ঘুম- দ্য স্লিপ

রাশেদুল হক যে সমস্যা মোকাবেলা করছেন, পৃথিবীর অন্য কেউ কখনো এমন বিচিত্র ও বিতিকিচ্ছিরি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে কি না জানেন না তিনি। মুখরা স্ত্রীর মুখে খই ফুটতে থাকে সবসময়; বাধ্য হন নিজের মুখ বন্ধ করে রাখতে। হাজার হোক সংসারে শান্তিই মূল কথা। ফুটন্ত তেলে এক ফোঁটা পানি ঢাললে কী দশা হয়- নিপীড়িত পুরুষ হিসেবে ভালোই জানা আছে!

রাতে দূরে থাকুক, দিনেও বাসায় ঘুমাতে পারেন না রাশেদুল হক। মনে হয় কে যেন চোখের প্রচ্ছদ ছিঁড়ে নিয়েছে, যে কারণে সে চোখ ঘুমের কথা বলে না। অন্যদিকে বাইরে কোথাও বসলে দুই মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। তিন মিনিটের মাথায় উপস্থিত লোকজন নাসিকা গর্জনের আওয়াজ পায়। বাইরের ঘুমচর্চার খবর বাসায় পৌঁছাতে থাকলে তার স্ত্রী হাফিজা বেগম রাগেন বারবার, ‘মিনসের নখরামি দেখে বাঁচি না। তিনি ঘুমের ইতিহাসে নাম লেখাবেন। ঘুম-রাজা হবেন!’

ঘুম নিয়ে রাশেদুল হক বরাবরই তিন-টানায় ভুগে এসেছেন। ঘরে-বাইরে দেখতে হয়েছে অসংখ্য মানুষের ভ্রুকুটি। এর মধ্যেই প্রতিবেশিনী তামান্না জেরিন একটি প্রস্তাব নিয়ে এলেন; খুশি হবেন নাকি বেজার- বুঝে উঠতে পারলেন না। রাশেদুল হকের দ্বিধা-বিভক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে তামান্না জেরিন বললেন, ‘কাজটা কঠিন নয়, ভাইয়া। সকাল সাতটার দিকে আপনি আমার বাসায় এসে মিনিট পাঁচেক ঘুমাবেন।’

‘কী যা তা বলছেন! বেগানা পুরুষ হয়ে... তাছাড়া আপনার স্বামীই বা ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবেন!’

‘কথা শেষ করতে দিন। আমার বাসায় এসে মিনিট পাঁচেক বসবেন। তারপর স্বভাব সুলভভাবে ঘুমিয়ে তো পড়বেনই। আপনার নাকসংগীতের মূর্ছনায় অন্তু জেগে উঠবে।’

এবার বিরক্ত হলেন রাশেদুল হক, ‘শিশুদের ঘুম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া ঠিক না।’

‘সাড়ে সাতটায় ওর স্কুল। ঘুম থেকে জাগাতে পারি না বলে স্কুলে যেতে পারে না সময়মতো। আপনার নাকডাকাটা সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিলে ও ধড়ফড় করে উঠে যাবে। লোকজন বলে, যেদিকে আপনি ঘুমান সেদিক থেকে নাকি বিড়াল-কুকুরও ভেগে যায়।’

এর মধ্যেই হাফিজা বেগম একবার দেখে গেছেন তাদের। ঠোঁটও বাঁকিয়েছেন তামান্না জেরিনের অলক্ষ্যে। রাশেদুল হকের কাছে কোনো নারী অতিথি এলে তিনি কখনোই চা-নাশতা দেন না। সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময়ের তো প্রশ্নই ওঠে না।

অনেকটা নিমরাজি হয়ে প্রস্তাবে সম্মতি জানালেন রাশেদুল হক। ঘুমিয়েই যদি কিছু টাকা উপার্জন হয়- ক্ষতি কী। ভালো নাশতা-পানিও নিশ্চয়ই দেবে!

অন্তু বাবু নিয়মমতো স্কুলে পৌঁছতে শুরু করলে আরেকটি চাকরির অফার পেলেন। ইনিও প্রতিবেশিনী। সুন্দরী নারীদের সঙ্গে সময় কাটাতে মন্দ লাগে না! একবাক্যেই ইতিবাচক মত দিলেন রাশেদুল হক।  

সাত মাসের মাথায় দেখা গেল, স্বল্প টাইম চাকরির সংখ্যা চল্লিশ পেরিয়েছে। অফিসে দেরি করে গেলেও সমস্যা হয় না যেহেতু- রাশেদুল হক সুযোগগুলো লুফে নিতে থাকলেন। এই উপার্জন মূল চাকরির বেতনের চেয়েও বেশি। কিন্তু তার এত সুখ, অর্থ সমাগম, সুন্দরী-সান্নিধ্য হাফিজা বেগমের সইবে কেন! দায়িত্বশীল স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে তাকে নিয়ে গেলেন ঘুম ও পরস্ত্রী আসক্তি রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু কোনো ডাক্তারই সমাধান দিতে পারলেন না। রাতের ঘুম পুনঃস্থাপনের পাশাপাশি নাক গলানো বন্ধ করতে পারলেই কেল্লাফতে। 

৫৩ জায়গায় ব্যর্থ হওয়ার পর বিদেশফেরত এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন হাফিজা বেগম। ধারাবাহিক ১৪ বারের ট্রিটমেন্টেও যখন কাজ হলো না চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল পিএইচডি ডাক্তারের কপালে। একপ্রকার রুষ্ট হয়েই বললেন, ‘সত্য করে বলেন তো ভাই, আপনি কী করেন?’

রাশেদুল হক বরাবরের মতো ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললেন, ‘সরকারি চাকরি!’

‘অফিসে নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত ঘুমের সময় পান?’

‘হ্যাঁ, ঘুমিয়েই কাটাই। কাজ আর কতটুকু।’

‘রাতে আর কী করেন?’

‘কোন তরিকায় মক্কেলের কাছ থেকে বেশি উৎকোচ আদায় করতে পারব- সেসব ভাবি।’

হাফিজা বেগম ধমকের সুরে বললেন, ‘এসব আগে বলোনি কেন? তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ। বাসায় চল!’

পরের বছরেই রাশেদুল হক ‘বর্ষসেরা শিক্ষাবান্ধব ব্যক্তিত্ব’ পদক পেলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ল তার ঘুম-যশ তথা সুনাম!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //