মেঘালয়ের তুরা পাহাড় থেকে বাংলাদেশ দেখা

বাংলাদেশের সিলেট জেলা থেকে যেমন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় দেখা যায়। তেমনি শেরপুর জেলা থেকে মেঘালয়ের তুরা পাহাড় দেখা যায়। আকাশ যদি মেঘমুক্ত থাকে তবে বিকেলের দিকে শেরপুর জেলা শহরের উঁচু ভবন এবং শহরের বাইরে গ্রামের খোলা প্রান্তর থেকে তেমনি স্পষ্ট তুরা পাহাড় দেখা যায়। তবে সীমান্তের কাছাকাছি গেলে আরও পরিষ্কার ভাবে তুরা পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।

মেঘালয় রাজ্যের দক্ষিণ গারো পাহাড় জেলার সদর দপ্তর তুরা শহরটি মূলত বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার নাঁকুগাও স্থল বন্দর ও ইমিগ্রেশন পয়েন্ট এবং ভারতের ঢালু সীমান্ত থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। পুরো শহরটি গড়ে উঠেছে মূলত গারো পাহাড়ের প্রায় ১২শত ফিট উপরে। তবে শহরের চেয়েও আরও প্রায় দুই হাজার ফিট উঁচু পাহাড় রয়েছে দক্ষিণ গারো পাহাড় জেলায়। এসবের মধ্যে একটিতে সম্প্রতি ‘সানসেট ভিউ’ নাম দিয়ে পর্যটকদের সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ করে দিয়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন। সেখানে প্রবেশ মূল ধারা হয়েছে জনপ্রতি ৪০ রুপি।

ওই সানসেট ভিউটি দারিচিকগ্রী পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছে। যেটি তুরা এলাকার সর্বোচ্চ উঁচু পাহাড়। বর্তমানে ওই পাহাড়ে উঠার জন্য আঁকাবাঁকা সড়কটি পাকা করণ করা হয়েছে। ফলে খুব সহজে ওই সানসেট ভিউ পয়েন্টে ওঠা যায়। কিন্তু গত এক বছর আগেও ওখানে বাইকাররা ছাড়া সহজেই কেউ যেতে পরতো না। রাস্তা ছিলো ভাঙ্গাচোড়া আর এবড়োখেবড়ো। স্থানীয় প্রশাসন তুরার পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি একটু সজাগ হয়েছে। ফলে সানসেট ভিউসহ অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোতেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেতে শুরু করেছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী মারপি এম মারাক জানান, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা আমাদের এই এলাকার বাসিন্দা। তিনি এনপিপি পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি তুরার কাছাকাছি। অর্থাৎ পশ্চিম গারো পাহাড় জেলায়। তার মানে বাংলাদেশের শেরপুর জেলার উত্তর সীমান্ত বরাবর গ্রাম আমপাতি নগর পাড়া এলাকায়। যে কারণে পশ্চিম মেঘালয়ে বেশ কাজ হচ্ছে।

‘সানসেট ভিউ’ এর মূল স্থানে আগত পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার বা বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে একটি ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় শেষে দিকে। এর আগে এখানে যারা বেড়াতে আসতো তারা অনেক কষ্ট করে উপরে উঠে কোনো রকমে সূর্যাস্ত দেখে দ্রুত ফিরে যেতো। বর্তমানে ওই ভবন নির্মাণসহ স্পটটির আরও বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ চলছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। তবে বর্তমানে মনের মাধুরি মিশিয়ে পড়ন্ত বিকেলে কাঠ এবং সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চে বসে সূর্য ডোবা দেখতে পাবেন। তবে সূর্য ডোবা দৃশ্য দেখা সবার কপালে জোটে না। আকাশে মেঘ থাকলে আশা ভঙ্গ হবে। আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে সমুদ্র সৈকতের মতোই অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্ত দেখা মিলবে তুরা শহরের অদূরে দারিচিকগ্রী ‘সানসেট ভিউ’ পয়েন্টে। এখানে সূর্যাস্তের পাশাপাশি বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য বাড়তি পাওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ দেখা। বিশেষ করে শেরপুর-হালুয়াঘাট সীমান্ত গ্রাম দেখা যায় ওই পাহাড় থেকে। তবে আকাশ থাকতে হবে সম্পূর্ণ পরিষ্কার।

স্থানীয়রা জানায়, বর্ষা ও শীত মৌসুমে মেঘ ও কুয়াশার জন্য সূর্যাস্ত এবং বাংলাদেশ ভিউ পরিষ্কার না দেখা গেলেও শরৎকালে মোটামুটি পরিষ্কার আকাশে এসব দেখা যায়।

তুরা শহর থেকে দারিচিকগ্রী পাহাড়ের ‘সানসেট ভিউ’ স্পটের দূরত্ব মাত্র ১৬ কিলোমিটার। তবে ওখানে উঠার রাস্তাটি অনেক খাঁড়া থাকায় সব মডেলের কার বা জীপ উঠতে পারবে না। আমরা বৃষ্টির সময় ওই সানসেট দেখতে যাওয়ায় মেঘের কারণে ওই দিন আর সূর্যাস্ত দেখতে পেলাম না। তবে সানসেট স্পটের বেঞ্চে বসে কথা হয়েছে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ভেসে বেড়ানো মেঘের সাথে। দূর পাহাড়ের অচেনা পাখপাখালির সুরে বিমোহিত হয়েছি। ক্ষণিকের জন্য মেঘের উপর ভেসে বেড়িয়েছি। তবে মাঝে মধ্যে মেঘের ফাঁকে সূর্যের দেখা মিললেও ক্ষণিক পরেই আবারও তা ঢেকে যাচ্ছিলো। এদিকে বৃষ্টির প্রভাব বেড়ে যাচ্ছিলো। তাই সূর্যাস্ত দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে সন্ধ্যার একটু আগেভাগেই আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবশেষে সূর্যাস্ত না দেখতে পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে তুরা শহরের উদ্দেশে রওনা হই। এসময় সেই সূর্যাস্ত না দেখার কিছুটা হলেও সার্থকতা পাই ‘সানসেট ভিউ’ টিলা থেকে নামার সময় যখন মেঘ এসে আমাদের ঘিরে ফেলে।

আমাদের গাড়ীসহ কুয়াশার মধ্যে জেনো ঢুকে পড়ি আমরা। এ দৃশ্য দেখে আমি কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থেকে নেমে হাত দিয়ে মেঘ ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের গাইড তখন বলেন, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে এখানে অবস্থান করা ঠিক হবে না, যেকোনো সময় ভারী বৃষ্টিও নেমে পড়তে পারে।’ গাইডের এ কথা শুনে তাই দ্রুত আবারও গাড়িতে উঠে বসি। আর জানালার কাঁচ দিয়ে দেখি মেঘেদের ছুটাছুটি। ঘন কুয়াসা ভেদ করে সামনে থেকে অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বিমুখ মনে কিছু একটা ভাবতেই হঠাৎ আবার দিনের আলোর ঝলকানি দেখে চমকে যাই। আসলে আমরা মেঘ থেকে আরও অনেক নিচে নেমে আসায় সাঁজ বেলার শেষ রোদ্দুরের ঝিলিক দেখে মনটা ভরে গেলে। আমরা তখন মনের ভিতর সেই সোনালী রোদের ঝিলিক নিয়ে ফিরে গেলাম তুরা শহরের হোটেলে। 

লেখক: রফিক মজিদ, সাংবাদিক ও কবি, শেরপুর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //