বাংলা ভাষা: ক্ষয়ক্ষতি ও দায়দায়িত্ব

“আসুন বাংলা বলি, বাংলায় বলি”- অনেক দিন ধরে নানান সঙ্গে অনুষঙ্গে এই কথাটি বলতে চেষ্টা করছি। বাংলায় যখন কথা বলতে হবে, তখন বাংলায়ই বলাটা সুন্দর। এবং যথাসাধ্য বাংলা শব্দ ব্যবহার করেই সেটি করা যেতে পারে। তার মানে সারাক্ষণ চিবিয়ে চিবিয়ে বাংলা বলতে হবে তা তো নয়। 

প্রয়োজন হলে হিব্রু থেকে শব্দ নিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে, অপ্রয়োজনে একটি ইংরেজি শব্দের ব্যবহার নয়। এই কথায় অনেকেই বলতে চান, তাহলে চেয়ার টেবিল স্কুল কলেজ- এগুলোকে কীভাবে এড়াবেন। আমিও বলি, এড়াতে তো চাই। কিন্তু বাংলায় আমরা এর নাম দিতে পারিনি।

হাতের কাছের সবচেয়ে সহজ একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে শুরু করা যাক: ‘সাম্প্রতিক দেশকালে’র বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে যে সংখ্যাটি প্রকাশ করেছিল, সেটির নাম ছিল ‘আল রিহালা’। ফুটবলকে আরবিতে রিহালা বলে। অর্থাৎ আরবিতেও ফুটবলের একটি নাম আছে। আরবি ধ্রুপদী ভাষা। অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা।

এ ছাড়াও ইউরোপের সঙ্গে আরবের যোগাযোগ অনেক নিবিড় বিধায় আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তি যা আধুনিক জীবনযাপনের নানান দ্রব্যাদি ও কাজকর্মের ধাঁচধরনের নাম আরবিতে অপেক্ষাকৃত দ্রুত অভিযোজিত হয়, কিন্তু সেটি হয় তাদের নিজের ভাষায়। সারা পৃথিবী যে নামে কোনো কিছুকে চেনে- সেটিকে নির্বিচারে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে নয়। যেমন চীন দেশে বাংলাদেশকে বলা হয় ‘মান-জা-লা’ এবং চীনে তাদের নিজের দেশের নাম ‘চুং কু য়া’। জার্মানিতে তাদের নিজের দেশের নাম ডয়েশ্চল্যান্ড।

বাংলা ভাষা বিশ্বের আধুনিক ভাষার তুলনায় খুব পুরনো নয়। বাংলা ভাষা উর্দু-হিন্দির মতো সেনাব্যারাকে বা রাজদরবারে তৈরি ভাষাও নয়, যদিও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বর্তমানে উর্দু ও হিন্দির প্রসার বাংলা ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। এদিকে জনসংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ, কারো মতে পঞ্চম, বা নিদেনপক্ষে দশম ভাষা হিসেবে বাংলা অবস্থান করলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলা ‘ভাষা’ হিসেবে তেমন গণ্য নয়। কেন? এর জন্য কারা দায়ী?

ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, ঔপনিবেশিক শক্তি পর্তুগিজ, স্পেনীয়, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, ফরাসি বা ইতালীয়রা অনেক ক্ষেত্রে উপনিবেশের ভাষাকে উৎখান করে, কখনো বর্ণমালাকে উৎখান করতে সক্ষম হয়েছে। লাতিন আমেরিকার ভাষা- মায়া-ইনকা-আজটেক সভ্যতার ঐতিহ্যসম্পন্ন ভাষার জায়গায় স্পেনীয় ও পর্তুগিজ ভাষা ঠাঁই নিয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষা এবং ভারতের নানা ভাষাকে উৎখান করা সম্ভব হয়নি। তামিল-তেলেগুর মতো অতি প্রাচীনভাষার কাছে বিশ্বের অনেক ভাষায়ই তো অর্বাচীন।

ইউরোপে চেক বা ফিনিশ ভাষায়, সুইডিশ বা সুইস ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞানের সব কিছুই চর্চা করা যাচ্ছে। অথচ জনসংখ্যায় বাংলা কথা বলা মানুষের সংখ্যায় তারও চেয়ে বেশি। তাহলে কেন বাংলায় উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না? 

এদিকে কেউ কেউ মুখের ভাষার কাছাকাছি এনে বাংলা ভাষা লেখায় আগ্রহী। জগতের সবখানে লেখা ও বলার ভাষা আলাদা। আমরা সেই লেখার ভাষাটিকে সমৃদ্ধ করার বদলে বলার ভাষাটিকে লেখায় এনে আদতে কী বিপ্লব ঘটাতে চাই?- স্পষ্ট করে এর চর্চাকারীরা বলতে পারবে কিনা জেনে নেওয়া দরকার।

ভাষা কী ও কেন?- এই সম্পর্কে গভীর নিবিড় পর্যবেক্ষণ যারা করেন তারা ভাষার স্বরূপটি জানেন। একটি ভাষা কোনো একটি জনগোষ্ঠীর সম্পদ, সেটি কারো ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি মতো চলে না। এর একটি নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে। ব্যাকরণ আছে। অবশ্য ব্যাকরণই ভাষার চূড়ান্ত কথা নয়, কিন্তু ভাষা গড়ে তোলার একটি শেষ সীমা আছে। যেমন- একটি মানুষ লম্বায় এগারো ফুট হলে, সে প্রায় অকেজো মানুষে পরিণত হয়।

তার হাতের দশটি ও পায়ের দশটি আঙুলের বদলে কুড়ি যোগ কুড়ি- চল্লিশটি আঙুল হলে কেমন হতো? একটা স্বাভাবিক গড়নে তা পূর্ণ হয়। ভাষা বদলে বদলে হস্ত-হত্ত-হাত হয়েছে, কিন্তু সেই হাতকেও যদি বদলানোর চেষ্ট করা হয়, তাহলে তা ভাষা বিপর্যয়ের সূচনা করে।

একটি শব্দের বা কথার চূড়ান্ত বানান সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার পর তা যদি কেউ নিজের ইচ্ছা মতো লিখতে চায়, তাতে সে আসলে নিজের ক্ষতিই করে। যেমন কারো নামের বানান একটু এদিক ওদিক করে লিখলে নামটা আর চেনা যায় না, নিজের পিতার নাম, নিজের নামের ভুল হলে পদে পদে কত মাসুল দিতে হয়, ভুক্তভোগীরা জানেন।

তেমন কোনো বানান, যা প্রতিষ্ঠিত ও সবাই যেটিকে কবুল করেছে, সেটি না মানার অর্থ কী? ‘শাসন’ বানানটিকে উচ্চারণ অনুযায়ী ‘শাশন’, ‘সাশন’, ‘শাসণ’, ‘শাশণ’, ‘সাশণ’ ইত্যাদি বানানে লেখা যেত- কিন্তু শেষাবধি তা ‘শাসন’-এ এসে থিতু হয়েছে, এখন যদি এটি ‘আমি মানব না, আমি এই বানান যা খুশি করে লিখব’- তাহলে আর শিক্ষাদীক্ষা বইপত্রের তো কোনো মানে হয় না, হয় কি?

ভাষার বিভিন্ন দিকে নানান বিষয়ে শত শত অভিধান আছে। সাধারণ ব্যবহারিক অভিধান তো আছেই, এছাড়া দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, সংগীত, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ক্রিটিক্যাল থিওরিসহ ফুল ফল পাখি বৃক্ষ চলচ্চিত্র আলোকচিত্র মানুষের চর্চার হেন বিষয় নেই যা নিয়ে দেশে-বিদেশে অভিধান নেই। সেই সঙ্গে আছে পরিভাষার ভাণ্ডার।- এখন এই সব কিছু করা হয়েছে ভাষাকে একটি জাতীয়ভাবে স্বীকার করে নিয়ে।

তারপরও আমরা বিভন্ন পত্রপত্রিকার নিজস্ব বানানারীতি দেখতে পাই। কোথাও ‘আরও’ হচ্ছে ‘আরো’, কোথাও ‘সংগীত’ হচ্ছে ‘সঙ্গীত’, ‘কখনো’ নাকি ‘কখনও’- এমন নানান তর্ক আছে। বাংলা ভাষার এই বিষয়টি কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ ভাষাগত বিশৃঙ্খলা জাতিগত বিশৃঙ্খলার লক্ষণ। একটি অবিকশিত জাতিকে চেনার উপায়ই হলো এর ভাষাগত বিশৃঙ্খলা।

একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক বলেছিলেন, বাহান্ন সালের আগে যারা বাংলা ভাষায় যা লিখতেন, লিখতেন বুকের রক্ত দিয়ে। পরে আমরা সবাই কালি দিয়ে বাংলা লিখছি।- এই কথার ভেতরে মারাত্মক ইঙ্গিত এই যে বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের রক্তীয় বা স্নায়বিক সংযোগ কেটে গেছে। অন্তরের গভীর থেকে নয়, আমরা বাংলা লিখছি দায়সারাভাবে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো অভিনিবেশ আর নেই।

ফলে বায়ান্নর আগে, যে যা কিছু বাংলায় লিখতেন তা লিখতেন বুকের রক্ত দিয়ে, তারা রক্তকে কালিতে পরিণত করতেন। টি এস এলিয়টের ভাষায় কবিতা বলতে তিনি যেমন বলতেন, কবিতা হলো রক্তকে কালিতে পরিণত করা। বাংলা ভাষার চর্চাকারী ও ব্যবহারকারীরা প্রায় প্রত্যেকেই এই রক্তকে কালিতে পরিণত করতেন।- এটাই ওই সাহিত্যিক বোঝাতে চেয়েছেন। যদিও এটি ক্ষোভ বা অভিমানের কথা, তবু মনে হয় বাংলা ভাষা আমাদের বলা ও লেখায় বাংলাকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারছে না।

আজকাল ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে বললে অনেককেই বাংলায় কিছু বোঝানো যায় না। ফলে বাংলা ভাষা এখন ইংরেজি শব্দের পট্টি দেওয়া ক্ষতবিক্ষত ভাষায় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা অভিনেতা অভিনেত্রী, এমনকি বাংলায় গল্প কবিতা উপন্যাস লেখেন বা কেউ কেউ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মহাবিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তারাও বাংলা বলা ও লেখার সময় বাছবিচারহীনভাবে এবং অযথা অকারণে ইংরেজি শব্দ প্রয়োগ করেন। কেন? সো, বাট, মে বি, বাই দ্য বাই, অ্যাকচ্যুয়ালি, এক্সজেক্টলি- যেখানে প্রত্যেকটি শব্দের সুন্দর বাংলা আছে, কিন্তু তারা ব্যবহার করেন না। এ ছাড়াও বিজ্ঞাপনের ভাষা লক্ষ করলে বাংলা ভাষার প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞাই আসলে চোখে পড়ে। “লক করুন ময়েশ্চারাইজার, আনলক করুন সৌন্দর্য” এটা কথাটিকে: “রোধ করুন তৈলাক্ততা, উদ্ভাসিত হোক সৌন্দর্য”- এটা বলা যেত না?

অনেকেই বলেন, বাংলা এত কঠিন। বাংলার চেয়েও আরো কঠিন ভাষা আছে। বিখ্যাত লেখক ভি. এস. নাইপল ইউরোপের একটি ভাষাকে বলতেন, ওটা ভাষা নাকি গলার অসুখ- বোঝা যায় না। গলা খাকারি দিয়ে, কফ ফেলার আগের মতো শব্দ করেও অনেক ভাষায় শব্দ আছে। বলা হয়, ইউরোপের যত ভাষায় যত জটিলতা আছে, তার সবগুলো মিলে যে জটিলতা তার চেয়েও বেশি আছে রুশ ভাষায়।- এত কঠিন রুশ ভাষা বাদ দিয়ে কি তারা অন্যভাষার পট্টি দিয়ে দিয়ে রুশ ভাষা বলে না লেখে?- একটু খোঁজ নেওয়া দরকার। 

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম; আর আমরা সহজ খুঁজে বেড়াচ্ছি। কত সহজে বাংলায় কঠিন শব্দ বাদ দিয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি। দোহাই দিচ্ছি ছন্দে ভাবে যাচ্ছে না, কঠিন লাগছে, কানে লাগছে। হায়! বাংলাভাষা। মোদের গরব মোদের আশা! 

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঠিক সেই জায়গাটি বুঝতে পেরেছিলেন, একটি জাতির ভাষাগত অধিকার না থাকলে তার অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতে, বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি হবে গণহত্যার সমান। সেই গণহত্যার বাস্তবতাই ১৯৭১ সালে, বাঙালিকে ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু সময়ের বক্রাঘাত এই যে, বাঙালি নিজের দেশ পেল, কিন্তু যত দিন গেল, যে-ভাষার জন্য তার দেশ, সব কিছু, সেটিকেই সে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করছে।

ভাষা নিশ্চয়ই এর শোধ একদিন নেবে। কারণ মাতৃভাষায় দক্ষ না হলে সে জাতির সৃষ্টিশীলতা হ্রাস পায়। এক ভয়াবহ পরনির্ভরতার ভেতরে দিয়েই আমাদের সেই পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। ওপরে যতই চক চক ঝক ঝক করুক না কেন বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে আর যা-ই হোক বাঙালি জাতির প্রকৃত উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //