যাও, এখানে এসো না

তিনি রাস্তায় বের হয়েছেন আজ দশ দিন পর; কিন্তু কিছু যেন চিনতে পারছেন না। রাস্তায় গাড়ি নেই, রিকশা চলছে না, বাস যাচ্ছে না মাটি কাঁপিয়ে, ধুলো-বালিও উড়ছে না। আশপাশে, সামনে লোকজন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দেখার পরই প্রথমে তার কারফিউয়ের কথা মনে পড়ল। একেবারে সেই রকম, চারদিক শুধু সুনসান না, থমথমে ভাবও জাপ্টে বসে আছে। পুলিশ আর বিজিবির গাড়ি যাচ্ছে মাঝে-মাঝে রাস্তা অবাক করে দিয়ে। ভেতরে যারা বসে তারা অবাক চোখে দেখছে তাকে। চৌরাস্তার মোড়ে পুলিশের চৌকি, রাইফেল হাতে একজন সেপাই তাকে থামাল। গম্ভীর স্বরে বলল-

কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

ছবি তুলতে

ছবি তুলতে? কীসের ছবি?

এই রাস্তা-ঘাটের। দোকান-পাটের। গাছপালার।

কী করা হয়?

ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার।

ফ্রিল্যান্স?

মানে শখের ফটোগ্রাফার

শখের! হু। দেখতে পাচ্ছেন না সবকিছু বন্ধ। ছবি তোলার কিছু নেই এখন।

সব যে বন্ধ, তার ছবিই তুলব।

কেন? সেই ছবি তুলতে হবে কেন? সবাই জানে এখন সবকিছু বন্ধ। প্রশ্নকারী পুলিশ এবার একটু রেগে যায়। তার চোখে-মুখে সন্দেহও ঝিলিক মারে বিজলীর মতো। 

তিনি হেসে বলেন, হ্যাঁ, সবাই জানে সে কথা; কিন্তু দেখেনি তো চোখে। দেখবে কী করে? বের হতে তো পারে না। তাই ছবি তুলে কাগজে ছাপাব।

কোন কাগজে ছাপানো হবে?

দৈনিক বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকায়

সেখানে কাজ করা হয়? সাংবাদিক? 

না। বললাম না ফ্রিল্যান্স? মাঝে-মাঝে ছবি তুলে পাঠাই। ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পেলে। 

শুনে পুলিশের সেপাই চৌকিতে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করল। তারপর তার কাছে এসে বলল, আইডি আছে? দেখাতে হবে। 

তিনি পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে আইডি নিয়ে পুলিশের হাতে দিলেন। পুলিশের সেপাই সেটা উল্টে-পাল্টে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলল, ফটোগ্রাফার লেখা নেই। আপনার বয়স তো দেখছি অনেক, পঞ্চান্ন হবে। এত বয়সী ফটোগ্রাফারের ছবি ছাপে সংবাদপত্র?

তিনি হেসে বললেন, আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো, ন্যাশনাল আইডিতে পেশা বা শখের কথা লেখা থাকে না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমি অনেক বছর থেকেই পত্রিকায় ছবি পাঠাই। তারা আমার ছবি ছাপে। বিষয় দেখে, আমার বয়স নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বলে মনে হয়।

তার কথা শেষ হওয়ার পর পুলিশের সেপাই আবার চৌকিতে গিয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে। তারপর ফিরে এসে তার হাতে আইডি কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে বলে, যান। বেশিক্ষণ রাস্তায় ঘোরাঘুরি করবেন না। আর মুখে মাস্ক পরে থাকুন। না হলে শাস্তি পেতে পারেন।

তিনি অল্প হেসে বললেন, শাস্তি মানে কানে হাত দিয়ে ওঠবস? সেদিন টেলিভিশনে যেমন দেখাল? 

পুলিশের সেপাই এবার রেগে গিয়ে বলল, খুব বেশি কথা বলার অভ্যাস দেখছি। যা বললাম তাই করেন। না হলে বিপদে পড়বেন।

তিনি বুক পকেট থেকে সাদা রঙের মাস্ক বের করে মুখে লাগাতে-লাগাতে বললেন, চারদিকে ধুলো-বালি কিছু নেই। ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু এত পরিষ্কার যে এটা পরতে ভুলেই গেছি। 

পুলিশের সেপাই বলল, ধুলো-বালির সঙ্গে মাস্ক পরার সম্পর্ক নেই। ওটা অদৃশ্যে থাকে। পড়েননি কাগজে? টিভিতেও তো বলা হচ্ছে দিন-রাত। আপনি বেশ অদ্ভুত মানুষ। 

তিনি বললেন, কাগজ পড়ি। টিভি নিউজও শুনি; কিন্তু ছুটির দশ দিন পর বাইরে বেরিয়ে সবকিছু এত নতুন আর ঝকঝকে দেখাচ্ছে যে, ভুলেই গেছি ইমার্জেন্সি চলছে। তারপর মাস্কে মুখ ঢেকে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, এই যে পরলাম। হঠাৎ দেখলে পরিচিত কেউ চিনতে পারবে না। 

পুলিশ সেপাই বিরক্তির স্বরে বলল, যান। আর যা বললাম মনে রাখবেন। বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করবেন না। সন্দেহজনক মনে হবে। 

হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছু দূর চলে এলেন তিনি। জনশূন্য, ট্রাফিকবিহীন রাস্তার বেশ কয়েকটা ছবি তুললেন। যেসব রাস্তায় আগে ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকত, গাড়ি-বাস আটকে থাকত কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেইসব এখন বিরান। দেখে মনে হলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রাস্তার পাশে দোকানপাট, শপিং মল সব বন্ধ। আগে সেখানে লোক গিজগিজ করত। ফুটপাতগুলো খাঁ খাঁ করছে। তাদের ভাঙা এবড়ো-থেবড়ো ভাঙা চেহারা যেন ভেংচি কাটছে। কুকুরগুলো শূন্য ডাস্টবিনের কাছে ঘুরঘুর করছে। মাঝে-মাঝে সামান্য কিছু পেলে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় মেতে উঠছে। ওপরে ঝোলানো কেবলে বসে তারস্বরে ডাকছে কয়েকটি কাক। ওড়াউড়ির ব্যস্ততা নাই তাদের। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে তিনি ক্যামেরা ঠিক করে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। সাত-আট জন মজুর কোদাল আর ঝুঁড়ি নিয়ে ফুটপাতে বসে আছে। তাদের দৃষ্টি শূন্য, নিজেদের মধ্যে কথাও বলছে না। উদাস দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে মুখে হাত দিয়ে। তিনি ঝটপট তাদের ছবি তুললেন। তার ছবি তোলা শেষ হতে না হতে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। পেট মোটা একজন নেমে বাজখাই গলায় তাকে বলল, কিসের ছবি তুলছেন? 

তিনি মজুরগুলোকে দেখিয়ে বললেন, এদের। 

পুলিশ বলল, ছবি তোলার কি আছে? 

তিনি বললেন, সব কিছু বন্ধ। এদের রোজগারও বন্ধ। কাজের আশায় বসে আছে। এর মধ্যে একটা স্টোরি আছে। 

স্টোরি? পুলিশ সন্দিগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকাল। 

স্টোরি মানে নিউজ। এই ছবি নিয়ে নিউজ হতে পারে। তাই তুললাম।

পুলিশ রেগে গিয়ে বলল, এসব ছবি ছাপতে দেবেন না। এই লোকগুলো বেআইনিভাবে এখানে বসে আছে। এখন সারাদেশে ছুটি চলছে। এদের বাড়িতে থাকার কথা। শুধু বাইরে বেরিয়ে আসেনি, ফুটপাতে আরামসে বসে আছে। ফাজলামি পেয়েছে? আইন-কানুন মানবে না? এটাই তো স্টোরি। আপনি আবার অন্য কী স্টোরির কথা বলছেন? যান, ওই ছবি মুছে ফেলেন, না হলে ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত করব। বলা শেষ করে পুলিশ লাঠি ঘুরিয়ে বসে থাকা মজুরগুলোকে ধমক দিয়ে বলল, এই ব্যাটারা, এখানে কী করছিস? জানিস না ছুটি চলছে? এই সময় বাইরে বেরুনো নিষেধ। যা, ভাগ এখান থেকে। না হলে সবাইকে থানায় নিয়ে যাব।

তার কথা শুনে মজুরগুলো কোদাল আর ঝুড়ি তুলে নিয়ে ত্রস্তে উল্টো দিকে চলে যেতে থাকল। তিনি আর দেরি করলেন না। দ্রুত পায়ে হেঁটে অদূরে পার্কের দিকে গেলেন। 

একটু পর তিনি পার্কে এসে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হলো যেন নতুন কোনো জায়গায় এসেছেন। সব কিছু অন্য রকম দেখাচ্ছে। সবুজ ঘাস ঝিকিয়ে উঠেছে দুপুরের রোদে। কি উজ্জ্বল সবুজ সেই রঙ। গাছের পাতায় সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। ধুলো-বালির পলেস্তরায় আগের মতো মলিন দেখাচ্ছে না। লেকের পাড়ে লতাগুল্মের ওপর উড়ছে নানা রঙের প্রজাপতি। এত প্রজাপতি তিনি আগে এখানে দেখেননি। গাছের ডালে বসে ডাকাডাকি করছে যেসব পাখি তাদের অনেকগুলোই তার কাছে অচেনা। এই সময়ে তিনি এত পাখি দেখেননি পার্কে। খুব সকালে উঠে তারা খাবারের খোঁজে কোথায় উড়ে চলে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে কোথাও উড়ে যায়নি, কিংবা উড়ে গেলেও তাড়াতাড়ি নিড়ে ফিরে এসেছে। খাবারের সন্ধানে তাদের মনে হয় এখন খুব বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। দিনের আলোতেই অবসর পেয়ে তারা ফূর্তিতে নিজেদের মধ্যে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। তিনি ক্যামেরা উঁচু করে পাখিদের কিছু ছবি তুললেন। আশ্চর্য! পাখিগুলো তাকে কাছে দেখেও ভয় পেল না, উড়ে গেল না।

তিনি ছবি তুলতে তুলতে ধীর পায়ে হাঁটছেন আর অবাক হয়ে সবকিছু দেখছেন। কাঠবিড়ালিগুলো নির্ভয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে পার্কের ঘাসে, দৌড়াদৌড়ি করছে ফূর্তিতে। এরাও তাকে দেখে ভয় পেল না, পালিয়ে গিয়ে গাছের উপরে উঠল না। তিনি ছাড়া পার্কে এখন কেউ নেই বলেই মনে হলো। নির্জন দেখে পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালী সবাই নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা গাছে লাল-নীল রঙ পাখার একটা নতুন পাখি দেখে থামলেন তিনি। না, আগে কখনো চোখে পড়েনি। নতুন, এই প্রথম দেখলেন। বাহ! বেশ তো দেখতে, মনে হয় পেইন্ট করা। তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে ছবি তুললেন। এই পাখিটা উড়ে গেল না। তাকে যেন গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। দেখে তিনি হাসলেন। 

পার্কের সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে বসে তিনি একটা সিগারেট বের করে হাতে ধরে রাখলেন। দিয়াশলাই বের করে জ্বালাবেন কি জ্বালাবেন না, এই চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। চারদিকে কোথাও একটুও ধোঁয়া নেই। বাতাস একেবারে নির্মল, আকাশ রবীন ব্লু রঙ দিয়ে ধোঁয়া ঝকঝকে নীল। আজ সকালেই দেখলেন সিএনএন চ্যানেলে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের এয়ার কোয়ালিটির ওপর প্রতিবেদনে দেখিয়েছে ঢাকার অবস্থান দুই নম্বরে। বেইজিং আর ম্যানিলা পাঁচ। ভাবা যায়? যে ঢাকা শহর এতদিন পাঁচ নম্বরে থেকে এয়ার কোয়ালিটির দিক দিয়ে সব শহরের ওপরে থাকত সেই শহর এই ক’দিনে দুই নম্বরে চলে এসেছে। এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে এটা একটা সুখবর। তিনি সিগারেটটা না জ্বালিয়ে পকেটে রেখে দিলেন। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। হোক না একটা সিগারেট, তা থেকে ধোঁয়া উড়ে বাতাস একটু হলেও তো দূষিত করবে। তার চোখ আটকে থাকল লেকের পাড়ে উড়তে থাকা কয়েকটা ফড়িংয়ের ওপর। তাদের ফিনফিনে পাখা এত দ্রুত উঠছে-নামছে যে আছে বলে মনেই হয় না। 

একটু পর ডান দিকে তাকিয়ে তিনি বেশ মুষড়ে পড়লেন। ফুটো হয়ে যাওয়া বেলুনের মতো তার উচ্ছ্বাস যেন বাতাসের মতো বের হয়ে যেতে থাকল। মেয়েগুলো তার দিকে এগিয়ে আসছে। সস্তা শাড়ি পরা, হাতে কাচের চুড়ি, মুখে রঙ মাখা, ঠোটের লিপস্টিক যেন জ্বলন্ত অঙ্গার। তাদের কেউ কেউ মাথার চুলে লাল ফুল গুজে রেখেছে। এদের তিনি আগেও দেখেছেন, তবে সন্ধ্যার দিকে যখন তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরতেন। দেখা যাচ্ছে এখন তারা দিনে-দুপুরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে পার্কে। তিনি বিরক্ত হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পারলেন না। মেয়েগুলো চোর-ডাকাত কিংবা হাইজ্যাকার না। তার কোনো ক্ষতি করবে না। হয়তো কথা বলার চেষ্টা করবে তাকে একা দেখে। অবশ্য তারা তা কোনো দিন করেনি। দেখেই বুঝেছে যে, তারা যাদের খুঁজছে তিনি তাদের একজন নন। অন্যদের বেলাতেও যে তারা খুব বাচাল নয়, তা তিনি দেখেছেন। অঙ্গভঙ্গি আর চোখের ঠারে-ঠোরে তাকিয়েই কাজ চালায়। যারা বোঝার তাতেই কাজ হয়ে যায়। পাবলিক ন্যুইসেন্স? এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। এমন রায় দেওয়ার অধিকার তার আছে বলে মনে হয়নি, কেননা মেয়েগুলো কখনো তাকে বিরক্ত করেনি।

কিন্তু তার অবাক হতে দেরি হলো না। মেয়েগুলো কাছে এসে পাশে দাঁড়াল। তাদের একজন অল্প হেসে বলল, স্যার একা বইস্যা আছেন? মন ভালো নাই বুঝি? তিনি তার দিকে না তাকিয়ে বললেন, তা নয়। একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছি। চমৎকার দিন তো। আরেকটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ আপনাগো লাইগ্যা খুব ভালো দিন। আল্লায় সুখে রাখছে; কিন্তু আমাগো হইছে জ্বালা। কেন, জ্বালা হয়েছে কেন? তোমাদের সমস্যা কি? তিনি তার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেন। অন্য সময় হলে তিনি লোক-লজ্জায় এদের সঙ্গে কথা বলতেন না; কিন্তু আজ ধারে-কাছে কেউ নেই। তিনি একা বসে আছেন। পাশে রাখা আছে রোলি ফ্লেক্স ক্যামেরা।

বহু পুরাতন। তার ওপরে এদের নজর পড়েছে এমন ভাবার কারণ নাই। নতুন মোবাইলের মতো এই ক্যামেরা লোভনীয় মনে হবে না, যারা ক্যামেরা বিশারদ নয়। তার কথা শুনে আগের মেয়েটি বলল, ক্যান, আমাগো সমস্যা বোঝেন না স্যার? আমাদের রুজি-রোজগার বন্ধ। এই যে ছুটি দিছে, কাস্টমাররা কই যে গ্যাছে বুঝতাম পারতাছি না। আমরা কি পরিষ্কার বাতাস দিয়া পেট ভরামু? 

ওহ! সেই কথা! এই সহজ বিষয়টা কেন যে তার মাথায় ঢুকল না তিনি বুঝতে পারলেন না। সত্যিই তো এরা বেশ বিপদে পড়েছে। সমাজের চোখে যেভাবেই দেখা হোক, ওরা এই পথেই রোজগার করে বেঁচে-বর্তে ছিল। ছুটির জন্য দেখা যাচ্ছে সেটা বন্ধ। তিনি পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে এক শত টাকার একটা নোট তাদের একজনের হাতে দিয়ে বললেন, যাও সবাই মিলে কিছু কিনে খেও। আমার কাছে এর বেশি নেই। 

মেয়েরা একসঙ্গে খুশিতে কলরব করে উঠল। যেন তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না। টাকার নোটটা তাদের হাতে-হাতে ঘুরতে থাকল। যেন মস্ত বড় একটা লটারি জিতেছে। তাকে সালাম দিয়ে যেতে যেতে হাসি মুখে বলল, সাব খুব ভালোা মানুষ। দরদ আছে কলিজায়। গরিবের ব্যথা বোঝে। 

ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে তিনি ভাবলেন, সত্যিই কি তার মনটা খুব নরম? লোকের দুঃখে-কষ্টে মন ভিজে ওঠে? এটা কি পথে-ঘাটে ছবি তুলতে তুলতে হয়েছে? তার ছবির বিষয় তো মানুষের দুঃখ-কষ্টই। তবে অন্য ব্যাপারও আছে। খুব বেশি দিন মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখতে দেখতে মনে আর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। সে সব স্বাভাবিক মনে হয়। যেমন ডাক্তাররা রোগী দেখতে দেখতে অন্যরকম হয়ে যান; কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিনি এখনো বদলাননি। তার ভেতরের নরম মনটা ভেজা কাঁদার মতো হয়েই আছে। এটা ভালো না মন্দ, তা তিনি বুঝে উঠে পারলেন না। তবে এই মুহূর্তে তার মনে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব এসে গিয়েছে। মেয়েগুলোকে যে সামান্য সাহায্য করতে পারলেন তার জন্য মনটা বেশ হালকা হয়ে এসেছে এখন। তিনি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালেন। মনের এই ফুর্তি ভাবটার সঙ্গে একটা সিগারেট খাওয়া যায়। এতে বাতাস আর কতটুকুই বা দূষিত হবে। একটাই তো সিগারেট!

তিনি তন্ময় হয়ে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দেখতে পেলেন মাঝে-মাঝে দু-একটা মাছ ভেসে উঠছে। এই লেকের উপর মাছ ভেসে উঠতে দেখা গিয়েছে যখন তারা মারা যায়; কিন্তু জ্যান্ত মাছ সাঁতরে উপরে ভেসে উঠছে, এই দৃশ্য তিনি প্রথম দেখলেন। তার অভ্যস্ত চোখ খুশিতে নেচে উঠল। তিনি বুঝলেন শুধু স্থলে নয়, অন্তরীক্ষে নয়, জলেও নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে এই ক’দিনে। অথচ কি পরিহাস! অন্য সব প্রাণি যখন এই সময় উৎসবে মেতে উঠেছে একমাত্র মানুষই বিপদগ্রস্ত, মহাসংকটে নিপতিত। এর মধ্যে বিধাতার কি মেসেজ আছে কোনো? মানব সমাজকে কি তিনি কিছু বলছেন? জীব জগতে এবং প্রকৃতিতে এই বৈপরীত্য দেখিয়ে? ভাবতে ভাবতে তার মনে বেশ একটা দার্শনিকতার ভাব এসে গেল। তার তন্ময়তা ভাঙল একটি মেয়েলি স্বরে। তিনি ঘাড় না ঘুরিয়ে ভাবলেন আবার কি ওই মেয়েগুলো ফিরে এলো? এক শত টাকা পেয়ে লোভ হয়ে গিয়েছে? আরও পাওয়ার জন্য এসেছে? ব্ল্যাকমেইল করবে তাকে? বেশ বিরক্ত হয়ে তিনি পাশ ফিরে তাকালেন। দেখবার আগেই ভাবলেন, না কারও ভালো করতে নেই। তাহলে পেয়ে বসে। 

পাশের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন ওই মেয়েদের কেউ না। অন্য একটা মেয়ে একা এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। ভদ্রঘরের বলেই মনে হলো। তাঁতের একটা পরিষ্কার শাড়ি পরে আছে। মুখে প্রসাধন নাই। দেখতে বেশ সুশ্রী। বয়স পঁচিশের বেশি হবে না। বেশ কুণ্ঠিত হয়ে ভিরু ভঙিতে দাঁড়িয়ে আছে। সামনা-সামনি তাকাতে পারছে না, এমন লজ্জার ভাব। তিনি মুখের বিরক্তির ভাব দূর করে বললেন, আমাকে কিছু বলছ তুমি?

মেয়েটি বলল, জ্বি। যদি বিরক্ত না হন। 

তিনি বললেন, বিরক্ত হওয়ার মতো কিছু না বললে আমি কেন বিরক্ত হব? বলে তিনি হাসলেন। তারপর বললেন, লজ্জা কর না, যা বলতে চাও বল। তারপর কি ভেবে বললেন, বস বেঞ্চের ওই পাশে। মেয়েটি ইতস্তত করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, দাঁড়িয়ে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। 

তিনি বুঝলেন মেয়েটির মাত্রাবোধ আছে। দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলা আর তার পাশে বেঞ্চে বসে কথা বলার মধ্যে যে পার্থক্য তা সে বেশ ভালো করে বোঝে। অথচ তিনি এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। তাকে বেঞ্চে তার পাশে বসতে বলার জন্য তিনি বেশ লজ্জা পেলেন। স্বাভাবিক হয়ে এসে তিনি বললেন, কি বলতে চাও বল। 

মেয়েটি শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমি মানে আমার পরিবার। 

তিনি বললেন, কী হয়েছে? কী বিপদে পড়েছ? 

মেয়েটি বলল, বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। আমরা কেউ তাকে দেখতে যেতে পারছি না। 

তিনি বুঝতে পেরে বললেন, এই অসুখের রোগী খুব ছোঁয়াচে হয়। সেই জন্য দেখতে দেয় না। কাছে যাবার নিয়ম নেই। ডাক্তার, নার্স যারা চিকিৎসা করে তাদের প্রতিরোধমূলক পোশাক থাকে গায়ে। অন্যের ভালোর জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা। অপেক্ষা কর। দেখ কি হয়। তারপর কিছু মনে পড়ায় তিনি বললেন, আমাকে বলতে এসেছ কেন? 

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লজ্জাজড়িত স্বরে বলল, বাড়িতে খাবার কিছু নেই। আমরা দু’দিন থেকে অভুক্ত। 

তিনি অবাক হয়ে বললেন, সে কি? তোমাদের বাবা কি করতেন? বাড়িতে টাকা-পয়সা কিছু নেই।

মেয়েটি বলল, একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করতেন। ছুটি হওয়ার পর থেকে অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বেতন দিচ্ছে না। 

তিনি বললেন, ঢাকায় তোমাদের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই? 

মেয়েটি বলল, কয়েকজন আছেন। তাদের অবস্থা আমাদের মতোই। কেউ কেউ গ্রামে চলে গিয়েছেন। 

তিনি বললেন, তোমাকে শিক্ষিত মনে হয়। কত দূর পড়াশোনা করেছ?

মেয়েটি বলল, এ বছর গ্র্যাজুয়েশন হওয়ার কথা। যদি পরীক্ষা দিতে পারি। 

তিনি বললেন, তোমার ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই? ভাই-বোন?

ভাই আছে। ছোট। সে স্কুলে পড়ে। মানে পড়ত। এখন তো বন্ধ। বাড়িতেই বসে আছে। 

বাড়িটা তোমাদের, না ভাড়া করা? 

ভাড়া করা। ভাড়া না দেওয়ার জন্য মালিক চাপ দিচ্ছে। বলছেন উঠে যেতে। 

শুনে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, হু। তোমাদের দেখছি বড় বিপদ। তা কি করতে চাও তুমি? আমার কাছে এসেছ কেন? 

মেয়েটি মুখ নিচু করে থাকল। বোঝা গেল উদ্গত কান্না রোধের চেষ্টা করছে। সে সামলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, কোথাও যদি একটা চাকরি ... । তার কথা শেষ হয় না। 

তিনি বললেন, এখন তো কোথাও চাকরি হবে না। সব কিছু বন্ধ। 

মেয়েটি মুখ তুলে বলল, টিউশনি। আমি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী পড়াতে পারব।

তিনি বললেন, এখন পড়াশোনা বন্ধ। সে তো তুমি জানই। তা ছাড়া বাইরের লোক কেও ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না অসুখটার ভয়ে। তারপর একটু থেমে বললেন, তুমি কি চাকরি খোঁজার জন্য এই দুপুরে পার্কে এসেছ?

শুনে মেয়েটি ভয়ে আর লজ্জায় কেঁপে উঠল। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, শুনেছি পার্কে ভদ্রলোকরা হাঁটতে আসেন। ভাবলাম তাদের কেউ যদি দয়া করে ...। এবারও সে তার কথা শেষ করতে পারে না। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এখন কেউ পার্কে বেড়াতে আসে না। আসলেও তোমার কথা শুনেই চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন এমন লোক নেই বলেই মনে হয়। তা ছাড়া পার্কে কিন্তু সবাই ভদ্রলোক নয়। যাদের দেখে ভদ্রলোক মনে হয় তাদেরও অনেকে ভেতরে ভেতরে ভদ্র নয়। 

মেয়েটি মরিয়া হয়ে বলল, আপনাকে দেখে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি ভালো লোক। আপনি আমার জন্য একটা কিছু করতে পারবেন না?

শুনে তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন, দ্যাখো মেয়ে তোমার বয়স কম। জীবনের অভিজ্ঞতা প্রায় কিছুই হয়নি এখনো। কাউকে দেখেই বিশ্বাস করে ফেল না। বিপদে পড়বে। 

মেয়েটি আকুল স্বরে বলল, এর চেয়ে বেশি বিপদে আর কি পড়তে পারি? 

শুনে তিনি বেশ বিব্রত হলেন। কি বলবেন ভেবে পেলেন না কিছুক্ষণ। তারপর কি মনে করে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দ্ইুশ’ টাকার নোট নিয়ে মেয়েটির হাতে দিয়ে বললেন, আমার কাছে এই আছে। এটা নিয়ে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা কর। তোমার বাবার হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা কর। এর মধ্যে একটা কিছু নিশ্চয়ই হয়ে যাবে যার জন্য তোমাদের বিপদটা চলে যেতে পারে। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, যদি তোমার বাবা চাকরিটা ফিরে না পান, তাহলে তোমরাও গ্রামে গিয়ে থাকতে পার কিছু দিন। সেখানে অন্তত: না খেয়ে থাকবে না। কথাটা বলার পর তিনি বেশ অস্বস্তিতে পড়লেন। এটা কি তার বলা উচিত হলো? তারপর তিনি উঠতে উঠতে বললেন, আর শোনো পার্কে ভদ্র লোকের খোঁজে এসো না। পার্ক ভালো জায়গা না। এখন বেশ শান্ত-শিষ্ট দেখাচ্ছে বটে। হঠাৎ করে বদলে যেতে পারে। যাও, বাড়ি ফিরে যাও। কথা শেষ করে তিনি মেয়েটার দিকে আর না তাকিয়ে বাড়ি যাবার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন। 

দরজা খুলে তাকে দেখে স্ত্রী বললেন, কি হলো? অমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? 

কেমন দেখাচ্ছে? 

কেমন যেন মনমরা ভাব। ছবি তুলতে গেলে। সেখানে কি কিছু হলো? খারাপ কিছু দেখলে?

না, কিছু হয়নি। খারাপ কী আর হবে এখন যা হচ্ছে তার চেয়ে? হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পার্কে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। জান পার্কটা এখন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। দেখে চেনাই যায় না। সেখানে গিয়ে বেশ নতুন অভিজ্ঞতা হলো। 

কেমন নতুন অভিজ্ঞতা?

কিছু ভালো, কিছু মন্দ। অবিমিশ্র বলে তো কিছু নেই সংসারে।

তার স্ত্রী বললেন, এখন দার্শনিকতা রাখ। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে তারপর জামা-কাপড় বদলে এস। খাবে। আমরা তোমার দেরি দেখে খেয়ে ফেলেছি। খেতে খেতে তিনি বললেন, এই ছুটির সময়ে গরিব আর নিম্ন আয়ের মানুষেরা খুব বিপদে পড়েছে। বেতন পাচ্ছে না, রোজগার নেই। তার স্ত্রী বললেন, কেন, সরকার সবাইকে প্রণোদনা না কি যেন বলে, দিচ্ছে। নগদ টাকা পাচ্ছে গরিব পরিবার। আড়াই হাজার না কত করে যেন। 

তিনি বললেন, সবাই কী পাচ্ছে? আর মাসে আড়াই হাজার টাকায় কি একটা পরিবার চলে? 

বিকেলে এক বন্ধু ফোনে বললেন, বুঝলে ভাইয়া-এই অসুখটা জীবিকার প্যাটার্ন বদলে দিয়েছে। 

তা কেমন? তিনি জিজ্ঞেসা করেন। সবকিছু ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। অনলাইন। বাড়িতে বসে কাজ হচ্ছে। কেনাকাটা হচ্ছেও অনলাইনে অর্ডার দিয়ে। মানুষকে এখন বাড়ির বাইরেই যেতে হচ্ছে না। তারপর একটু থেমে বললেন, শুধু একটা পেশা বদলায়নি। মনে হয় বদলাবে না। 

কোন পেশা? তিনি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন?

ওল্ডেস্ট প্রফেশন ইন দি ওয়ার্ল্ড। বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। 

শুনে তিনি কিছু বললেন না। পার্কে রঙ চঙ মাখা মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ল তার। চোখের সামনে ভেসে উঠল তারা।

ফোনের ওপাশ থেকে বন্ধু বললেন, শুধু তাই নয়। এই প্রোফেশনে এখন নতুনরাও যোগ দিয়েছে। দিচ্ছে। অভাব-অনটন তাদের টেনে নিয়ে এসেছে। কি ভয়াবহ অবস্থা! একটা অসুখ মানুষকে রাতারাতি কত অসহায় করে তুলতে পারে। ভেবে দেখেন। 

তার সামনে পার্কে দেখা তরুণীটির মুখ ভেসে উঠল। শুকনো মুখ, কোটরাগত চোখ, ভিরু স্বর, সব যেন তিনি দেখতে আর শুনতে পেলেন। সেও কি? ভাবতেই তিনি শিউরে উঠলেন। তার কপালে জমে উঠল কয়েকটা শ্বেত বিন্দু। যেন তিনি এর জন্য দায়ী অথবা অপরাধী। ফোনের ওপাশ থেকে তার বন্ধু বললেন, চোখে পড়েনি তোমার? তুমি তো ছবি তুলতে রাস্তা-ঘাটে, পার্কে ঘোরাঘুরি কর। শুনতে পাই তাদেরকে এখন দিনের বেলাতেই দেখা যায়। নতুন যারা যোগ দিয়েছে তারাও লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে গড়াগড়ি করছে খদ্দের ধরার জন্য। কি দারুণ অবস্থা! সব তছনছ হয়ে গেল। 

একটু পর তার বন্ধু ফোন রেখে দিলেন। তার স্ত্রী চায়ের পেয়ালা সামনে এনে তাকে দেখে বললেন, কি হয়েছে? খারাপ কিছু শুনলে? তোমার মুখ অমন দেখাচ্ছে কেন? 

স্ত্রীর হাত থেকে চায়ের পেয়ালা নিয়ে তিনি বললেন, না। তেমন কিছু না। অন্য একটা বিষয় মনে পড়ল। পর দিন দুপুরে তিনি পার্কে গেলেন। বসে থাকলেন সেই বেঞ্চে। দুপুরের সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিমে হেলে পড়ল। তারপর দুপুর হাই তুলে এলিয়ে পড়ল পশ্চিমের আকাশে আধশোয়া হয়ে। তিনি বেঞ্চে বসে আসার পর থেকেই চারদিক দেখছেন। অনেক নতুন পাখি দেখা যাচ্ছে। কাঠবিড়ালীর সংখ্যাও বেড়েছে। অনেক রকমের প্রজাপতি উড়ছে। তার পাশে বেঞ্চের ওপর ক্যামেরাটা পড়ে আছে। তিনি একবারও ক্যামেরাটা হাতে তুলে নেননি পার্কে আসার পর। তার চোখ ব্যস্ত হয়ে চারদিক দেখছে। আজ পার্কটা খুব নির্জন, সুনসান। কারও পদশব্দ বা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না। তিনি যখন বাড়ি ফিরলেন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে। তার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, এত দেরি করলে যে? দুপুরের খাওয়া নিয়ে কখন থেকে বসে আছি। কোথায় গিয়েছিলে? খুব দূরে কি? তারপর মৃদু তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, এত ছবি না তুললে কি হয়? এত চাকরি না, সখ করে তোলা। 

তিনি বেডরুমে গিয়ে কাপড় বদলালেন। পকেট থেকে পাঁচশ’ টাকার নোটটা বের করে ড্রয়ারে রেখে দিলেন। তারপর বাথরুমে গিয়ে বেসিনের পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুলেন। কপালটা গরম মনে হলো। অনেকক্ষণ পার্কে রোদের ভেতর বসে ছিলেন বলে কি? 

খাবার টেবিলে পাশে বসে তার স্ত্রী বললেন, তোমাকে একটু কেমন যেন দেখাচ্ছে। কি হয়েছে? খারাপ বোধ করছ? বলে তিনি ডান হাত তার কপালে ছোয়ালেন। ছুতেই আতকে উঠে বললেন, ওমা তোমার দেখি কপাল গরম। জ্বর এলো নাকি? খেয়ে নাও। থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখব। 

থার্মোমিটারে পারদের কালো রেখা দেখে সুচালু চোখে দেখে তার স্ত্রীর মুখ শুধু গম্ভীর না, আতঙ্কে কুকড়ে উঠল। তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, তোমার দেখি জ্বর। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়। তিনি বললেন, কত দেখলে? 

তার স্ত্রী বললেন, এক শত তিন ডিগ্রি। অনেক জ্বর। দাঁড়াও, আমি জলপট্টি নিয়ে আসছি। তুমি বিছানায় শুয়ে পড়। 

তার স্ত্রী অন্য ঘর থেকে ফোনে তাদের পরিচিত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন। সব শুনে ডাক্তার গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, কাশি আছে? 

আছে; কিন্তু কফ নেই।

ডাক্তার বললেন, হু। খারাপ উপসর্গ সব। এখন এসবের কথা শুনলেই একটা অসুখের কথাই মনে হয়। দুশ্চিন্তা করবেন না। এখুনি বলছি না। তার কী হয়েছে। তবে আজই সোয়াব টেস্ট করতে হবে। 

হাসপাতালে যেতে হবে টেস্টের জন্য। 

ডাক্তার বললেন, নাহ। আমি আমার পরিচিত ল্যাবকে বলে দিচ্ছি তারা টেকনিশিয়ান পাঠাবে। এক দিন পর রেজাল্ট পাওয়া যাবে। 

দু’ঘণ্টা পর সাদা পিপিই পরা টেকনিশিয়ান এসে তার জিভের ভেতর আর নাক থেকে সোয়াব নিয়ে গেল। সেই সঙ্গে ব্লাড। কয়েকটা ব্লাড টেস্ট করতে হবে। রাতে তার জ্বর বাড়ল। তার স্ত্রী থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখলেন এক শত চার ডিগ্রি। তিনি প্রায় বেহুঁশের মতো শুয়ে আছেন বিছানায়। মাঝে-মাঝে কি যেন বলছেন অষ্পষ্ট স্বরে। তার স্ত্রী শুধু শুনতে পেলেন, ‘চলে যাও’।

পরদিন রিপোর্ট পাওয়া গেল। পজেটিভ। দেখে তার স্ত্রী প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ডাক্তার সাহেবকে বলার পর তিনি ফোনে বললেন, ঘাবড়াবেন না ভাবি। আইসোলেশনে রাখুন। তার ঘরে কেউ ঢুকবেন না। আমি একজন পুরুষ নার্স পাঠাচ্ছি। সে ওষুধপত্র খাওয়াবে। একটা অক্সিমিটার কিনে আনুন। অক্সিজেন সেচুরেশন দেখতে হবে ঘন ঘন। 

হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে না?

ডাক্তার বললেন, এখুনি নয়। দেখি অবস্থা কি দাঁড়ায়। অক্সিজেন সেচুরেশন মাপুন ঘন ঘন। পঁচানব্বইয়ের নিচে গেলেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে রেখেছি। ফোন নম্বরটা লিখে রাখুন। আর হ্যাঁ, আপনি কিংবা বাড়ির কেউ ওই ঘরে ঢুকবেন না। যা কিছু করার আমার পাঠানো পুরুষ নার্সই করবে। সে সব কিছু করছে তো যা যা বলা হয়েছে তাকে?

জ্বি করছে; কিন্তু আমি ভেতরে না গিয়ে কি করে পারি? আমার হাজবেন্ড!

ডাক্তার বললেন, না যাবেন না। কেউই যাবে না। এটাই প্রটোকল। মেনে চলতে হবে। এখন সেন্টিমেন্টাল হওয়ার সময় না ভাবি। সাবধানে থাকুন। দূরে থাকুন। 

কিন্তু তিনি শুনলেন না। ঘরের ভেতর কাতরানি শুনে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। পুরুষ নার্স তাকে দেখে অবাক হলো। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তিনি স্বামীর কপালে হাত রাখলেন। মনে হলো পুড়ে যাচ্ছে। টেম্পারেচার কত এখন? তিনি পুরুষ নার্সকে জিজ্ঞাসা করলেন। 

এক ঘণ্টা আগে একশত চার ডিগ্রি। 

তিনি বললেন, অনেক জ্বর। হাসপাতালে নিতে হবে না? 

পুরুষ নার্স বলল, অন্য প্যারামিটারগুলো এখনো ভালো। তার লাং আক্রান্ত হয়নি। অক্সিজেন সাচুরেশন পঁচানব্বই এর নিচে নামেনি। এখুনি হাসপাতালে না নিলেও চলবে, ডাক্তার সাহেব বলেছেন। 

তিনি শুনলেন তার স্বামী যেন বিড়বিড় করে কি বলছেন। তার চোখ আধবোঝা। তাকেই কি কিছু বলছেন? তিনি বিছানার দিকে এগিয়ে এগিয়ে মাথা ঝুঁকে দাঁড়ালেন। এবারে পরিষ্কার শুনতে পেলেন। তার স্বামী বলছেন, এখানে এসো না। চলে যাও।

পুরুষ নার্স তার দিকে তাকিয়ে বলল, এই কথা তিনি মাঝে-মাঝেই বলছেন। কাউকে না দেখেই বলছেন। তিনি শুনলেন তার স্বামী খুব আস্তে আস্তে, শোনা যায় কি যায় না এমন স্বরে বলছেন, এখানে এসো না। জায়গাটা ভালো না। চলে যাও।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //