কিউবা : বিপ্লবীদের দেশে

ছোটবেলা থেকেই চে ও ক্যাস্ট্রোর সশস্ত্র বিপ্লব আমাকে উজ্জীবিত করেছে, শানিত করেছে। কিউবা আমার স্বপ্নের দেশ; আমার কাছে কিউবা যাওয়া মানে কেবল ক্যারিবিয়ান দ্বীপের সৌন্দর্য অথবা স্প্যানিশ সংস্কৃতি দেখা নয়, আমার দেখার আগ্রহ ছিল একটি সোশ্যালিস্ট সমাজ ব্যবস্থা।

বাড়ির সবাই মিলে বড়দিনের ছুটিতে কিউবা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মনে হয়েছিল আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। অবশেষে কানাডার টরন্টো থেকে প্লেনে কিউবার পথে রওনা দিয়ে আমরা পৌঁছলাম ভারাদেরো শহরে। আটলান্টিক মহাসাগরের পাশ দিয়ে ২০ কিলোমিটার জুড়ে এই শহরকে বলা হয় হোটেল আর রিসোর্টের নগরী। এ শহর থেকেই গাইডেড বাসে করে ট্যুরিস্টদের অন্য শহরগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়, এই ব্যবস্থাপনা সত্যিই প্রশংসনীয়। আর বলতেই হয় কিউবা খুবই নিরাপদ দেশ এবং মানুষজনও ভীষণ সৎ। তারা জানেন যে পর্যটকনির্ভর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে পর্যটন শিল্পের প্রতি হতে হবে নিষ্ঠাবান। কিউবার অভিজ্ঞতা বলার আগে দেশটার একটু পরিচয় দেওয়া যাক। উত্তর ক্যারিবিয়ান সাগর, মেক্সিকো উপসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে ১০৯,৮৮৪ কিলোমিটারের এই দ্বীপ দেশটির অবস্থান। দেশটির জনসংখ্যার বেশিরভাগই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে এবং দ্বীপদেশ বলে সারা বছরেই আবহাওয়া উষ্ণ থাকে।

রেভ্যুলেশনারি স্কয়ার, হাভানা


যা-ই হোক প্রথম দিনেই আমরা ট্যুরিস্ট গাইডকে বলেছিলাম, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সমাধিতে যেতে চাই। জানতে পারলাম সান্তিয়াগো শহরটি অনেক দূরে আর সেখানে যেতে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। আরও জানতে পারলাম ফিদেল মারা যাওয়ার আগে তার নামে কোনো স্ট্যাচু তৈরি করতে ও কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করতে মানা করে গিয়েছিলেন। মনটা একটু খারাপ হলেও চে গুয়েভারার মেমোরিয়াল দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়েছিলাম। কিউবার সশস্ত্র বিপ্লবের সময় চের নেতৃত্বে শান্তা ক্লারা শহরটি প্রথম স্বাধীন হয়। আর এই শহরেই রয়েছে চে গুয়েভারা মিউজিয়াম, রেভ্যুলেশনারি স্কয়ার, চের বিশাল স্ট্যাচু, রাস্তায় রাস্তায় চের ছবি, আর দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের স্লোগান লেখা। এই শহরে এসে মনে হচ্ছিল আমি যেন গল্পে শোনা অভ্যুত্থানকে চোখে দেখতে পাচ্ছি। কিউবা বিপ্লবের পরে চে বলিভিয়ার মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিতে গেলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তাকে হত্যা করে। বহু বছর পর বলিভিয়া সরকার চের দেহের কিছু অংশ (কবজি) কিউবাকে হস্তান্তর করে। মিউজিয়ামে চের বিভিন্ন ছবি, চিঠি, পিস্তল, চুরুট, জামাসহ ব্যবহৃত জিনিসগুলো ঘুরে দেখছিলাম। এসব দেখতে দেখতে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম যে  কান্না আটকে রাখতে পারিনি।

আমাদের এর পরের গন্তব্য ছিল হাভানা। পথে ট্যুরিস্ট গাইড কিউবার ইতিহাস, সরকারের জনহিতকর নীতি সম্পর্কে বলতে থাকেন। হাভানা শহরকে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন বলা যেতে পারে। কিউবার অধিবাসীরা খুব প্রাণবন্ত বলে পথের ধারে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেল- কেউ গান গাচ্ছে, কেউবা গানের তালে নাচছে। ঘুরে দেখলাম রেভ্যুলেশনারি স্কয়ার, যেখানে ফিদেল লাখো মানুষের জনসভায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিতেন। হাভানায় নোবেল জয়ী সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাড়ি দেখতে যাওয়ার মতো সময় আমাদের ছিল না, তবে যেখানে তিনি জীবনের প্রথম দিনগুলোতে থাকতেন সেই হোটেলে আমাদের যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। 

হাভানার পর আমরা জিপে করে কিউবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরতে যাই। সেখানকার আদিবাসীদের জীবন ও কিউবার গ্রামীণ কৃষিজীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়।


গভীর সমুদ্রে বেড়াতে না গেলে কিউবা বেড়ানো যেন অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ছোট জাহাজে করে গভীর সমুদ্রে গিয়ে ডলফিনের সঙ্গে সাঁতার কাটা ও স্কুবা ডাইভিং করা যায়। কিউবার সমুদ্র ছাড়াও একটি অদ্ভুত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে, তা হলো Cueva de Saturno বা Saturn Cave। মাটি থেকে অনেক নিচে গুহার অভ্যন্তরে স্বচ্ছ পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ। 

প্রথমে গুহার ভেতরে ঢুকতে আমার একটু ভয় লাগছিল। প্রায় অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে অনেক নিচে নেমে যেতে হয়। কল্পনাও করতে পারিনি যে গুহার ভেতরে অদ্ভুত সুন্দর স্বচ্ছ পানিতে ভ্রমণকারীরা সাঁতার কাটছেন। আমরাও পানিতে নেমে পড়লাম। কিউবানরা নিজেদের দেশ গড়তে আত্মপ্রত্যয়ী এক জাতি, তারা তাদের সংগ্রামের ইতিহাস নিয়েও খুবই গর্বিত। কিউবা ভ্রমণ আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ভ্রমণ হয়ে থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //