প্রবাসে বাংলা চর্চা

প্রবাসে বাংলা চর্চা কেমন হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের একটু ভালো করে জেনে নিতে হবে ভাষার কাজ কী এবং কীভাবে ভাষা সেই কাজটি করে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রকৃতিও কিছুটা এই আলোচনায় বিশ্লেষণ করা দরকার বলে আমি মনে করি।

ভাষার প্রধান কাজ হচ্ছে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো। যখন দুজন মানুষ তাদের মধ্যে মতবিনিময় করেন তখন একটি ভাষার দরকার হয়। তারা এমন একটি ভাষা বেছে নেন যেটি দুজনের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বা বোধগম্য।

যদি এমন হয় যে একজন ফ্রেঞ্চ ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না এবং অন্যজন শুধুমাত্র বাংলা ভাষা জানেন, তখন তারা একজন মধ্যস্থতাকারীকে খোঁজেন যিনি দুটো ভাষাই জানেন এবং তাদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটানোর জন্য সাহায্য করেন। আমরা এরকম মধ্যস্থতাকারীকে বলি অনুবাদক বা ইন্টারপ্রেটার।

কিন্তু যখন ইন্টারপ্রেটারও পাওয়া যায় না তখন দুজন মানুষ তাদের শাব্দিক ভাষা দূরে সরিয়ে রেখে অঙ্গভঙ্গি এবং ইশারা-ইঙ্গিতে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এতে হয়তো সময় একটু বেশি লাগে কিন্তু সফল যোগাযোগ ঘটে।

অধ্যাপক আলবার্ট মেহরাবিয়ান একজন ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি শব্দহীন ভাষা বা নন-ভারবাল ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, যোগাযোগের ৫৫ শতাংশ হচ্ছে অঙ্গভঙ্গি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। ৩৮ শতাংশ কণ্ঠের অভিব্যক্তি আর বাকি মাত্র ৭ শতাংশ শব্দের যোগাযোগ। দেখুন যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষা কতটা গৌণ।

অধ্যাপক মেহরাবিয়ানের শতাংশের হিসেবটা আমার কাছে ততটা বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলেও দেহ বা কণ্ঠের অভিব্যক্তি যে গুরুত্বপূর্ণ তা ভীষণভাবে স্বীকার করি। কেন আমি মেহরাবিয়ানের শতাংশের হিসেব পুরোপুরি মেনে নিচ্ছি না তা দুটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। টেলিফোনে যখন আমরা কথা বলি তখন মেহরাবিয়ানের মতে, যোগাযোগের মাত্র ৪৫ শতাংশ সফল হয়।

যখন ইমেইলে বা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে যোগাযোগ করি তখন মাত্র ৭ শতাংশ সফল হয়। আসলেই কি এই তথ্য ঠিক? এটি যে ঠিক নয় তার অন্য একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে। ধরুন ক্রিস্টফ ফরাসিভাষী, নয়ন বাংলাভাষী। তারা দুজন মুখোমুখি বসে যার যার ভাষায় কথা বলছে। এক্ষেত্রে কি যোগাযোগের ৯৩ শতাংশ সফল হবে?

যদি তাই হতো তাহলে সারা পৃথিবীতে ইন্টারপ্রেটারদের এত কদর থাকত না। আমি তো আর এই বিষয়ে গবেষক নই, গবেষক হচ্ছেন আলবার্ট মেহরাবিয়ান। কাজেই তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উপস্থাপিত তার যুক্তিই আধুনিক পৃথিবী গ্রহণ করেছে।

বিশ্বখ্যাত এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ বিষয়ে আমি কিছু পাঠ নিয়েছি। আমার অধ্যাপকও মেহরাবিয়ানের শতাংশের হিসেবই শুনিয়ে দিয়েছেন। তিনি অবশ্য আরো কিছু বাড়তি যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অঙ্গভঙ্গি ও কণ্ঠের অভিব্যক্তি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে আমরা ৩০ লাখ বছর নন-ভারবাল ছিলাম, যোগাযোগ করতাম অঙ্গভঙ্গি দিয়ে।

মানুষ ভাষা শিখেছে মাত্র দেড় থেকে দুই লাখ বছর আগে। যোগাযোগ বিষয়ে আমাদের জিনের অভিজ্ঞতার ৯৩ শতাংশই হচ্ছে নন-ভারবাল। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত ইথোলজিস্ট রিচার্ড ডকিন্সের বই ‘দ্য সেলফিশ জিন’ যারা পড়েছেন বা এই বইয়ের প্রতিবাদ্য সম্পর্কে যারা জানেন তারা অবগত আছেন যে জিনের ক্ষমতা শুধু এক দেহের মধ্যেই সীমিত নয়, এর ক্ষমতা অনেক ব্যাপক। মানুষের বয়স যদি ৩২ লাখ বছর হয় তাহলে ৩২ লাখ বছরের অভিজ্ঞতার প্রবাহ আজকের মানুষের জিনের মধ্যে আছে।

এবার একটু আলোচনা করা যাক, প্রবাসীদের প্রকৃতি বা ধরন নিয়ে। প্রবাসী আর অভিবাসী এক নয়। যে কোনো কারণেই কেউ নিজ দেশের বাইরে, মানে বিদেশে, অবস্থান করলে তিনি বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে প্রবাসী। কিন্তু প্রবাসীদের মধ্যে যারা ভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান তারা অভিবাসী।

সাধারণত অভিবাসীরা ভিন্ন কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সেই দেশে সন্তান-সন্ততির জন্ম দেন, সেই দেশের শিক্ষা গ্রহণ করেন, সেই দেশের পেশায় আত্মনিয়োগ করেন, বাড়ি-ঘর কেনেন অর্থাৎ প্রজন্ম পরম্পরায় নতুন ভূখণ্ডে বসবাস করেন।

অভিবাসীরা নতুন দেশে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও আরো অনেক প্রজন্মের জন্ম দেন। কিন্তু যারা অল্প সময়ের জন্য বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে আবার নিজ দেশে ফিরে আসেন তারা প্রবাসী। এই প্রবাসীরা এবং অভিবাসী প্রবাসীদের প্রথম প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষা কিছুতেই ভুলতে পারেন না।

নতুন দেশে গিয়ে বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে নতুন ভাষা শিখতে হয় বটে কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি তারা আমৃত্যু গভীর টান অনুভব করেন। এই শ্রেণির প্রবাসীদেরই আমরা দেখি পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে।

যেসব প্রবাসী আবেগপ্রবণ কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠ করে ভিডিওচিত্র তৈরি করেন এবং ফেসবুকে পোস্ট করেন তারা সবাই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বা প্রবাসী। তাদের সন্তান, যারা প্রবাসে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, তারা জীবনানন্দ দাশ কে ছিলেন এই প্রশ্নে শুধু অবাকই হন না বিরক্তও হন। এটি হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের একটি অতি সাধারণ চিত্র।

প্রয়োজন থেকেই ভাষার ব্যবহার, প্রয়োজন থেকেই সংস্কৃতির উৎপত্তি। এ-কারণেই আমরা সংস্কৃতি চর্চাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই পেশাগত বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যখন একজন মানুষ শখ করে গান আর যখন অন্য একজন জীবিকার জন্য গান করে এই দুইজনের গান করার মধ্যে গুণগত পার্থক্য অনেক। জীবিকাটা হচ্ছে প্রয়োজন। প্রয়োজন না হলে স্বভাবতই মানুষ তার সর্বোচ্চটা দেয় না।

আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালিতে যেসব অভিবাসী বাঙালি বসবাস করেন, দৈনন্দিন যোগাযোগের প্রয়োজনে তাদেরকে ওই সব দেশের ভাষা ব্যবহার করতে হয়। স্কুলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে সেই ভাষা ব্যবহার করতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়ে তাদেরকে ভিনদেশি ভাষাটি শিখতে হয়, বলতে হয় এবং প্রতিদিন লিখতে হয়। দিনের যাবতীয় কাজ সেরে পরিবারের সঙ্গে যখন রাতের বেলা দেখা হয় তখন আর বাংলা ভাষার চর্চা করার সময় কই?

তারপরও স্মৃতিকাতরতা, আবেগ, মাতৃভাষার প্রতি টান, এসব কারণে প্রথম প্রজন্ম যে কোনোভাবেই হোক বাংলা ভাষাটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কোথাও বাংলা গান, কবিতার অনুষ্ঠান হচ্ছে খবর পেলে ছুটে যান। কিন্তু পরের প্রজন্মের কাছে এই ভাষা হস্তান্তর করা কঠিন হয়ে পড়ে।

শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে দেখেছি, তাদের সন্তান বাংলা জানে না, কিন্তু ভালো ইংরেজি বা ফ্রেঞ্চ জানে, জার্মান বা ইতালীয় ভাষা জানেÑ এতে তারা গর্বিত। তাদের কাছে বাংলাটা যেন গরিবের ভাষা। কিছু সংস্কৃতিমনা বাঙালি পরিবার চায় তাদের সন্তানেরা বাংলা শিখুক, বাংলা বলুক। পূর্বপুরুষের ভাষা জানার মধ্য দিয়ে, সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে শেকড়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুক। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সফল হন না।

জাতিসংঘ এ বিষয়ে খুব আন্তরিক। যেসব দেশে জাতিসংঘের অফিস আছে সেই সব দেশে যখন অন্য দেশের স্টাফ কাজ করে তাদের ছেলেমেয়েরা যাতে মাতৃভাষা ভুলে না যায় সেজন্য ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা শেখানোর জন্য টিউশন ফি পরিশোধ করে থাকে সংস্থাটি। এই একই কারণে পৃথিবীর সাত হাজার মাইনর ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জাতিসংঘ ‘২১ ফেব্রুয়ারি’কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

যেহেতু শিক্ষা-দীক্ষা এবং কাজের প্রয়োজনে দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্মের বাঙালিরা অভিবাসের ভাষাকেই তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাই প্রথম প্রজন্মের বাঙালিরা সব সময় আক্ষেপ করে বলে থাকেন, আমরা মরে গেলে প্রবাসে আর বাংলা ভাষার অস্তিত্ব থাকবে না। আসলে তাদের এই আশঙ্কার কোনো কারণ দেখছি না।

বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে হয়তো আগামী আরো এক, দেড়শ বছর নিয়মিতই মানুষ অভিবাস গ্রহণ করবে। সব সময়ই আমেরিকায়, কানাডায়, অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম প্রজন্মের একটি বড় কম্যুনিটি থাকবে। বাংলা ভাষার চর্চা তাদের মধ্যেই এই দূর প্রবাসে বেঁচে থাকবে। 

এছাড়া অল্প কিছু শেকড়-সন্ধানী প্রবাসে জন্ম নেয়া নতুন উত্তর প্রজন্মের আগ্রহী হৃদয়ে কিংবা তাদের গবেষণায় বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //