সোয়া ৫শ বছরের পুরোনো ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার নবগঠিত গোমতী জেলার অন্তর্গত উদয়পুর এ প্রায় সোয়া ৫শত বছরের পুরোনা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরটি আজো কালের সাক্ষী হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ ওই স্থানটিকে মাতাবাড়ির বলেন। মন্দিরের দেবী প্রতিমাটি কষ্টি পাথরে নির্মিত। দেবীর মূর্তি উচ্চতায় এক মিটার ৫৭ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থ ৬১ সেন্টিমিটার। 

ইতিহাস সূত্রে জানাযায়, ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার তৎকালীন ১৪৫তম মহারাজা ধন্যমানিক্য এই ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে ত্রিপুরেশ্বরীকে ত্রিপুরাসুন্দরী নামেও উল্লেখ আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজারানি’ উপন্যাসে মহারাজ গোবিন্দ মানিক্যের সময়ে পুরোহিত রঘুপতি, সেবাইত জয়সিংহসহ এই মন্দিরে পশুবলি নিষিদ্ধ করার অনেক কাহিনী বর্ণিত আছে। মহারাজার পালিত শিশুর মুখে ‘এত রক্ত কেন?’ কথাটা বাঙালি পাঠকমাত্রকেই আজো নাড়া দেয়।

১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই সময় ত্রিপুরার রানী কাঞ্চন প্রভাদেবীর অন্যতম শর্ত ছিলো কয়েকটি মন্দিরের পরিচালনার ভার সরকারকে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার শর্তে রাজি হয়। এরপরই রাজ্য সরকার ত্রিপুরেশ্বরী বা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। পদাধিকারবলে মন্দিরের সেবায়েত হন গোমতী জেলার জেলাশাসক। ২০১৮ সালের নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর মাতাবাড়ি মন্দির পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করে রাজ্য সরকার। সরকার পরিচালিত মন্দিরের সমস্ত কাজ হলেও রাজপরিবারের বর্তমান প্রতিনিধি প্রদ্যুৎ কিশোর দেব বর্মনের নামে পুজোর অর্ঘ্য আহ্বান করা হয়।

ইতিহাস মতে, দেবী সতী দক্ষ রাজার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন দক্ষ রাজা। যজ্ঞের আগুনে আত্মঘাতী হন সতী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন মহাদেব। পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভয়ে ভগবান বিষ্ণু প্রলয় থামাতে, সুদর্শন চক্র পাঠিয়ে দেন। এতে দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পড়ে। এই সব কটি জায়গাকে সতীপীঠ বলা হয়। ধারনা করা হয় সতীর ডান পা এখানে পতিত হয়েছিলো। সতীর ৫১ পীঠ হিন্দু ধর্মে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গাগুলি প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পবিত্রের জায়গা। বিভিন্ন জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ৫১ পীঠ। ভারতবর্ষ-সহ বাংলাদেশ,পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় আজও এই ৫১টি পীঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

প্রতিটি মন্দিরের কোনো না কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। আর সেই নিয়ম মেনে ভক্তরা মায়ের পূজা করে থাকেন। এই মন্দিরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। প্রতিদিন ভোর ৪টায় দেবী মায়ের মঙ্গল আরতি ও ভোগ নিবেদন করা হয়। এরপরে সকাল ৮টায় শুরু হয় দেবীর স্নানকার্য। তার পরে পরেই সকাল সাড়ে ৯টায় বলি দিয়ে মায়ের পূজা শুরু হয়।

সন্ধ্যে ৭টায় মায়ের সন্ধ্যা আরতি শুরু হয় এবং রাতের বেলা সাড়ে ৯টার আবার মায়ের ভোগ নিবেদন এবং মায়ের নিদ্রা সম্পন্ন হয়। তবে এই মন্দিরে বলির সময় মায়ের সঙ্গিনী ডাকিনী-যোগিনীদের উদ্দেশ্যে সেটি উৎসর্গ করা হয়। এই বলির কিছু অংশ কল্যাণ সাগরের কচ্ছপ, সরীসৃপ এবং মাছদের দেওয়া হয়।

মন্দিরের সামনের দিকে প্রায় সাড়ে ৬ একর জমি জুড়ে একটি পুকুর বা একটি দীঘি রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে তা কল্যাণ সাগর হিসেবেই পরিচিত। সাগরের জলে বিভিন্ন জলজ প্রাণীসহ মাছ এবং কচ্ছপ রয়েছে। পূণ্যার্থীরা পূণ্য অর্জন করার জন্য এখানে এসে ভিড় জমান, এই সমস্ত জলজ প্রাণীদের কে বিস্কুট, মুড়িসহ অন্যান্য খাদ্য খাইয়ে থাকেন তাদের ইচ্ছা অনুসারে। জনশ্রুতি আছে: ‘নিশুতি রাতে বৃহদাকার কচ্ছপগুলো মন্দিরের চাতালে উঠে এসে মাতার মন্দির ঘিরে রাখে!’

এই মন্দির প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখলে বোঝা যায় যে, পুন্যার্থীরা মোমবাতি, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে দেবীকে স্মরণ করেন। আর অনেক পুণ্যার্থীকে পূজা অর্চনায় মগ্ন থাকলে দেখা যায়। আবার অনেকেই পুণ্য লাভের আশায় মন্দিরের ঘর ঘিরে দণ্ডী কাটতে থাকেন। বহু মানুষ এমন তীর্থস্থানে ঘুরে নিজেদের মনের ইচ্ছা দেবীকে জানিয়ে থাকেন। আপনিও চাইলে খুবই সহজেই এমন শক্তিপীঠ অথবা সতি পীঠ থেকে ঘুরে আসতে পারেন। মন্দিরের মনোরম সৌন্দর্য আর চারিদিকের সুন্দর পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ তো করবেই, তার সাথে মন অনেক খালি হালকা হবে। কথায় আছে ভক্তিতে থাকি শক্তি, তাই এখানে ভক্তি সহকারে দেবীর পূজা অর্চনা করলে সকলের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়।

স্থানীয়দের এবং আগত পূর্ণাথীদের সাথে সাথে কথা বলে জানাগেছে, এক সময় এখানে প্রতিবছর দিপাবলিতে ৪ থেকে ৫ হাজার পাঠা বলি হতো। সেসময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আসেন মন্দিরে ভোগ দিতে। কেউবা আবার কেবল পরিদর্শন করতে আসেন। বর্তমানে এখানে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০টি পাঠা বলি হয়ে থাকে।

মন্দিরকে ঘিরে দিপাবলী ছাড়াও বছরজুড়েই বসে মেলা। তবে দিপাবলীর সময় মেলার পরিধি কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পরে। মেলার বিভিন্ন দোকানে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন পণ্য ও মুখরোচক মিষ্টান্ন পাওয়া যায়। পাওয়া যায় দেবীর নামে অঞ্জলী বা ভোগ দেয়ার নানা ফুল ও খাদ্যদ্রব্য।

মন্দিরের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খুবই চমৎকার। পর্যটকরা এখানে এসে মুগ্ধ হয়ে যায়। এখানে মন্দির চত্বরে ওঠার মুখে থরে থরে ওষুধি গাছ তুলসি গাছ রয়েছে। এ তুলসি গাছের ছায়া মাড়িয়ে এক এক করে সিঁড়ির ধাপ পার হয়ে মন্দিরের পরিবেশ বেশ মনোরম লাগবে। মন্দিরের উপরি ভাগ এবং চতুরপাশ্বে লাল রঙ দিয়ে রাঙানো হয়েছে।

আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ মন্দির। এখানে আগরতলা শহর থেকে যেকোনো সিএনজি বা বাসে যাওয়া যায়। উদয়পুর বাজারের একটু পরেই প্রধান সড়কের পাশেই একটি টিলার উপর মন্দিরটির অবস্থান। প্রধান সড়ক থেকে মন্দিরের প্রবেশ পথে রাস্তার দুইপাশে অসংখ্য ভোগ পণ্য ও মিষ্টান্নের দোকান রয়েছে। এক একটি ভোগের জন্য সাজানো ডালার দাম নেয়া হয় ৩শ থেকে ৫শ টাকা।

মন্দিরে যারা ভোগ দেন তারা তাদের পছন্দ মতো ভোগ কিনে নেয় মন্দিরের মায়ের ভোগ দিতে। তবে যারা কেবলমাত্র মন্দির দর্শনে আসেন তারা ভোগ না কিনেও মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন। মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে অসংখ্য নারীদের হাতের শাখা-মালা, সঙ্খ, সিঁদুর, চন্দন কাঠ, ধর্মীয় পুস্তকসহ পূজা অর্চনার এবং বাসা-বাড়ির প্রয়োজনীয় নানা আসবাবপত্র ও পোশাক এর দোকান রয়েছে। মন্দির দর্শন বা পূজা অর্চনা শেষে ইচ্ছে করলে সেসব জিনিসপত্র কিনে নিতে পারেন। এছাড়া মিষ্টান্ন দোকানগুলোতে ত্রিপুরার সেরা প্যারা বা সন্দেশও কিনে নেয়া যায় বাড়ির জন্য।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক, শেরপুর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //