সিডি ওয়াকম্যান। কানে সে ইয়ারফোন লাগাতেই বুঝতে পারি- আমার খুব কাছাকাছি থেকেও এখন সে নিমজ্জিত হবে নিজের ভেতর।

খানিক দূরে ফুটে আছে একহারা গড়নের সুদর্শন ফুল। তাতে এসে বসে ঝলমলে নীলচে-সবুজ একটি সান-বার্ড। বর্ণের নীলাঞ্জন ছড়িয়ে অত্যন্ত ছোট্ট এ পাখিটি চুষে খায় পুষ্পের নেক্টার। পাথুরে আর্চের বৃত্ত ছড়িয়ে ওপাশে ঘন হয়ে জমেছে আলোছায়ার খেলা। নিসর্গের মায়াময় মাদকতা ছেড়ে এখনই জিপে চড়ে বসে অন্যত্র যেতে ইচ্ছা হয় না। নাকাতুলে এ মুহূর্তে আমার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হচ্ছে না, এ বিষয়টা আমাকে ইরিটেট করে না। তবে তার ভাবনা রক্তস্রোতে বীজাণুর মতো কুরে কুরে খায়। নাকাতুলে সচেতন না হলেও, আমার সুহৃদ মোজাফেলার কাছ থেকে তার সম্পর্কে ইন্টারেস্টিং একটি তথ্য পেয়েছি। এবার মাসেরুতে এসে আমি নাকাতুলের সঙ্গ তেমন পাচ্ছি না। ভেবেছি- সে তার পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যস্ত আছে। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মোজাফেলা বিষয়টা খেয়াল করেছেন। তিনি তার সম্পর্কে কয়েক পৃষ্ঠা ঝরঝরে টাইপ করা সম্পূর্ণ একটি ডোসিয়ার তৈরি করে ফাইল ফোল্ডারসহ তা আমার কাছে পাঠিয়েছেন। গত রাতে আমি যখন সেলাবেথেবে- তে সফরের প্রস্তুতি নেই, তখন ডোসিয়ারটি খুঁটিয়ে পড়েছি। না, সন্ধ্যায় সব সময় নাকাতুলে পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যস্ত থাকেনি। একটি সিলভার কালারের ঝক ঝকে ফোর-রানার এসইউভি জাতীয় গাড়ি তাকে রেগুলার পিক করে নিয়ে গেছে শহরের একমাত্র ফাইভস্টার হোটেল সান-এর রেস্তোরাঁয়। ওখানে সে ডিনার করছে ইউএনডিপিতে কাজ করা লালচুলো এক আইরিশ সাহেবের সঙ্গে। লালচুলোর বয়স তেপ্পান্ন থেকে আটান্নর মাঝামাঝি। ডাবলিনে ডক্টরেট করা এ ভদ্র সন্তানের শার্টের হাতায় ঝিকমিক করে পাথর বসানো কাফলিংকস্। ডিনারের অর্ডার করে তিনি নিপুণ হাতে বো-টাই খুলে তা টেবিলে রেখে নাকাতুলেকে কষে চুমো খান। তারপর কাঠিতে অলিভ গাঁথা মার্টিনির পাত্রে চুমুক দেন।

নাকাতুলে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে জিপে চড়ে বসার জন্য ইশারা দেয়। আমি গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, প্রায় বছর চারেক আগে সে বতসোয়ানার বিখ্যাত কবি মাঝ-বয়সী বাৎজিলি বালমোজার সঙ্গে লিভ টুগেদার করেছে। তখন কিশোরী নাকাতুলে ছিল খুবই চটুল স্বভাবের। একবার বাৎজিলি বালমোজাসহ আমি তাকে নিয়ে জিম্বাবুয়ের কামি রুইন বলে একটি প্রাসাদের ভগ্ন স্তূপ দেখতে গিয়েছিলাম। স্ন্যাকবারের সামনে দাঁড়িয়ে সে ঠোঁট কুঁচকে আবদার করেছিল, ‘বাই মি সাম চকোলেট নাও।’ বলেই আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কপট টাকার সন্ধানে স্পর্শ করে ছড়িয়ে ছিল সংবেদন। হয়তো সে লালচুলো ডক্টরেট করনেওয়ালা আইরিশকে আজকাল ওভাবে স্পর্শ করে। জিপের পাদানিতে পা দিতেই একটি বিষয়ের জট খুলে যায়। নাকাতুলে স্পষ্টত তার বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাতে তার অবচেতনে সৃষ্টি হয়েছে ভ্যাকুয়ামের, তবে কী সে বয়স্ক পুরুষদের সন্নিধ্যে পূরণ করতে চাইছে সে শূন্যতাকে ?

পথে এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের সংখ্য কম। হাল্কা চালে কাতেলেটসো জিপ ছোটাচ্ছে। চাকার তাড়নে দীর্ঘ ঘাস থেকে লাফিয়ে উঠছে কীট পতঙ্গ ও ছোট ছোট পাখি। খানিক দূরে ঢালু একটি উপত্যকা ঘাসে ঘাসে ছড়াচ্ছে তীব্র সবুজ। তার রীজে কালচে ধুসর পাথরের দেয়াল তৈরি করছে ভিজ্যুয়েল প্রতিবন্ধক। নাকাতুলে ঝিমুনিতে বার বার ঢলে পড়তে থাকে। আমি জিপের জানালা দিয়ে সামনে প্রান্তরের সীমাহীন শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে আমার কাঁধে আবার ঢলে পড়লে ভোরে মাখা ল্যাভেণ্ডারের মৃদু সুরভীতে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ভাবি, সদ্য তরুণী হয়ে ওঠা নাকাতুলে কি নারী হিসেবে আমার প্রতি কখনো আগ্রহ দেখিয়েছে? সঠিক করে বলা মুশকিল, তবে বয়সের বিগত ব্যবধান অতিক্রম করে সে কাছাকাছি এসেছে ঢের এবং আমি লিসোটোতে ফের তার তালাশে এসেছি, বিষয়টা সত্য। আমাদের সম্পর্ক গভীর কোন মাত্রায় না পৌঁছালেও, মনে হয় তার বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি বেশ খানিকটা। জানতে পেরেছি মেয়েটির হৃদয়ের গুপ্ত কুঠিরে তালা দিয়ে রাখা কিছু ব্যক্তিগত ঘটনাদি। আমার মধ্যে প্রণয়ের কোনো প্রত্যাশা না থাকলেও বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা চেষ্টা আছে পুরামাত্রায়। এ যাত্রায় সেলাবেথেবের বিজন প্রান্তরে ফোরহুইল জিপ হাঁকিয়ে তার বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করে নিচ্ছি যতোটা সম্ভব। বুঝতে চেষ্টা করি, আমার এ প্রবণতার পেছনে মূল কারণটা কি? তবে কী নওল তারুণ্যে কোনো কিশোরীর বিশ্বাসভাজন হতে পারিনি বলে বয়সের আস্তাচলে এসে তা পুষিয়ে নিচ্ছি। ঘাসের ফাঁকে খরগোসের সতর্ক চোখের মতো অতীত থেকে উঁকি দেয় একটি স্মৃতি। আমি এখন আর এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে চাই না। তাই আয়না থেকে মুখ সরিয়ে নেওয়ার মতো ভাবনাকে অন্যদিকে ধাবিত করি। জানালার বাইরে দৃশ্যপট ড্রামাটিক হয়ে ওঠে। বুঝতে পারি কেন সেলাবাথেবে ন্যাশনাল পার্কের প্রান্তরকে ঔপনিবেশিক যুগের অভিযাত্রিকরা বলতেন ‘বিগ স্কাই কান্ট্রি এন্ড লিমিটলেস স্পেস।’ দৃষ্টি পথে ভেসে ওঠে বেশ দূরে থ্রি বুশম্যান মাউন্টেনের তিনটি পাহাড়। তারা যেন আফ্রিকান গোত্রপ্রধানদের গাম্ভীর্য নিয়ে নিমগ্ন হয়ে আছে কোনো ভাবনায়।

ড্রাকেনসবার্গ-মালোতি পর্বত থেকে নেমে সেলাবাথেবের গ্রাসল্যান্ড কেটে আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে গেছে অ্যারেঞ্জ রিভার। আমি নদীটিকে চাক্ষুষ করার জন্য ড্রাইভার কেতেলেটসোকে বার কয়েক অনুরোধ করি; কিন্তু আমার আবেদন উপেক্ষা করে সে একটি ছড়া নদীর রুপালি জলরেখা নিশানা করে জিপ চালায়। আর সামনে বাড়া ফোর হুইলের সাধ্যে কুলাবে না। তাই জিপ পাথরের প্রাকৃতিক স্থাপনার আড়ালে রেখে আমরা নেমে পড়ি। এবার পদতলে অত্যন্ত অসমতল ট্রেইল মাড়িয়ে যেতে হবে পাথরের গুহায় আদিম যুগের বুশম্যানদের আঁকা রক-আর্টের থানে। পদযাত্রার আগে আমরা একটু বিরতি নেই। নাকাতুলে পানির বোতলে অরেঞ্জ স্কোয়াশ মিশিয়ে ড্রিংকস তৈরি করছে। আমি কাজুবাদামের প্যাকেট ছিড়তে ছিড়তে ছড়া নদীটিকে নিরিখ করে দেখি। তার টলটলে জল যেন আটকে আছে ধূসর পাথরে বাঁধানো নিগড়ে। নদীটির শিয়রে ছোটখাটো কয়েকটি রক-পুল বা পাষাণে বাঁধানো পুকুর। পানিতে ভাসছে মেঘভাসা আকাশের প্রতিফলন। আমরা পাড়ে এসে দাঁড়াতেই কয়েকটি বর্ণাঢ্য মাছ কাজা-কচ্চিৎ দেখা বিরল স্বপ্নের মতো সাঁতরে যায় শ্যাওলার অন্তরালে। এখানে শীত খুবই কম। নাকাতুলে তার লেদার জ্যাকেট খুলে তা পাথরের পাড়ে রেখে বাঁকা হয়ে পানিতে তার প্রতিফলন দেখে, তাতে জলজগুল্মের জটাজাল ছড়িয়ে বেরিয়ে আসা শিশু-কাছিমের মতো তার লোকাট টপে ভরাট স্তন যুগল ঝাঁকিয়ে ওঠে মৃদু। সে সোজা হয়ে আমার চোখে চোখ রাখলে আমি বলি, ‘পাথরের পাড়ে বসে কাটিয়ে দেই না সারা দিন। রক-আর্টের থানে আজ না গেলে হয় না?’ যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তার চোখে ম্যাচকাঠির মতো জ্বলে ওঠে ক্রোধের শিখা। ইমোশনে গলার স্বর খানিকটা দ্রবীভূত করে সে জবাব দেয়, ‘তুমি কী চাও না আমি কাউ-বয় ডিমাকাটসোর সঙ্গে দেখা করি? আমি যে তার জন্য বেশ কিছু খাবার দাবারের সাপ্লাই নিয়ে এসেছি।’ আমার কৌশলে কাজ হচ্ছে, সে রেগে যাচ্ছে দেখে আমি সরাসরি অনাধিকার চর্চা করি। বলি, ‘কাউ-বয় ডিমাকাটসো গরু ও ছাগল চরিয়ে দিন কাটায়। তুমি রাজধানী মাসেরু শহরের মেয়ে, এ রাখাল ছেলের প্রতি তোমার টান দেখে আমার কেন জানি খুব অবাক লাগছে।’ নাকাতুলে এবার চুল থেকে হেয়ারটাই খুলে নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়, ‘তুমি তো অবাক হবেই, সিসোটো ভাষার ডিমাকাটসো শব্দের অর্থই হচ্ছে অবাক হওয়া। আমিও তার আচরণে অবাক হয়েছিলাম ভীষণভাবে। আর ঘটনা হচ্ছে- আই লাইক ইউ টু নো দ্যাট আই লাভ হিম সো মাচ, ইনডিড আই লাভ হিম, আই ডু।’ আবেগের তোড় দেখে আমি একটু পিছু হটি। আমি অবগত যে, জনবিরল প্রান্তরে গবাধি পশু চরানো রাখালদের নিয়ে বাসোটো গোত্রের মেয়েদের আছে দারুণ রকমের ভাবালুতা। তা নিয়ে নাকাতুলে লিখেছেও কয়েকটি স্পর্শকাতর কবিতা। তাই বলে এক রাখাল যুবকের তালাশে সশরীরে পর্বত উপত্যকা প্রান্তর পাড়ি দিয়ে সে মেলা দেবে ছেলেটির গুহার ভেতর স্যাঁতস্যাঁতে আঁধার আস্তানায়- এতটা প্রত্যাশা করিনি। ভাবি, তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আর না ঘাঁটিয়ে এখনই পজিটিভ কিছু বলে সমোঝতায় চলে আসা উচিত। আমি মৃদু হেসে তার দিকে তাকালে সে বলে, ‘কাম উইথ মি প্লিজ।’ আমরা কয়েক কদম হেঁটে এসে দাঁড়াই অসাধারণ চেহারার একটি উদ্ভিদের সামনে। আলোভেরা প্রজাতির এ প্ল্যান্টে স্পাইর‌্যাল হয়ে বৃত্তাকারে ক্রমাগত ঘুরানো পাতার রেখায় লেগে আসে কিছু শিশির বিন্দু। কয়েকটি ছোট্ট সান-বার্ড ধারালো ঠোঁটে ছিড়ে নিচ্ছে চিরল চিরল ফেসো, বোধ করি নীড় বাঁধবে। আমরা তাকাচ্ছি দেখে হেডমিসট্রেসকে দেখতে পাওয়া বালিকাদের মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে পালায় তারা। আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে নাকাতুলে এবার বলে, ‘রোগে ভুগতে ভুগতে শেষ কয়েক মাস মায়ের শরীরে তীব্র প্রদাহ হতো। কোন ওষুধবিসুদে জ্বালাপোড়ার হাত থেকে সে রেহাই পাচ্ছিল না। এক নাগানগার কাছ থেকে আমার দিদিমা জানতে পারেন যে, এ উদ্ভিদের নির্যাসে আছে উপশম। এ প্রজাতির আলোভেরা জন্মে শুধুমাত্র সেলাবাথেবের বিজন প্রান্তরে। বিষয়টা আমি অন্য এক রাখাল ছেলের মাধ্যমে তাকে জানালে দুদিন পর ডিমাকাটসো ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের বাসায় পৌঁছে দেয় এক ঝাঁকা আলোভেরার পাতা।’ নাকাতুলের বর্ণনার গভীরতা আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি আন্তরিকভাবে বলি, ‘আই আন্ডারস্ট্যান্ড ডিমাকাটসো ইজ অ্যা স্পেশাল বয় টু ইউ।’ সে ম্লান হেসে জবাব দেয়, ‘নট অনলি স্পেশাল, বাট অলসো অ্যান আমেজিং ওয়ান এ্যাজওয়েল। তার সবচেয়ে অ্যামেজিং ঘটনা হচ্ছে... ...কীভাবে বলবো, সো পেইনফুল অ্যান্ড পার্সোনাল.. ..। মায়ের মৃত্যুর পর যে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়, তা হচ্ছে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করা। সপ্তাহ দিনের মাঝে তা সম্পন্ন করতে না পারলে, তার আত্মা বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়িয়ে ছড়াবে তীব্র অশান্তি। অন্তেষ্ঠিক্রিয়ায় উৎসর্গ করতে হয় পশুর রক্ত ও মেদ। মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের অসুখের জন্য আমি পাফরমেন্স বন্ধ রেখেছি। তাতে আমার ইনকাম নেমে এসেছে জিরোতে। দিদিমা কিছুতেই অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার সব উপাচার সংকুলান করে উঠতে পারছেন না। বাবার কাছ সহায়তা প্রত্যাশা করেছিলাম; কিন্তু তিনি তো ফোন পর্যন্ত তুলেননি। দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। সকাল বেলা দেখি ডিমাকাটসো আমার জন্য ডিম্ফো নিয়ে এসেছ। সুসোটো ভাষায় ডিম্ফো শব্দের অর্থ হচ্ছে গিফ্ট। সে মায়ের শেষ আচারের জন্য নিয়ে এসেছে তিনটি নাধুস নুধুস ছাগল।’ নাকাতুলে চোখ নামিয়ে বোধ করি ইমোশনকে চাপে। তারপর বিষাদ মাখা চোখ তুলে আমার দিকে তাকালে আমি দুহাতে তার গন্ডদেশ আলতোভাবে চেপে দিয়ে বলি,‘ এ অভিজ্ঞতাগুলো তো তুমি অতিক্রম করে এসেছো। ট্রাই নট টু লুক ব্যাক এন্ড থিংক এবাউট দিস এগেইন। আমাদের সামনে আজ পড়ে আছে বেজায় অসমতল ট্রেইল। চলো আমরা বুনোপথে ঘাস ও পাথর মাড়িয়ে এগিয়ে যাই রক-আর্টের থানের দিকে।’

রক আর্টের থান ও রাখাল ছেলে

বুনো ট্রেইলটি কোমর সমান দীর্ঘ ঘাসের ভেতর চলে গেছে, যেন তেপান্তরের দিকে। রাখালদের টাট্টু ঘোড়া ছোটানোতে তৈরি হয়েছে এ পায়ে চলা পথ। মাটিতে প্রোথিত হয়ে আছে প্রচুর শীলা পাথর। তাই খাবার দাবার, কুলার, কম্বল, স্লিপিংব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক নিয়ে সাবধানে আগ বাড়তে হয়। পথে ছড়িয়ে আছে কাঁটাওয়ালা নিষ্পত্র কিছু ঝোপ। তাতে বার বার আটকে যায় জ্যাকেট। জিন্স ফুটো করে চামড়ায় খোঁচা দেয় সুঁচালো কন্টক। আর আমাদের চলাচল ছুটছাট কথাবার্তার তাড়নে ঘাসের ডগা থেকে লাফিয়ে ওঠে গ্রাসহপার নামের গোটা ছয়েক পাঅলা পতঙ্গ। এ কীটগুলো নির্ভয়ে এসে বসে জ্যাকেটের হাতা, পকেটের খাঁজ ও বোতামে। কুঁতকুঁতে চোখে তাকিয়ে শুড় নাড়ায়। ব্যাপক নাড়াচাড়া করে তাদের ঝেড়ে ফেলতে হয় জামাকাপড় থেকে। তাতে তেমন কোনো সুবিধা হয় না। নাছোড় বান্দা গ্রাসহপরাররা উড়ে এসে বসে কালো চশমার ফ্রেম বা ফেল্টহ্যাটের প্রান্তে।

সেলাবেথেবের একটি ব্যাপার হচ্ছে, কিছু সময় পর পরই বদলে যায় ল্যান্ডস্কেপ। সঙ্গে সঙ্গে উঠানামা করে তাপমাত্রা। আমরা গাছপালা ঘাসহীন এক প্রান্তরের কিনার ঘেষে হেঁটে যাচ্ছি। দূরে রাজকীয় মহিমা নিয়ে প্রতিবেশে রীতিমতো গাম্ভীর্য ছড়াচ্ছে পাথরের একটি আশ্চর্য ফর্মেশন। পাষাণের এ প্রাকৃতিক স্থাপত্যেকে দেখায় মিসরের পিরামিডের চত্ত্বরে হাজার বছর ধরে পড়ে থাকা স্ফিংসের মতো। যেন পিরামিড জামানার পাথরের সিংহটি লিসোটোতে সাফারী করতে এসে পথ হারিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেজায় বিভ্রান্ত হয়ে।

আমরা আরেকটি ট্রেইলে এসে ওঠি। কুকুরের ভুক ভুক শব্দে নির্জনতা চিড় খায়। খানিক হেঁটে যেতেই দেখতে পাই অল্প দূরে ছনে ছাওয়া পাথর দিয়ে তৈরি একটি কুটির। তার আঙ্গিনায় কুকুর সামলে দাঁড়িয়ে গায়ে কম্বল জড়ানো দুই রাখাল নওজোয়ান। তারা খুব ফ্রেন্ডলিভাবে হাত নেড়ে আমাদের বোধ করি শুভযাত্রা জানান। আমরা না থেমে সংকীর্ণ এক গিরিপথ ধরে নেমে আসি দুদিকে হাল্কা ঘাসে ছাওয়া বৃক্ষহীন পাহাড়ের দেয়াল দেওয়া এক উপত্যকায়। জায়গাটি একেবারে নির্জন না। চার পাঁচটি ছন-পাথরের গোলাকার কুটিরে বস্তির মতো। ঠিক বুঝতে পারি না, এখানে বসবাস করনেওয়ালারা কী পেশায় লিপ্ত আছেন? আমি হাঁটতে হাঁটতে বার বার বাইনোকুলারে চোখ রেখে স্ক্যান করি। বেশ দূরে কয়েকটি রক-পুল বা পাথর বাঁধানো পুকুর দুপুরের খর রোদে আয়নার মতো ঝলসাসে যেন। তার পাড়ে তাঁবু খাটানো। অনেক দূর ছোট ছোট তাঁবুগুলোকে দেখায় ঘাসে ছড়িয়ে শুকাতে দেওয়া টুপির মতো। আন্দাজ করি, সেলাবেথেবের প্রান্তরে আজ আরও কিছু মানুষ অভিযাত্রী হয়ে এসেছেন। তাদের তাড়া কিছু নেই, হাতে সময় নিয়ে এসেছেন লিসোটোতে। আপাতত তাঁবু খাটিয়ে উপভোগ করছেন বিপুল প্রান্তরের অসামান্য শূন্যতা।

একটি ত্রিভুজাকৃতি টিলার ওপারে আসতেই দেখি, খুঁটির উপর ত্রিপল খাটিয়ে ছাউনি করা হয়েছে। তাতে ক্যানভাসের ক্যাম্প-চেয়ার পেতে কারা যেন বসে আছেন। ছাউনির আঙিনায় ঘাস খাচ্ছে তাদের কয়েকটি টাট্টু ঘোড়া। কাছাকাছি আসতেই এদের একজন ডেকে ওঠেন, ‘নাকাতুলে, সুইট গার্ল, সো নাইস টু সি ইউ আর হিয়ার।’ আমরা তাদের হ্যালো বলতে থামি। সিগার কামড়ানো টাকপড়া যে সাহেব এসে নাকাতুলের দুগালে চাকুস চাকুস করে জোড়া চুমো খান, তিনি আমাদের অপরিচিত না। বুয়ার গোত্রের শ্বেতাঙ্গ এ ভদ্রসন্তানের নাম ম্যাথু উইগিল। গাত্রবর্ণে সাহেব হলেও, তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা লিসোটোতে। তিনি অনেক বছর হয় গুহাগাত্রে আঁকা চিত্র ও আগ্নেয়শীলার ওপর গবেষণা করছেন। উনি হামেশা মাসেরু শহরের গুড টাইম ক্যাফেতে সন্ধ্যাবেলা আসেন নাকাতুলের পারফরমেন্স দেখতে। নৃত্যে কোমরে বিশেষ রকমের দোদুল্যমানতা ছড়ালে, তিনি মাঝে মধ্যে টাকা পয়সা ছুড়ে দিয়ে সেনসেশনের সৃষ্টি করেন। 

উইগিল সাহেব আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন তার দুই সাথী পেশাদার পাখি পর্যবেক্ষক স্টুয়ার্ট ম্যাকলিন ও অত্র এলাকার বুনোফুল বিষয়ক গুরু এলাসা পৌলির সঙ্গে। এরা দুজনে কিছু দিন হলো পাশের দেশ সাউথ আফ্রিকা থেকে এখানে এসেছেন বিরল প্রজাতির পাখির ছবি ও বুনোফুলের নমুনা সংগ্রহ করতে। এদের আমি গুডটাইম ক্যাফেতে দেখেছি। কিছুটা মুখ চেনাচেনিও আছে। পরিচিত হতেই তাদের স্থানীয় সহিস ও পোর্টাররা আমাদের জন্য ক্যাম্প-চেয়ার পেতে দেয়। পরিবেশন করা হয় তপ্ত তিতকুটে কফি ও মাখনে চুবচুবে স্কৌন। গল্প করতে করতে দেখি, এলসা কাঁচি দিয়ে কেটে সংগ্রহ করা কিছু বুনোফুলের নমুনাকে কাচের কেইসে পিন দিয়ে আটকাচ্ছেন। এই মেমসাহেবের গ্রীবা, গন্ডদেশ ও নিরাবরণ বাহুতে রোদে পোড়া ফ্রেকোলের ফোটা ফোটা খয়েরি দাগ। তিনি শিস দিয়ে বেগুনি রঙের একটি ফুলের দিকে এমনভাবে চোখ মুখের ইশারা করেন, এমন আলতো করে তার পাপড়ি ছুঁয়ে দেন, যেন ফুলটিকে তিনি বিবেচনা করছেন পোষা পাখির মতো। মিঠে করে শিস কেটে তাকে উৎসাহিত করছেন বোল শেখাতে। আমার পাশেই বসেছেন পাথর ও রক-আর্টের যুগ্ম-এক্সপার্ট উইগিল সাহেব। তার পায়ের কাছে ছড়ানো বেশ কয়েকটি ছোট বড় পাথর। বুঝতে পারি, পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনে সাহেব এগুলো সংগ্রহ করেছেন। তিনি পাষাণের নিষ্প্রাণ খণ্ডগুলোর দিকে কাবুলিওয়ালার মতো এমন শ্যান দৃষ্টিতে তাকান যেন, এরা তার কাছে থেকে সুদে ঋণ নিয়ে এতদিন পালিয়ে ছিল। আজ বাছাধনদের তিনি পাকড়াও করতে পেরেছেন। তিনি সিসোটো ভাষায় নাকাতুলেকে পাথরের বৈশিষ্ট বর্ণনা করতে করতে বা হাতে তার কোমর পেচিয়ে আদরের সুচনা করেন। তিনি ফিস ফিস করে তাকে কিছু বলছেন। ঠিক বুঝতে পারি না, তার বচন পাথর সম্পর্কিত না-কি এতে প্রকাশ পাচ্ছে সোমত্থ নারীদেহের প্রতি স্রেফ অনুরাগ। পাখি পর্যবেক্ষণ বিষয়ক সাহেব স্টুয়ার্ট মেকলিনের সঙ্গে আমার খোশালাপ জমে ওঠে। তিনি কোনো কারণ ছাড়াই এক রকমের চাপা উল্লাসের ভেতর আছেন। তার চোখ দুটি চিনি শিরায় চুবে থাকা ছোট রসগুল্লার মতো গোলাকার ও তীব্র রকমের ফ্যাকাশে। জানতে চাই.‘মি. স্টুয়ার্ট, এ দিকে পাখি কোথায়, কী পর্যবেক্ষণ করছেন আপনি?’ যেন আমি গোপাল ভাড়ের একটি চুটকি শেয়ার করেছি এ রকম বেজায় মজা পেয়ে ফিকফিকিয়ে হেসে তিনি বলেন, ‘ম্যান, লুক কেয়ারফুলি, রাইট অন দি টপ অব দিস লিটিল ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার বুশ।’ তার ইশারা অনুসরণ করে দেখি, সত্যিই তো খুব দুর্বল চেহারার ছোট্ট হিলহিলে ফুল গাছের আগায় বসে কালোকুলো একটি পাখি। তার লেজটি এতোই লম্বা যে তা ছড়িয়ে আছে আরও দুটি লিকলিকে বুনোফুলের গাছের ডগায়। স্টুয়ার্ট সাহেবের উল্লাস চরমে পৌঁছায়। তিনি আমার কাঁধে চাটি মেরে বলেন, ‘দিস লং টেইল ব্ল্যাক বার্ডের স্থানীয় নাম হচ্ছে, সাকাবুলা পাখি। তার লেজের মাপ বিশ ইঞ্চির মতো। আমরা ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছি দেখে সাকাবুলা পাখিটি শরম পেয়ে উড়াল পাড়ে। ডানা প্রসারিত করতে আমি তাতে কমলালেবু রঙের কিছু উজ্জ্বল পালক দেখতে পাই। অন্যান্য ঝোপঝাড় থেকে বাতাসে ভাসে আরও কয়েকটি মাদি সাকাবুলা পাখি। মরদ তার আধ মিটার লম্বা লেজ কায়ক্লেশে বাতাসে ভাসিয়ে মাদিদের ফুর্তিতে চেইজ করছে। স্টুয়ার্ট সাহেব ফিস ফিস করে বলেন, ‘লিসেন, ইংরেজিতে এ পাখির নাম লং টেইল উইডো বার্ড। এর মাদি অনুরাগীর সংখ্যা দেখেছো, মোট সাতটি মেয়ে পাখির নেক নজর পাওয়ার জন্য বাতাসে খেলছে। ঠিক বুঝতে পারি না কোন মূর্খ এর নাম রেখেছে উইডো বার্ড। এ ব্যাটা তো দেখছি এখানে রীতিমতো বার্ড-হেরেম পুষছে।’ মি. স্টুয়ার্ট আমার দিকে তাকিয়ে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠেন ফিকফিকিয়ে।

কফি পান শেষ হতেই এরা ছাউনি গুটান। কৃষ্ণাঙ্গ স্থানীয় সহিস ও পোর্টাররা ত্রিপল ভাঁজ করে ক্যাম্প-চেয়ার ইত্যাদি ফোল্ড করে টাট্টু ঘোড়ার পিটে চাপায়। হাত-টাত মিলিয়ে ঘোড়ায় চেপে এরা রওয়ানা হন বিপরীত দিকে। পাখি, পাথর ও বুনোফুল খোঁজা দলটি যাচ্ছে স্ফিংসের মতো দেখতে রক ফর্মেশনের কাছে। ওখানে তারা বিচিত্র পাথুরে আকৃতির মাপঝোঁক করবে, স্লাইড তুলবে, তারপর ওর কাছাকাছি কোনো জায়গায় তাঁবু খাটাবে। গোধূলির সময় না-কি অদ্ভুত এ পাথরটির ওপর উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট্ট এক ধরনের পাখি। তারা চক্রাকারে উড়ে সন্ধ্যা অব্দি। কিছু পাখি নেমে পাথুরে সিংহটির পিটে বসে দারুণ কিচির মিচিরের গুলতানিতে মেতে ওঠে। এরা সঙ্গে করে ভিডিও ইক্যুইপমেন্ট বহন করছেন, বিষয়টি ফিল্মে ধারণ করবেন বলে।

তাকিয়ে ছিলাম টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের গিরিপথের দিকে মিলিয়ে যাওয়া কাফেলাটির দিকে। নাকাতুলে কাপড় চোপড় বদলানোর জন্য চলে গেছে বড় একটি রকের আড়ালে। এখন সে বোল্ডারের ওপর আয়না রেখে মেতেছে মেকাপে। সামান্য সময়ের ভেতর তার গন্ডদেশ ও কপাল ভরে ওঠে নীল রঙের বৃত্ত ও ধুসর ফোটায়। সে লেদার জ্যাকেট খুলে বুকে গিট্টি দিয়ে বেঁধেছে নকশা করা ছোট্ট একটি চাদর। এর নাম ‘স্লিয়ে ও বুতসো’-যার অনুবাদ হবে ‘খুলে রেখেছি কপাট।’ কোমরে সে ‘মহোলোবেলা’ বলে একটি কম্বল জড়িয়ে বোল্ডারের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রওয়ানা হওয়ার জন্য ইশারা দেয়। কাতেলেটসো ইতিমধ্যে অন্য একটি পাথরের আড়ালে জড়ো করে রেখেছে আমাদের ব্যাকপ্যাক, স্লিপিংব্যাগ, কুলার ইত্যাদি ভারী সামানাদি। আমাদের খানিকটা পথ হাঁটতে হবে। তাই ভারী গিয়ার বহন করার কোনো প্রয়োজন নেই। এ নির্জন উপত্যকায় এসব চুরি হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। কথা হয় যে- ফেরার পথে আমরা মালপত্র এখান থেকে তুলে নেবো। কম্বল জড়ানোতে নাকাতুলের চেহারায় এসেছে প্রচুর পরিবর্তন। তাকে দেখাচ্ছে লিসোটোর গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আদিবাসি বাসোটো মেয়েদের মতো। আমি পরিবর্তনটি নজর করি। মহালোবেলা নামের কম্বলটিতে আঁকা আছে অনেকগুলো যবের ছবি, যা নারীদেহে উর্বরতার প্রতীক। লিসোটো সংস্কৃতিতে প্রত্যেক আচার অনুষ্ঠানে পরার জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের কম্বল। ডিজাইনগুলো মূলত প্রতীক। প্রতীকগুলোর অর্থ আমি কয়েকদিন আগে তার কাছ থেকে শুনেছি। সুতরাং যবের চিত্র যে সম্ভাব্য সঙ্গমে সম্মতির প্রতীক, তা বুঝতে পারি। নাকাতুলে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বোধ করি আমার ভেতরে নীরবে ঘুরপাক করা ভাবনাটি বুঝতে পারে। তাই গ্রীবা বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকায়। সামান্য চোখাচুখি হতেই বুঝতে পারি, তার মুখে ছড়িয়ে পড়ছে মেঘে সূর্যাস্তের আভার মতো লজ্জার রক্তিম রেখা।

পথের পাশে টিলা কেটে ভেতরে সেঁদিয়ে গেছে পায়ে চলা ট্রেইল। তা ধরে খানিক ভেতরে ঢুকলেই পাওয়া যাবে রক-আর্টের থান। কথা হয় আমি ওখানে গুহাগাত্রে আদিম যুগে বুশম্যানদের আঁকা চিত্র দেখবো। এ সুযোগে নাকাতুলে ঘুরে আসবে তার রাখাল বন্ধু ডিমাকাটসোর আস্তানা। ডিমাকাটসোর জন্য সে মাসেরু শহর থেকে নিয়ে এসেছে চা, পটের দুধ, চিনি, পাউরুটি, বিস্কিট ও আরও কিছু খাবার-দাবার। কাতেলেটসো এ সব ক্যারি করে তার সঙ্গে যাবে। তো আমি একাই ট্রেইল ধরে রওয়ানা হই রক-আর্টের থানের দিকে। কয়েক পা সমানে যেতে নাকাতুলে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘লিসেন, জাস্ট ফর অ্যা ওয়ান সেকেন্ড।’ আমি দাঁড়াতেই সে কাছে এসে পার্স থেকে বের করে আমার হাতে দেয় দাখকার একটি ট্যবাকো মিশিয়ে রোল করা জয়েন্ট। তো রক-আর্টের থানে আমার একাকী সময় খারাপ কাটবে না ভেবে কব্জিতে চাপ দিয়ে আমি তাকে বলি,‘ও তাসামইয়ে হান্তে বা গুড জার্নি।’ জবাবে সে নিঃশব্দে হাসে, তাতে তার গালের টোল দুটি ভরে ওঠে ব্যাপক লাবণ্যে।

খানিক হেঁটে এসে আমি একাকী ঢুকে পড়ি রক-আর্টের গুহায়। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে একটু সময় লাগে। গুহাটি বেশ বড়, সহজে চলাচলের নিশানা পাই না। কেমন যেন স্যাঁতসে্যঁতে অনুভূতিতে গা শিরশির করে ওঠে। এক পা দু’পা করে সামনে বাড়ি। মনে হয় চার দিক থেকে লাল ঝিকমিকে ছোট ছোট চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পেন্সিল টর্চের আলো ফেলতেই সরসর করে আড়ালে চলে যায় ইঁদুরের মতো চারপেয়ে প্রাণী। নিঃসঙ্গতা গাঢ় হয়ে বুকে চেপে বসলে আমি সিসোটো ভাষায় আওয়াজ দেই ,‘লুমেলা বা হ্যালো’, প্রতিধ্বনিতে শব্দটি গমগমিয়ে ফিরে আসে আমার দিকে। অন্ধকারে পথ হাতড়ে আরও খানিকটা সামনে যেতেই আলোকিত হয়ে ওঠে পরিসর। দেখি পাথর ফেটে তৈরি হয়েছে একটি ফোঁকর। তা দিয়ে আলো এসে পড়েছে ছাদের ফিকে গোলাপি রঙের রকে। ওখানে আদি যুগে বুশম্যানদের আঁকা চিত্রটি পরিষ্কার দেখা যায়; কিন্তু বুঝতে পারি না লালচে রঙে আঁকা ছবির প্রাণীগুলো কি? তাদের পাশে দুটি মানুষের প্রতীকী ফিগারও দেখা যায়। বেশিক্ষণ চিত্রে নজর করা যায় না। ঘাড় ব্যথা করে ওঠে। তো আমি দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসার পাথরে ঠেস দিয়ে বসে পড়ে দাখকার জয়েন্টটি ধরাই।

এ পরিবেশ থেকে মনকে দূরে সরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাবি, ছোটবেলা আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশে ষাড়ের গজ পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা। অবচেতন থেকে পত্রপল্লব ছড়িয়ে বেরিয়ে আসে চাপালিশ গাছের বিপুল বিস্তার। তার ডালপালায় বসে কাকলি করছে শত খানেক সবুজ টিয়া। আমার পা দুটি ছড়া নদীর জল ডিঙিয়ে কাশবন ভেঙে ওপারে এসে উঠতেই রোদ আলোছায়া আঁকে টেউ খেলানো টিলার ঢালে। আমি স্মৃতির এ চিত্রপটকে আকড়ে ধরতে চাই; কিন্তু ফিল্ম ডেভেলপ করার মতো অবচেতনের আঁধার থেকে ওঠে আসে ভিন্ন এক ছবি। আমাকে দেখতে পাই হাসপাতালের টেবিলে সাদা চাদরের নিচে শোয়া। অনুভব করি, অপারেশন টেবিলের হিম শীতল বাতবরণ। কেটে যাচ্ছে অসংখ্য মুহূর্ত, মিনিট, ঘন্টার পর ঘন্টা। ডুবুরীর শরীর ছুঁয়ে যাওয়া মাছের মতো সময় যেন আমার পাঁজর, বাহু ও ধমনীর রক্ত প্রবাহ স্পর্শ করে বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাই একটি ঝুলন্ত বেলকনিতে বসে থাকতে। সামনের সড়ক দিয়ে লোকজন হাঁটছে, ঘোড়ার গাড়ির পাশে হর্ন বাজাচ্ছে মোটরকার। মানুষজনের পোশাক-আশাক দেখে মনে হয় তারা মিসরের লোক। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ভালো করে তাদের নজর করতে চাই; কিন্তু তীব্র ব্যথায় কঁকিয়ে উঠি। খানিক দূরে জড়ো করে রাখা জোড়া ক্র্যাচ। আমি হাত বাড়াই কিন্তু ওখানে পৌঁছতে পারি না।

সারা গুহায় গমগমিয়ে তারের বাজনা প্রতিধ্বনিত হলে আমার দিবাস্বপ্নের অবসান হয়। বিষয় কী? ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াই। বাজনা যেন আমার দিকে ধেয়ে এসে ধ্বনির বিপুল তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে গুহার ছোটবড় কন্দরে। দ্রুত হেঁটে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। আধো অন্ধকারে পকেট হাতড়েও খুঁজে পাই না পেন্সিল টর্চ। কঁতুকুঁতে লালচুখো লোমশ প্রাণীগুলো লাফিয়ে আামর পা ছুঁয়ে ছুটে যাচ্ছে দিগ্বিদিক। পাথরে হোঁচট খাই। কপালের চন্নায় বাড়ি লাগে। দাঁড়িয়ে পড়তেই কার যেন হিমেল হাত আমার বাহু স্পর্শ করে। কাছে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হতেই আমি ম্যাচকাটি জ্বালাই। দেয়ালের পাশ থেকে কিচকিচ শব্দে ছোট্ট লোমশ প্রাণীগুলো প্রতিবাদ জানায়। তখন আমি নাকাতুলের খিলখিলে হাসির শব্দ শুনি। টানেলের শেষ দিকে আলোর মৃদু ইশারা নজর করে হাঁটি। উদ্বেগের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখনই কপালগুনে এসে পৌঁছি গুহার মুখে।

বাইরে এসে দেখি, খানিক দূরে একটি গাছের গোড়ায় মুখ ভোঁতা করে বসে আসে কাতেলেটসো। সে হাতের ইশারায় আমাকে কী যেন দেখায়। ওদিকে নজর করে দেখি, গুহার অন্য একটি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে রাখাল যুবক ডিমাকাটসোর সঙ্গে নাকাতুলে। গুহাতে ঢুকার জন্য অন্যদিকে যে আরেকটি পথ আছে আগে তা খেয়াল করিনি। নাকাতুলে কাছে এসে আমাকে ডিমাকাটসোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। গায়ে কম্বল জড়ানো তরুণটি কাঠের টুকরায় তার বেঁধে তৈরি করেছে তার গিটার। বাদ্যযন্ত্রটির গোড়ায় জারিক্যান বাঁধা তাই টিউন তুলতে তা থেকে ছড়ায় প্রতিধ্বনির বোল। কথা-বার্তায় তরুণটিকে আমার খুব ভালো লাগে। সেলাবাথেবের নির্জন উপত্যকায় সে একাকী বাস করছে। তার তত্ত্বাবধানে আছে ষাটটি গরু ও শতাধিক ছাগল। একটি টাট্টুঘোড়া ও দুটি কুকুর নিয়ে সে গবাদিপশুর তত্ত্ব তালাবি করে। এগুলোর মালিক সে নিজে না। তবে এ পশু পালের সঙ্গে তার নিজেরও কয়েকটি ছাগল আছে। ছাগলগুলো সংখ্যায় বাড়ছে।

ডিমাকাটসো আমাকে গিটার বাজিয়ে শোনায়। নাকাতুলে ছোট্ট একটি টেপ রেকর্ডার বের করে তার বাদন রেকর্ড করতে করতে বলে, ধবল শ্বেতীগ্রস্ত মানুষদের কষ্টের বর্ণনা দিয়ে সে যে পালা বাঁধছে, তাতে এ টিউনের স্ট্রাকচার ব্যবহার করা যাবে। আমি জানি, নাকাতুলে এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। গানের কথাগুলো কম্পোজ করা হয়ে গেছে। সুরে-লয়ে বাঁধতে পারলে সে তা পারফর্ম করতে পারবে। ভাবছে, তৈরি করাবে একটি শ্বেতীগ্রস্ত মানুষের মুখোশ, যা পরে সে স্টেজে নামবে। বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। এ পালা স্টেজে নামাতে পারলে সামান্য হলেও শ্রোতাদের মাঝে ছড়াবে সংবেদনশীলতা; কিন্তু একটি চ্যালেঞ্জের কিছুতেই সুরাহা করা যাচ্ছে না। লিসোটোর সামজে আছে শ্বেতীগ্রস্ত মানুষদের নিয়ে তীব্র সংস্কার। যে ক্যাফের স্টেজে নাকাতুলে ফি সন্ধ্যায় নৃত্যগীতে কবিতার পালা উপস্থাপন করে থাকে, ওখানকার মালিক কিন্তু এসব বিষয়ে সম্মতি দিচ্ছে না। তার ধারণা পালায় শ্বেতীগ্রস্ত মানুষদের প্রসঙ্গ চলে আসলে তা দর্শক শ্রোতারা পছন্দ করবে না। বিষয়টি অপয়া মনে করে তারা ক্যাফেতে আসা বন্ধ করে দেবে। নাকাতুলে কী এ পালা স্টেজ করার জন্য খুঁজে পাবে অন্য কোনো মঞ্চ বা লিবারেল একটি প্রতিষ্ঠান?

ডিমাকাটসো ক্রমাগত বাজিয়ে যাচ্ছে। তার বাদনে আছে এক ধরনের হন্টেড কোয়ালিটি। নিশিডাকে পাওয়া বিভ্রান্ত মানুষের মতো তা যেন ঘুরে ফেরে বিপুল এক প্রান্তরে। শুনতে শুনতে সুর বাঁক নেয়। এবার থেমে থেমে ভেঙে ভেঙে আকুল আবেদনের মতো ছড়াচ্ছে আর্তি। বুঝতে পারি, সুরপ্রবাহের এ অংশে হয়তো নাকাতুলে সংযোজন করবে তার পালা গানের কথা। ডিমাকাটসো গিটার বাজানো থামিয়ে আমার সম্পর্কে প্রচুর কৌতূহল দেখায়। আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য সে নিয়ে এসেছে ছাগলের কোঁকড়ানো একটি শিং। যে সব মেয়েদের সঙ্গে আমি হালফিল অন্তরঙ্গ হয়েছি, তাদের বয়ফ্রেন্ডরা সুযোগ মতো আমাকে শায়েস্তা করার বাসনা প্রকাশ করেছে। বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে ডিমাকাটসো এক বিরল ব্যতিক্রম। ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লাগে। বলি, পরের বার সেলাবাথেবেতে আসলে তোমার কুটিরে এক রাত কাটাব। গরুগুলো আমি কাছ থেকে দেখতে চাই। সে খুশি হয়ে হাল্কা আরেকটি টিউন বাজিয়ে শোনায়। এ দিকে বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে, তাই আমার অধৈর্য্য লাগে। তো তাকে হার্সির মিল্ক চকোলেটের একটি বার উপহার দিয়ে সিনিওর সার্ভিসের প্যাকেট থেকে এক শলা সিগারেট বের করে তাতে আগুন দেই। ছেলেটি একটি সিগারেট চায়। আমি পুরা প্যাকেট দিতে চাইলে নাকাতুলে প্যাকেট থেকে বের করে গুনে পাঁচ শলা সিগারেট টিস্যু পেপারে জড়িয়ে ডিমাকাটসোর হাতে দেয়। কেবলমাত্র দুটি কুকুরের জিম্মায় এতোগুলো গরু, ছাগল রেখে এসেছে তাই ডিমাকাটসো বিদায় নেয়। আর আমরাও ফেরার পথে পা বাড়াই।

সূর্য দিগন্তের ঠিক কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ত্রি বুশম্যান মাউন্টেনের শিয়রে নেমে এসেছে। ওখানে সারা বিকাল ধরে জমে ছিল থোকা থোকা গোলাপি আভা ছড়ানো মেঘদল। এখন তাতে লাগছে কমলালেবু রঙের পরশ। ঘাসপাতায় লুকিয়ে থাকা অজস্র পতঙ্গ অকারণে ডেকে যাচ্ছে সর্বত্র। লাঞ্চ করা হয়নি বলে খিদা পেয়েছে প্রচুর; কিন্তু থেমে এখন সময় নষ্ট করার কোনো উপায় নেই। তাই হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঔটমিলে বাদাম কিসমিস দেওয়া পওয়ার বার চিবাই। কেতেলেটসো কিশোর বয়সে সেলাবাথেবে উপত্যকায় রাখাল হিসেবে গবাধিপশু পালন করেছে পাক্কা চার বছর। এখানকার পথঘাট, গুহা জলাশয় তাবৎ কিছু তার ভালো করে চেনা। যারা তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করতে ভালোবাসে এ রকম শ্বেতাঙ্গ পর্যটকদের সে মাঝে মাঝে তার ফোর হুইল জিপে চড়িয়ে এখানে নিয়ে আসে। দুর্গম উপত্যকায় ড্রাইভিং ছাড়াও তার ট্যুরগাইড হিসেবেও সুনাম আছে।

রাতে ফেরা যাবে না, বিষয়টা জানি বলে প্রস্তুতি হিসেবে আমরা ট্রেকিং কোম্পানীর কাছ থেকে ভাড়া করা কম্বল, স্লিপিংব্যাগ ও খাবার দাবার ক্যারি করছি। সমস্ত চরাচর এখন ছেয়ে যাচ্ছে মিহি কুয়াশায়। ঘাসে পাতায় জমছে বিন্দু বিন্দু শিশির। তাতে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে জোনাকি পোকার মতো জ্বলছে ঝিকমিকিয়ে। ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর কেতেলেটসো আমাদের নিয়ে আসে একটি কেইভ শেল্টারে। আগ্নেয়শিলার ছত্রীর তলায় একটি আদিম গুহার সম্মুখভাগে পাথরের দেয়াল তুলে রাখালরা তৈরি করে এ শেল্টার। অত্যধিক গোচানের ফলে এ দিককার গ্রাসল্যান্ড নিষ্ফলা হয়ে পড়ে। তখন রাখালরা এ ধরনের গুহা-কুটির ফেলে রেখে খানিক উজিয়ে গিয়ে ত্রি বুশম্যান মাউন্টেনের উল্টাদিকে সবুজাভ প্রান্তরে ডেরা বেঁধেছে। বর্তমানে পর্যটকরা রাত্রিকালীন শেল্টারের জন্য ব্যবহার করে থাকে এ গুহা-কুটিরটি।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, তাই কেতেলেটসো গুহার পাথুরে চাতালে ঝাড়পোছ শুরু করে। চাতালটি সমতল, তাতে স্লিপিংব্যাগ পেতে এক্সট্রা কম্বল জড়িয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে সারারাত। নাকাতুলে হ্যারিকেনের তেল ও সলতে চেক করে। কেতেলেটসো পাম্প দিয়ে গুহা-কুটিরের চারদিকে স্প্রে করছে কীটনাশক। অবশেষে কাঠ কুড়িয়ে সে আয়োজন করে ক্যাম্প-ফায়ারের। আমরা সঙ্গে করে গোটা কয়েক স্মোক করা ট্রাউট মাছ নিয়ে এসেছি। কুলারে রাখা আছে লেবানীজ ব্র্যাড, ও ফ্রোজেন কিছু ফ্রুটস্। ডিনারের জন্য দুর্ভাবনা করতে হবে না। তাই আমি গুহা-কুটিরের আশপাশে একটু হাঁটাচলা করি। প্রগাঢ় বিচ্ছিন্নতাবোধের সঙ্গে তীব্র নির্জনতা ঝিঁঝি পোকার মতো করোটিতে গুঞ্জন করে ওঠে। গুহা-কুটিরের পেছনে আসতেই অসাধারণ একটি দৃশপট আমার মনকে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে যায়। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ত্রি বুশম্যান মাউন্টেনের পরষ্পরের সঙ্গে সংযুক্ত তিনটি পাহাড়। চরাচরের সর্বত্র সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও, বেলাশেষের তাবৎ সৌররাশ্মি লালচে আভায় জ্বলছে পর্বত শ্রেণির শিখর ও ঢালে। সামনের নীলাভ সরোবরে ভাসছে স্পষ্ট প্রতিবিম্ব। দেখতে দেখতে এ অসামান্য আলোছায়া মুছে সরোবর ও পাহাড়ের ঢাল আবছা হয়ে আসে। আমি আলোর অত্যন্ত ক্ষণকালীন দিব্য প্রদর্শনীর দিকে তাকিয়ে ভাবি- আজ আমার শরীরে আছে পর্যটনের যে উদ্যম, মনে আছে ভিন্ন সংস্কৃতির নারী ও পুরুষের সঙ্গে যোগাযোগের যে স্পৃহা, ত্রি বুশ মাউন্টেন থেকে মিটে যাওয়া বর্ণালীর মতো, তাও মুছে যাবে কিছু দিন পর। তারপর... ..রক-আর্টের থানে অনুভব করা দিবাস্বপ্নের ইমেজ মনে ফিরে আসে। তবে কী আদিম মানুষের আঁকাজোকার হাজার বছরের পুরনো পিটে দাঁড়িয়ে আমি চাক্ষুষ করেছি আমার ভবিষ্যৎ?

গুহা-কুটির থেকে বেরিয়ে এসে আমার কাছাকাছি দাঁড়ায় নাকাতুলে। সে আগের মতো চটুল ভঙিতে আমার সম্পূর্ণ বাহু জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,‘আই উড লাইক টু টেল ইউ সামথিং।’ আমি জবাব দেই, ‘ওকে, গো এহেড। কী বলতে চাও? বলে ফেলো।’ সে ফিচেল হেসে বলে, ‘থাক আজকে না হয় নাই বলালাম।’ আমি তাতে ভ্রুকুটি করে বিরক্তি প্রকাশ করলে সে, ‘কামঅন’ বলে উষ্ণ-হাগে জড়িয়ে ধরে। তার শরীর থেকে ছড়ায় খড়ের গাদা ও গবাদিপশুর গাঢ় গন্ধ। সে ফিসফিস করে বলে, ‘কে আ ও রাতা।’ সিসোটো ভাষার এ বাক্যটি আমি তার কাছ থেকে শিখেছি, যার অনুবাদ, ‘আই লাভ ইউ।’ শুনতে তা ভালো লাগে বটে, তবে আমি বিশ্বাস করি না একবিন্দু। সে ‘ট্রুলি, আমি মিন রিয়েলি অনেস্টলি’, বলে আরও কাছে আসলে, আমি প্রতিদানে পজিটিভ হতে পারি না। কেতেলেটসো ক্যাম্প ফায়ারের আগুন জ্বালিয়ে কম্বল পেতে দিয়েছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কনকনে ঠান্ডার অনুভূতি। ভাবি- এবার আগুনের আঁচে জাঁকিয়ে বসে দেখতে হয় রাতের আকাশ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //